পরিবেশের এমন একটি প্রভাব-ক্ষমতা আছে যার ফলে ভালো মানুষ খারাপ হয়, আবার। খারাপ মানুষ ভালোও হয়ে থাকে। বহু যুবকই এমন আছে, যাদের মন ভালো, ভালো হওয়ার ইচ্ছাও রাখে, কিন্তু পরিবেশের চাপে খারাপ হয়ে যায়। এ জগতে যেহেতু মন্দলোকের সংখ্যাই বেশি, তাই মন্দের প্রভাব আগে ও বেশি পড়ে যুবকের উপর। আর এ মন্দ পরিবেশে প্রভাবান্বিত তারাই বেশি হয়, যাদের মন দুর্বল, ঈমান দুর্বল, দুর্বল দ্বীনী জ্ঞান। সত্যকে মানতে গিয়ে ঠাট্টা-উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কটাক্ষ-টিপ্পনী, লোকহাস্য প্রভৃতির শিকার হয়ে অনেকে সত্য ত্যাগ করে বসে। দ্বীন ও দুনিয়ার নানান সমস্যা নিয়ে মানুষের মাঝে যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব-কলহ আছে তার কুচক্রে পড়ে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পরিবেশগত বিভিন্নমুখী স্রোতের মুখে নিজের স্বাতন্ত্র্য ও ঈমানকেও বাচিয়ে রাখতে পারে না অনেকে।
ভোগ-বিলাসের প্রবণতা এমন বেড়ে উঠছে যে, সেই বিলাসবহুল দ্বীনহীন পরিবেশে একজন মানুষকে মুসলিম’-রূপে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন হল অগাধ ধৈর্যের। “যত (মন্দ) বছর বা যত দিন অতিবাহিত হবে তার তুলনায় আগামী বছর ও দিন হবে আরো মন্দতর।” (আহমদ, বুখারী, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে” ৭৫৭৬ নং)
“এমন দিন আগামীতে আসছে যে, ধৈর্যের সাথে দ্বীন বাচিয়ে রাখতে ঠিক ততটা কষ্টকর মনে হবে, যতটা কষ্টকর মনে হয় হাতের মুঠোয় আগুনের আঙ্গার রাখা।” (তিরমিযী, সহীহুল জামে’ ৮০০২নং) “আগুনের আঙ্গার হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে যেমন কঠিন ও কষ্টের কাজ ঠিক তেমনি উম্মতের মতবিরোধ ও কলহের সময় মহানবীর সুন্নাহ (তরীকা) অনুসারে জীবন-যাপন করা কঠিন ও কষ্টের কাজ বলে মনে হবে।” (সহীহুল জামে ৬৬ ৭৬ নং)
এমন পরিবেশে ধৈর্য ধরা সহজ নয়। যেমন সহজ নয় হাতের মুঠোয় আগুন ধরে রাখা। শত বাধা-বিঘ্ন ও আপদ-বিপদ উপেক্ষা করেও যারা দ্বীন ও ঈমান বাঁচিয়ে রাখবে এবং এমন ঘোলাটে নোংরা পরিবেশের আবর্জনায় নিজেদের দ্বীনদারীকে মলিন হতে দেবে না। তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। এমন লোক হবে তারা, যারা প্রত্যেকে ৫০ জন শহীদ সাহাবীর সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ২২৩৪ নং)
পরিবেশ ইত্যাদির কারণে মুমিনের ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। তাই প্রিয় নবী ৪৪ বলেন, “তোমাদের দেহের ভিতরে ঈমান ঠিক সেইরূপ পুরাতন হয়ে যায়, যেরূপ পুরাতন হয়ে যায় নতুন কাপড়। সুতরাং তোমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর, যাতে তিনি তোমাদের হৃদয়ে ঈমানকে (ঝালিয়ে) নতুন করে দেন।” (ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে ১৫৯০ নং)
পরিবেশের এমন এক শক্তি আছে, যার ফলে মানুষের চরিত্র, ব্যবহার, পরিধান, পানাহার প্রভৃতির মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার লাভ করে থাকে। পরিবেশ-দোষেই সত্য মিথ্যারূপে এবং মিথ্যা সত্যরূপে, সভ্যতা অসভ্যতারূপে এবং অসভ্যতা সভ্যতারূপে, সুন্নাত বিদআতরূপে এবং বিদআত সুন্নাতরূপে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। একই পোশাক
কোন পরিবেশে পরিধান করলে লোকে তা দেখে হাসে। আবার ঐ পোশাকই অন্য এক পরিবেশে পরিধান না করলে লোকে তা না দেখতে পেয়ে আশ্চর্যবোধ, কটাক্ষ ও ব্যঙ্গ করে। তাছাড়া ভালোর তুলনায় নোংরা পরিবেশেরই প্রভাব-ক্ষমতা অধিক।পরশমণির সংস্পর্শে লোহা সোনা হওয়ার কথা শোনা যায় ঠিকই, কিন্তু তার বাস্তবরূপ বিরল। পক্ষান্তরে একটা পঁচা আলুর চারিপাশে বহু আলুকে পঁচ ধরতে অনেকেই দেখে থাকে।
এক যুগ ছিল যখন রেডিও কেনাও পাপ মনে করা হত। কিন্তু আজ আর তা হয় না। পূর্বে টিভিকে অধিকাংশ মুসলিম খারাপ মনে করতেন। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিমই টিভি তো দূরের কথা ডিসকেও খারাপ মনে করেন না। আর এ স্বাভাবিকতা আসে পরিবেশের গুণেই। পরিবেশের চাপেই কাল যা পাপ মনে করা হত, আজ তাকে বৈধ বা পুণ্য কাজ অথবা এক ফ্যাশনরূপে পরিগণিত হতে দেখা যায়।
কোন মুসলিম যদি রমযানের রোযার দিনে কিছু খায় তাহলে তা দেখে অনেকে তাকে মুসলিম নয় বলে ধারণা করবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তিকেই নামায ত্যাগ করতে দেখে তারা কোন কিছু মনে করে না। অথচ নামাযের মর্যাদা রোযার চাইতে বহুগুণ উর্ধে। কিন্তু পরিবেশে বেনামাযী ও ‘আটকী-খাটকী-তিনশো ষাটকী’ নামাযীর সংখ্যা বেশী ও স্বাভাবিক হওয়ার ফলে তা আর বড় পাপ বা আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে করা হয় না।
কোন মসজিদের ইমামকে যদি লোকে সোনার আংটি বা অন্য কিছু পরে থাকতে দেখে অথবা বিড়ি-সিগারেট পান করতে দেখে তাহলে সকলের চোখ ডাগর হবে। পক্ষান্তরে তাকে গীবত করতে দেখলে অথবা শিকী তাবীয লিখে ব্যবসা করতে দেখলে লোকের কোন ক্ষেপ দেখা যায় না। অথচ শেষােক্ত কর্মদ্বয়ের পাপ অধিকতর বড়। কারণ, পরিবেশ এমন সৃষ্টি হয়ে থাকে যে, মানুষ সেই হিসাবেই ভালো-মন্দ ও স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বিচার করে থাকে। অথচ একজন মুসলিমের জন্য এ দৃষ্টিভঙ্গি ও মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। মুসলিমের সর্বকর্ম ও সকল ভালো-মন্দ বিচারের মানদন্ড হল ইসলাম, আল্লাহর বিধান। কারণ, মানুষ পরিবেশ সৃষ্টি করে। আর মানুষের জ্ঞান-বিবেক সীমিত ও বিভিন্নমুখী। একই বস্তু সকলের কাছে ভালো না-ও হতে পারে। সুতরাং ইসলামকে পরিবেশের ছাঁচে না ঢেলে, বরং পরিবেশকেই ইসলামের ছাঁচে ঢেলে গড়ে তোলা মুসলিমের কর্তব্য।
পরন্তু ইসলামী পরিবেশে মিশে যেতে হবে দুধে চিনি ঘুলে যাওয়ার মত। পক্ষান্তরে অনৈসলামী পরিবেশে মিশতে হলে মিশতে হবে চানাচুরে বাদাম মিশার মত; বড় সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে, যেন নিজস্ব সত্তা, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিলীন ও একাকার হয়ে বা হারিয়ে না যায়।
যদি বল, মাছ ধরব, অথচ গায়ে কাদাও লাগাব না তা কি করে সম্ভব? তাহলে বলা যায় যে, যে মাছ ধরতে গিয়ে তোমার গায়ে কাদা লাগবে এবং তোমার সৌন্দর্য কাদাতে মলিন হয়ে যাবে, সে মাছ ধরতে তুমি যাবে না। মাছ খাওয়ার দরকার একান্তই পড়ে থাকলে ছিপ দিয়েও তো ধরতে পার। হিকমত অবলম্বন করে চললে চলার পথ অতি সহজ।
পরিবেশ মানুষকে অতি সহজে তার দাসে পরিণত করে ফেলে। অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক ও পাপকে সাধারণ কর্মে পরিবর্তিত করে। কারণ, প্রত্যেক জিনিসের কসরতই মানুষকে
