নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
৫. বনু হানীফাহ প্রতিনিধি দল (وفد بني حنيفة)

৫. বনু হানীফাহ প্রতিনিধি দল(وفد بني حنيفة) :

ইয়ামামাহর হানীফাহ গোত্রের ১৭ সদস্যের অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন (ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭১-এর পরের অনুচ্ছেদ)। তাদের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী(ثُمَامَةُ بْنُ آثَالٍ الْحَنَفِيُّ) ‘যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার কুমতলবে ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে মদীনায় যাওয়ার পথে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে পাকড়াও হয়ে মদীনায় নীত হন। তিনদিন বন্দী থাকার পর রাসূল (ছাঃ) তাকে মুক্তি দিলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করেন। প্রধানতঃ তাঁরই দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। উক্ত প্রতিনিধি দলে ইয়ামামার নেতা মুসায়লামা ছিলেন। তিনি শর্ত দিলেনإنْ جَعَلَ لِيْ مُحَمَّدٌ الْأَمْرَ مِنْ بَعْدِهِ تَبِعْتُهُ ‘যদি মুহাম্মাদ তাঁর পরে আমাকে তাঁর শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন, তাহ’লে আমি তাঁর অনুসারী হব’ (অর্থাৎ বায়‘আত করব)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর হাতে রাখা খেজুরের শুকনো ডালটির দিকে ইশারা করে বললেন,لَوْ سَأَلْتَنِيْ هَذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكهَا ‘যদি তুমি এই শুকনা ডালের টুকরাটিও চাও, তাহ’লেও আমি তোমাকে এটা দিব না’। অর্থাৎ নেতৃত্বের শর্তে বায়‘আত নেব না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি বায়‘আত না নিয়ে ফিরে যাও, তবে আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করে দিবেন। কারণ তোমার পরিণতি আমাকে দেখানো হয়েছে’ (বুখারী হা/৩৬২০)। রাবী ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি উক্ত বিষয়ে পরে আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমাকে পৃথিবীর ধনভান্ডার দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমার দুই হস্ততালুতে দু’টি সোনার বালা এসেছে। এতে আমি খুব ভারি বোধ করি। তখন স্বপ্নেই আমাকে বলা হয় যে, ওটা ফুঁক দিয়ে উড়িয়ে দাও। ফলে আমি ফুঁক দিতেই বালা দু’টি উড়ে গেল। আমি এর ব্যাখ্যা করছি এভাবে যে, এরা হ’ল ঐ দু’জন ভন্ডনবী, যারা আমার পরে বের হবে। তাদের একজন হ’ল ছান‘আর আসওয়াদ ‘আনাসী। অপরজন হ’ল ইয়ামামার মুসায়লামা কাযযাব’।[1] উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) ত্রিশ জন ভন্ডনবী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২; হাকেম হা/৮৩৯০)

অতঃপর মুসায়লামা ফিরে গিয়ে মুরতাদ হন ও নিজেই নবুঅত দাবী করেন। তিনি তার অনুসারীদের জন্য ছালাত নিষিদ্ধ করেন এবং মদ্যপান ও ব্যভিচার হালাল করে দেন। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কেও নবী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। যাতে তার এলাকার মুসলমানরা তার বিরুদ্ধে না চলে যায়। অতঃপর ১০ম হিজরীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিম্নোক্ত পত্র লেখেন।-

مِنْ مُسَيْلِمَةَ رَسُولِ اللهِ، إلَى مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ، سَلاَمٌ عَلَيْكَ، أَمَّا بَعْدُ : فَإِنِّي قَدْ أُشْرِكْتُ فِي الْأَمْرِ مَعَكَ، وَإِنَّ لَنَا نِصْفَ الْأَرْضِ، وَلِقُرَيْشٍ نِصْفَ الْأَرْضِ، وَلَكِنَّ قُرَيْشًا قَوْمٌ يَعْتَدُونَ-

‘আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ হ’তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর আমাকে আপনার সাথে রাজত্বে শরীক করা হয়েছে। জনপদের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং বাকী অর্ধেক কুরায়েশদের জন্য। কিন্তু কুরায়েশরা এমন কওম, যারা সীমালংঘন করে’ (ইবনু হিশাম ২/৬০০)। বালাযুরীর বর্ণনায় এসেছে,ولكن قريشًا لا يُنْصِفُونَ والسَّلامُ عليكَ ‘কিন্তু কুরায়েশরা ন্যায় বিচার করে না। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ফুতূহুল বুলদান ৯৭ পৃঃ)। উক্ত পত্রের জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লেখেন,

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى مُسَيْلَمَةَ الْكَذَّابِ، السَّلاَمُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى- أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ الْأَرْضَ ِللهِ يُوْرِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتّقِينَ-

‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে মিথ্যুক মুসায়লামার প্রতি। যে ব্যক্তি হেদায়াতের অনুসারী হয়, তার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর জেনে রাখা আবশ্যক যে, পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর হাতে। তিনি স্বীয় বান্দাগণের মধ্য হ’তে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করে থাকেন। আর শুভ পরিণাম হ’ল আল্লাহভীরুদের জন্য’।[2] লেখক ছিলেন উবাই ইবনু কা‘ব (ফুতূহুল বুলদান ৯৮ পৃঃ)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত পত্র হাবীব বিন যায়েদ বিন ‘আছেম ও আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব আসলামী (রাঃ) বহন করে নিয়ে যান। কিন্তু প্রচলিত রীতি-নীতি উপেক্ষা করে মুসায়লামা কাযযাব হাবীব বিন যায়েদ-এর দু’হাত ও দু’পা কেটে দেয়। হাবীব-এর মা ছিলেন বায়‘আতে কুবরায় অংশগ্রহণকারিণী দুইজন ভাগ্যবতী মহিলার অন্যতম বীরমাতা উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব (রাঃ)। যিনি ওহোদ যুদ্ধে যোগ দেন এবং হোদায়বিয়াতে বায়‘আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে যোগ দিয়ে তীর ও তরবারির ১২টি আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং একটি হাত হারান।[3]

অথচ ইতিপূর্বে মুসায়লামার পত্র নিয়ে যে দু’জন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসেছিল, তারা তাঁর সামনে চূড়ান্ত বেআদবী করা সত্ত্বেও তিনি তাদের কোনরূপ শাস্তি দেননি। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুসায়লামার দূতদ্বয় রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দিবে? তারা বলল,نَشْهَدُ أَنَّ مُسَيْلِمَةَ رَسُولُ اللهِ ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,آمَنْتُ بِاللهِ وَرُسُلِهِ ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর ঈমান রাখি’। অতঃপর বললেন,لَوْ كُنْتُ قَاتِلاً رَسُولاً لَقَتَلْتُكُمَا ‘যদি আমি কোন দূতকে হত্যা করতাম, তাহ’লে তোমাদের দু’জনকে হত্যা করতাম’।[4]

দুই ভন্ডনবীর অবস্থা (عاقبت المتنبيَيْن الكاذبين) :

আল্লাহপাক ভন্ডনবী মুসায়লামাকে দুনিয়াতেই এর শাস্তি দেন এভাবে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে হযরত খালেদ বিন অলীদকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয় এবং হযরত হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী বিন হারব, যিনি তখন উত্তম মুসলমান ছিলেন, তার হাতেই এই ভন্ডনবী নিহত হয়। ওয়াহ্শী তাই প্রায়ই বলতেন, কাফের অবস্থায় আমি একজন শ্রেষ্ঠ মুসলমানকে হত্যা করেছিলাম। মুসলমান হওয়ার পরে আমি একজন নিকৃষ্টতম কাফেরকে হত্যা করেছি (ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩)

অতঃপর দ্বিতীয় ভন্ডনবী ইয়ামনের আসওয়াদ ‘আনাসী, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাতের মাত্র একদিন ও একরাত পূর্বে ফীরোয (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। সে খবর সাথে সাথে অহী মারফত রাসূল (ছাঃ)-কে জানানো হয় এবং তিনি বিষয়টি ছাহাবীদের জানিয়ে দেন’।[5]

[শিক্ষণীয় : (১) দূতকে অসম্মান করা যায় না বা হত্যা করা যায় না। (২) নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ। (৩) উপরে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীতে আবুবকর (রাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। কেননা তাঁর আমলেই রিদ্দার যুদ্ধে মুসায়লামা কাযযাব নিহত হয়। (৪) ইসলামী দাওয়াতের লক্ষ্য হ’ল আখেরাত লাভ, দুনিয়া উপার্জন নয়। কিন্তু ভন্ডরা চিরকাল দুনিয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৫-৩৬; বুখারী হা/৪৩৭৫, ৩৬২১; মুসলিম হা/২২৭৩-৭৪; মিশকাত হা/৪৬১৯।

[2]. ইবনু হিশাম ২/৬০১; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৪।

[3]. আবুল হাসান আল-বালাযুরী (মৃ. ২৭৯ হি.), ফুতূহুল বুলদান (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ ১৪০৩/১৯৮৩) ১০২ পৃঃ ‘ইয়ামামাহ’ অধ্যায়; আল-ইছাবাহ উম্মে ‘উমারাহ ক্রমিক ১২১৭৮।

[4]. আহমাদ হা/৩৭৬১; দারেমী হা/২৫০৩; মিশকাত হা/৩৯৮৪, হাদীছ ছহীহ সনদ যঈফ -আরনাঊত্ব; ইবনু হিশাম ২/৬০০। দারেমীর বর্ণনায় এসেছে, وَفْدًا আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে, أَمَا وَاللهِ لَوْلاَ أَنَّ الرُّسُلَ لاَ تُقْتَلُ لَضَرَبْتُ أَعْنَاقَكُمَا ‘আল্লাহর কসম! যদি দূতদের হত্যা করা বিধি বহির্ভূত না হ’ত, তাহ’লে অবশ্যই আমি তোমাদের দু’জনের গর্দান উড়িয়ে দিতাম’ (আবুদাঊদ হা/২৭৬১)।

[5]. বুখারী হা/৪৩৭৯; ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭৮-এর আলোচনা; আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ।