অভাবের তাড়নায় ও বেকারত্বের ফলে সংঘটিত দুঃখ-জ্বালা কম নয়। এ ছাড়া সংসারের ঝড়-ঝামেলাও বিভিন্নমুখী, শতরূপী। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির দরুন যেমন দাম্পত্য-কলহ বাধে, তেমনি মনোমালিন্য ঘটে বাপ-বেটা ও শাশুড়ী-বউ-এর মাঝেও। হিংসা-জ্বালায় বিষময় হয়ে ওঠে ভাই-ভ্রাতৃত্বের সংসার। এমনিই ঘটে থাকে। না ঘটা বিরল ব্যাপার। সংসারে দুঃখকষ্ট একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন গড়া। যারা তা স্বীকার করতে চায় না, তারা আসলে জীবনকেই অস্বীকার করে। অবহেলিত পিতা-মাতা অথবা সন্তান, নিপীড়িতা গৃহবধু অথবা শাশুড়ী, লাঞ্ছিত ভাই অথবা অন্য কেউ -যেই হোক না কেন, জীবনের সমস্যাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না।
সমস্যা যতই আসুক তবুও তারই মাঝে সমাধানের আলো খুঁজে নিতে চেষ্টা করতে হবে। আর তারই মাঝে সন্ধান করতে হবে। আনন্দময় জীবন। জীবনে সমস্যার সৃষ্টি না হলে হয়তো বা আমাদের জীবনে বাঁচার আনন্দ অর্ধেক নষ্ট হয়ে যেত। কারণ, যে ভোজনে টক নেই, সে ভোজনে তত তৃপ্তি নেই। যে ভ্রমণে বিপদের ঝুঁকি নেই, সে ভ্রমণে তত আনন্দের স্বাদ নেই। মানুষের জীবনেও দুঃখ, দুশ্চিন্তা, দৈন্য আছে বলেই জীবন কখনো একঘেয়ে হয়ে ওঠে না।
পাঁচ জনের সংসারে ভুল বুঝাবুঝি স্বাভাবিক। হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ প্রভৃতি উল্লংঘন করে যাওয়া জীবনের এক শুভ জয়। আপদ-বিপদ, বালা-মসীবত ইত্যাদি সন্তুষ্টচিত্তে বরণ করে নেওয়া পূর্ণ ঈমানের পরিচায়ক। এমনই তো মুমিনের জীবন। নদীতে স্রোত আছে, তাই নদী বেগবান। জীবনে দ্বন্দ্ব আছে, তাই জীবন বৈচিত্রময়। সুতরাং এই বৈচিত্রময়তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোন সমস্যা আসেনি। এমন কেউ নেই, যে জীবনে কোন দুঃখ পায়নি। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোন রিক্ততা ও তিক্ততা নেই। এমন কেউ নেই, যে। জীবনভর শুধু পেয়েই গেছে এবং কখনোও কিছু হারায়নি জীবনে। পরন্তু সংসারের এক নিয়ম এই যে, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়, কিছু লাভ করার জন্য কিছু বিসর্জন দিতে হয়।
অবশ্য মনকে এই বলে প্রবোধ দিতে হবে যে, জীবনের সব সন্ধ্যাই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। তার মধ্যে শুভ সন্ধ্যারও পদার্পণ ঘটে। যে সন্ধ্যায় থাকে পূর্ণিমার পূর্ণশশীর মনমুগ্ধকর জ্যোৎস্নার আলো, অথবা থাকে মিলনের আকাঙ্খায় শুভ বাসরের ফুলশয্যার প্রস্তুতি, অথবা থাকে আগামী কালের ঈদ হওয়ার সুসংবাদ। তাছাড়া দুঃখ কিসের? যে ব্যক্তি তকদীরে বিশ্বাস রাখে, যার সাথের সাথী হল স্বয়ং পালনকর্তা আল্লাহ তাআলা, তার আবার দুঃখ কিসের? ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া ওয়াজেব। মানুষ নিজ ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না বলেই দুঃখ পায়। আর এ জন্যই মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যা ভাগ করে দিয়েছেন তা নিয়ে তুষ্ট থাক, তাহলে তুমিই হবে সবার চাইতে বড় ধনী।” (আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে ১০০নং)
পরন্তু মানুষ নানা মায়াজালে আবদ্ধ হয় হয় বলেই দুঃখ পায়। যা কামনা করে তা পায় না। বলেই ব্যথা-বেদনার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে হা-হুতাশ করে থাকে। পক্ষান্তরে যদি এমন জালে আবদ্ধ না হয়ে কোন কামনার বশীভূত না হয়, তাহলে মানুষ দুঃখের মুখ দেখে না।
কারো নিকট অতিরিক্ত অধিকার, বেশী মাত্রায় ভক্তি, অধিক পরিমাণে ভালোবাসা, অতি পরিমাণে সাহায্য-সহযোগিতা, বা মানুষ যতটার উপযুক্ত তার তুলনায় বেশী পরিমাণের মান-সম্মানের আশা করলে এবং যথা সময়ে তা না পেলে তার মনে আঘাত লাগে, দুঃখ হয়; নচেৎ কিন্তু হয় না। অতএব এরূপ আশা না রাখাই হল মনের বড় সুখ।
অবশ্য সব ধরনের সমস্যা ও দুঃখের একটি মহৌষধি ও প্রতিকার হল ধৈর্য। ধৈর্য তিক্ত; কিন্তু তার পরিণাম বড় মধুর। বৃক্ষের ছাল তিক্ত হলেও তার ফল বড় মিষ্ট। ধৈর্যধারণ করা কঠিন হলেও তার শেষ পরিণতি বড় শুভ।
আবার ধৈর্য ধরা শুরুতে কঠিন হলেও ধীরে ধীরে তাতে স্থিরতা আসে এবং পরে তা সয়ে যায়। তাছাড়া অসহ্য বলে কোন কিছু নেই। সময়ে সবই সহ্য হয়ে যায়। হরিণ বাঘের শিকার ও খাদ্য হলেও বাঘ যখন কুপোকাত হয় এবং হরিণ তার গাল চাটে, তখন বাঘ তাকে বলে, অভদ্রা বর্ষাকাল, হরিণী চাটে বাঘের গাল। শোরে হরিণী তোরে কই, সময় গুণে সবই সই। অতএব ছোটর কাছ থেকে লাথি খেলেও তা ধৈর্যের মাধ্যমে সহ্য করে নিতে হয়; বিশেষ করে যখন বদলা নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে তখন। পরন্তু বদলা নিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যদি ধৈর্যধারণ করে বদলা না নেয়, তবে সেটাই হল প্রকৃত ও বড় ধৈর্য। আর এ জন্যই দেখা গেছে যে, শক্তির চেয়ে ধৈর্যই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশী সফলতা আনতে পারে। মসীবত যেমনই হোক তা মসীবত। কিন্তু সব চাইতে বড় মসীবত হল মসীবতের উপর ধৈর্য রাখতে পারা। দুঃখ-কষ্ট যেমনই হোক, ধৈর্যের তরবারি দ্বারা কেটে ফেলা ছাড়া তার আর কোনই অব্যর্থ ওষুধ নেই। অতএব দুঃখী বন্ধু আমার! মসীবতে ধৈর্য ধর ও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নামায ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য কামনা কর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।” (সূরা বাকারাহ ১৫৩ আয়াত)
যাবতীয় বিপদ আসে আল্লাহর তরফ হতে। তিনি বিপদ-আপদের মাধ্যমে মু'মিনকে পরীক্ষা করে থাকেন। সোনা পুড়িয়ে সোনার খাঁটিত্ব যাচাই করে থাকেন। কখনো ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে, কখনো বা জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়, যারা হা-হুতাশ বর্জন করে সমুদয় দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণ করে, তারাই পায় আল্লাহর তরফ থেকে সুসংবাদ। উত্তম বিনিময়ের সুসংবাদ, বেহেস্তের শুভসংবাদ। যাদের উপর বিপদ পতিত হলে অসন্তুষ্ট ও বিচলিত না হয়ে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন। আসলে তাদেরই উপরে মহান প্রতিপালকের তরফ হতে শান্তি ও করুণা বর্ষণ হয় এবং তারাই হল সুপথগামী। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৫-১৫৭)
পক্ষান্তরে কোন কোন বিপদ আসে মানুষের কোন কৃতকর্মের ফলে। কোন অসৎ কর্মের। সত্বর সাজাস্বরূপ অকস্মাৎ বিপদ এসে মানুষকে সতর্ক করে যায়। তাকে ধ্বংস করার জন্য নয়; বরং তাকে নতুন করে গড়ার জন্য। মরিচা-পড়া লৌহ খণ্ডকে কর্মকার আগুনে দিয়ে আঙ্গার করে বারবার হাতুড়ি দ্বারা পিটিয়ে থাকে, তা নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য নয়; বরং নতুনরূপে কিছু তৈরী করার জন্য। মা জোর করে অনেক সময় শাস্তি দিয়েও তিক্ত ঔষধ শিশুকে সেবন করায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে মেরে ফেলার জন্য নয়; বরং তার প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে তাকে বাঁচিয়ে ও সুস্থ করে তোলার জন্য তা করে থাকে। কোন পশু গায়ের বল দেখিয়ে অত্যাচার শুরু করলে তাকে খাচায় পুরে খাওয়া বন্ধ করে শাস্তি দিয়ে জব্দ করা হয়। যে পাখীকে ক্ষুধায় রাখলে কেবল গান শোনায়, সে পাখীকে খাঁচার ভিতর ক্ষুধায় রেখে তার সুমধুর গান শুনতে অবশ্যই ভালো লাগে।
পরন্তু বান্দার কোন মসীবত এলে তাতে তার পাপ ক্ষয় হয়। এমন কি পায়ে কাঁটা ঢুকলেও তাতে মুমিন বান্দার গোনাহ মাফ হয়। অথবা মসীবতে বান্দার মর্যাদা বর্ধন হয়। নেক বান্দার জন্য মসীবত হল আল্লাহর দেওয়া এক নেয়ামত। যে বান্দা আল্লাহর নিকট যত প্রিয় হয়, সে বান্দার মসীবত তত বড় হয়। যার প্রেম যত প্রগাঢ়, তার প্রেমের পরীক্ষাও ততোধিক কঠিন। সুতরাং মসীবতে কাতর হওয়া, মুষড়ে পড়া, বিচলিত বা ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়। এমন হলে মসীবত সত্যই মসীবত।
একান্ত আপনজন পর হয়ে গেছে, ধোকা দিয়েছে অথবা আঘাত হেনেছে?