অভ্যস্ত করে তোলে এবং সেখান থেকে দেখাদেখি শুরু হয় পরিবেশের সৃষ্টি। আর যে মানুষ ঐ পরিবেশে বাস করে সে বুঝতেও পারে না যে, সে যা করছে তা অস্বাভাবিক বা পাপ কাজ। যেমন চামড়ার গুদামে কর্মরত কর্মচারীর জন্য গুদামের ভিতরে অবস্থান করতে কোন কষ্ট হয় না। দুর্গন্ধ নাকে নিতে নিতে অভ্যাসে পরিণত হলে তা সাধারণ গন্ধে পরিবর্তিত হয় তার। কাছে। অথচ বাইরে থেকে অন্য কোন মানুষ সেখানে প্রবেশ করলে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, অর্থাৎ, দেহের কোন। জায়গা (যেমন শিশুদের জন্য মায়ের স্তনবৃন্ত) অধিকরূপে চোষণ করা হয় তখন প্রথম প্রথম তা খুব বেশী অনুভুত হলেও পরের দিকে আর কোন অনুভুতি অবশিষ্ট থাকে না। কারণ, তখন তা অভ্যাস ও স্বাভাবিকতায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, পরিবেশের এই অবস্থা হওয়ার ফলে পরিবেশ-দূষণ থেকে বাচা বড় কষ্টকর। আমাদের পরিবেশের এমন নোংরা ও ঘোলাটে অবস্থা যে, সে পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা বড় দুষ্কর। মাছ ধরার ইচ্ছা না থাকলেও গায়ে যে কাদা লাগবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? কারণ, তোমাকেও তো ঐ পুকুর ধারেই বাস করতে হবে।
‘পশ্চিমে ঝড় ঐ যে আসে পুবে অন্ধকার।
মহাকালের বাজছে প্রলয়-ভেরী,
বসুন্ধরার কাপন বড় ভাঙ্গছে তোরণদ্বার
তুফান আসার নাইকো বেশী দেরী।
ধুলোয় নয়ন আঁধার হল, আকাশ ডাকে গুরু
মাথা গোজার নাইকো কোথাও ঠাই,
কাল-নাগেরি শতেক ফণায় বক্ষ-দুরুদুরু
পালিয়ে যাওয়ার পথ তো জানা নাই।
এমন সংকটাপন্ন পরিবেশে মুসলিম দোটানায় দোদুল্যমান। কাদামাখা পা ধোয়ার চেষ্টা করলেও পা ধুয়ে রাখার স্থান কোথায়? কারণ, সব জায়গাই তো কাদাময়। ধুয়ে পা যদি কাদাতেই রাখতে হয় তাহলে ধোয়ার মুল্যই বা কি থাকে? শুকনো জায়গায় বা পাথরে সরে গিয়ে পা ধুলে অবশ্য ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু ‘টকের ভয়ে দেশ ছেড়ে তেঁতুল-তলায় বাসা’ হলে তো আর এক মুশকিল।
সুতরাং এহেন পরিবেশে নিজেকে বাঁচাতে হলে কত যে সাধ, সাধ্য ও সাধনার প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। চোরকাটা ভরা মাঠে চলতে যেমন কাপড় বাঁচিয়ে চলতে হয়, পিচ্ছিল্য কাদাময় পথে যেমন পা টিপে টিপে চলতে হয়, মাইন-পাতা পথে যেমন গাড়ি সাবধানে চালাতে হয়, ঠিক তেমনি ভাবেই মুসলিমকে সতর্কতার সাথে, পা টিপে, হুঁশিয়ার হয়ে, অতি সন্তর্পণে জীবনের গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে।
বৃষ্টি নামলে যেমন ছাতা দিয়ে আড়াল করে নিজেকে ভিজা থেকে বাঁচানো যায়, ঝড় বা শিলাবৃষ্টির সময় যেমন একটি মজবুত আশ্রয়-স্থলের প্রয়োজন হয়, বন্যা এলে যেমন কোন উঁচু ঘর বা স্থান দরকার হয়, তেমনিই অপসংস্কৃতির বিভিন্ন অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন উপায়-অসীলার দরকার মুসলিমের।
আমাদের সামনে যে বড় ঝড় আসছে তা হল কুফরী ও ধর্মহীনতার ঝড়। পশ্চিম থেকে যে ঝড়ের লাল মেঘ দেখা দিয়েছে, তা হল জরায়ু-স্বাধীনতা ও যৌনবাদের ঝড়। সর্বগ্রাসী চরিত্ৰবিনাশী যে তুফান আমাদেরকে ধ্বংস করতে এবং যৌন-উন্মাদনার যে বন্যা প্রবল তান্ডবের সাথে নৃত্য করতে করতে আমাদেরকে গ্রাস করতে আসছে, তার কবল হতে রক্ষার জন্য আমাদের প্রয়োজন হল নুহের কি শুীর। আর সে কিশী হল শরীয়ত ও তার নীতিনৈতিকতা। যদি তাতে কেউ না চড়ে তবে ডুবে ও ভেসে যাবে ঐ পাপাচারের বন্যায় প্লাবিত হবে তার যথাসর্বস্ব। আর যদি কেউ নুহের ছেলে কিনআনের মত বলে যে, আমি কিন্তীতে
চড়ে কোন উচু পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেব’ তবুও সে রেহাই পাবে না। কারণ, এ তুফান হল ‘আকাশ-তুলতুল’, হিমালয় পর্বতও এ প্লাবনের নিচে হাবুডুবু খাবে। হে যুবক বন্ধু। কিন্তু তুমি পরিবেশ নোংরার ওজুহাতে নোংরায় গা ভাসিয়ে দিও না। তোমার অভিযোগ, দেশে ইসলামী শাসন কায়েম না হলে পরিবেশ ভালো হবে না। অবশ্য তোমার কথা নিশ্চয়ই ঠিক। পরন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কথাও ঠিক যে, পরিবেশ ভালো না করতে পারলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। কারণ, পরিবেশের অধিকাংশ লোক এ আসমানী শাশ্বত শাসনকে মেনে নিতে না চাইলে তুমি কার জোরে কার উপরে তা জারী করবে? হে ভাই যুবক! তুমি তো এক রাজা। তোমার রাজত্বে তোমার এমন সার্বভৌমত্ব আছে যে, ঐ রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বাইরের কারো জন্য বৈধ নয়। তুমি পার তোমার রাজ্যকে সোনা দিয়ে মুড়তে। তোমার ঐ রাজ্য থেকে অবিচার, অনাচার, অন্যায়, অত্যাচার, অরাজকতা ও বিভিন্ন দুর্নীতি দূরীভূত করে শান্তিময় ইলাহী শাসন পরিপূর্ণরূপে কায়েম করতে তোমাকে কেউ বাধা প্রদান করতে পারে না।
তুমি পারবে নির্ভয়ে ঘুসবাজি, চাঁদাবাজি, মস্তানি, গুন্ডামি, ভন্ডামি প্রভৃতি অন্যায়ের দ্বার রুদ্ধ করতে। আর এ কাজে তোমার ভোট যাওয়ার ভয় থাকবে না এবং গদি হাত ছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকবে না। তুমি যদি তোমার গৃহরাজ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পার, তাহলে দেখবে, দেশের রাজাও তার রাজ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হচ্ছে। নচেৎ অন্ততঃপক্ষে তোমার রাজ্যকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিতে অবশ্যই আগ্রহী হচ্ছে। কারণ, এতটুকু না করলে তার গদি যে উল্টে গিয়ে নদীতে ভেসে যাবে। হ্যা, তুমি তোমার পরিবার ও গৃহরাজ্যের রাজা। সংসারের সকল ব্যক্তির দায়িত্ব আছে তোমার উপরে। মহানবী সঃ বলেন, “সতর্ক হও! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বশীলতা প্রসঙ্গে কাল কিয়ামতে কৈফিয়ত দিতে হবে। পুরুষ হল তার সংসারের সকল ব্যক্তির জন্য দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে কিয়ামতে জবাবদিহি করতে হবে।---” (আহমাদ, বখারী মুসলিম আবুদাউদ, তিরমিযী সহীহুল জামে’ ৪৫৬৯ নং) সুতরাং পথে-ঘাটে ক্ষিপ্ত কুকুরদের ‘ঘেউ-ঘেউ ভেকানি যদি বন্ধ না-ও করতে পার, তাহলে এতটুকু নিশ্চয়ই পারবে যে, সেই কুকুরদলকে তুমি তোমার গৃহাঙ্গনে প্রবেশ না করতে দিয়ে তোমার পরিবেশকে অন্ততঃ শান্ত রাখবে।
বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষার জন্য যেমন তোমার শিশুদেরকে ভ্যাকসিন বা টিকা দিয়ে থাক, ঠিক তেমনিই এমন বিষাক্ত পরিবেশের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তাদেরকে প্রতিষেধক ঈমানী ও তরবিয়তী টিকা পূর্ব থেকেই দিয়ে রেখো।
হ্যাঁ, আর অপরের দোহাই দিয়ে এ কথা বলো না যে, কে আর মেনে চলছে?’ অর্থাৎ, সবাই যখন নোংরা, তখন আমিই বা ভালো কেন থাকি? লোকে মানে না, তাই আমিও মেনে চলি না। কিন্তু ভেবে দেখ, তুমি মানবে তোমার সৃষ্টিকর্তাকে, তোমার নিজের ভালাইর জন্য। তুমি কোন মানুষকে ভয় করে, কোন মানুষের খাতিরে ভালো হয়ে চলবে না -এটাই হবে তোমার নিজস্ব স্বকীয়তা ও সবলতার পরিচয়। দুনিয়ার সমস্ত লোক দোযখে গেলে তুমিও কি দোযখে যাবে? দুনিয়ার মানুষ অধিকাংশই কাফের বলে তুমিও কি (নাউযু বিল্লাহ) কুফরী করবে? তুমি কি চাও না মুক্তি? চাও না বেহেশ্ত?
হ্যা, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের সামনে এমন যুগ আসছে, যে যুগে আমাদেরকে অপসংস্কৃতির দুর্নিবার তুফানের সম্মুখীন হতে হবে। প্রগতিশীল অবাধ যৌনচারিতার বন্যায় ভেসে যাবে আমাদের নীতি নৈতিকতা। ভেঙ্গে যাবে সকল প্রকার সচ্চরিত্রতার বাঁধ। কিয়ামতের নিদর্শনসমূহের মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, ব্যভিচার ব্যাপক আকারে প্রকাশ পাবে, মহিলার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশী হবে। একটি মাত্র পুরুষ পঞ্চাশ জন মহিলার দেখাশোনা করবে। (বুখারী মুসলিম, মিফাত ৫৪৩৭ নং বাদ্যযন্ত্র ব্যাপক আকারে দৃষ্ট ও ব্যবহৃত হবে, ব্যাপক আকারে প্রকাশ পাবে নর্তকীদলের মক্ষীরাণীরা। যেমন মদ্যপানকে হালাল মনে করা হবে। {সহীহুল জামে’ ৩৬৬৫ নং) অযোগ্য লোক নেতৃত্ব পাবে। (বুখারী ৬৪৯৬ নং)।
আর এ কথাও প্রায় সকলের বিদিত যে, তেমন উদ্ধৃঙ্খল পরিবেশ পাশ্চাত্যে শুরু হয়ে গেছে বহু দিন আগে থেকেই। যে পরিবেশে ব্যভিচার কোন নোংরা বা মন্দ কাজ নয়; বরং আইন-সম্মত বৈধ কাজ। অবৈধ যৌন-সম্পর্ক ও ফেসানী নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তাদের। যত মাথা-ব্যথা হল, কুমারী ও কিশোরীদের গর্ভধারণ নিয়ে। সেখানে যৌনতা কোন গোপনীয় বিষয় নয়। সেখানে স্কুলে যৌনতা শিক্ষা দেওয়া হয়। কিশোরীদেরকে ব্যভিচার ও হারাম যৌন-সম্পর্কে জড়িত না হতে উপদেশ দেওয়া হয় না; বরং উপদেশ দেওয়া হয়, যাতে তারা এ সম্পর্কে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে। তাই তো কোন চৌদ্দ বছরের মেয়ে যদি যৌনমিলন না করে থাকে, তাহলে তাকে নিয়ে তার সখী ও সহপাঠিনীরা ব্যঙ্গ করে। আমাদের দেশে যেমন পনের-বিশ বছরের কোন তরুণ কলকাতা না দেখে থাকলে বন্ধুরা বলে, এখনো কলকাতা দেখিসনি? তুই এখনো মায়ের পেটে আছি রে!’ অনুরূপ ঐ সব দেশে তের-চৌদ্দ। বছরের কিশোরীকে নিয়ে তার সখীরা আশ্চর্য হয়ে ও ঠাট্টা করে বলে, 'এখনো এ মজা। চাখিসনি? তুই এখনো মায়ের পেটে আছি রে। এর ফলে দুই দিনের ভিতরে সেই কুমারীও অকুমারী হয়ে যায়! এর ছোঁয়া আমাদের পরিবেশে যে লাগেনি তা নয়। বর্তমানে দিল্লী, বোম্বাই, কলকাতা, ঢাকা সহ বড় বড় শহরের পার্কগুলিতে এ যৌন-পরিবেশ বেশ পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে পরিদৃষ্ট হয় সেই পাশ্চাত্য অসভ্যতার অকপট পূর্ণ অনুকরণ!
পাড়া-গ্রামে এ ধরনের পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষ এখনও বড় সচেতন ও সোচ্চার। কিন্তু সেখানেও যে ঘুণ ধরেনি তা নয়। বর্তমানের সিনেমা, ভিডিও ও টিভির মাধ্যমে সে অসভ্যতা ভালো ঘরেও অনুপ্রবেশ করছে। যারা এমন অসভ্যতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে।
তাদেরকে সাদাসিধা, ক্ষ্যাপা মনে করা হয়! একদা এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে কথা প্রসঙ্গে ভৎসনার সুরে বলল, তোমার ছেলেরা বড় শয়তানী করে বেড়ায়; শাসন করো।' দ্বিতীয় জন বলল, 'এখন সবারই ছেলেরা এমন করে। শুধু আমার ছেলেরা কেন? প্রথম ব্যক্তি বলল, 'আমার ছেলেরা ও পথে নেই। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘তোমার ছেলেরা তো ক্ষ্যাপা!’
এ কথা সত্য যে, পরিবেশে এমন প্রবাদ তৈরী করেছে যে, যার ফলে বলা হয়ে থাকে, ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ সত্য কথা বলে না। আর ক্ষ্যাপা ছাড়া কেউ ভালোবাসা (ব্যভিচার) ছাড়ে না! অতএব যে পরিবেশে কেউ ভালো থাকতে চাইলে তাকে ক্ষ্যাপা’ বলা হয়, সে পরিবেশে এ টিপ্পনী শোনার পর কে আর ভালো থাকতে চেষ্টা করবে?
যারা এমন নৈতিক অবক্ষয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করেন তাদেরকে লোকেরা নাক সিঁটকে মৌলবাদী’, ‘প্রাচীন-পন্থী’ প্রভৃতি বলে ব্যঙ্গ করে। ঐ শ্রেণীর ছন্নছাড়ারা ভাবে যে, নৈতিকতার পথ হল প্রাচীন। এ আধুনিক যুগে যৌনতাই হল নারী-পুরুষের স্বাধীনতা ও প্রগতির পথ। নতুনত্ব হল সংস্কারপন্থীদের (?) পথ। নতুনত্বে আছে জীবনের নতুন আনন্দ। গতানুগতিক সেকেলে ‘মোডেল চেঞ্জ’ না করলে একঘেয়ে কোন জিনিসই ভালো লাগে না। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, (كل جديد لذيذ) অর্থাৎ, প্রত্যেক নতুন জিনিসই মনোহর হয়, মজাদার হয়। হাতে নতুন নোট এলে তা খরচ করতে মায়া লাগে, অন্য কেউ দেখলে তা নিতেও চায়। নতুন কনের প্রতি বরের টান একটু বেশীই থাকে। নতুনত্ব প্রায় সকলের মন আকর্ষণ করে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তা পুরাতন হয়ে যায়, তখন সেই জিনিসের প্রতি মনের ততটা বা মোটেই টান ও আগ্রহ থাকে না। তখন নূতন নূতন ন’ কড়া, পুরনো হলে ছ’ কড়া’ তে পরিণত হয়। এটাই বাস্তব।
অবশ্য সব কিছুতেই যে নতুনত্ব ভালো তা সকলেই স্বীকার করবে না। যেমন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে, পুরনো ঘিয়ে মাথা ছাড়ে। যতই নতুন নতুন চাল আবিষ্কার হোক এবং ফলন যত বেশীই হোক না কেন, পুরনো যুগের ও পুরনো চালের মত ভাত আর অন্য চালের হয়। অনেকে বলে, উনি পুরনো মেট্রিক পাশ, উনার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশী। আগেকার পড়া পড়াই ছিল--- ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে সবচেয়ে আধুনিকতম ঐশীধর্ম ইসলামের নীতি-নৈতিকতাকে যারা প্রাচীন ও বস্তাপঁচা মনে করেন, তারা নিজেদের ধর্মের কথা ভেবে দেখতে পারেন। আর যদি ধর্মহীন। নাস্তিক হন, তাহলে তো তাঁর নিকট নূতন-পুরাতনের কোন প্রশ্নই নেই। পক্ষান্তরে নতুনত্ব ও সংস্কার আনার অর্থ যদি এই হয় যে, কিছুদিন অতিবাহিত হলেই তা বদলাতে হবে তাহলে আসল সংস্কৃতিটা কি? এর কি কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা রূপরেখা থাকবে? নারীবাদী ও যৌনদুষ্ট পরিবেশে নারী তথা জরায়ু-স্বাধীনতার যে দাবী চরিত্রহীনরা করে আসছে তা আসলে কি সংস্কার? পর্দার অন্তরাল থেকে বের হয়ে বেআবরু অবস্থায় মঞ্চে পুরুষের পাশাপাশি অবস্থানই কি সংস্কৃতি? মহিলাদের নিয়ে পুরুষদের বিভিন্ন উষ্ণ যৌনসুখ উপভোগের প্রবণতা, তাদেরকে কাছে-পাশে পাওয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থা ইসলামের পূর্বে জাহেলী যুগে ছিল। নারী নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হত,
নৃত্যগীত হত, অর্ধনগ্ন দেহ নিয়ে যৌনসুখ ভোগ করা হত। পতিতালয় ছিল, অনেক বেশ্যাই তার ঘরের দরজায় বিশেষ পতাকা উড়উন রাখত, যা দেখে খদ্দের জমা হত। ৮৯ জন পুরুষ একত্রে জমায়েত হয়ে একটি নারীর সহিত যৌন-মিলন করত এবং তাতে গর্ভ হলে ঐ মহিলা নিজের পছন্দমত ওদের একজনকে তার সন্তানের পিতা বলে চিহ্নিত করত। কোন কোন ঈর্ষাহীন স্বামী তার স্ত্রীকে অন্যের কাছে বীর্য সংগ্রহ করে গর্ভধারণ করতে পাঠাত।
ইসলাম এসে ব্যভিচার হারাম ঘোষণা করে রমণীর মান বাড়িয়ে তুলল। সংস্কার এল মানুষের চরিত্রে। সভ্যতা বলতে যা কিছু ছিল সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে তা মানুষকে দেখিয়ে ও জানিয়ে দেওয়া হল। এ সংস্কারের আবার কি সংস্কার চাই? এর পরেও সংস্কার কি অপসংস্কার নয়? একটি মৃত ভূমিকে উৎপাদনশীল করে তাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করা হলে বলা হয় ভূমি-সংস্কার হয়েছে। এখন যদি কোন বুদ্ধিজীবী বলেন, 'এ ভূমিরও সংস্কার। চাই; অর্থাৎ, ফুল-ফলের গাছ নষ্ট করে কাটা ও আগাছা লাগাও, তাহলেই নতুনত্ব আসবে এবং গতানুগতিক সৌন্দর্য থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা যাবে। তাহলে এমন বুদ্ধিজীবী যে কুবুদ্ধিজীবী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ যারা নারীকে মাঠে-ঘাটে, পথে-পার্কে, বাজারে-অফিসে বেপর্দায় এবং নৃত্য-গীত ও শিল্প-কলায় অবৈধ ও অশ্লীলভাবে ব্যবহার করাকে সংস্কার ও সংস্কৃতি মনে করে, সেই মাথা-মোটাদেরকে আর কি বলা যায়?
