অভাবের তাড়নায় ও বেকারত্বের ফলে সংঘটিত দুঃখ-জ্বালা কম নয়। এ ছাড়া সংসারের ঝড়-ঝামেলাও বিভিন্নমুখী, শতরূপী। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির দরুন যেমন দাম্পত্য-কলহ বাধে, তেমনি মনোমালিন্য ঘটে বাপ-বেটা ও শাশুড়ী-বউ-এর মাঝেও। হিংসা-জ্বালায় বিষময় হয়ে ওঠে ভাই-ভ্রাতৃত্বের সংসার। এমনিই ঘটে থাকে। না ঘটা বিরল ব্যাপার। সংসারে দুঃখকষ্ট একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন গড়া। যারা তা স্বীকার করতে চায় না, তারা আসলে জীবনকেই অস্বীকার করে। অবহেলিত পিতা-মাতা অথবা সন্তান, নিপীড়িতা গৃহবধু অথবা শাশুড়ী, লাঞ্ছিত ভাই অথবা অন্য কেউ -যেই হোক না কেন, জীবনের সমস্যাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না।
সমস্যা যতই আসুক তবুও তারই মাঝে সমাধানের আলো খুঁজে নিতে চেষ্টা করতে হবে। আর তারই মাঝে সন্ধান করতে হবে। আনন্দময় জীবন। জীবনে সমস্যার সৃষ্টি না হলে হয়তো বা আমাদের জীবনে বাঁচার আনন্দ অর্ধেক নষ্ট হয়ে যেত। কারণ, যে ভোজনে টক নেই, সে ভোজনে তত তৃপ্তি নেই। যে ভ্রমণে বিপদের ঝুঁকি নেই, সে ভ্রমণে তত আনন্দের স্বাদ নেই। মানুষের জীবনেও দুঃখ, দুশ্চিন্তা, দৈন্য আছে বলেই জীবন কখনো একঘেয়ে হয়ে ওঠে না।
পাঁচ জনের সংসারে ভুল বুঝাবুঝি স্বাভাবিক। হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ প্রভৃতি উল্লংঘন করে যাওয়া জীবনের এক শুভ জয়। আপদ-বিপদ, বালা-মসীবত ইত্যাদি সন্তুষ্টচিত্তে বরণ করে নেওয়া পূর্ণ ঈমানের পরিচায়ক। এমনই তো মুমিনের জীবন। নদীতে স্রোত আছে, তাই নদী বেগবান। জীবনে দ্বন্দ্ব আছে, তাই জীবন বৈচিত্রময়। সুতরাং এই বৈচিত্রময়তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোন সমস্যা আসেনি। এমন কেউ নেই, যে জীবনে কোন দুঃখ পায়নি। এমন কেউ নেই, যার জীবনে কোন রিক্ততা ও তিক্ততা নেই। এমন কেউ নেই, যে। জীবনভর শুধু পেয়েই গেছে এবং কখনোও কিছু হারায়নি জীবনে। পরন্তু সংসারের এক নিয়ম এই যে, কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়, কিছু লাভ করার জন্য কিছু বিসর্জন দিতে হয়।
অবশ্য মনকে এই বলে প্রবোধ দিতে হবে যে, জীবনের সব সন্ধ্যাই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। তার মধ্যে শুভ সন্ধ্যারও পদার্পণ ঘটে। যে সন্ধ্যায় থাকে পূর্ণিমার পূর্ণশশীর মনমুগ্ধকর জ্যোৎস্নার আলো, অথবা থাকে মিলনের আকাঙ্খায় শুভ বাসরের ফুলশয্যার প্রস্তুতি, অথবা থাকে আগামী কালের ঈদ হওয়ার সুসংবাদ। তাছাড়া দুঃখ কিসের? যে ব্যক্তি তকদীরে বিশ্বাস রাখে, যার সাথের সাথী হল স্বয়ং পালনকর্তা আল্লাহ তাআলা, তার আবার দুঃখ কিসের? ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া ওয়াজেব। মানুষ নিজ ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না বলেই দুঃখ পায়। আর এ জন্যই মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যা ভাগ করে দিয়েছেন তা নিয়ে তুষ্ট থাক, তাহলে তুমিই হবে সবার চাইতে বড় ধনী।” (আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে ১০০নং)
পরন্তু মানুষ নানা মায়াজালে আবদ্ধ হয় হয় বলেই দুঃখ পায়। যা কামনা করে তা পায় না। বলেই ব্যথা-বেদনার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে হা-হুতাশ করে থাকে। পক্ষান্তরে যদি এমন জালে আবদ্ধ না হয়ে কোন কামনার বশীভূত না হয়, তাহলে মানুষ দুঃখের মুখ দেখে না।
কারো নিকট অতিরিক্ত অধিকার, বেশী মাত্রায় ভক্তি, অধিক পরিমাণে ভালোবাসা, অতি পরিমাণে সাহায্য-সহযোগিতা, বা মানুষ যতটার উপযুক্ত তার তুলনায় বেশী পরিমাণের মান-সম্মানের আশা করলে এবং যথা সময়ে তা না পেলে তার মনে আঘাত লাগে, দুঃখ হয়; নচেৎ কিন্তু হয় না। অতএব এরূপ আশা না রাখাই হল মনের বড় সুখ।
অবশ্য সব ধরনের সমস্যা ও দুঃখের একটি মহৌষধি ও প্রতিকার হল ধৈর্য। ধৈর্য তিক্ত; কিন্তু তার পরিণাম বড় মধুর। বৃক্ষের ছাল তিক্ত হলেও তার ফল বড় মিষ্ট। ধৈর্যধারণ করা কঠিন হলেও তার শেষ পরিণতি বড় শুভ।
আবার ধৈর্য ধরা শুরুতে কঠিন হলেও ধীরে ধীরে তাতে স্থিরতা আসে এবং পরে তা সয়ে যায়। তাছাড়া অসহ্য বলে কোন কিছু নেই। সময়ে সবই সহ্য হয়ে যায়। হরিণ বাঘের শিকার ও খাদ্য হলেও বাঘ যখন কুপোকাত হয় এবং হরিণ তার গাল চাটে, তখন বাঘ তাকে বলে, অভদ্রা বর্ষাকাল, হরিণী চাটে বাঘের গাল। শোরে হরিণী তোরে কই, সময় গুণে সবই সই। অতএব ছোটর কাছ থেকে লাথি খেলেও তা ধৈর্যের মাধ্যমে সহ্য করে নিতে হয়; বিশেষ করে যখন বদলা নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে তখন। পরন্তু বদলা নিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যদি ধৈর্যধারণ করে বদলা না নেয়, তবে সেটাই হল প্রকৃত ও বড় ধৈর্য। আর এ জন্যই দেখা গেছে যে, শক্তির চেয়ে ধৈর্যই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশী সফলতা আনতে পারে। মসীবত যেমনই হোক তা মসীবত। কিন্তু সব চাইতে বড় মসীবত হল মসীবতের উপর ধৈর্য রাখতে পারা। দুঃখ-কষ্ট যেমনই হোক, ধৈর্যের তরবারি দ্বারা কেটে ফেলা ছাড়া তার আর কোনই অব্যর্থ ওষুধ নেই। অতএব দুঃখী বন্ধু আমার! মসীবতে ধৈর্য ধর ও আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নামায ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য কামনা কর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।” (সূরা বাকারাহ ১৫৩ আয়াত)
