মুসলিম মাইয়্যেতের উপর জানাযার নামায পড়া ফর্যে কিফায়াহ (অর্থাৎ কিছু লোক তা পালন করলে বাকী লোকের কোন পাপ হয়না এবং কেউই পালন না করলে সকলেই পাপী হয়। কারণ, এ নামায পড়তে আল্লাহর নবী (ﷺ) আদেশ করেছেন। যায়দ বিন খালেদ জুহানী বলেন, খাইবারের দিন নবী (ﷺ) এর এক সাহাবী মারা গেলে সকলে তাকে খবর দিলেন। কিন্তু তিনি বললেন, “তোমাদের সঙ্গীর জানাযা তোমরা পড়।” এ কথা শুনে সকলের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। কারণ বর্ণনা করে তিনি বললেন, “তোমাদের ঐ সাথী আল্লাহর পথে খেয়ানত করে মারা গেছে-----।” (আবু দাউদ ২৩৩৫ক, নাসাঈ ২৯৩৩ক, ইবনে মাজাহ ২৮৩৮ক, আহমাদ ২০৮৬ক, প্রমুখ।
অবশ্য দুই প্রকার মাইয়্যেতের জানাযা এ নির্দেশের আওতাভুক্ত নয়। অর্থাৎ তাদের জানাযা পড়া ওয়াজেব নয়; তবে বিধেয় বটে।।
প্রথম হল, নাবালক শিশু। কারণ, নবী (ﷺ) তার শিশুপুত্র ইব্রাহীম এর জানাযা পড়েন নি। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) এর পুত্র ১৮ মাস বয়সে মারা যায়। তিনি তার জানাযা পড়েন নি।” (আবু দাউদ ২৭৭২ক আহমাদ ২৫১০১, সহীহ আবু দাউদ ২৭২৯নং)
আর দ্বিতীয় হল শহীদ। কেননা, নবী (ﷺ) উহুদ প্রভৃতি যুদ্ধের শহীদদের জানাযা পড়েন নি বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। অবশ্য তার নামায না পড়াটা উক্ত ধরনের মাইয়্যেতের অবিধেয় হওয়ার নির্দেশ দেয় না। বরং নিম্নোক্ত শ্রেণীর মাইয়্যেতের জানাযা পড়া ওয়াজেব না হলেও বিধেয়ঃ
১। শিশুঃ এমন কি গর্ভপাত-জনিত মৃত প্রাণেরও জানাযা পড়া বিধেয়। যেহেতু পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “শিশু (অন্য এক বর্ণনায়-গর্ভুচ্যুত প্রাণের জানাযা পড়া হবে এবং তার পিতা-মাতার জন্যও ক্ষমা ও রহমত লাভের দুআ করা হবে।”
প্রকাশ যে, গভচ্যুত ভ্রূণে রূহ ফুকার পর অর্থাৎ গর্ভধারণের পুর্ণ চার মাস পর মারা গিয়ে চ্যুত হলেই তার জানাযা পড়া বিধেয়। চার মাসের পূর্বেই চ্যুত হলে তার জানাযা পড়া বিধেয় নয়। কারণ, তাকে মাইয়্যেত বলা হয় না। কেননা, যার মধ্যে এখনো রূহ আসেনি এবং বিশেষ জীবন সঞ্চার হয় নি। তাকে মৃত বলা যায় না। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি (অর্থাৎ তার মূল উপাদান প্রথমে) ৪০ দিন তার মাতার গর্ভে শুক্ররূপে থাকে। অতঃপর ৪০ দিন লাল জমাট রক্ত পিন্ডরূপে অবস্থান করে, তৎপর ৪০ দিনে মাংস পিন্ডরূপ ধারণ করে। অতঃপর আল্লাহ তার নিকট এক ফিরিশ্তা পাঠিয়ে---- তার রূহ ফুকা হয়--- ” (বুখারী ২৯৬৯ক, মুসলিম ৪৭৮ ১ক, আবু দাউদ ৪০৮৫ক, মিশকাত ৮২ নং, দেখুনঃ আল মুমতে’ ৫/৩৭৪)।
এ ক্ষেত্রে ভ্রূণের জীবন্ত ভূমিষ্ঠ হওয়া শর্ত নয়। অর্থাৎ মরা ভূমিষ্ট হলে ও যদি চার মাসের বা ততোধিক বেশী বয়সের ভ্রূণ অথবা শিশু হয়, তাহলে তার জানাযা পড়া বিধেয়। আর উক্ত শর্তের যে হাদীস বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (দেখুন, ইরওয়াউল গালীল ১৭০ ৪নং, আহকামুল জানাইয ৮১ পৃঃ)
২। শহীদঃ আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ) উহুদের দিন নিহত হামযাকে (চেককাটা) চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে আদেশ করলেন। অতঃপর নয় তকবীর দিয়ে তার জানাযা পড়লেন। তারপর অন্যান্য নিহতদেরকে এনে সারাসারি রাখা হল এবং তিনি তাদের উপর ও তাদের সাথে তার উপরেও জানাযার নামায পড়লেন।' (মাআনিউল আষার, ত্বহাবী ১/২৯০) এ ব্যাপারে এ ছাড়া আরো অন্যান্য হাদীসও রয়েছে।