আর সংস্কার নয়ই বা কেন? নারীই তো এখন সবকিছু। নারীর হাতে রয়েছে সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। নারীর হাতে রয়েছে পুরুষের শান্তি ও স্বস্তি। সকল জ্বালার মলম। ব্যবসায় উন্নতি চাইলে একজন সুন্দরী যুবতীকে ম্যানেজার করে দাও, ব্যবসা দারুণ চলবে। চা, পান, মিষ্টি অথবা যে কোন দোকানে রূপসী যুবতীকে বসিয়ে দাও, খদ্দের বেশী আসবে তোমার ঐ দোকানেই। সেলুন খুলে যুবতীকে বসিয়ে দাও, আর কোন যুবক তোমার সেলুন ছাড়া অন্য সেলুনে যাবে না চুল-দাড়ি কাটতে। হোটেল খুলে সুন্দরী আধুনিকাদেরকে পরিচারিকা রেখে নাও, সমস্ত হোটেল বন্ধ হয়ে গেলেও তোমার হোটেল খুব ভালোভাবে। চলবে। যে কোন ব্যবসায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুন্দরী পাঠাও, সফলতা সুনিশ্চিত। যে অফিসে বারবার গিয়েও তোমার কার্য সিদ্ধ হয় না, সে অফিসে তুমি নিজে না গিয়ে তোমার আধুনিকা মিসেস’কে পাঠাও, তড়িঘড়ি কাজ হয়ে যাবে। কোন কিছুর বিজ্ঞাপন দেবে? সুন্দরীর মুখশ্রী ও সুঠাম রম্য আবেদনময়ী দেহ ব্যবহার কর, ক্রেতাদল তোমার মালকেই বেশী পছন্দ করবে। দর্জি যুবতী হলে আবার কি চাই?
সমস্ত যুবকদল ভেঙ্গে পড়বে তার কাছে জামাপ্যান্টের মাপ দিতে। পত্রিকায় মডেল যুবতী বা হিরোইনের ছবি বেশি বেশি ছাপো, পত্রিকার গ্রাহক-সংখ্যা বেড়ে যাবে নাটকীয়ভাবে। তাছাড়া পতিতালয়, ফিল্ম, ব্লু ফিল্ম প্রভৃতির ক্ষেত্রে নারীর অবদান অস্বীকার করা যায় কি? সংস্কৃতি (?) নৃত্যশালায় যুবতী নর্তকীদের পিছনে অর্থ কামাও, এমন অর্থকরী ব্যবসা আর অন্য কিছু নেই। মোট কথা, অর্থ উপার্জনের এক আজব যন্ত্র এই নারী। একে গোপনে রাখলে, সতীর হালে ঘরের বউ করে রাখলে কি করে চলে? অনেক মোটা বুঝের মানুষ মনে করে থাকে যে, ইসলাম বা মুসলিমরা নারীকে ‘ভোগ্যপণ্য বা ভোগের বস্তু’ গণ্য করে। আসলে জলাতঙ্ক রোগী তো, তাই নির্মল জলেও কুকুর দেখে। থাকে। কিন্তু জিজ্ঞাস্য যে, যাদের ঘরে-বাইরে নারী, বডিগার্ড নারী, প্রাইভেট-সেক্রেটারী নারী, নাপিত নারী, পরিচারিকা নারী, কফি পরিবেশক নারী, সম্মুখে নারী, পশ্চাতে নারী, ডানে। নারী, বামে নারী, বিয়ের আগেও শয্যাসঙ্গী নারী, অফিসে নারী, ক্লাবে নারী, খেলার মাঠে নারী, পার্কে নারী, যাদের কাছে নারী পুরুষ সমাজের সেফটি ভাল্ব’, যাদের কাছে পত্নী ও উপপত্নী সমান, যাদের জীবনই নারীতে নারীময়, তাদের কাছে নারী ভোগের বস্তু, নাকি যারা নিজের বিবাহিতা স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট এবং অন্য কোন গম্য নারীর মুখদর্শনও অবৈধ ভাবে, তাদের কাছে নারী ভোগের সামগ্রী?
যুবক বন্ধু আমার! নারীবাদীদের কুহকে পড়ে ‘মেড়া’ হয়ে যেও না। স্ত্রী-কন্যা ও বোনের ব্যাপারে ঈর্ষাহীন হয়ে পড়ে না। তাদেরকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে তুমি নিজে সীমাহীন পরাধীনতার শিকার হয়ে যেও না। আমাদের সমাজ-বিজ্ঞানী নবী বলেন, “তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ বেহেশু হারাম করে দিয়েছেন; এদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হল মদ্যপায়ী, দ্বিতীয় ব্যক্তি হল পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, আর তৃতীয় ব্যক্তি হল ‘মেড়া’ পুরুষ; যে তার পরিবারের নোংরামীতে মৌনসম্মতি জানায়।” (আহমাদ, সহীহুল জামে’ ৩০৪৭ নং)
নারী-স্বাধীনতাবাদীর অবস্থা এই যে, তার নতি স্বীকার করা দরকার ছিল আল্লাহর বিধানের কাছে; কিন্তু তা না করে গোবেচারা নতি স্বীকার করে স্ত্রীর কাছে! তাই স্ত্রীকে অন্যের সাথে অবৈধ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে আঁটতে পারে না। কোন কোন কাজে বা খিদমতে বাধ্য করতে পারে না। কারণ, সে তো আধুনিক যুগের মানুষ। সে লাগামছাড়া নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাই স্ত্রীকে চরম ও পরম স্বাধীনতা দিয়ে মনের উদারতা প্রকাশ করে থাকে। কেউ তাকে ‘ভেড়া’ বললেও স্ত্রী ও তার বন্ধুরা তো তাকে উদার মনের মানুষ’ বলে প্রশংসা করে। এ যুগে এটাই তো পৌরুষ। অথচ সে বেচারা যে নিজে পরাধীনতার শিকার হয়ে পড়ে, তা হয়তো নিজেও অনুভব করতে পারে না। অবশেষে সে স্ত্রৈণ ও আঁচল-ধরা’ পুরুষে পরিণত হয়, তা নিজে বুঝতে না পারলেও সমাজের সচেতন মানুষরা অবশ্যই বোঝে।
আর একটি কথা মনে রেখো বন্ধু! লজ্জা হল নারীর ভূষণ এবং সতীত্ব হল তার মূলধন। এ দুই না থাকলে নারীর আর কিছুই থাকে না। তখন অবস্থা হয় বাদুড়-চোষা তালের মত। এতদুভয় নিয়ে নারী বা অন্য কেউ যখন ব্যবসা বা চিত্তবিনোদন শুরু করে, তখন নারী যে কেবল শাড়ী-সর্বস্বই থেকে যায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু নারীবাদীদের তাতে কি এসে যায়? তারা তো আসলে ‘কানা বেগুনের ডোগলা খদ্দের। প্রগতিবাদীর প্রগতির চাকা সদা গতিময়। স্বামী-স্ত্রীর সংসার। সর্বদা ঘরে থেকে একঘেয়েমি জমে ওঠে মনে৷ এরও একটা সংস্কারের দরকার। এই গতানুগতিকতা দূর করতে প্রগতির পথে খোলা-মেলা বের হতে হবে প্রগতির ময়দানে মুক্ত আকাশের নিচে, কোন পার্কে, সবুজ বনানীতে, অথবা সমুদ্র সৈকতে। যেখানে প্রগতিময় প্রেমের সাক্ষী হবে ছায়াঘন বন, ফুটন্ত ফুল ও তার সুবাস, বিশাল সমুদ্রের ফুলে ফুলে ওঠা তরঙ্গমালা, সৈকতের ধুলাহীন বালি এবং সন্ধ্যা আকাশের কোটি কোটি তারকারাজি। জ্যোৎস্না-আলোকিত স্নিগ্ধময় রাত্রে প্রেমিক-প্রেমিকার মনে ক্ষণে ক্ষণে পুলক জেগে উঠবে। রোমা ছাড়া প্রেম জীবনের আর স্বাদ কোথায়? কুকুর-বিড়াল রাস্তা-ঘাটে প্রেম-মিলন ঘটায়, বাঘ-শিয়াল ঘটায় বনেঝোপে, সুতরাং মানুষ কেন তা ঘরের কোণে গোপনে ঘটাবে? আমি যে একজনকে ভালোবাসি, প্রেমের মিলন উপহার দিই, তা যদি অপ্রকাশিত থেকেই গেল এবং প্রকৃতির। কেউ জানতেও পারল না, তাহলে সে ভালোবাসা ও প্রেমের মূল্য কি?
