শির্ক কী ও কেন? প্রথম পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি

শির্কে আকবার এর প্রকার বর্ণনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ [1]এটিকে মোট চার প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :

১. জ্ঞানগত শির্ক (الشرك في العلم)

২. পরিচালনাগত শির্ক (الشرك في التصرف)

৩. উপাসনাগত শির্ক (الشرك في العبادات)

৪. অভ্যাসগত শির্ক (الشرك في العادات) [2]

মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী এটাকে অন্য আরো চার প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :

১. শির্কুল এহতিয়ায (شرك الاحتياز), এর সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন : আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো কোনো বস্তুর উপর স্বয়ংসম্পূর্ণ মালিকানা রয়েছে বলে বিশ্বাস করাকে শির্কুল এহতিয়ায বলা হয়।

২. শির্কুশ শিয়া‘ (شرك الشياع), এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ জগতের কোনো বস্তুতে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো একচ্ছত্র মালিকানা না থাকলেও কোনো কোনো বস্তুতে আল্লাহর সাথে অন্যের যৌথ মালিকানা রয়েছে। যদিও উভয়ের মাঝে অবস্থান ও মর্যাদার দিক থেকে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

৩. শির্কুল এ‘য়ানত (شرك الإعانة), এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ জগতের কোন কিছুতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো মালিকানা বা শরিকানা না থাকলেও এর কোনো কোনো বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যকারী রয়েছে।

৪. শির্কুশ শাফা‘আত (شرك الشفاعة), এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাঁর বান্দাদের মাঝে এমন কতিপয় বান্দাও রয়েছেন যারা তাঁদের মর্যাদার বদৌলতে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাঁর পূর্ব অনুমতি ছাড়াই নিজস্ব শাফা‘আতের মাধ্যমে নিজ নিজ ভক্ত অনুরক্তদের আল্লাহর পাকড়াও থেকে নাজাত দিতে সক্ষম।[3]

তিনি তাঁর এ চার প্রকার শির্ক প্রমাণের জন্যে কুরআনুল কারীমের নিম্ন বর্ণিত আয়াতটি উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُۥۚ﴾ [سبا: ٢٢، ٢٣]

‘‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য বলে ধারণা করেছ তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ ওজনের কিছুরও মালিক নয়, এতে তাদের কোন শরীকানাও নেই, তাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহর সাহায্যকারীও নয়, যার জন্য তিনি শাফা‘আতের অনুমতি দেবেন কেবল সে ব্যতীত কারো শাফা‘আত কারো জন্যে উপকারে আসবে না।’’[4]

তিনি এ আয়াতটি উদ্ধৃত করে বলেন : এ আয়াত থেকে শির্কের কোন প্রকারই বাদ পড়ে যায় নি।[5] ‘আল-ঈমান ওয়া আ-ছা-রুহু ওয়া আশ শির্কু ওয়া মাজাহিরুহু’ কিতাবের লেখকও অনুরূপ দাবী করেছেন।[6] তবে উপর্যুক্ত আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এ আয়াতে মূলত পরিচালনাগত শির্ক সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে, যা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত শির্ক। এতে মহান আল্লাহ চার প্রকারের পরিচালনাগত ধারণার শির্কের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি কাফিরদের বলে দিয়েছেন যে, যাদেরকে তোমরা তোমাদের ইহকালীন কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের মালিক বলে ধারণা করেছো, তারাতো আসলে তোমাদের কিছুই করার মালিক নয় কারণ; কোন বস্তুর মালিক তার মালিকানার অবস্থানুযায়ী সে বস্তুটি পরিচালনা বা তাতে হস্তেক্ষেপ করে থাকে। আর কোন বস্তুতে কারো মালিকানা সর্বোচ্চ চার ধরনের হতে পারে :

১. হয়তো কেউ এ জগতের কোন বস্তুর পরিপূর্ণ মালিক হবে, ফলে সে তার মালিকানাধীন বস্তুটি যেমন ইচ্ছা পরিচালনা করবে।

২. কোন কিছুতে কারো পরিপূর্ণ মালিকানা না থাকলে হয়তো এর কোন কিছুতে কারো শরীকানা থাকতে পারে এবং সে অনুযায়ী সে তা পরিচালনার ক্ষেত্রে শরীক হতে পারে।

৩. কোন কিছুতে কারো কোন মালিকানা বা শরীকানা কোনটাই না থাকলে হয়তো কোন কিছু পরিচালনার ক্ষেত্রে কেউ কারো সাহায্যকারী হতে পারে।