আগুন, ঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পে বাসা-বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে?
অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় বা বন্যায় তৈরী ফসল নষ্ট হয়ে গেছে?
গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? ছেলে বা আব্বা-আম্মা কেউ মারা গেছে?
চাকুরি চলে গেছে? কারো অত্যাচারে গৃহহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছ?
ব্যবসায় মোটা টাকা নোকসান গেছে? বড় অসুখে ভুগছ?
মসীবত যেমনই হোক, দুঃখ করো না, মনমারা হয়ো না, ভেঙ্গে পড়ো না, হা-হুতাশ করো, হায়-হায়’ করে হায়-পস্তানি কোন কাজে দেবে না। অতএব সে আঘাত ভুলার চেষ্টা কর, মনকে শক্ত করে আবার নতুন করে জীবন গড়ে তোল। যা হারিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় মহান প্রভুর নিকট ধৈর্যের সাথে সাহায্য ভিক্ষা কর। আবার লেগে যাও কাজে। কারণ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনা থেকে বাঁচতে হলে কাজের ভিতর দিয়েই বাঁচতে হবে। নিজেকে অকেজো ভেবো না। যা হারিয়েছে তা যাবার ছিল তাই গেছে -এ কথা মনে করো। যা পাওনি তা পাবার উপযুক্ত তুমি ছিলে না -এই ধরে নিও। যা চলে গেছে তা তোমার জন্য মঙ্গলময় ছিল না -এ কথাকেও নিশ্চিতের সাথে মনে স্থান দিও। “--- কিন্তু তোমরা যা পছন্দ কর না, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” (সুরা বাকারাহ ২১৬) আর “এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তা অপছন্দ করছ।” (সূরা নিসা ১৯ আয়াত)
সুতরাং অতীতের ঘটনা ভুলে এবার ভবিষ্যতে মন দাও। বুক ভেঙ্গে গেছে, তবুও ভয় নেই। ভাঙ্গা বুক নিয়েই আল্লাহর উপর ভরসা করে আবার বিজয়ের আশায় খাড়া হয়ে দাঁড়াও। দুঃখ, বেদনা ও অভাবকে তোমার উন্নতির পথে বাধা মনে না করে পরীক্ষা’ বলে ধরে নিও। তোমার পুনঃ উন্নতির পথে এই অবসরে শয়তান যেন বাদ সাধতে না পারে তার খেয়াল রেখো। মনে রেখো মহানবীর মহাবাণী; তিনি বলেন, “সবল মু'মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা প্রিয় ও ভালো। অবশ্য উভয়ের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে। তোমার যাতে উপকার আছে তাতে তুমি যত্নবান হও।
আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর, আর অক্ষম হয়ে বসে পড়ো না। কোন মসীবত এলে এ কথা বলো না যে, '(হায়) যদি আমি এরূপ করতাম, তাহলে এরূপ হতে। (বা যদি আমি এরূপ না করতাম, তাহলে এরূপ হতো না।) বরং বলো, আল্লাহ তকদীরে লিখেছিলেন। তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।' (আর তিনি যা করেন, তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন; যদিও তা সে বুঝতে পারে না।) পক্ষান্তরে। যদি-যদি না’ (বলে আক্ষেপ) করায় শয়তানের কর্মদ্বার খুলে যায়।” (আহমদ, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে ৬৬৫০ নং)