বলা বাহুল্য এই হল প্রগতির গতি। পরন্তু সঙ্গিনী যদি উপপত্নী অথবা গার্ল ফ্রেন্ড’ হয় তাহলে প্রগতির প্রকৃতিই হল উক্ত প্রকার রোমান্স।
আসলে এসবের মূলে রয়েছে লজ্জাহীনতা ও মুসলিমের ঈমানী দুর্বলতা। মহানবী ও বলেন, “অবশ্যই লজ্জাশীলতা ও ঈমান এক অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুতরাং দু’টির একটি উঠে গেলে অপরটিও উঠে যায়।” (হাকেম সহীহুল জামে’ ১৬০৩ নং) সুতরাং এ শ্রেণীর মানুষদের ঈমান দুর্বল অথবা একেবারে নেই বলেই লজ্জা-হায়ও নেই। আর এ কথা ঠিক যে, বেহায়া মানুষের মনে ঈমানও লুপ্তপ্রায় হতে থাকে।
পরিবেশ নোংরা করতে বড় হাত রয়েছে ঐ তথাকথিত নারীবাদী বহু লেখক-লেখিকাদের। যারা নারী-পুরুষের সর্ব বিষয়ে সমান অধিকার দাবী করে থাকেন। যারা বলেন,
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন(?) ভেদাভেদ নাই।
ইসলাম যদিও নারীর উপর কোন পীড়ন আনেনি তবুও ঐ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের পর্দার বিধানকে নারীর জন্য অবরোধ-প্রথা মনে করে দ্বীনের উপর বাকতরবারির আঘাত চালান। এদের ধারণা হল, ইসলামে নারী হল নরের দাসী। মুসলিম পরিবেশে নারীদেরকে হেরেম কারাগারে বন্দিনী করে রাখা হয়। অবশ্য এ হল কোন কোন বাহ্যিক পরিবেশের অবস্থা দর্শনের পর সীমিত ও সংকীর্ণ জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফল। আর উক্ত দাবীর ফলেই কবির এ কথা সত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে,
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর,
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
আজ সর্বক্ষেত্রে নারী ও নারীবাদীরা পুরুষের মত সমান অধিকার দাবী করছে। ভাবতে অবাক লাগে যে, তারা এমন অধিকার দাবী করে বসে, যাতে তাদের নিজেদেরই ক্ষতি থাকে। আমেরিকার কিছু মহিলা সৈনিক দাবী জানায় যে, বৈষম্য না রেখে পুরুষ সৈনিকদের মত তাদেরকেও মাথা নেড়া করতে অনুমতি দেওয়া হোক! কেউ চায় পুরুষদের মত প্যান্ট পরে দাড়িয়ে পেশাব করতে, পুরুষদের মত খালি গায়ে থাকতে! গরমে পুরুষরা খালি গায়ে মেয়েদের সামনে হাওয়া খাবে, অথচ মেয়েরা পুরুষদের সামনে খালি গায়ে হাওয়া খেতে পারবে না কেন? অনেকে কার্যক্ষেত্রে সমান অধিকার নিতে গিয়ে বন্ধুত্ব ও অবাধ স্বাধীনতায় সমান অধিকার দাবী করে। পুরুষ যে কাজ করবে সে কাজ নারী করবে না কেন?
নারীদেরকে যে কষ্ট ভোগ করতে হয় তা তারা একা ভোগ করবে কেন? পুরুষদেরকেও তাতে ভাগী হতে হবে। আর পরিশেষে হয়তো সম্ভব হলে এ দাবীও উঠবে যে, প্রথম সন্তান যদি স্ত্রী প্রসব করে তাহলে দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করতে হবে স্বামীকে! অথচ সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ সকলকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন ইনসাফের সাথে। তিনি নারীর উপর নরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর এ কথাও স্পষ্ট ঘোষণায় বলে দিয়েছেন যে, “যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ। তোমরা আল্লাহরই নিকট অনুগ্রহ ভিক্ষা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা নিসা ৩২ আয়াত)
শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতেই নয় বরং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও নারী ও পুরুষ এক অপরের সমকক্ষ নয়। দৈহিক ও প্রকৃতিগত বহু পার্থক্য রয়েছে নারী-পুরুষের মাঝে। যেমন, পুরুষরা নারীদের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ বেশি লম্বা, ২০ ভাগ বেশি ভারী এবং ৩০ ভাগ বেশী শক্তিশালী। পুরুষ এবং মহিলা একই খাদ্য খেলে নারীদের পক্ষে তা হজম করতে বেশি সময় লাগে। নারীদের ব্যথার অনুভূতি অনেক তীব্র। মানসিক দিক দিয়ে নারীদের পক্ষে বিষাদগ্রস্ত। হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। মস্তিষ্কের উপর হরমনের প্রতিক্রিয়াও মহিলা এবং পুরুষ। ভেদে যথেষ্ট আলাদা। মানুষের মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী সেরেটনী’ নামক রাসায়নিক পদার্থ নারীদের দেহে কম তৈরী হয়। যার ফলে নারীদের মানসিক প্রতিক্রিয়া পুরুষদের তুলনায় তীব্র। সে জন্যই বাইরের ঘটনার প্রতি নারীদের প্রতিক্রিয়া অনেক প্রবল। হার্ট এ্যাটাকের ফলে পুরুষদের মারা যায় শতকরা ২৪ জন এবং মহিলাদের মৃত্যুর সংখা হল ৪২। বেশি বয়সের নারীদের হাড় দুর্বল হয়। তাদের হাড়ের ওজনও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। এমনকি তাদের মাংসপেশী কম জোড়ালো এবং তার ওজনও কম।
মোটকথা, আন্দোলনের ফলে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নারীবাদীদের নিকট অংশতঃ স্বীকৃত হলেও প্রাকৃতিক দিক দিয়ে পুরুষ পুরুষ এবং নারী নারীই। তারা সমান হতে পারছে । হয়তো কোন কালে পারবেও না। (বিবিসির প্রতিবেদন) সুতরাং যুবক বন্ধু পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করে যারা খেতে চায়, তাদের কুহকে পড়ে তুমিও অনুরূপ শিকারীতে পরিণত হয়ো না। এটাই আমার উপদেশ।
আমরা যে পরিবেশে বসবাস করি তার অবস্থা একেবারে উল্টা বুঝিল রাম। যেখানে কথা ছিল, দাড়িহীন মুখ দেখে লোকে ঠাট্টা করে বলত, 'আরেপুরুষ অথচ মুখে দাড়ি নেই! অথবা মুসলিম অথচ মুখে দাড়ি নেই!’ সেখানে লোকে বলে, 'এ্যা! মুখভর্তি দাড়ি! যেখানে দরকার ছিল অর্ধনগ্নতা দেখে অবাক হওয়া, সেখানে তা না হয়ে অবাক হয় পর্দা-পুশিদা দেখে! যেখানে কথা ছিল, নারী (মাথা সহ) গলা-ঢাকা ও পায়ের গাঁট-ঢাকা লেবাস পরিধান করবে, সেখানে এ শ্রেণীর লেবাস ব্যবহার করে পুরুষরা। আর নারীরা করে তার বিপরীত। অর্থাৎ, পুরুষের গলা টাই দ্বারা টাইট করে বাধা হয় এবং প্যান্ট ইত্যাদি মাটিতে ঝুলিয়ে পরা হয়। আর মহিলাদের মাথা ও গলার কাপড় নেমে যায় স্তনের উপর এবং গাটের নিচের কাপড় উঠে আসে হাঁটুর উপর! পুরুষদের চুল ছোট এবং মেয়েদের চুল বড় করার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে অধিকাংশ তার উল্টাটাই হয়ে থাকে। আর সম্ভবতঃ এ ধরণের উল্টাপাল্টা করার নামই হল বর্তমানের সংস্কৃতি ও প্রগতি। সুতরাং সমাজে ইসলামী সংস্কার আনার জন্য যে তোমার বিশেষ ভূমিকা থাকা উচিত, তা বলাই বাহুল্য। বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি এই যে, সমাজে যে শ্রেণীর মানুষ বেশী হবে তাদেরই হবে জয়জয়কার এবং তাদের চরিত্রই পরিণত হবে নৈতিকতা ও সভ্যতায়। লম্পটের সংখ্যা অধিক হলে পুরো সমাজের প্রতিনিধি হয়ে বসবে লম্পট! বেশ্যার সংখ্যা অধিক হলে তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার দাবী উত্থাপিত হলে তাদেরকেও দেওয়া হবে প্রতিনিধিত্ব! কেউ তা দিতে না চাইলে সমাজের কত চিন্তাবিদ ও কবিরা তাদের সুরে সুর মিলিয়ে গাইবেন,
কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল কেহ সে ঘৃণ্য নহে,
ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা-কালিয় দহে।
শোন মানুষের বাণী,
জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোন গ্লানি।
---- শুনো ধর্মের চাই
জারজ-কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
যদিও ধর্মে উভয় সন্তানের মাঝে মানবিকতায় কোন পার্থক্য নেই তবুও উভয়ের পিতামাতার মাঝে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে তা বলাই বাহুল্য। যেমন নিজ হাতে কামাই করা টাকাও টাকা এবং চুরি করা টাকাও টাকা। কিন্তু পরিশ্রমী ও চোরের মাঝে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা তো সকলকেই মানতে হবে। পরন্তু সংখ্যাধিক্যের কারণে লম্পট ও বেশ্যাদের দাবী রক্ষার্থে দেশে বিশেষ আইন তৈরী হবে! বরং তাদের ঐ লাম্পট্য ও বেশ্যাবৃত্তি সুবিধা ও সহজ করার জন্য দেশের সরকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে। তাদেরকে সমাজের বন্ধু মনে করে দেশ উন্নয়নের (যৌন) কর্মী মনে করা হবে। মানবাধিকার রক্ষার নামে সংগঠন ও সংস্থা কায়েম হবে! এটাই হল বাস্তব, যাদের সংখ্যা ও ভোট বেশী, জয় তাদের। আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও তাদেরই হাতে।
আর এও এক বাস্তব যে, পৃথিবীতে চিরদিনই সৎ ও ভালো লোকের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। জগতের অধিকাংশ লোকই অসৎ। অধিকাংশ লোকেই যৌনবাদ ও জরায়ু-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কারণ, এতেই আছে জীবনের পরম তৃপ্তি, মানুষের প্রকৃতিগত চরম সুখ। সুতরাং তারাই যে পৃথিবীর নেতৃত্ব হাতে পাবে, তা তো গণতন্ত্র-শাস্ত্র আমাদেরকে ভবিষ্যৎবাণী করে। আজ যারা অর্ধনগ্ন হয়ে কোমর দুলিয়ে দুনিয়াকে অশ্লীল নাচ দেখাচ্ছিল, তারাই কাল দুনিয়ার নেতৃত্ব হাতে পাবে। কারণ, দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নাচে খুশী হয়েছে, তাই তাদেরকে পছন্দ ও নির্বাচিত করবে। কাল যাদের দেহরূপ ও অঙ্গভঙ্গি দেখে চক্ষুশীতল করেছে, আজ দুনিয়া তাদের নিকট মাথা নত করে তাদের আনুগত্য করবে!