যাবতীয় বিপদ আসে আল্লাহর তরফ হতে। তিনি বিপদ-আপদের মাধ্যমে মু'মিনকে পরীক্ষা করে থাকেন। সোনা পুড়িয়ে সোনার খাঁটিত্ব যাচাই করে থাকেন। কখনো ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে, কখনো বা জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়, যারা হা-হুতাশ বর্জন করে সমুদয় দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণ করে, তারাই পায় আল্লাহর তরফ থেকে সুসংবাদ। উত্তম বিনিময়ের সুসংবাদ, বেহেস্তের শুভসংবাদ। যাদের উপর বিপদ পতিত হলে অসন্তুষ্ট ও বিচলিত না হয়ে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন। আসলে তাদেরই উপরে মহান প্রতিপালকের তরফ হতে শান্তি ও করুণা বর্ষণ হয় এবং তারাই হল সুপথগামী। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৫-১৫৭)
পক্ষান্তরে কোন কোন বিপদ আসে মানুষের কোন কৃতকর্মের ফলে। কোন অসৎ কর্মের। সত্বর সাজাস্বরূপ অকস্মাৎ বিপদ এসে মানুষকে সতর্ক করে যায়। তাকে ধ্বংস করার জন্য নয়; বরং তাকে নতুন করে গড়ার জন্য। মরিচা-পড়া লৌহ খণ্ডকে কর্মকার আগুনে দিয়ে আঙ্গার করে বারবার হাতুড়ি দ্বারা পিটিয়ে থাকে, তা নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য নয়; বরং নতুনরূপে কিছু তৈরী করার জন্য। মা জোর করে অনেক সময় শাস্তি দিয়েও তিক্ত ঔষধ শিশুকে সেবন করায় ছেলের প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে মেরে ফেলার জন্য নয়; বরং তার প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে তাকে বাঁচিয়ে ও সুস্থ করে তোলার জন্য তা করে থাকে। কোন পশু গায়ের বল দেখিয়ে অত্যাচার শুরু করলে তাকে খাচায় পুরে খাওয়া বন্ধ করে শাস্তি দিয়ে জব্দ করা হয়। যে পাখীকে ক্ষুধায় রাখলে কেবল গান শোনায়, সে পাখীকে খাঁচার ভিতর ক্ষুধায় রেখে তার সুমধুর গান শুনতে অবশ্যই ভালো লাগে।
পরন্তু বান্দার কোন মসীবত এলে তাতে তার পাপ ক্ষয় হয়। এমন কি পায়ে কাঁটা ঢুকলেও তাতে মুমিন বান্দার গোনাহ মাফ হয়। অথবা মসীবতে বান্দার মর্যাদা বর্ধন হয়। নেক বান্দার জন্য মসীবত হল আল্লাহর দেওয়া এক নেয়ামত। যে বান্দা আল্লাহর নিকট যত প্রিয় হয়, সে বান্দার মসীবত তত বড় হয়। যার প্রেম যত প্রগাঢ়, তার প্রেমের পরীক্ষাও ততোধিক কঠিন। সুতরাং মসীবতে কাতর হওয়া, মুষড়ে পড়া, বিচলিত বা ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়। এমন হলে মসীবত সত্যই মসীবত।
একান্ত আপনজন পর হয়ে গেছে, ধোকা দিয়েছে অথবা আঘাত হেনেছে?
আগুন, ঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পে বাসা-বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে?
অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় বা বন্যায় তৈরী ফসল নষ্ট হয়ে গেছে?
গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? ছেলে বা আব্বা-আম্মা কেউ মারা গেছে?
চাকুরি চলে গেছে? কারো অত্যাচারে গৃহহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছ?
ব্যবসায় মোটা টাকা নোকসান গেছে? বড় অসুখে ভুগছ?