৩। শরীয়তের কোন হদ্দ (দন্ডবিধি)তে নিহত ব্যক্তিঃ ইমরান বিন হুসাইন বলেন, ‘জুহাইনাহ গোত্রের এক মহিলা নবী (ﷺ) এর নিকট এল। তখন সে ব্যভিচারের ফলে গর্ভবতী ছিল। এসে বলল, হে আল্লাহর নবী! হদ্দের উপযুক্ত এক কাজ আমি করে ফেলেছি, আপনি তা আমার উপর কায়েম করুন। নবী (ﷺ) তার অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “এর প্রতি সদ্ব্যবহার কর। অতঃপর সন্তান প্রসব করার পর ওকে আমার নিকট নিয়ে এস।” সুতরাং তাই করা হল। আল্লাহর নবী (ﷺ) তার দেহের কাপড় শক্ত করে বাঁধতে আদেশ করলেন। অতঃপর তাকে পাথর ছুঁড়ে মারার আদেশ দিলেন। মরার পর তিনি তার জানাযা পড়লেন। উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি ওর জানাযা পড়লেন, অথচ ও ব্যভিচার করেছিল?? উত্তরে প্রিয় নবী (ﷺ) বললেন, “কিন্তু ও এমন তওবা করে নিয়েছিল যে, যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত, তবে তাদের জন্য তা যথেষ্ট হত। আর এর চেয়ে উত্তম তওবা কি পেয়েছ যে, সে আল্লাহ তাআলার জন্য নিজের প্রাণ হত্যা করালো?!” (মুসলিম ৩২০৯ক, তিরমিযী ১৩৫৫ক, নাসাঈ ১৯৩ ১ক, আবু দাউদ ৩৮৫২ক, ইবনে মাজাহ ২৫৪৫ক)
৪। আল্লাহ ও তদীয় রসুলের অবাধ্যাচরণে লিপ্ত, কাবীরা গোনাহর গোনাহগার ব্যক্তিঃ ওয়াজেব বর্জন এবং হারাম গ্রহণে জড়িত থাকা অবস্থায় মৃত ফাসেক, ফাজের, পাপাচার, দুরাচার ও দুষ্কৃতী ব্যক্তি; যেমন, নামায ও যাকাত ফরয জানা ও মানা সত্ত্বেও যে তা ত্যাগ করে, ব্যভিচার করে, মদ্য পান করে, খেয়ানত করে, আত্মহত্যা করে, অথবা অনুরূপ কোন পাপ করে মারা যায় তার জন্যও জানাযা পড়া বিধেয়। তবে উলামা, ইমাম ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উচিত, এমন লোকদের জানাযা না পড়া। যাতে ওদের ন্যায় জীবিত অন্যান্য পাপীরা এ থেকে শিক্ষা ও উপদেশ পায়। প্রিয় নবী (ﷺ) অনুরূপ করে গেছেন।
আবু কাতাদাহ (রাঃ) বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে যখন কোন জানাযা পড়ার জন্য ডাকা হত তখন তিনি মৃতব্যক্তি প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। অতঃপর লোকেরা তার নাম ও প্রশংসা করলে জানাযা পড়তেন। নচেৎ তার পরিজনকে বলতেন, “তোমাদের জানাযা তোমরাই পড়গে!” এবং তিনি তার জানাযা পড়তেন না। (আহমাদ ২১৫১৩ক, হাকেম ১/৩৬৪)
যায়দ বিন খালেদ কর্তৃক বর্ণিত, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) কোন। কিছু খেয়ানত করলে নবী (ﷺ) তার জানাযা না পড়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জানাযা পড় (আমি পড়ব না। কারণ, তোমাদের সঙ্গী আল্লাহর রাস্তায় খেয়ানত করেছে!” (মুআত্তা, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ হাকেম ২/১২৭, আহমাদ ৪/১১৪, ৫ ১৯২)।
অনুরূপ একজন আত্মহত্যা করে মারা গেলে তার জানাযাও তিনি পড়েন। নি। (মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ হাকেম ১/৩৬৪, বাইহাকী ৪/ ১৯, আহমাদ ৫/৮৭ প্রভৃতি)।
ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেন, আত্মহত্যা করে মৃতের জানাযা ইমাম পড়বেন বরং অন্যান্য লোকেরা পড়ে নেবে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, যিনি হত্যাকারী, খেয়ানতকারী, ঋণগ্রস্ত প্রভৃতি পাপীদের উপর তাদের মত অন্যান্য। পাপীদেরকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে জানাযা না পড়েন, তিনি ভালোই করেন। তবে যদি তিনি প্রকাশতঃ এমন পাপীর জানাযা না পড়েন এবং গোপনভাবে তার জন্য দুআ করেন তাহলে দুটির মধ্যে একটি কল্যাণ হাতছাড়া না হয়ে উভয় প্রকার কল্যাণই লাভ করা সম্ভব হয়। (আল- ইখতিয়ারাত ৫২ পৃঃ আহকামুল জানাইয ৮৪ পৃঃ) অর্থাৎ এমন করলে পাপীদেরকে শিক্ষাও দেওয়া যায় এবং গোপনে দুআও মৃতের জন্য ফলপ্রসু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া নেক লোকের চাইতে বদ লোকেরাই তো দুআর অধিক মুখাপেক্ষী।
যারা নামায, যাকাত প্রভৃতি ফরয হওয়ার কথা অস্বীকার করে তারা সৰ্ববাদিসম্মতিক্রমে কাফের। এদের জানাযা কারো নিকটেই কারো জন্য পড়া বৈধ নয়। আবার যাদের মতে ফরয মানা সত্ত্বেও অবহেলায় নামায ত্যাগকারী কাফের তাঁদের মতেও এমন বেনামাযীদের জানাযা কোন মুসলিমই পড়তে পারে না এবং তার জন্য গোপনে বা প্রকাশ্যে কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনার দুআ করা যাবে না। বরং তাকে কাফের ও মুর্তাদ্দ- এর মত মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। (দেখুন, হুকমু তারিকিস সালাহ ফাতাওয়াহ তা'যিয়াহ ১৪ পূঃ সাবউন সুআলান ফী আহকামিল জানাইয় ২০ পৃঃ, ইবনে বাযের বিভিন্ন ফতোয়া)
৫। এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যার এমন কোন ত্যক্ত সম্পদ নেই যাতে ঋণ পরিশোধ হতে পারে। এরূপ ব্যক্তির জানাযা পড়া বিধেয়। তবে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইমাম পড়বেন না। অবশ্য তার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব ইমাম নিজে অথবা অন্য কেউ নিলে তার জানাযা সকলেই পড়বে। সালামাহ বিন আকওয়া বলেন, আমরা নবী (ﷺ) এর নিকট বসে ছিলাম। ইতিমধ্যে একটি জানাযা উপস্থিত হলে লোকেরা তাকে তার জানাযা পড়তে বললেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “ওর কি ঋণ পরিশোধ বাকী আছে?” সকলে বলল, না। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, “ও কি কোন সম্পদ ছেড়ে যাচ্ছে?” সকলে বলল, 'না। অতঃপর তিনি তার জানাযা পড়লেন।
এরপর আর একটি জানাযা উপস্থিত হলে সকলে তাকে তার জানাযা পড়তে অনুরোধ করল। তিনি তার সম্পর্কেও প্রশ্ন করলেন, “ওর কি কোন ঋণ পরিশোধ বাকী আছে?” বলা হল, 'হ্যাঁ। বললেন, “ওকি কোন সম্পদ ছেড়ে যাচ্ছে?” সকলে বলল, ‘তিন দীনার। তা শুনে তার জানাযা পড়লেন। অতঃপর তৃতীয় জানাযা উপস্থিত হলে এবং লোকেরা শেষ নামায পড়তে আবেদন জানালে তার সম্বন্ধেও তিনি একই প্রশ্ন করলেন, “ওকি কোন সম্পদ ছেড়ে যাচ্ছে?” সকলে বলল, 'না। বললেন, “ওর কি কোন ঋণ পরিশোধ বাকী আছে?” বলল, “ তিন দীনার।” একথা শুনে তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জানাযা পড়ে নাও।” তখন আবু কাতাদাহ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! ওর জানাযা আপনি পড়ুন। আমি ওর ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিচ্ছি।” (বুখারী ২১২৭ক, নাসাই ১৯৩৫ক, আহমাদ ১৫৯১৩)
জাবের এ কর্তৃক বর্ণিত, (নবী (ﷺ) প্রথমতঃ ঋণগ্রস্ত মৃতের জানাযা পড়তেন না।) অতঃপর যখন বহু বিজয় ও সম্পদ লাভ হল, তখন তিনি বললেন, “মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের চাইতে আমিই অধিক হকদার দায়িত্বশীল। সুতরাং যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা যাবে তার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপর এবং যে সম্পদ রেখে মারা যাবে তার অধিকারী হবে তার ওয়ারেসীনরা।” (মুসলিম ১৪৩৫ক, নাসাঈ ১৯৩৬, আবু দাউদ ২৫৬৫ক, ইবনে মাজাহ ৪৪, প্রমুখ অনুরূপ বর্ণিত আছে আবু হুরাইরা কর্তৃকও। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ও ৩০৪১ নং)
৬। যে মাইয়্যেতকে পূর্বে জানাযা পড়ে কবরস্থ করা হয়েছে। কিন্তু কিছু লোক যারা এই জানাযায় শরীক হতে পারে নি তারা তার কবরকে সামনে রেখে। জামাআত করে বা একাকী কেউ জানাযার নামায পড়তে পারে। অবশ্য জামাআত করে পড়লে যেন এই ইমাম পূর্বে তার জানাযা না পড়ে থাকে।
পক্ষান্তরে মুক্তাদীগণ ডবল করেও পড়তে পারে। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'এক ব্যক্তিকে তার পীড়িত অবস্থায় নবী (ﷺ) সাক্ষাতে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। সে মারা গেলে তাকে রাতে-রাতেই দাফন করে দেওয়া হল। অতঃপর সকাল হলে সে কথা তাঁর নিকট উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “আমাকে তার মৃত্যু খবর জানাতে তোমাদের কি বাধা ছিল?” সকলে বলল, গভীর রাত্রি ছিল আর অন্ধকারও ছিল খুব বেশী। তাই আপনাকে কষ্ট দিতে আমরা অপছন্দ করলাম। এ শুনে তিনি তার কবরের নিকট এসে তার জানাযা পড়লেন। তিনি আমাদের ইমামতি করলেন। আমরা তার পশ্চাতে কাতার দিয়েছিলাম। ঐ কাতারে আমিও শামিল ছিলাম। তিনি তাঁর জন্য চার তকবীর দিয়ে নামায পড়লেন। (বুখারী ১১৭০ক, মুসলিম ১৫৮৬ক, তিরমিযী ৯৫৮ক, ফাতহুল বারী হাদীস নং ১৩২৬)।
অতএব কোন কারণবশতঃ যদি কোন মাইয়্যেতকে জানাযা না পড়েই দাফন করা হয়ে থাকে, তাহলে তার কবরে যাওয়া সম্ভব হলে কবরের উপর জানাযা পড়া বিধেয়। আর এর জন্য গায়েবানা জানাযা বিধেয় নয়।
৭। যে মাইয়্যেত এমন স্থানে মারা গেছে, যেখানে জানাযা নামায পড়ার মত কেই ছিল না অথবা তাকে জানাযা না পড়েই দাফন করা হয়েছে জানা গেলে এবং সেই স্থানে যাওয়া সম্ভব না হলে অথবা লাশ পাওয়া অসম্ভব হলে সে ক্ষেত্রে ঐ মাইয়্যেতের জন্য গায়েবানা জানাযা পড়া বিধেয়। বাদশা নাজাশী হাবশায় মারা গেলে তার খবর পেয়ে নবী (ﷺ) সাহাবাদেরকে সঙ্গে করে তার গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৬৫২নং)।
কিন্তু প্রত্যেক মাইয়্যেতের জন্য গায়েবানা জানাযা পড়া নবী (ﷺ) এর তরীকা ও আদর্শ ছিল না। যেহেতু বহু সাহাবাই মদীনার বাইরে নবী (ﷺ) এর অনুপস্থিতিতে মারা গেছেন, কই তাদের গায়েবী জানাযা তিনি পড়েন নি। সুতরাং যে মাইয়্যেতের উপর কিছু মুসলিম জানাযার নামায পড়ে তাকে দাফন করেছে বলে জানা যায়, তার জন্য আর গায়েবানা জানাযা পড়া বিধেয় নয়। বরং এই ধরনের প্রত্যেক (জানাযা পড়ে দাফন কৃত) মাইয়্যেতের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাযা পড়া ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে তা পড়তে মুসলিম জনসাধারণকে আবেদন করা বিদআত। (দেখুন আহকামুল জানাই ৯১-৯৩পৃঃ, সাবঊনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ৮-৯পৃঃ, ফাতাওয়াত তা'যিয়াহ ১৮- ১৯পৃঃ)
