সুতরাং সম্মুখের অকস্মাৎ এ মসীবত দেখে ভয় পেয়ো না। মসীবত সরে যাওয়া নিশ্চিত ব্যাপার। বিপদের যে ঘন মেঘ তোমার জীবনকে অন্ধকার করে রেখেছে তা অবশ্যই একদিন কোন হাওয়ার ঠেলায় সরে যাবে।

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে,

হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।

মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই দুঃখের পরেই আছে সুখ, নিশ্চয়ই কষ্ট্রের পরে আছে। স্বস্তি।” (সূরা ইনশিরাহ ৫-৬ আয়াত)। বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত নবী (সা.) বলেন, “ধৈর্যের সাথেই আছে বিজয়, বিপদের পাশেই আছে উদ্ধারের পথ এবং কষ্টের সাথেই আছে স্বস্তি।” (সহীহুল জামে’ ৬৮০৬ নং)

অতএব ভয় কিসের? ভয়কে জয় কর। কারণ, তুমি যেখানে একা কপালে হাত দিয়ে বসে আছ, সেখানে তুমি একা নও দয়াবান আল্লাহ যে তোমার সাথের সাথী।

আর মনে রেখো, নদীর এক কুল ভাঙ্গলে অপর কূল গড়ে। তোমার-আমার জীবনটাও সেইরূপ। জীবন যতক্ষণ আছে বিপদ ততক্ষণ থাকবেই। জীবনের সবটাই সুখময় কারো হয়। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই মানুষের জীবন। কিন্তু দুঃখের পর সুখ আসবে এটাও ধ্রুব সত্য। দুঃখের ঘড়ি ধীরে চললেও সে সময় যে কেটে যাবে তা নিশ্চিত। যে হালে আছ, সে হালের পরিবর্তন অবশ্যই ঘটবে। ফিরে আসবে আবার নতুন জীবন, নতুন উদ্যম।

‘কোনদিনই হায় পোহাবে না যাহা এমন রাত্রি নাই। জীবনের সে আঁধার-ঘিরা রাত্রি যতই লম্বা হোক, যেমনই হোক, যত কষ্টেরই হোক, তার অন্ধকার ভেদ করে এক সময় প্রভাতের আলো উদ্ভাসিত হবেই তোমার হৃদয় আকাশে।

দুর্যোগ রাতি পোহায়ে আবার প্রভাত আসিবে ফিরে। বিপদগ্রস্ত বন্ধু আমার! নিরাশ হয়ে মুষড়ে পড়ে না। কপালে আঘাত করে লাভ নেই। মানুষের যখন সব কিছুই হারিয়ে যায়, ভবিষ্যত তখনও অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। জীবন-গাছের খাওয়া পাতা আবার সবুজ হয়ে নতুন করে গজিয়ে উঠবে। গাছ মুড়া গেলে আবার বীজ বোনো। পুনরায় চারা গজিয়ে উঠবে। যেখানে বাসনা-রথ, সেখানেই সিদ্ধির পথ। সাধ, সাধ্য আর সাধনা, তবেই সিদ্ধির বাসনা। মনের বাসনাকে হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে দিও না। তোমার যে সাধ্য আছে, তার মাঝে সাধনা এনে তাতে সিদ্ধিলাভ কর।

তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমার মত নিরাশ-বিহুল ভগ্ন-হৃদয়ের মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে চলে, আল্লাহ তার উপায় বের করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে র্যী দান করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা রাখে সে। ব্যক্তির জন্য তিনিই যথেষ্ট হন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেন। আল্লাহ সমস্ত কিছুর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রা স্থির করে রেখেছেন।” (সূরা ত্বালাক ২-৩) “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” (ঐ ৪ আয়াত)।

অতএব আল্লাহর বান্দা! ওঠ, কোমর শক্ত করে, মাথা উচু করে। যে মাটিতে পড়ে আছ, সে মাটিতেই ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়াও। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করবেন না।

নিরাশ হিয়ার বন্ধু আমার। বর্তমানের এ ব্যর্থতা ও বিফলতা দেখে পিছপা হয়ো না। বিফলতা মানুষকে হতাশ ও নিরাশ করে ঠিকই, কিন্তু জেনে রেখো, যারা এ হতাশাকে। উল্লংঘন করে বিফলতাকে পরাভূত করেছে, তারাই তাকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে সফলতা ও সৌভাগ্যের প্রাসাদ।

কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে,

দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?’

দুঃখ এলে পরোয়া নেই। বিরক্তি নেই। নৈরাশ্য নেই।

“যে মাটিতে পড়ে লোক ওঠে তাই ধরে

বারেক হতাশ হয়ে কে কোথায় মরে?

