নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

আরবের এই প্রসিদ্ধ গোত্রটির প্রতিনিধি দল তাদের বিখ্যাত অশ্বারোহী বীর যায়েদ আল-খাইলের[1](زَيْدُ الْخَيْلِ) নেতৃত্বে রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়। অতঃপর প্রয়োজনীয় কথোপকথন শেষে তারা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। তাদের ইসলাম খুবই সুন্দর থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দলনেতা যায়েদ-এর প্রশংসা করে বলেন, আমার সম্মুখে আরবের যে সব ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়েছে, সামনে আসার পর তাদের আমি তার চেয়ে কম পেয়েছি, কেবল যায়েদ ব্যতীত। কেননা তার খ্যাতি তার সকল গুণের নিকটে পৌঁছতে পারেনি’। অতঃপর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে যায়েদ আল-খায়ের(زَيْدُ الْخَيْرِ) অর্থাৎ ‘যায়েদ অশ্বারোহী’র বদলে ‘যায়েদ কল্যাণকারী’ রাখেন।[2]

উল্লেখ্য যে, ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে ‘ত্বাঈ’ গোত্রের খ্যাতনামা দানবীর হাতেম ত্বাঈ-এর পুত্র বিখ্যাত খ্রিষ্টান পন্ডিত ও পুরোহিত ‘আদী বিন হাতেম স্বীয় বোন সাফফানাহর (سَفَّانَة) দাওয়াতে সাড়া দিয়ে শাম থেকে মদীনায় এসে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে মর্যাদা প্রদর্শন করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। অতঃপর কুশল বিনিময়ের পর আলোচনা শুরু করেন। যথারীতি হাম্দ ও ছানার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন বস্ত্ত তোমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে? তুমি কি মনে কর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য আছেন? ‘আদী বললেন, না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর বললেন, আল্লাহ যে সর্বোচ্চ (আল্লাহু আকবর) একথা বলা থেকে তুমি পালিয়ে যাচ্ছ। তুমি মনে কর যে, আল্লাহর চাইতে অন্য কিছু বড় আছে। ‘আদী বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّ الْيَهُودَ مَغْضُوبٌ عَلَيْهِمْ وَإِنَّ النَّصَارَى ضُلاَّلٌ ‘মনে রেখ ইয়াহূদ হ’ল অভিশপ্ত এবং নাছারা হ’ল পথভ্রষ্ট’। তখন ‘আদী বললেন, فَإِنِّى جِئْتُ مُسْلِمًا ‘আমি একজন মুসলিম হিসাবে এসেছি’। এ জওয়াব শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো’ (তিরমিযী)

অতঃপর তিনি তাকে এক আনছার ছাহাবীর বাড়িতে মেহমান হিসাবে রেখে দেন এবং সেখান থেকে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে নিয়মিত দু’বেলা যাতায়াত করতে থাকেন। এভাবে দৈনিক যাতায়াতে তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা হয়। বিভিন্ন হাদীছে যার বর্ণনা এসেছে। যেমন- (১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন,أَلَسْتَ مِنَ الرَّكُوسِيَّةِ وَأَنْتَ تَأْكُلُ مِرْبَاعَ قَوْمِكَ ‘হে ‘আদী! তুমি কি পুরোহিত ছিলে না? তুমি কি তোমার কওমের কাছ থেকে (বায়তুল মালের) সিকি গ্রহণের নিয়ম চালু করোনি? ‘আদী বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّ هَذَا لاَ يَحِلُّ لَكَ فِى دِينِكَ ‘অথচ এটি তোমার দ্বীনে হালাল নয়’ (আহমাদ)।[3] ‘আদী বললেন,قُلْتُ: أَجَلْ وَاللهِ ‘আল্লাহর কসম! এটা ঠিক কথা’। وَقَالَ: وَعَرَفْتُ أَنَّهُ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، يَعْلَمُ مَا يُجْهَلُ ‘আদী বলেন, আমি তখুনি বুঝে নিয়েছিলাম যে, ইনি আল্লাহর প্রেরিত নবী। যিনি সেসব কথা জানেন, যা অন্যেরা জানে না’ (ইবনু হিশাম)।[4]

[শিক্ষণীয় : ধর্মনেতারা দুনিয়াবী স্বার্থে অনেক সময় এলাহী বিধানের বিকৃতি সাধন করে থাকেন, এটা তার অন্যতম প্রমাণ।]

(২) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আদী বিন হাতেম বলেন,

أَتَيْتُ رسولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي عُنُقِي صُلَيبٌ من ذَهَبٍ، فقال: يا عَدِيُّ، اِطْرَحْ هذا الوَثَنَ مِنْ عُنُقِكَ ! قال: فَطَرَحْتُهُ، وَانْتَهَيْتُ إِلَيْهِ وهُوَ يَقْرَأُ في "سُورةِ بَراءةٍ"، فَقَرأَ هَذهِ الآيةَ : (اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ)، قال قلتُ : يا رسولَ الله، إِنَّا لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ! فقال: أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّونَ مَا حرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ قال: قُلتُ: بَلَى! قال: فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ- رواه ابن جرير-

‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ (বা রৌপ্যের) ক্রুশ ঝুলানো ছিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার গলা থেকে ঐ মূর্তিটা ফেলে দাও। এ সময় তিনি সূরা তওবাহর ৩১ আয়াতটি পাঠ করছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে,اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘ইহূদী-নাছারাগণ আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’। তখন আমি বললাম,لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা ওদের ইবাদত করি না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّونَ مَا حرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ ‘তোমরা কি ঐসব বস্ত্তকে হারাম করো না, যা আল্লাহ হালাল করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হারাম করে? তোমরা কি ঐসব বস্তকে হালাল করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হালাল করে? ‘আদী বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[5]