৪. তাও যদি না হয়, তবে হয়তো বা কেউ নিজের মর্যাদার বদৌলতে কারো কোন কিছু পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বঘোষিত উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে এবং তার সুপারিশ ও উপদেশ অনুযায়ী কিছু পরিচালিতও হতে পারে।

উপর্যুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ কাফিরদের বলে দিলেন : তোমরা যাদেরকে তোমাদের ভাগ্যের কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক বলে ধারণা করে বসেছো, তারাতো উক্ত এ চার ধরনের মালিকানার কোনোটিরই মালিক নয়; সুতরাং তারা কিভাবে তোমাদের কল্যাণার্জন বা অকল্যাণ দূরীকরণে কাজ করবে? এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, উপর্যুক্ত আয়াতে কেবল পরিচালনাগত শির্কের যাবতীয় দিক নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। জ্ঞানগত, উপাসনাগত ও অভ্যাসগত শির্ক সম্পর্কে এ আয়াতে কোন আলোকপাত করা হয় নি। কাজেই মুহাম্মদ ইবন মুবারক আল-মীলী উপরে যে দাবী করেছেন, তা যথার্থ বলে মনে হয় না।

আবুল বাকা আল-হানাফী আবার শির্ককে অন্য আরো ছয় ভাগে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ :

১. শির্কুল ইস্তেকলাল (شرك الاستقلال) : এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন : আল্লাহর পাশাপাশি আরো দু’জন স্বয়ংসম্পূর্ণ শরীক থাকার ধারণা পোষণ করাকে ‘শির্কুল ইস্তেকলাল’ বলা হয়। যেমন- অগ্নিপূজকদের শির্ক; তারা যাবতীয় কল্যাণের বিষয়াদিকে ‘ইয়াজদান’ নামক দেবতার কাজ বলে মনে করতো, আর যাবতীয় অকল্যাণমূলক কাজকে ‘আহরমন’ নামক দেবতার কর্ম বলে মনে করতো।

২. শির্কুত তাবয়ীদ (شرك التبعيض) : একাধিক উপাস্য থেকে এক উপাস্য গঠন করাকে ‘শির্কুত তাবয়ীদ’ বলা হয়। যেমন- খ্রিষ্টানদের শির্ক। তারা বলে : আল্লাহর তিনটি অংশ রয়েছে, যথা : পিতা, পুত্র ও রুহুল কুদুস অথবা মরয়ম, ঈসা ও রুহুল কুদুস। এই তিনে মিলে হলেন এক আল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ তিন ইলাহের তৃতীয় জন।

৩. শির্কুত তাকলীদ (شرك التقليد) : অন্যের অনুসরণে গায়রুল্লাহের উপাসনা করাকে ‘শির্কুত্ তাকলীদ’ বলা হয়। যেমন- আরব জনগণের শির্ক, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণে মূর্তি পূজা করতো।

৪. শির্কুত্ তাকরীব (شرك التقريب) : আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে গায়রুল্লাহের উপাসনা করাকে ‘শির্কুত্ তাকরীব বলা হয়। যেমন- আরবের মুশরিকরা বলতো :

﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣]

‘‘আমরা দেবতাদের উপাসনা কেবল এ-জন্যেই করছি যে, তারা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’’[7]

৫. শির্কুল আসবাব (شرك الأسباب) : কোনো বিষয় আল্লাহর কারণে হয়েছে এমনটি না বলে অপর কোনো বস্তুর প্রভাবে তা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা বা বলাকে শির্কুল আসবাব বলা হয়। যেমন- প্রকৃতিবাদীদের শির্ক, যারা এ-জগত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য আল্লাহর পরিকল্পনাকে স্বীকার না করে প্রকৃতিকেই এর পরিচালক বলে মনে করে।

৬. শির্কুল আগরাদ (شرك الأغراض) : গায়রুল্লাহের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কাজ করাকে ‘শির্কুল আগরাদ’ বলা হয়।[8]

ড. ইব্রাহীম বুরাইকান শির্কে আকবারকে অপর আরো ছয় প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :

(১) আহ্বানগত শির্ক (২) উদ্দেশ্যগত শির্ক (৩) আনুগত্যগত শির্ক (৪) ভালোবাসাগত শির্ক (৫) ভয়ভীতিগত শির্ক (৬) ভরসাগত শির্ক।[9]