মসীবত যেমনই হোক, দুঃখ করো না, মনমারা হয়ো না, ভেঙ্গে পড়ো না, হা-হুতাশ করো, হায়-হায়’ করে হায়-পস্তানি কোন কাজে দেবে না। অতএব সে আঘাত ভুলার চেষ্টা কর, মনকে শক্ত করে আবার নতুন করে জীবন গড়ে তোল। যা হারিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় মহান প্রভুর নিকট ধৈর্যের সাথে সাহায্য ভিক্ষা কর। আবার লেগে যাও কাজে। কারণ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনা থেকে বাঁচতে হলে কাজের ভিতর দিয়েই বাঁচতে হবে। নিজেকে অকেজো ভেবো না। যা হারিয়েছে তা যাবার ছিল তাই গেছে -এ কথা মনে করো। যা পাওনি তা পাবার উপযুক্ত তুমি ছিলে না -এই ধরে নিও। যা চলে গেছে তা তোমার জন্য মঙ্গলময় ছিল না -এ কথাকেও নিশ্চিতের সাথে মনে স্থান দিও। “--- কিন্তু তোমরা যা পছন্দ কর না, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, সম্ভবতঃ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” (সুরা বাকারাহ ২১৬) আর “এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তা অপছন্দ করছ।” (সূরা নিসা ১৯ আয়াত)
সুতরাং অতীতের ঘটনা ভুলে এবার ভবিষ্যতে মন দাও। বুক ভেঙ্গে গেছে, তবুও ভয় নেই। ভাঙ্গা বুক নিয়েই আল্লাহর উপর ভরসা করে আবার বিজয়ের আশায় খাড়া হয়ে দাঁড়াও। দুঃখ, বেদনা ও অভাবকে তোমার উন্নতির পথে বাধা মনে না করে পরীক্ষা’ বলে ধরে নিও। তোমার পুনঃ উন্নতির পথে এই অবসরে শয়তান যেন বাদ সাধতে না পারে তার খেয়াল রেখো। মনে রেখো মহানবীর মহাবাণী; তিনি বলেন, “সবল মু'মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা প্রিয় ও ভালো। অবশ্য উভয়ের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে। তোমার যাতে উপকার আছে তাতে তুমি যত্নবান হও।
আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর, আর অক্ষম হয়ে বসে পড়ো না। কোন মসীবত এলে এ কথা বলো না যে, '(হায়) যদি আমি এরূপ করতাম, তাহলে এরূপ হতে। (বা যদি আমি এরূপ না করতাম, তাহলে এরূপ হতো না।) বরং বলো, আল্লাহ তকদীরে লিখেছিলেন। তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।' (আর তিনি যা করেন, তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন; যদিও তা সে বুঝতে পারে না।) পক্ষান্তরে। যদি-যদি না’ (বলে আক্ষেপ) করায় শয়তানের কর্মদ্বার খুলে যায়।” (আহমদ, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে ৬৬৫০ নং)
সুতরাং সম্মুখের অকস্মাৎ এ মসীবত দেখে ভয় পেয়ো না। মসীবত সরে যাওয়া নিশ্চিত ব্যাপার। বিপদের যে ঘন মেঘ তোমার জীবনকে অন্ধকার করে রেখেছে তা অবশ্যই একদিন কোন হাওয়ার ঠেলায় সরে যাবে।
‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে,
হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।
মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই দুঃখের পরেই আছে সুখ, নিশ্চয়ই কষ্ট্রের পরে আছে। স্বস্তি।” (সূরা ইনশিরাহ ৫-৬ আয়াত)। বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত নবী (সা.) বলেন, “ধৈর্যের সাথেই আছে বিজয়, বিপদের পাশেই আছে উদ্ধারের পথ এবং কষ্টের সাথেই আছে স্বস্তি।” (সহীহুল জামে’ ৬৮০৬ নং)
অতএব ভয় কিসের? ভয়কে জয় কর। কারণ, তুমি যেখানে একা কপালে হাত দিয়ে বসে আছ, সেখানে তুমি একা নও দয়াবান আল্লাহ যে তোমার সাথের সাথী।