উক্ত হাদীছের ও কুরআনী আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) ও যাহহাক বলেন, لَمْ يَأْمُرُوهُمْ أَنْ يَسْجُدُوا لَهُمْ، وَلَكِنْ أَمَرُوهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَأَطَاعُوهُمْ، فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَلِكَ أَرْبَابًا ‘ইহূদী-নাছারাদের সমাজনেতা ও ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার আদেশ দেননি। বরং তারা তাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে নির্দেশ দিতেন এবং তারা তা মান্য করত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[6]

(৩) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আদী বিন হাতেম বলেন, একদিন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে বসে ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে তার অভাব-অনটনের কথা পেশ করল। আরেকজন এসে রাহযানির(قَطْعُ السَّبِيلِ) কথা বলল। (তাদের সমস্যাবলী সমাধান শেষে) রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে ‘আদী! তুমি কি (ইরাকের সমৃদ্ধ নগরী) হীরা চেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন,

فَإِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتَرَيَنَّ الظَّعِيْنَةَ تَرْتَحِلُ مِنَ الْحِيْرَةِ، حَتَّى تَطُوْفَ بِالْكَعْبَةِ، لاَ تَخَافُ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ، وَلَئِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتُفْتَحَنَّ كُنُوْزُ كِسْرَى. وَلَئِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ، لَتَرَيَنَّ الرَّجُلَ يُخْرِجُ مِلْءَ كَفِّهِ مِنْ ذَهَبٍ أَوْ فِضَّةٍ، يَطْلُبُ مَنْ يَقْبَلُهُ مِنْهُ، فَلاَ يَجِدُ أَحَدًا يَقْبَلُهُ مِنْهُ-

(ক) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তুমি দেখবে একজন হাওদানশীন মহিলা একাকী ‘হীরা’ থেকে এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করবে। অথচ রাস্তায় সে কাউকে ভয় করবে না আল্লাহ ব্যতীত (খ) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহ’লে তোমরা কিসরার ধনভান্ডার জয় করবে। (গ) যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তুমি দেখবে যে, একজন ব্যক্তি হাত ভরে সোনা-রূপা নিয়ে ঘুরবে, অথচ তা নেবার মত কাউকে সে খুঁজে পাবে না’।

উক্ত হাদীছ বর্ণনা করার পর হযরত ‘আদী বিন হাতেম (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম দু’টি ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আমি পর্দানশীন মহিলাদের একাকী হীরা থেকে এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দেখেছি। পারস্য সম্রাট কিসরা বিন হুরমুযের ধন-ভান্ডার জয়ের অভিযানে আমি নিজেই শরীক ছিলাম। এখন কেবল তৃতীয়টি বাকী রয়েছে।وَلَئِنْ طَالَتْ بِكُمْ حَيَاةٌ لَتَرَوُنَّ مَا قَالَ النَّبِىُّ أَبُو الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘যদি তোমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তোমরা অবশ্যই তৃতীয়টি দেখতে পাবে। যা বলে গেছেন আবুল ক্বাসেম মুহাম্মাদ (ছাঃ)’। অর্থাৎ হাত ভরে স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে ঘুরেও তা নেবার মত কোন দরিদ্র লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।[7]

[শিক্ষণীয় : যোগ্য শিষ্য পেলেই কেবল যোগ্য উত্তর সমূহ পাওয়া সম্ভব]

[1]. ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, যায়েদ ছিলেন কবি, বাগ্মী ও বীর যোদ্ধা। তার দুই পুত্র মুকনিফ ও হুরাইছ (مُكْنِفُ وَحُرَيْثٌ) পিতার ন্যায় রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবী ছিলেন। তারা আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে খালেদ বিন অলীদ-এর নেতৃত্বে রিদ্দার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৯)।

[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৮-৩৯; ইবনু হিশাম ২/৫৭৭; আর-রাহীক্ব ৪৫৩; সনদ যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৮০ পৃঃ)।

[3]. আহমাদ হা/১৮২৮৬, হাদীছের কিছু অংশ ছহীহ, সনদ হাসান -আরনাঊত্ব।

[4]. তিরমিযী হা/২৯৫৪ সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৫৮০-৮১; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫২-৫৩।

[5]. তাফসীর ইবনু জারীর হা/১৬৬৩২; তিরমিযী, হা/৩০৯৫; ছহীহাহ হা/৩২৯৩; সনদ হাসান।

[6]. তাফসীর ইবনু জারীর (বৈরূত : ১৯৮৬) ১০/৮০-৮১; হা/১৬৬৪১। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান পতনদশায় উক্ত হাদীছটি অতীব গুরুত্ববহ। এর মধ্যে হেদায়াতের আকাংখীদের জন্য রয়েছে সঠিক পথের দিশা।

[7]. বুখারী হা/৩৫৯৫, আহমাদ হা/১৮২৮৬; মিশকাত হা/৫৮৫৭। বস্ত্ততঃ ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালেই মুসলমানদের মধ্যে উক্তরূপ সচ্ছলতা ফিরে আসে। ‘আদী বিন হাতেম হিজরত-পূর্ব ৫১-৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯ম হিজরীতে ইসলাম কবুল করেন। তিনি ছিফফীন যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যোগদান করেন। অতঃপর ৬৭-৬৮ হিজরীর মধ্যবর্তী সময়ে ১২০ বছর বয়সে কূফায় মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছাবাহ, ‘আদী বিন হাতেম ক্রমিক ৫৪৭৯)।