কাফের, মুনাফেক, মুশরিক, কবর বা মাযারপূজারী, (এবং অনেকের মতে বেনামাযী)র জন্য জানাযার নামায, দুআ, ক্ষমা প্রার্থনা, এবং তাদের উদ্দেশ্যে ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বলা হারাম। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰ أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِ ۖ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ
অর্থাৎ, ওদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনো তার জানাযা পড়বে না এবং (ক্ষমা প্রার্থনার জন্য) তার কবর পার্শ্বে দাঁড়াবে না; ওরা তো আল্লাহ ও তার রসূল (ﷺ)কে অস্বীকার করেছিল এবং সত্যত্যাগী অবস্থায় ওদের মৃত্যু হয়েছে। (সূরা তাওবাহ ৮৪ আয়াত) তিনি আরো বলেন,
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَن يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَىٰ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
অর্থাৎ, আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও মুমিনদের জন্য সংগত নয়; যখন তাদের নিকট এ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা জাহান্নামী। (সূরা তাওবাহ ১১৩ আয়াত)
মৃত্যুর খবর শুনে অথবা জানাযা পড়ার সময় যদি কারো পাকা সন্দেহ হয় যে, মাইয়্যেত হয়তো শির্ক করে বা নামায ত্যাগ করে মারা গেছে, তবে তার জন্য দুআতে সন্দেহ বা শৰ্তমূলক শব্দ ব্যবহার করায় দোষ নেই। অতএব দুআয় বলা যায় যে, আল্লাহ! ওকে মাফ করে দাও; যদি ও মুমিন হয়। আল্লাহ! ওর প্রতি রহম কর, যদি ও তওহীদবাদী মুসলিম হয়--- ইত্যাদি। পক্ষান্তরে সন্দেহ পাকা না হলে অনুরূপ শৰ্তমূলক শব্দ ব্যবহার বৈধ নয়। কারণ মুসলিম মাত্রেই আসল ও মৌলিক চরিত্র হল তওহীদবাদী ও মুমিন হওয়া। সুতরাং তাতে সন্দেহ হওয়ার কথা নয়।
শতমূলক দুআ করার বৈধতার ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহতে বর্তমান। আল্লাহ তাআলা লিয়ানের আয়াতে বলেন, “পঞ্চমবারে (পুরুষ) বলবে ও যদি (তার স্ত্রীর ব্যভিচারে অপবাদে) মিথ্যাবাদী হয়, তাহলে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ। ”
তদনুরূপ স্ত্রীও পঞ্চমবারে বলবে, তার নিজের উপর আল্লাহ গযব, যদি তার স্বামী সত্যবাদী হয়।” (সুরা নুর ৭, ৯ আয়াত)
অনুরূপভাবে কুফার আমীর সা’দ বিন আবী অক্কাসের বিরুদ্ধে উসামাহ বিন কাতাদাহ খলীফা উমার (রাঃ) এর নিকট দাঁড়িয়ে অবিচারের অভিযোগ করলে সা’দ (রাঃ) শৰ্তমূলক শব্দে দুআ করে বলেছিলেন, 'হে আল্লাহ! যদি এই ব্যক্তি লোক প্রদর্শন ও সুনাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, তাহলে ওকে অন্ধ করে দিও, ওর হায়াত দারাজ করো এবং ফিতনায় পতিত করো।' (বুখর ৭৫৫ নং)
আর নবী (ﷺ) তালবিয়্যাহ পাঠের সময় যুবাআহ বিন্তে যুবাইরকে বলেছিলেন, “তুমি যা শর্ত লাগাবে তাই তোমার প্রতিপালকের নিকট তুমি প্রাপ্ত হবে।” (দারেমী ১৭৫৬নং) এই উক্তির সাধারণ ইঙ্গিতও দুআতে শর্ত লাগানো বৈধ হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে।