যুবক বন্ধু! মহানবী সঃ এর এক অহীলব্ধ ভবিষ্যৎ-বাণী শোন, তিনি বলেন, “মানুষের। নিকট এমন ধোকাব্যঞ্জক যুগ আসছে, যাতে মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদীরূপে এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত করা হবে। যখন খেয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে এবং আমানতদার আমানতে খেয়ানত করবে। যখন জনসাধারণের ব্যাপারে তুচ্ছ লোক মুখ চালাবে।” (আহমাদ, ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহুল জামে ৩৬৫০ নং) তিনি বলেন, “কিয়ামত ততদিন পর্যন্ত কায়েম হবে না, যতদিন না পার্থিব ব্যাপারে সবচেয়ে সুখী ও সৌভাগ্যের অধিকারী হবে অধমের পুত্র অধম।” (আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে' ৭৪৩ ১ নং)
বলা বাহুল্য, সে যুগ যে এসে গেছে তাতে কোন মুমিনের সন্দেহ থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও লাগামছাড়া পাশ্চাত্য সভ্যতা-ঘেরা দেশ ও পরিবেশ। যেখানকার এমন কোন আইন নেই, যা মানুষের প্রবৃত্তিপূজায় বাধা দেয়। বরং অনেক আইনেই উদ্বুদ্ধ করা হয় প্রবৃত্তিপূজায়, ভোগবাদিতায় এবং ধর্মহীন অবাধ স্বেচ্ছাচারিতায়। তাদের সকলের মুখেই যেন একই বাণী,
দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি কর,
আগামী কাল বাঁচবে কি না বলতে পার?
মরণের পরপারের কথায় অবিশ্বাসীদের এই ভোগবাদী পরিবেশে মুসলিমদের অবস্থাও বিপর্যস্ত। তারপর আবার ঘরের টেকি কুমীর। মুর্তাদ্দ বুদ্ধিজীবীরা; যারা নিজেদের কুবুদ্ধিকে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জীবিকা ও অর্থ অর্জন করে তাদের লেখনি, বক্তৃতা ও ব্যবহারেও মুসলিম যুবক কুহকগ্রস্ত। এদের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজ ও পরিবেশ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। বাইরের শত্রু যত ক্ষতি সাধন করতে না পারে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী পারে ঐ মীরজাফরেরা।
আর বাইরের শত্রুরা এদেরকে ব্যবহার করে, এদের বুদ্ধিকে ক্রয় করে নিয়ে কাঁটা দিয়ে কঁটা তোলার কাজ করিয়ে নেয়। তাদের শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমে তাদেরকেই সমাজসেবী। বীর-বাহাদুররূপে চিত্রিত করে।
ভাইজান! যদিও এই শ্রেণীর মানুষদের নিকট থেকে গোড়া-রক্ষণশীল’ বলে অনেক গালি ও কটাক্ষ শোনা যায়, তবুও তুমি মনে মনে আল্লাহর আদেশ পালনে গর্ববোধ করো। আর তাদের ঐ কথায় কর্ণপাত না করে ভেবো, কুত্তা হুঁকতা রহেগা, আওর হাথী চলতা রহেগা।
মুসলিম আজ সুপরিকল্পিতরূপে হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার শিকার। মুসলিমের অমূল্য ধন চরিত্র ও নৈতিকতা দেখে সারা বিশ্বের চোখ-টাটানি রয়েছে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই। তাছাড়া এমনিতেই মানুষ এক অপরের ভালাই দেখতে পারে না। হাসলে বলে, লোকটা প্রগম্ভ। কাঁদলে বলে, ছিচকাদুনে। বেশী কথা না বললে বলে, গোমরামুখে। কথা বললে বলে, গপে। সহ্য করলে বলে, ভীরু। প্রতিশোধ নিলে বলে, অসহিষ, সন্ত্রাসী। ভালোর চেষ্টা থাকলেও মানুষ তাকে মন্দ আখ্যা দিতে দেরী করে না। দেখতে না পারলে চলন বাঁকা লাগে। চোখে। অবশ্য এর মুলে থাকে ভুল বুঝাবুঝি ও কুধারণা মাত্র।
ইসলামের প্রতি কিছু সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের নাক-সিঁটকানির একটি কারণ এই যে, তারা মনে করেন, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত একটি ধর্ম অথবা মতবাদ। অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন তথ্য যেমন বিজ্ঞানের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়েছে এবং বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব তথ্য প্রকাশ করে বহু বৈজ্ঞানিককে ধর্মযাজকদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে -যেমন হয়েছে। গ্যালিলিও প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকের সাথে -তেমনি ইসলামেরও বহু তথ্য আছে যা অবৈজ্ঞানিক।
আসলে তারা কিন্তু নিছক ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মধুকে মদ মনে করেছেন। তুলনা । করেছেন দুধকে আলকাতরার সাথে। তাদের চুন খেয়ে গাল তেঁতেছে, তাই দই দেখেও ভয়। পাচ্ছেন! অথচ তারা যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে ইসলাম ও তার সংবিধান
কুরআন ও সহীহ হাদীস এবং উভয়ের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে বিবেচনা-গবেষণা করতেন, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তাদের সে ভুল ধারণা ও সন্দেহের মেঘ মনের আকাশ থেকে পরিষ্কার হয়ে যেত। আর ঊর্ধ্বপক্ষে তারা প্রমাণ করতে পারতেন যে, ইসলাম কোন বিকৃত ধর্ম বা মানব-রচিত মতবাদের নাম নয়। বরং ইসলাম হল মহান সৃষ্টিকর্তা মহাবৈজ্ঞানিক আল্লাহর তরফ থেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি অক্ষত জীবন-ব্যবস্থা। আর তার সাথে তাদের দুই দেখে সেই ভয় দূর হয়ে যেত; যে ভয় চুন খেয়ে গাল তাতার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল।
বিশ্বপরিচালনা করার মত শক্তি কোন ধর্মের না থাকলেও ইসলামের আছে। যেহেতু ইসলাম হল সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। মানব-জীবনের সকল প্রকার সমস্যার পূর্ণ সমাধান এক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে নেই। তাই তো খৃষ্টধর্মাবলম্বী হয়েও আমেরিকার এক গবেষক লেখক মাইকেল এইচ হার্ট’ তার 'দি হানড্রেড’ নামক প্রসিদ্ধ পুস্তকে মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে স্বীকার করেছেন এবং একশত মনীষীর মধ্যে তাকেই ঐ পুস্তকের প্রথমে স্থান দিয়েছেন। আর এর কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে, অন্যান্য মনীষী ছিলেন শুধু জাগতিক অথবা শুধু ধার্মিক নেতা। কিন্তু মুহাম্মাদ ই ছিলেন জাগতিক এবং ধার্মিক উভয় ক্ষেত্রের পুরোধা। (শ্রেষ্ঠ ১০০, ৪পৃঃ)
সুতরাং অন্য ধর্মের ব্যর্থতা দেখে অনুমান করে এ ধারণা এক প্রকার অজ্ঞতা যে, অন্য ধর্ম যা পারেনি, তা ইসলামও পারবে না। অথবা অন্যান্য ধর্মমতের অনুরূপ ইসলামও একটা ধর্মমত। বরং প্রকৃত বাস্তব এই যে, ইসলাম হল স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীলতায় পরিপূর্ণ একটি শ্বাশত ও চিরন্তন ধর্ম।
বহু যুবকই ঐ শ্রেণীর হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পড়েছে। পরিবেশের বিষাক্ত ধুয়া নাকেমুখে লেগে তাদের শ্বাসরোধ করে ফেলেছে। এর একটি ছোট্ট উদাহরণ হল দাড়ি রাখার ব্যাপার। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা আমাদের সারা দেহে বিভিন্ন ধরনের লোম সৃষ্টি করেছেন। বান্দার কাছে আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি কিছু লোম ছাঁটতে, কিছু চেঁছে ফেলতে, কিছু সৌন্দর্যের সাথে বহাল তবীয়ত ছেড়ে রাখতে আদেশ করেছেন; আর তা অবৈজ্ঞানিক নয়। কারণ আল্লাহ বিজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা। “সৃষ্টি ও নির্দেশ কেবলমাত্র তাঁরই। বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ মঙ্গলময়।” (সূরা আ'রাফ ৫৪ আয়াত) এবারে তার আদেশ। হল দাড়ি রাখা। যা পুরুষের প্রতীক, সকল মহামনীষীদের আদর্শ এবং মুসলিমের জন্য (কমপক্ষে এক মুষ্ঠি পরিমাণ) ওয়াজেব। কিন্তু পরিবেশের চাপে মুসলিম তা অস্বীকার করতে চায়। কেউ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, 'ঈমান তো এখানে। অর্থাৎ, মুখে নয়, বুকে। আর তার মানেই হল, বুকে ঈমান রাখাই যথেষ্ট। কাজে পরিণত না করা বা আল্লাহ ও তদীয় রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করা কোন প্রকার ক্ষতিকারক নয়! অথচ ঈমান হল, বুকে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কর্মে পরিণত করার নাম।