বিভিন্ন মণীষীগণ শির্কে আকবার এর প্রকার সম্পর্কে যা বলেছেন সেগুলো নিয়ে একটু ভাবলে দেখা যায় যে, আবুল বাক্বা কর্তৃক বর্ণিত প্রকারসমূহের মধ্যকার প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম প্রকার মূলত পরিচালনাগত শির্কের অন্তর্গত। পঞ্চম প্রকারটি পরিচালনাগত শির্কের অন্তর্গত হওয়ার বিষয়টি নিতান্তই পরিষ্কার। প্রথমটি পরিচালনাগত শির্কের অন্তর্ভুক্ত এভাবে যে, অগ্নিপূজকরা ভাল ও মন্দ সৃষ্টির কর্ম পরিচালনার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দুই ইলাহে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর দ্বিতীয়টি এর অন্তর্ভুক্ত এভাবে যে, খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে তিন ইলাহের একজন বলে বিশ্বাস করে এবং এক ইলাহ গঠনের ক্ষেত্রে এ তিন ইলাহের কার্যকর প্রভাব রয়েছে বলে মনে করে। অবশিষ্ট তৃতীয় ও চতুর্থ প্রকার উপাসনাগত শির্কের অন্তর্গত এবং ষষ্ঠ প্রকারটি শির্কে আসগার এর অন্তর্ভুক্ত।

ড. বুরাইকান কর্তৃক বর্ণিত প্রকারগুলোর প্র্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, একমাত্র দ্বিতীয় প্রকারটি ব্যতীত অবশিষ্ট সকল প্রকারই উপাসনাগত শির্কের অন্তর্গত। আর দ্বিতীয় প্রকারের একক কোনো অস্তিত্ব নেই কারণ; উদ্দেশ্যতো সর্বদাই কোনো কর্ম ও উপাসনার সংগী হয়ে থাকে। মানুষ যে উদ্দেশ্যে যে কর্ম করে তার কর্ম সে উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে।

আল্লামা ইসমাঈল শহীদ কর্তৃক বর্ণিত প্রকারগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এ প্রকারগুলো কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থিত, কেননা; কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার যুগে আরব সমাজে যে সব শির্কের প্রচলন ছিল, তা এ-চার প্রকার শির্কের অন্তর্গত ছিল। সে জন্যেই কুরআন ও হাদীসে এ চার প্রকার শির্কেরই সমালোচনা করা হয়েছে। যেহেতু আল্লামা ইসমাঈল শহীদ কর্তৃক বর্ণিত প্রকারগুলো কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত, সেহেতু আমার দৃষ্টিতে শির্কে আকবারকে এ চার প্রকারে বিভক্ত করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। আর সে জন্যেই ইনশা আল্লাহ নিম্নে আমরা শির্কে আকবারকে উক্ত চার প্রকারেই বিভক্ত করবো।

">
[1]. শাহ ইসমাঈল শহীদ, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী এর নাতী ছিলেন। তিনি ১১৯৩ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। একজন প্রখ্যাত ‘আলেমে দ্বীন ছিলেন। শির্ক ও বেদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী নেতা ছিলেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখনীর মধ্যে রয়েছে: ‘তাকবিয়াতুল ঈমান ওয়া তাজকিরাতুল ইখওয়ান’ গ্রন্থ। তৎকালীন সময়ে শিখ ধর্মাবলম্বনকারীরা পাঞ্জাব প্রদেশের মুসলিমদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালালে স্যার সৈয়্যিদ আহমদ ব্রেলভী এর নেতৃত্বে ইসলামের প্রসার ও মুসলিমদের মুক্ত করার জন্য শিখদের বিরুদ্ধে পরিচালিত একাধিক যুদ্ধে অংশ গৃহণ করে ১২৪৬ হিজরীতে বালাকোটের যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।

[2].শাহ ইসমাঈল শহীদ, তাক্ববিয়াতুল ঈমান; (দেওবন্দ : মাকতাবা থানভী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮৪ খ্রি.), পৃ. ২৯-৫৬।

[3]. মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী, আশশির্কু ওয়া মাজাহিরুহু; (মদীনা : আল-জামি‘আতুল ইসলামিয়্যাঃ, ১ম সংস্করণ, ১৪০৭হি.), পৃ. ৬৫, ৬৬।

[4]. আল-কুরআন, সূরা আস-সাবা : ২২।

[5]. তদেব।

[6]. জাকারিয়া আলী ইউসুফ, প্রাগুক্ত; পৃ. ৮০।

[7]. আল-কুরআন, সূরা আয-যুমার : ৩।

[8]. মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৬৬। তিনি এ প্রকারগুলো আবুল বাকা এর كليات নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। অনুরূপভাবে দেখুন : আহমদ রূমী, মাজালিসুল আবরার; (করাচী : দ্বারুল এশা‘আত, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ১৫০।

[9]. ড. ইব্রাহীম বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ. ১২৮-১৩৮।