তবে জানাযার সময় মাইয়্যেত জীবিতকালে নামায পড়েছে কি না---সে প্রশ্ন করা মুক্তাদীর দায়িত্ব নয়। বরং এ সময় তার দ্বীনদারী বিষয়ে কাউকে প্রশ্ন করাই হল বিদআত। (ফাতাওয়াত তাযিয়াহ ১৩-১৪ পৃঃ) পক্ষান্তরে বেদ্বীন বা বেনামাযীর জানাযা পড়ার জন্য ইমাম বা অন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে অনুরোধ করা ওয়ারেসীন বা অভিভাবকের অনুচিত। কারণ, এমনটি করা তাদের জন্য অবৈধ। যেমন, যদি কেউ এমন লোকের জানাযা না পড়ে, তবে তার প্রতি রাগ বা ক্ষোভ রাখা উচিত নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন)
জানাযার নামাযের জন্য আযান-ইকামত নেই। তাই সাধারণভাবে মাইকে নামাযের ঘোষণা ও কবরস্থানের প্রতি সাধারণকে আহবান অবশ্যই বিদআত।
পক্ষান্তরে এক অপরকে নামাযের নির্দিষ্ট সময় বলে মুসল্লী সংখা বৃদ্ধি করা দূষণীয় নয়। (সাবউনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ৫পৃঃ)
জানাযার নামাযের জন্য জামাআত ওয়াজেব; যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য ওয়াজেব। কারণ, নবী (ﷺ) সর্বদা জামাআত সহকারেই জানাযা পড়েছেন। (আহকামুল জানাইয ৯৭পৃঃ)।
আর জামাআতে লোক যত বেশী হবে ততই মাইয়্যেতের জন্য উত্তম ও সৌভাগ্য-ব্যঞ্জক। কারণ, প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে মাইয়্যেতের জন্য ১০০ জন মত মুসলিমের জামাআত জানাযা পড়ে প্রত্যেকে তার জন্য সুপারিশ করলে (আল্লাহর দরবারে) তাদের সুপারিশ মঞ্জুর করা হয়।” (মুসলিম ১৫৭৬ক, তিরমিযী ১৫০ক নাসাঈ ১৯৬৪ক, আহমাদ ১৩৩০৩ক) অন্য এক বর্ণনায় আছে, “তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।“ (সহীহ ইবনে মাজাহ ১২০৯নং)
অবশ্য মুসল্লীর সংখ্যা একশতের চাইতে কম হলেও মাইয়্যেত ক্ষমার্হ হতে পারে। যেমন যদি মাত্র ৪০ জন এমন লোক মাইয়্যেতের জন্য সুপারিশের দুআ করে, যারা কোনদিন কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে কোন প্রকারে শরীক (শির্ক) করে নি - তাহলে তাদের সুপারিশও তাঁর দরবারে মঞ্জুর হয়। এ ব্যাপারে পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “কোন মুসলিম মারা গেলে তার জানাযায় যদি ৪০ জন এমন লোক নামায পড়ে যারা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করে নি, তাহলে আল্লাহ তাদের সুপারিশ তার জন্য কবুল করে নেন।” (মুসলিম ১৫৭৭ক, আবু দাউদ ২৭৫৬ক, ইবনে মাজাহ ১৪৭৮ক, আহমদ ২২৭৯)
এই জামাআতে ইমামের পশ্চাতে তিনটি কাতার হওয়া মুস্তাহাব। আবু উমামাহ (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এক মাইয়্যেতের জানাযার নামায পড়লেন। তখন তাঁর সাথে মাত্র সাতটি লোক ছিল। তিনি তিন ব্যক্তি দ্বারা একটি কাতার আর দুই ব্যক্তিদ্বোরা একটি কাতার এবং অপর দুটি ব্যক্তির দ্বারা আর একটি (মোট তিনটি) কাতার করে দাঁড় করালেন।” (ত্বাবারানী কাবীর, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৪৩২)
মালেক বিন হুবাইরাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “কোন মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে যদি তার জন্য মুসলিমদের, তিন কাতার লোক জানাযা পড়ে, তাহলে তার জন্য (জান্নাত) অবধার্য হয়ে যায়।” (অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, “তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।) মারষাদ বিন আব্দুল্লাহ ইয়াযানী বলেন, মালেক বিন হুবাইরা (রাঃ) জানাযার অংশগ্রহণকারী লোক কম দেখলে সকলকে তিন কাতারে ভাগ করে দিতেন।” (আবু দাউদ ২৭৫৩, তিরমিযী ২৭১৪নং)
কোন জানাযায় যদি ইমাম ব্যতীত অন্য একটি লোক ছাড়া আর কোন লোক না থাকে, তাহলে অন্যান্য নামাযের মত ইমাম-মুক্তাদী পাশাপাশি দাঁড়াবে না। বরং ইমামের পশ্চাতে একাকী দাড়িয়ে জানাযা পড়বে। কারণ, আব্দুল্লাহ বিন আবী তালহা বলেন, 'উমাইর বিন আবু তালহা ইন্তেকাল করলে তালহা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে ডেকে পাঠালেন, তিনি এসে তাদের বাড়িতে জানাযা পড়লেন; আল্লাহর রসূল (ﷺ) সামনে দাঁড়ালেন। আবু তালহা দাঁড়ালেন তাঁর পিছনে এবং উম্মে সুলাইম দাঁড়ালেন আবু তালহার পিছনে। সে দিন ওঁরা ছাড়া তার সাথে আর কেউ ছিল না। (হাকেম ১/৩৬৫, বাইহাকী ৪/৩০-৩১, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৩৪)
এই জামাআতের কাতারে গোলাপ পানি বা কোন সেন্ট ছিটানো বিদআত।। উক্ত নামাযে ইমামতির অধিক হকদার মুসলিমদের সাধারণ গভর্নর বা আমীর অথবা তার নায়েব।
আবু হাকেম বলেন, হাসান বিন আলী (রাঃ) যেদিন ইন্তেকাল করেন সেদিন আমি তার জানাযায় উপস্থিত ছিলাম। আমি দেখলাম, হুসাইন বিন আলী (রাঃ) সাঈদ বিন আসকে তার ঘাড়ে স্পর্শ করে বললেন, ‘আগে বাড়ুন। (ইমামতি করুন।) যদি তা সুন্নাহ না হত তাহলে আমি আপনাকে বাড়াতাম না। সাঈদ ছিলেন তৎকালীন মদীনার আমীর। আর তাঁদের আপোসে কোন প্রকার মনোমালিন্য ছিল। (হাকেম ৩/১৭ ১, বাইহাকী ৪/২৮) কিন্তু গভর্নর, আমীর অথবা নায়েব না থাকলে বা উপস্থিত না হলে ইমামতির হকদার তিনিই বেশী যিনি পাঁচ-অক্ত নামাযে হকদার। যেমন প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “লোকেদের ইমামতি করবে সেই ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক কুরআন (উত্তম ও বেশীরূপে) পাঠ করে। কুরআন পাঠে তারা সমমানের হলে যে ব্যক্তি সুন্নাহ বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে সে ইমামতি করবে। এতেও তারা সমমানের হলে প্রথম হিজরতকারী, তাতেও সমান হলে প্রথম যে মুসলিম হয়েছে সে ইমামতি করবে। আর কোন ব্যক্তি যেন কারো ইমামতির জায়গায় ইমামতি না করে এবং কারো আসনে তার বিনা অনুমতিতে না বসে।” (মুসলিম ১০৭৮ক, আবু দাউদ ৪৯৪ক, তিরমিযী ২ ১৮ক, নাসাঈ ৭৭২ক, ইবনে মাযাহ ৯৭০ক, আহমাদ ১৬৪৪৬ক)
সুতরাং উক্তরূপ উপযুক্ত যে কেউই না বালক হলেও ইমামতি করতে পারবে, আর জানাযা মসজিদে হলে ইমামতি করবেন মসজিদের ইমাম সাহেব। অবশ্য তার অনুমতিক্রমে অন্য কেউ পড়তে পারে। কিন্তু মৃতব্যক্তি জীবিতকালে যদি তার জানাযা পড়তে কাউকে অসিয়ত করে যায়, তাহলে অসী ব্যক্তিই ইমামতি করবে। জানাযায় আমীর উপস্থিত না থাকলে অথবা জানাযা মসজিদে না হলে এবং সব দিকে উপযুক্ত হলে তবেই কোন আত্মীয় ইমামতি করবে।
একই সময়ে একাধিক মাইয়্যেত একই স্থানে জমায়েত হলে একবারই জানাযা পড়া সকলের জন্য যথেষ্ট। পুরুষ ও শিশু হলে ইমামের সম্মুখে পুরুষ থাকবে। মহিলা ও শিশুপুত্র হলে ইমামের সামনে শিশু থাকবে। পুরুষ, মহিলা ও শিশুপুত্র হলে ইমামের সম্মুখে পুরুষ, অতঃপর শিশুপুত্র অতঃপর, মহিলা থাকবে। আর পুরুষ, মহিলা, শিশুপুত্র ও শিশুকন্যা থাকলে ইমামের সম্মুখে পুরুষ, অতঃপর শিশুপুত্র, অতঃপর মহিলা এবং শেষে কেবলার দিকে শিশুকন্যা থাকবে। মাইয়্যেত কেবল মহিলা ও শিশুকন্যা হলে ইমামের সম্মুখে মহিলা ও পরে শিশুকন্যা কেবলার দিকে থাকবে।