কেউ কেউ বলে, সে যুগে ব্লেড ছিল না, তাই লোকে দাড়ি রেখে নিত। অর্থাৎ, সে যুগে ব্লেড থাকলে তারাও দাড়ি রাখত না এবং এ যুগে ব্লেড আছে, তাই দাড়ি রাখাটা যুক্তিহীন। অবশ্য এ কথা বলা মূর্খামি বৈ কিছু নয়। যেমন বহু মূখ বলে থাকে, সে যুগে লোকেরা খেতে পেত না বলে রোযা রাখত। তাছাড়া উপবাস করতে হবে কেন?! অথচ জ্ঞানী মাত্রই
জানেন যে, দাড়ি রাখার সাথে সাথে কিছু লোম না রাখারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। গুপ্তাঙ্গ ও তার চারিপাশের লোম চেঁছে পরিষ্কার করার জন্য ৪০ দিন সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অতএব সে যুগেও যে চাঁছা-ছিলার ব্যবস্থা ছিল তা বলাই বাহুল্য।
এই পরিবেশগত কারণেই বহু মহিলা পুরুষের মুখে দাড়ি পছন্দ করে না। তাই তো অনেক স্বামী পছন্দ সত্ত্বেও শুধুমাত্র ‘মিসেস'কে খুশ করার জন্য মহানবী ৪ এর আদেশ লংঘন করে তার আনুগত্য বরণ করে নেয়।
অমুসলিম পরিবেশে বয়সে হাজার ছোট হলেও দাড়ি রাখলেই বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট থেকেও ‘চাচা’ ব্যঙ্গ শুনতে হয়। অনেকে বিশ্বকবির অনুকরণে আব্দুল মাঝির মত সকলকেই এক নজরে মুখে ছুঁচলো দাড়ি, কামানো গোঁফ এবং নেড়া মাথা থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। তাই বহু মুসলিম যুবক শুধু কাফেরদের ঐ শ্রেণীর বিদ্রুপের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ইচ্ছা সত্ত্বেও আর দাড়ি রাখতে পারে না। অথবা রাখলেও ফ্যাশন মত কেটে-হেঁটে বাদ দিয়ে রাখে। আর ঐ একই কারণে অনেকে চাকরি পাওয়ার আগে পুরুষের পৌরুষ ও দাড়ি নষ্ট করে ফেলে।
অবশ্য অনেকে এর দায়ে লড়াইও করে থাকে। যেমন এক যুবক বাসের সীটে বসে আছে। সীট বলে রাখার জন্য বাপের বয়সের এক লোক তাকে ব্যঙ্গচ্ছলে জিজ্ঞাসা করল, 'ও চাচা! তুমি কোথায় নামবে?’ অমনি যুবক চকিত হয়ে বলে উঠল, 'ভাইপো! আমি অমুক বাসষ্ট্যান্ডে নামব। ভাবী কেমন আছে?’ বয়স্ক লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভাবী কে?’ যুবকটি বলল, কেন? তোমার মা। তুমি না আমার ভাইপো?' লোকটি বলল, তুমি রাগছ কেন? দাড়িওয়ালা লোকদেরকে তো চাচা বলা হয়। যুবক বলল, 'তাহলে রবি ঠাকুর তোমার কোন চাচা ছিল? মুনি-সাধুরাও কি তোমার এক একটি চাচা?’ লোকটি স্তম্ভিত হয়ে ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হল। হয়তো সে এ ভুল আর কোন দিন। করবে না।
এক সহপাঠী তার মুসলিম সহপাঠীকে বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলে বলল, কিরে তুই এই বয়স থেকে দাড়ি ছেড়ে বুড়ো সাজলি কেন?’ মুসলিম যুবক উত্তর দিল, বুড়ো সাজার জন্য নয় রে, পুরুষ সাজার জন্য দাড়ি ছেড়েছি।' সেই সহপাঠীও সেদিন তওবা করেছিল। কিন্তু নরম জায়গায় বিড়ালের আঁচড় যে বড় সুবিধা।
আসলে মুসলিমদের উচ্চ ও দৃঢ় মনোবল নেই বলেই তাদেরকে নিয়ে লোকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের ঐ পা-চাটা বহুরূপী মন-মানসিকতাই অন্যের নিকটে তাদের ওজন হাল্কা করে দিয়েছে। যে মুসলিমদের কথা ছিল, আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না, সেই মুসলিমরা আজ সৃষ্টির দাসে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থ ও গদির লোভে নিজের স্বকীয়তা বর্জন করতে পর্যন্ত রাজী হয়েছে। হয়তো কোনদিন যদি এর জন্য খাসি হতে হয় তাও হবে!
পক্ষান্তরে রাজনৈতিক যে মর্যাদাতেই উন্নীত হোক না কেন, কোন শিখ তার ধর্মীয় প্রতীক পাগড়ী ও দাড়ি বর্জন করে না। তবুও কই, তাদেরকে কেউ চাচা” বলে না, বলতে পারে না। কারণ, তাদের আছে সুদৃঢ় মনোবল, সুউচ্চ আত্মমর্যাদা এবং ধর্মীয় প্রতীকের প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও চরম গুরুত্ব। কিন্তু মুসলিম হীনম্মন্যতার শিকার। নিজেদের কাছে নিজেরাই নীচ,
হীন ও নিকৃষ্ট। অপরের কাছে নিজেদেরকে নেহাতই ছোট ও লাঞ্ছিত ভাবে। যে জাতি সর্বের সেরা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে আল্লাহ-প্রদত্ত খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পৃথিবীতে এসেছিল, যে জাতি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নতি স্বীকার করতে জানত না, যে জাতির জন্য মহান প্রতিপালকের ঘোষণা ছিল, “তোমরা নিজেদেরকে হেয় মনে করো না। এবং চিন্তিত হয়ো না। তোমরাই হবে (পৃথিবীর) সর্বোপরি, যদি তোমরা মুমিন হও।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৩৯ আয়াত) সেই জাতির অবস্থা এই যে, সে নিজের চোখে নিজেকে ছোট ও নীচ এবং অপরকে বড় ও সমুন্নত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আজ শুধু মনের ভিতর প্রশ্ন জাগে যে, কোথায় সে জাতি, ভিখারীর বেশে খলীফা যাদের শাসন করিল আধা জাহান’? কোথায় সে জাতি, যে জাতির শিক্ষা ছিল,
‘আল্লাহর কাছে কখনো চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,
আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে শির করিও না নিচু।
আজ মনে শুধু প্রশ্ন জাগে,
‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান,
কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবনে-মৃত্যু-জ্ঞান?
যার মুখে শুনি’ তৌহিদের কালাম,
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যাহার দ্বীন রবে কাপিত দুনিয়া জি-পরি-ইনসান।
স্ত্রী-পুত্রে আল্লারে সঁপি’ জিহাদে যে নির্ভিক,
হেসে কুরবানী দিত প্রাণ যারা, আজ তারা মাগে ভিখ?
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া,
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কুরআন।
আসলে আজকের মুসলিম মানসিক আগ্রাসন ও পরাজয়ের শিকার। তাই নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে! বাঘের বাচ্চা ছাগের পালে পড়ে নিজেকে ছাগ থেকেও ছোট ও হেয় মনে করে নিয়েছে। হিরার টুকরা মাটিতে পড়ে ধূলিধূসরিত হয়ে নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে নিজেকে মাটির ঢেলাই মনে করেছে। অথচ ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিতে তার গর্ব হওয়া উচিত ছিল।
মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে, আমি একজন (আত্মসমর্পণকারী) মুসলিম’, সে ব্যক্তির কথা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কথা। আর কার?” (সূরা ফুসসিলাত ৩৩ আয়াত)। কিন্তু যে শক্তিবলে সে নিজেকে মু'মিন’ ও ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবে, সে শক্তি ঈমান’ ও ‘ইসলাম’ যদি তার মন, কথা ও কাজে দুর্বল বা বিলীন থাকে তাহলে সে নিজেকে গোপন করবে না কেন? যে দেশের রচিত বিকৃত ইতিহাস তার চেহারাকে কালিমাময় করে ফেলেছে সে দেশে নিজ চেহারাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে না তো আর কি করবে? ইতিহাসের পর্দা তুলে কে তার আসল পরিচয় জেনে মনের মাঝে সে হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনবে?