বিপদে পতিত, তবু ছাড়িব না হাল,

আজিকে বিফল হলে, হতে পারে কাল।

জীবনে পরাজয় আসার পর অলসভাবে বসে থাকা জ্ঞানীর কাজ নয়। যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে চেষ্টা করাই হল বুদ্ধিমানের কাজ। সবল মু’মিন সাতবার বিপদে পড়লেও আবার ওঠে। কিন্তু দুর্বল মনের অসৎ মানুষ একবার বিপদে পড়লেই আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ্য প্রকাশ করে; ফলে সে আর উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না।

দয়ার নবী ৪৯ বলেন, “মুমিনের উপমা হল গম গাছের মত; যে হাওয়ার চাপে কখনো নুয়ে পড়ে, আবার তখনই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও কাফেরের উপমা হল আরযা’ (Cedar) গাছের মত; যা হাওয়ার চাপের মুখেও সোজা খাড়া থাকে। কিন্তু (সামলাতে না পেরে) অবশেষে ভেঙ্গে শেষ হয়ে যায়।” (সহীহুল জামে ৫৮৪৪ নং)

পতন জীবনে আসতেই পারে। পতনকে যে ভয় করে, সে আসলে জীবনে জয়লাভ করতে পারে না। আবার পতন অনেক সময় মানুষের উপকারও করে। পতন মানুষের সফলতা আনে, প্রচ্ছন্ন সত্যকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে, উদাসীন হৃদয়কে জাগ্রত করে তোলে। অতএব তোমার এ পতনে বড় মঙ্গল অবশ্যই আছে।

আর গরীব বা নিঃস্ব বলে দুঃখ করো না বন্ধু আমার! কারণ, আসল নিঃস্ব তো সেই, যে কিয়ামতে নিঃস্ব। তাছাড়া জেনে রেখো যে, গরীবরাই অধিকাংশ বেহেস্তে যাবে।

হ্যা, আর আত্মহত্যা করার কথা মনেও এনো না। আত্মহত্যা কেন করবে? হয়তো দুঃখের তাড়নায় এই ভাববে যে, মরণেই তোমার শান্তি আছে। মরতে পারলেই তোমার সকল দুঃখ

জ্বালা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কোথায়? তুমি কি জান না, মরণের ওপারে তোমার জন্য কি অপেক্ষা করছে? কবরের পরীক্ষা এবং হয়তো বা আযাব ও আখেরাতের ভয়ংকর শাস্তি। তার জন্য তোমার প্রস্তুতি আছে কি? সে শাস্তি থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে, তার নিশ্চয়তা আছে কি? যদি না থাকে তাহলে সে দুঃখ-জ্বালা যে এ দুঃখ-জ্বালা থেকে বহু গুণ তাছাড়া তুমি তো জানো যে, আত্মহত্যা মহাপাপ। মনের ধিক্কারে তুমি নিজেকে হত্যা করবে -এ অধিকার তোমার নেই। তুমি যেমন অপরকে খুন করতে পার না, তেমনিই পার

নিজেকে খুন করতে। তা তোমার নিজের জীবন হলেও সে তো সৃষ্টিকর্তারই আমানত। তাতে খেয়ানত করলে অবশ্যই অপরাধী সাব্যস্ত হবে তার নিকট। তাই তিনি মানুষকে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছেন। (সূরা নিসা ২৯ আয়াত) নিষেধ করেছেন নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে। (সুরা বাকারাহ ১৯৫ আয়াত)।

আর পরকালে এ কাজের শাস্তির কথা শোন। মহানবী ৪৬ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন পাহাড় হতে নিজেকে ফেলে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে ফেলে অনুরূপ শাস্তিভোগ করবে। যে ব্যক্তি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও সর্বদা চিরকালের জন্য বিষ পান করে যাতনা ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি কোন লৌহখন্ড (ছুরি ইত্যাদি) দ্বারা আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামেও ঐ লৌহখন্ড দ্বারা সর্বদা ও চিরকালের জন্য নিজেকে আঘাত করে যাতনা ভোগ করতে থাকবে।” (বুখারী ৫৭ ৭৮, মুসলিম ১০৯নং প্রমুখ)

আল্লাহর রসূল (সা.) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ফাসি নিয়ে আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ ফাসি নিয়ে আযাব ভোগ করবে। আর যে ব্যক্তি বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করবে সে ব্যক্তি দোযখেও অনুরূপ বর্শা বা ছুরিকাঘাত দ্বারা (নিজে নিজে) আযাব ভোগ করবে।” (বুখারী ১৩৬৫নং)