আর মনে রেখো, নদীর এক কুল ভাঙ্গলে অপর কূল গড়ে। তোমার-আমার জীবনটাও সেইরূপ। জীবন যতক্ষণ আছে বিপদ ততক্ষণ থাকবেই। জীবনের সবটাই সুখময় কারো হয়। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই মানুষের জীবন। কিন্তু দুঃখের পর সুখ আসবে এটাও ধ্রুব সত্য। দুঃখের ঘড়ি ধীরে চললেও সে সময় যে কেটে যাবে তা নিশ্চিত। যে হালে আছ, সে হালের পরিবর্তন অবশ্যই ঘটবে। ফিরে আসবে আবার নতুন জীবন, নতুন উদ্যম।
‘কোনদিনই হায় পোহাবে না যাহা এমন রাত্রি নাই। জীবনের সে আঁধার-ঘিরা রাত্রি যতই লম্বা হোক, যেমনই হোক, যত কষ্টেরই হোক, তার অন্ধকার ভেদ করে এক সময় প্রভাতের আলো উদ্ভাসিত হবেই তোমার হৃদয় আকাশে।
দুর্যোগ রাতি পোহায়ে আবার প্রভাত আসিবে ফিরে। বিপদগ্রস্ত বন্ধু আমার! নিরাশ হয়ে মুষড়ে পড়ে না। কপালে আঘাত করে লাভ নেই। মানুষের যখন সব কিছুই হারিয়ে যায়, ভবিষ্যত তখনও অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। জীবন-গাছের খাওয়া পাতা আবার সবুজ হয়ে নতুন করে গজিয়ে উঠবে। গাছ মুড়া গেলে আবার বীজ বোনো। পুনরায় চারা গজিয়ে উঠবে। যেখানে বাসনা-রথ, সেখানেই সিদ্ধির পথ। সাধ, সাধ্য আর সাধনা, তবেই সিদ্ধির বাসনা। মনের বাসনাকে হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে দিও না। তোমার যে সাধ্য আছে, তার মাঝে সাধনা এনে তাতে সিদ্ধিলাভ কর।
তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমার মত নিরাশ-বিহুল ভগ্ন-হৃদয়ের মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে চলে, আল্লাহ তার উপায় বের করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে র্যী দান করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা রাখে সে। ব্যক্তির জন্য তিনিই যথেষ্ট হন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেন। আল্লাহ সমস্ত কিছুর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রা স্থির করে রেখেছেন।” (সূরা ত্বালাক ২-৩) “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” (ঐ ৪ আয়াত)।
অতএব আল্লাহর বান্দা! ওঠ, কোমর শক্ত করে, মাথা উচু করে। যে মাটিতে পড়ে আছ, সে মাটিতেই ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়াও। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করবেন না।
নিরাশ হিয়ার বন্ধু আমার। বর্তমানের এ ব্যর্থতা ও বিফলতা দেখে পিছপা হয়ো না। বিফলতা মানুষকে হতাশ ও নিরাশ করে ঠিকই, কিন্তু জেনে রেখো, যারা এ হতাশাকে। উল্লংঘন করে বিফলতাকে পরাভূত করেছে, তারাই তাকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে সফলতা ও সৌভাগ্যের প্রাসাদ।
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে,
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’
দুঃখ এলে পরোয়া নেই। বিরক্তি নেই। নৈরাশ্য নেই।
“যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে
বারেক হতাশ হয়ে কে কোথায় মরে?
বিপদে পতিত, তবু ছাড়িব না হাল,
আজিকে বিফল হলে, হতে পারে কাল।
জীবনে পরাজয় আসার পর অলসভাবে বসে থাকা জ্ঞানীর কাজ নয়। যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে চেষ্টা করাই হল বুদ্ধিমানের কাজ। সবল মু’মিন সাতবার বিপদে পড়লেও আবার ওঠে। কিন্তু দুর্বল মনের অসৎ মানুষ একবার বিপদে পড়লেই আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ্য প্রকাশ করে; ফলে সে আর উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না।
দয়ার নবী ৪৯ বলেন, “মুমিনের উপমা হল গম গাছের মত; যে হাওয়ার চাপে কখনো নুয়ে পড়ে, আবার তখনই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও কাফেরের উপমা হল আরযা’ (Cedar) গাছের মত; যা হাওয়ার চাপের মুখেও সোজা খাড়া থাকে। কিন্তু (সামলাতে না পেরে) অবশেষে ভেঙ্গে শেষ হয়ে যায়।” (সহীহুল জামে ৫৮৪৪ নং)
পতন জীবনে আসতেই পারে। পতনকে যে ভয় করে, সে আসলে জীবনে জয়লাভ করতে পারে না। আবার পতন অনেক সময় মানুষের উপকারও করে। পতন মানুষের সফলতা আনে, প্রচ্ছন্ন সত্যকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে, উদাসীন হৃদয়কে জাগ্রত করে তোলে। অতএব তোমার এ পতনে বড় মঙ্গল অবশ্যই আছে।
আর গরীব বা নিঃস্ব বলে দুঃখ করো না বন্ধু আমার! কারণ, আসল নিঃস্ব তো সেই, যে কিয়ামতে নিঃস্ব। তাছাড়া জেনে রেখো যে, গরীবরাই অধিকাংশ বেহেস্তে যাবে।
হ্যা, আর আত্মহত্যা করার কথা মনেও এনো না। আত্মহত্যা কেন করবে? হয়তো দুঃখের তাড়নায় এই ভাববে যে, মরণেই তোমার শান্তি আছে। মরতে পারলেই তোমার সকল দুঃখ
জ্বালা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কোথায়? তুমি কি জান না, মরণের ওপারে তোমার জন্য কি অপেক্ষা করছে? কবরের পরীক্ষা এবং হয়তো বা আযাব ও আখেরাতের ভয়ংকর শাস্তি। তার জন্য তোমার প্রস্তুতি আছে কি? সে শাস্তি থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে, তার নিশ্চয়তা আছে কি? যদি না থাকে তাহলে সে দুঃখ-জ্বালা যে এ দুঃখ-জ্বালা থেকে বহু গুণ তাছাড়া তুমি তো জানো যে, আত্মহত্যা মহাপাপ। মনের ধিক্কারে তুমি নিজেকে হত্যা করবে -এ অধিকার তোমার নেই। তুমি যেমন অপরকে খুন করতে পার না, তেমনিই পার
নিজেকে খুন করতে। তা তোমার নিজের জীবন হলেও সে তো সৃষ্টিকর্তারই আমানত। তাতে খেয়ানত করলে অবশ্যই অপরাধী সাব্যস্ত হবে তার নিকট। তাই তিনি মানুষকে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছেন। (সূরা নিসা ২৯ আয়াত) নিষেধ করেছেন নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে। (সুরা বাকারাহ ১৯৫ আয়াত)।
আর পরকালে এ কাজের শাস্তির কথা শোন। মহানবী ৪৬ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন পাহাড় হতে নিজেকে ফেলে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে ফেলে অনুরূপ শাস্তিভোগ করবে। যে ব্যক্তি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা চিরকালের জন্য বিষ পান করে যাতনা ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি কোন লৌহখন্ড (ছুরি ইত্যাদি) দ্বারা আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও ঐ লৌহখন্ড দ্বারা সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে আঘাত করে যাতনা ভোগ করতে থাকবে।” (বুখারী ৫৭ ৭৮, মুসলিম ১০৯নং প্রমুখ)
আল্লাহর রসূল (সা.) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ফাসি নিয়ে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ ফাসি নিয়ে আযাব ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা (নিজে নিজে) আযাব ভোগ করবে।” (বুখারী ১৩৬৫নং)
অবশ্য পরকালের এ সব কথার উপর তোমার যদি বিশ্বাস না থাকে এবং এ বিশ্বাস না রেখেই তুমি আত্মহত্যা কর, তাহলে অবস্থা আরো ভয়ানক। কাফের হয়ে মারা গেলে কুফরীর শাস্তি তো তোমার অজানা নয়। তুমি মুসলিম। তোমার কর্মকাণ্ড হওয়া উচিত ইসলামের ভিত্তিতেই। কেন ক্ষতি করবে নিজের ইহ-পরকালের এবং তোমার ছেড়ে যাওয়া আব্বা-আম্মা বা ছেলে-মেয়েদের? পরিশেষে একটি কথা মনে রেখো যে, যে অবস্থাতেই থাক, হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পড়ো । ছোট কাজ করলেও নিজেকে ছোট ও নীচ ভেবে বসো না এবং সেই সাথে নিজের চরিত্রকেও হীন করে ফেলো না। মাথা উচু করে নিজের উন্নতির কথা সর্বদা মনে রেখো। নীচ হয়ে থাকা এবং উন্নতির আশা-আকাঙ্খা না করা হীনতার পরিচয়। আল্লাহর দেওয়া রুযী পেয়ে সন্তুষ্ট থেকেই উন্নতি ও বর্কতের আশা কর। আর উন্নতির সোপান বেয়ে চড়তে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে সে কথা ভুলে যেও না।
একদা এক কুকুর এসে এক সিংহকে বলল, 'হে পশুরাজ! আমি আমার নাম পরিবর্তন করতে চাই। দয়া করে আমার নামটা বদলে দিন। কারণ আমার নামটা বড় বিশ্রী ও অসভ্য।
সিংহ বলল, তুমি তো বিশ্বাসঘাতক ও নির্লজ্জ। তোমার আচরণ বড় হীন। অতএব এ নামই তোমার জন্য যথার্থ ও সার্থক।
কুকুর বলল, তাহলে আমাকে পরীক্ষা করে দেখে নিন, আমি সুন্দর নামের কাজ করতে পারি কি না। সিংহ কুকুরকে এক টুকরা গোশ্য দিয়ে বলল, 'ঠিক আছে। এটা আমার জন্য কাল পর্যন্ত তোমার কাছে যত্ন করে আমানত রেখে দাও। কাল আমি তোমার কাছ থেকে এটা নেব, আর তোমার নাম পাল্টে দিয়ে এক সুন্দর মত নাম রেখে আসব।' গোশ্য টুকরাটি নিয়ে কুকুর বাসায় ফিরল। ক্ষিদে লাগলে সে গোন্তের দিকে তাকিয়ে জিভের লাল ফেলতে শুরু করল। খাওয়ার ইচ্ছে হলেও নাম পাল্টাবার কথা মনে পড়লে ধৈর্যের সাথে সিংহের অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যখনই তার প্রবৃত্তিতে লালসার উদ্রেক হল তখনই আর ধৈর্যের বালির বাঁধ আটকে রাখতে পারল না। অবশেষে ভালো নাম নিয়েই বা আর কি হবে? কুকর’ ও তো ভালো নাম।' -এই বলেই সে গো টুকরাটি খেয়েই ফেলল।
এরূপ উদাহরণ হল চরিত্রহীন নীচমনা মানুষদের; যারা স্বার্থের খাতিরে নিজেদের হীন আচরণ বর্জন করতে পারে না। অথবা লালসার ফলে নিজেদের প্রবৃত্তি দমন করতে পারে। এ শ্রেণীর মানুষকে অনেক সময় চা পান করতে বললে বলে, আমার জন্য চা খাওয়া নিষেধ। কারণ, আমার ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু পরক্ষণে পাতে বড় বড় রসগোল্লা এলে তখন আর লোভ সামলাতে না পেরে বলে, 'দু-একবার মিষ্টি খেলে কিছু ক্ষতি হয় না। মোট কথা, মনকে ধরে রাখা সবল ও দৃঢ় মনোবলশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয়। তোমাকে সেইরকম একটা শক্ত মনের মানুষ হওয়ার কথাই বলছি। উচু দরের মানুষ হতে হলে উচু দরের খেয়াল হতে হবে, উঁচু আশা ও মনোবল রাখতে হবে। যেমন উঁচু দরের মানুষ হয়ে নীচ মনের পরিচয় দেওয়াও বর্জন করতে হবে। জাতে গোয়াল হয়ে কঁজি ভক্ষণ’ স্বভাব অবশ্যই জাত মানুষের নয়।
উঁচু হিম্মতের মন হল, উচু আকাশে উড়ন্ত পাখীর মত। যে পাখী অন্যান্য পাখীর মত নীচুতে উড়তে রাজী নয়। যে পাখীর নিকট সেই বিপদ-আপদ পৌছে না যা নীচে উড়ন্ত পাখীর নিকটে পৌছে থাকে। তাই হিম্মত যত উঁচু হবে মন তত আপদমুক্ত হবে। আর হিম্মত যত নীচু হবে মনও তত আপদগ্রস্ত হবে। সুতরাং উচু হিম্মত মানুষের সফলতার শিরোনাম। পক্ষান্তরে নীচু হিম্মত তার বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার নিদর্শন।
হে মুসলিম যুবক! তুমি তোমার আচরণ, ব্যবহার, চরিত্র, শিক্ষা, অধ্যবসায়, অর্থোপার্জন ও দ্বীনদারীতে উচু হিম্মত, সংকল্পবদ্ধ মন এবং উন্নত ও উদ্যমশীল হৃদয়ের অধিকারী হও -এই কামনা করি।