হে ভাই যুবক! পারবে না কি তুমি তোমার বদনামকে সুনামে পরিণত করতে? অবশ্যই পারবে। অতএব সে শক্তি আনয়ন কর, যে শক্তি ছাড়া তুমি হীন ও ক্ষীণ। যে শক্তি পরমাণু বোমা থেকেও অনেক শক্তিমান। অতঃপর যেখানেই থেকো, যে পরিবেশেই থেকো, মাথা উঁচু করে বলে, 'আমি মুসলিম। বুক ফুলিয়ে বলো, আমি মুসলিম। জোর গলায় বলো, আমি মুসলিম। গর্বের সাথে বলো, ‘আমি মুসলিম। মনের তৃপ্তির সাথে বলো, আমি মুসলিম। নির্ভয়ে বলো, আমি মুসলিম। নির্দ্বিধায় বলো, আমি মুসলিম। হিম্মতের সাথে বলো, 'আমি মুসলিম। মনের সকল সংকোচ কাটিয়ে বলো, আমি মুসলিম। জিহ্বার জড়তা কাটিয়ে বলো, আমি মুসলিম। আমি সেই সত্তার নিকট আত্মসমর্পণকারী, যিনি বিশ্বজাহানের সৃজনকর্তা ও দয়াময় পালনকর্তা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তুমি যদি কেবল নামসর্বস্ব মুসলিম হও, অন্তঃসারশূন্য মুসলিম হও অথবা ঈমানবিহীন মুনাফিক হও, তাহলে সে সৎসাহস, সে তৃপ্তি, সে গর্ব আসবে কোত্থেকে? পায়খানায় বসে তো আর মৌমাছির পরিচয় দেওয়া চলে না ভাই! বন্ধু আমার! এত লোক, এত সমাজ, এত ধর্ম ও জাতির মধ্যে একমাত্র তুমিই শ্রেষ্ঠ জাতি, সে কথা কোন সময়ের জন্য ভুলে বসো না। কুরআন সাক্ষ্য দেয়, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি; তোমরা মানবমন্ডলীর জন্য উদ্ভূত হয়েছ। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং মন্দকাজে বাধা দেবে। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।” (সূরা আ-লি ইমরান ১১০ আয়াত) “এভাবেই আমি তোমাদেরকে এক আদর্শ মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি; যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হতে পার।” (সূরা বাক্বারাহ ১৪৩ আয়াত) আর মহানবী #$ বলেন, “ইসলাম চির উন্নত, অবনত নয়।” (দারকুনী বইহাকী, সহীহুল জামে’ ২৭৭৮ নং)
সুতরাং মুসলিম হেয় নয়, তুচ্ছ নয়, নয় অবজ্ঞার পুতুল। শত হালাকুর হালাকের মুখে শত শতবার ভেঙ্গে পড়েছি, তবুও আমি আমার স্বকীয়তা নিয়ে জীবিত আছি। কত ফেরআউনের কুটিল চক্রান্ত আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, তবুও আমি মুসার অনুসরণ করে আজও টিকে আছি। কত ঝড়-ঝঞ্চার মুখে উড়ে-উড়ে আঘাত খেয়েছি, তবুও সেই ঘাত-প্রতিঘাতের প্রবল দ্বন্দ্বের মাঝে আমি বিলীন হয়ে যাইনি। শত বাতিলের তুফান এসে আমাকে বিনাশ করতে চেয়েছে, তবুও আমি সবকিছুকে উল্লংঘন করে পাহাড়ের মত অটল থেকেছি। আর এইভাবে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এবং আঘাত খেতে খেতে আমি কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত টিকে থাকব দুনিয়াতে। কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না আমাকে।
কি দোষ আমার যে, সে দায়ে আমি অত্যাচারের নির্মম আঘাত সহ্য করব? কেন আমাকে গৃহহীন ও দেশছাড়া করার এত কুটিল চক্রান্ত? আমিও তো ঐ জালেমদের মতই একজন মানুষ। হয়তো আমার অপরাধ এই যে, আমি সত্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আমি আমার ও সারা সৃষ্টির স্রষ্টারই কেবল ইবাদত করে থাকি। এ দোষেই কি আমি আমার মাতৃভূমি থেকে বহিস্কৃত হব?
এ পৃথিবীর আসল উত্তরাধিকারী হল মুসলমান। এ পৃথিবী সুসজ্জিত ও সুশোভিত আছে
শুধু মুসলিমদের জন্যই। মুসলমান ধ্বংস ও নিঃশেষ হলে পৃথিবী ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে। যতদিন পৃথিবীতে একটিও মুসলিমও বেঁচে থাকবে ততদিন পৃথিবীও মহাপ্রলয়ের কবলিত হবে না। (মুসলিম, মিশকাত ৫৫১৬ নং)
তাওহীদ কী আমানত সীন মে হ্যায় হামারে
আসা নেই মিটানা নাম ও নিশা হামারা।
সুতরাং যারা মুসলিমদের ধ্বংস কামনা করে, যারা দুনিয়া থেকে মুসলিমদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিতে চায়, যারা ইসলামকে মানবতার শত্রু মনে করে, সে হিংস্র মানুষেরা জানে না। যে, তারা সেই হিংসুক শিয়ালের মত, যে একদিন একটি কাককে গাছের মগডালে বসে থেকে মনের সুখে কা-কা করতে দেখে হিংসা-জ্বালায় ফেটে পড়ে বলেছিল, ঈশ্বর একটি আকাশ-তুলতুল তুফান দেয়, তাহলে শালার কাক কোথায় থাকে তাই দেখব! অথচ শিয়াল। মশায় নিজের কথাটা ভুলেই গেছে। সে এ কথাটা মনে ভেবেও দেখেনি যে, আকাশ-তুলতুল তুফানে গাছপালা ধংস হলে বা ডুবে গেলে কাক ধংস হওয়ার আগে সে নিজে ধংস হয়ে যাবে। গাছের মগডালে পানি পৌঁছনর আগেই তার গর্তের ভিতরে যে পানি থৈ-থৈ করবে সে কথা হিংসার বিষ-জ্বালায় ভাবতেও সযোগ পায়নি।
ভাই মুসলিম যুবক! তুমি যে পরিবেশেই থাক না কেন, নিজের মাথা উঁচু রেখো; তবে অহংকারী হয়ো না। তুমি তোমার ব্যবহার ও পরিবেশকে এমন নোংরা করে রেখো না, যাতে তা দেখে ইসলাম থেকে মানুষ দূরে সরে যায়, বা দূর থেকেই ইসলামের নাম শুনেই নাক সিটকায়। এ জগতে বহু মানুষ আছে, যারা ইসলামকে মনে-প্রাণে পছন্দ করে; কিন্তু ইসলামকে দ্বীনরূপে গ্রহণ করে না। এ শ্রেণীর মানুষের ইসলাম গ্রহণ না করার যে বিভিন্ন কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি কারণ হল, বহু মুসলিম পরিবেশের অবাঞ্ছিত নোংরা ব্যবহার এবং অনেক ফাসেক মুসলিমের বিভিন্ন অনাচার ও দুরাচার। মুসলিমদের দুরবস্থা দেখেই তারা ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয় না। অনেকে অতি পিপাসায় পিপাসার্ত হয়ে দুর দুর থেকে কাজল-জলা দীঘির সন্ধান পেয়েও তার পানির উপর মড়া ভাসতে দেখে আর সে পানি পান করতে রুচিবোধ করে না। ইসলামে মুগ্ধ। হয়েও মুসলিমদের বেআমল পরিবেশ দেখে দূর থেকে দূরেই সরে যায়।
অবশ্য এ শ্রেণীর মানুষেরা যে জ্ঞানী মানুষ তা নয়। হীরের টুকরা যদি কারো দোষে কর্দমাক্ত হয় এবং তাতে কাদা দেখে যে হীরে কুড়িয়ে নেয় না সে জ্ঞানী হয় কি করে? ‘ছুঁচোর গলায় চন্দ্রহার’ দেখে কেউ সে হার বরণ করতে নারাজ হলে সে জ্ঞানী নয়। যে হক দেখে ব্যক্তি। চেনে না; বরং ব্যক্তির মুখ দেখে হক চিনতে চায়, তাকে কেউ জ্ঞানী বলতে পারে না। জ্ঞানী। হল সেই ব্যক্তি, যে কাদা পরিষ্কার করে হীরের টুকরা কুড়িয়ে নেয় এবং ছুঁচোর কারণে চন্দ্রহারের কদর কম মনে করে না। সেই হল জ্ঞানী, যে হক দেখে পরিবেশের বিচার করে; পরিবেশ দেখে হকের বিচার নয়।
মদীনা ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর আমার ওস্তায ডক্টর যিয়াউর রহমান আযমী সাহেব যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার কর্তৃপক্ষ ও আপনজনেরা তাতে প্রতিবাদ জানিয়ে নানা প্রলোভন ও প্রচেষ্টার বলে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তবুও তিনি হক থেকে এতটুকু বিচলিত হননি। তাকে বলা হয়েছিল, 'ধর্ম পরিবর্তন করার ইচ্ছা যদি তোমার একান্তই ছিল, তাহলে ইসলাম কেন? ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেই তো পারতো।
আজ সারা বিশ্বে তাকিয়ে দেখ, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থ-সম্পদের দিক থেকে কত উন্নত ও সমৃদ্ধ। আর মুসলিমদের অবস্থা তো অধঃপতনের অতল তলে। তাদের ব্যবহার ও পরিবেশ দেখেও কি তাদের ধর্মেই দীক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ হলে?
আমার ওস্তায় বলেন, এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েও আমি সকলের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছিলাম, আমি আসলে মুসলমান ও তাদের পরিবেশ দেখে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হইনি। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি কেবল ইসলামের সৌন্দর্য দেখেই। যত ধর্ম পৃথিবীতে ছিল বা আছে তার কিছু আল্লাহর তরফ থেকে হলেও তার শেষ ও মনোনীত ধর্ম হল ইসলাম। বিজ্ঞানের যুগে এই ছোট্ট গ্রামের মত পৃথিবীতে একটা ধর্মই যথেষ্ট। তাছাড়া অন্যান্য ধর্মে ভেজাল ও বিকৃতি অনুপ্রবেশ করে তার আসলত্ব বিলীন করে ফেলেছে এবং সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থেই এই সর্বশেষ ধর্মের অনুসরণ করার আদেশ রয়েছে। এই সকল সত্যকে উপলব্ধি করেই জ্ঞানী-গুণীরা ইসলাম গ্রহণ করেন। এবারে সে সত্য ধর্মের অনুসারীরা যদি তার সঠিক অনুসরণ না করে চলে, তাতে সত্যের কি আসে-যায়? সত্য যা তা অম্লান আছে, তা বরণ করে নিজেকে সত্যের অনুসারী করার অধিকারী তো প্রত্যেক মানুষের আছে।