অবশ্য পরকালের এ সব কথার উপর তোমার যদি বিশ্বাস না থাকে এবং এ বিশ্বাস না রেখেই তুমি আত্মহত্যা কর, তাহলে অবস্থা আরো ভয়ানক। কাফের হয়ে মারা গেলে কুফরীর শাস্তি তো তোমার অজানা নয়। তুমি মুসলিম। তোমার কর্মকাণ্ড হওয়া উচিত ইসলামের ভিত্তিতেই। কেন ক্ষতি করবে নিজের ইহ-পরকালের এবং তোমার ছেড়ে যাওয়া আব্বা-আম্মা বা ছেলে-মেয়েদের? পরিশেষে একটি কথা মনে রেখো যে, যে অবস্থাতেই থাক, হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পড়ো । ছোট কাজ করলেও নিজেকে ছোট ও নীচ ভেবে বসো না এবং সেই সাথে নিজের চরিত্রকেও হীন করে ফেলো না। মাথা উচু করে নিজের উন্নতির কথা সর্বদা মনে রেখো। নীচ হয়ে থাকা এবং উন্নতির আশা-আকাঙ্খা না করা হীনতার পরিচয়। আল্লাহর দেওয়া রুযী পেয়ে সন্তুষ্ট থেকেই উন্নতি ও বর্কতের আশা কর। আর উন্নতির সোপান বেয়ে চড়তে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে সে কথা ভুলে যেও না।

একদা এক কুকুর এসে এক সিংহকে বলল, 'হে পশুরাজ! আমি আমার নাম পরিবর্তন করতে চাই। দয়া করে আমার নামটা বদলে দিন। কারণ আমার নামটা বড় বিশ্রী ও অসভ্য।

সিংহ বলল, তুমি তো বিশ্বাসঘাতক ও নির্লজ্জ। তোমার আচরণ বড় হীন। অতএব এ নামই তোমার জন্য যথার্থ ও সার্থক।

কুকুর বলল, তাহলে আমাকে পরীক্ষা করে দেখে নিন, আমি সুন্দর নামের কাজ করতে পারি কি না। সিংহ কুকুরকে এক টুকরা গোশ্য দিয়ে বলল, 'ঠিক আছে। এটা আমার জন্য কাল পর্যন্ত তোমার কাছে যত্ন করে আমানত রেখে দাও। কাল আমি তোমার কাছ থেকে এটা নেব, আর তোমার নাম পাল্টে দিয়ে এক সুন্দর মত নাম রেখে আসব।' গোশ্য টুকরাটি নিয়ে কুকুর বাসায় ফিরল। ক্ষিদে লাগলে সে গোন্তের দিকে তাকিয়ে জিভের লাল ফেলতে শুরু করল। খাওয়ার ইচ্ছে হলেও নাম পাল্টাবার কথা মনে পড়লে ধৈর্যের সাথে সিংহের অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যখনই তার প্রবৃত্তিতে লালসার উদ্রেক হল তখনই আর ধৈর্যের বালির বাঁধ আটকে রাখতে পারল না। অবশেষে ভালো নাম নিয়েই বা আর কি হবে? কুকর’ ও তো ভালো নাম।' -এই বলেই সে গো টুকরাটি খেয়েই ফেলল।

এরূপ উদাহরণ হল চরিত্রহীন নীচমনা মানুষদের; যারা স্বার্থের খাতিরে নিজেদের হীন আচরণ বর্জন করতে পারে না। অথবা লালসার ফলে নিজেদের প্রবৃত্তি দমন করতে পারে। এ শ্রেণীর মানুষকে অনেক সময় চা পান করতে বললে বলে, আমার জন্য চা খাওয়া নিষেধ। কারণ, আমার ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু পরক্ষণে পাতে বড় বড় রসগোল্লা এলে তখন আর লোভ সামলাতে না পেরে বলে, 'দু-একবার মিষ্টি খেলে কিছু ক্ষতি হয় না। মোট কথা, মনকে ধরে রাখা সবল ও দৃঢ় মনোবলশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয়। তোমাকে সেইরকম একটা শক্ত মনের মানুষ হওয়ার কথাই বলছি। উচু দরের মানুষ হতে হলে উচু দরের খেয়াল হতে হবে, উঁচু আশা ও মনোবল রাখতে হবে। যেমন উঁচু দরের মানুষ হয়ে নীচ মনের পরিচয় দেওয়াও বর্জন করতে হবে। জাতে গোয়াল হয়ে কঁজি ভক্ষণ’ স্বভাব অবশ্যই জাত মানুষের নয়।

উঁচু হিম্মতের মন হল, উচু আকাশে উড়ন্ত পাখীর মত। যে পাখী অন্যান্য পাখীর মত নীচুতে উড়তে রাজী নয়। যে পাখীর নিকট সেই বিপদ-আপদ পৌছে না যা নীচে উড়ন্ত পাখীর নিকটে পৌছে থাকে। তাই হিম্মত যত উঁচু হবে মন তত আপদমুক্ত হবে। আর হিম্মত যত নীচু হবে মনও তত আপদগ্রস্ত হবে। সুতরাং উচু হিম্মত মানুষের সফলতার শিরোনাম। পক্ষান্তরে নীচু হিম্মত তার বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার নিদর্শন।

হে মুসলিম যুবক! তুমি তোমার আচরণ, ব্যবহার, চরিত্র, শিক্ষা, অধ্যবসায়, অর্থোপার্জন ও দ্বীনদারীতে উচু হিম্মত, সংকল্পবদ্ধ মন এবং উন্নত ও উদ্যমশীল হৃদয়ের অধিকারী হও -এই কামনা করি।