ইবনে উমার একদা এক সঙ্গে ৯ টি মাইয়্যেতের উপর জানাযার নামায পড়লেন। এতে পুরুষ মাইয়্যেতদেরকে ইমামের (নিজের) দিকে রাখলেন এবং মহিলা মাইয়্যেতদের রাখলেন কেবলার দিকে। সকল লাশকে রাখলেন একই কাতারে। আর উমার বিন খাত্তাবের স্ত্রী উম্মে কুলম বিন্তে আলী এবং তার যায়দ নামক এক ছেলের জানাযা রাখলেন এক সাথে। তখন ইমাম (গভর্নর) ছিলেন সাঈদ বিন আস। ঐ জামাআতে ছিলেন ইবনে আব্বাস, আবু হুরাইরা, আবু সাঈদ ও আবু কাতাদাহ । ইবনে উমার কিশোরটিকে নিজের দিকে কাছাকাছি রাখলেন। এক ব্যক্তি বলেন, আমি এতে আপত্তি করলাম। অতঃপর ইবনে আব্বাস, আবু হুরাইরাহ, আবু সাঈদ ও আবু কাতাদার দিকে দৃকপাত করে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি? তারা বললেন, 'ওটাই সুন্নাহ। (নাসাঈ ১৯৫২ক বাইহাকী ৪/৩৩ দারাকুত্বনী ১৯৪নং)।
এক সঙ্গে একই শ্রেণীর মাইয়্যেত জমায়েত হলে ইমামের কাছাকাছি সেই ব্যক্তিকে রাখা হবে যে অধিক (শুদ্ধভাবে) কুরআন পাঠকারী (হিফযকারী) এবং অধিক দ্বীনদার। কারণ নবী করীম (ﷺ) উহুদের শহীদদেরকে কবরস্থ করার সময় সেই ব্যক্তিকে সর্বাগ্রে কবরে রাখতে আদেশ করেছিলেন, যে ব্যক্তি অধিক কুরআন পাঠকারী (হিফযকারী)। যাতে নির্দেশ রয়েছে যে, সব চেয়ে অধিক কুরআন, সুন্নাহ বা দ্বীন বিষয়ে জ্ঞান রাখে আমল করে। (দেখুন সাবউন সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ১০পৃঃ)।
পরন্তু প্রত্যেক মাইয়্যেতের জন্য পৃথকভাবে পৃথক-পৃথক জানাযাও পড়া যায়। মৌলিক নিয়ম হল এটাই। তাছাড়া উহুদের দিন মহানবী (ﷺ) শহীদদের জানাযা পৃথক-পৃথক ভাবেই পড়েছিলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন হামযা (রাঃ) এর জানাযা পড়ার জন্য দাঁড়ালেন তখন তাঁকে কেবলার দিকে রাখতে আদেশ করলেন। অতঃপর নয় তকবীর দিয়ে তার জানাযা পড়লেন। তারপর অন্যান্য শহীদগণকে তার নিকট আনা হল। এক একজন শহীদকে হামযা (রাঃ) এর পাশে রেখে জানাযা পড়লেন। এভাবে তিনি সকল শহীদগণের সাথে হামযা (রাঃ)-এর উপরও সর্বমোট বাহাত্তর বার জানাযা পড়লেন।” (তাবারানী কাবীর ৩/১০৭-১০৮)
মসজিদের ভিতর জানাযা পড়া বৈধ। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, সা’দ বিন আবী অক্কাসের ইন্তেকাল হলে নবী (ﷺ) এর পত্নীগণ বলে পাঠালেন, যেন তার লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় মসজিদ বেয়ে অতিক্রম করা হয়; যাতে তারা তার উপর জানাযার নামায পড়তে পারেন। সুতরাং লোকেরা তাই করল এবং তাদের হুজরার পাশে লাশ রাখা হলে তারা সকলে জানাযা পড়লেন। অতঃপর তার লাশ নিয়ে লোকেরা মাক্বাইদ (প্রয়োজনে বসা ও ওযুর জন্য নির্ধারিত স্থানে) এর পার্শ্ববর্তী বা-বুল জানাইয’ (জানাযা গেট) দিয়ে বের হয়ে গেল। পরবর্তীকালে নবী (ﷺ) এর পত্নীগণের নিকট খবর পৌছল যে, মসজিদে জানাযা পড়ার দরুন লোকেরা তাদের নিন্দা গাইছে; বলছে, মসজিদে কোন দিন জানাযা প্রবেশ করানো হত না!’ আয়েশা (রাঃ) এর নিকট খবর গেলে তিনি বললেন, ‘লোকেরা এত তাড়াতাড়ি সে বিষয়ে কেন নিন্দা গায়, যে বিষয়ে তাদের মোটেই কোন জ্ঞান নেই?! মসজিদে জানাযা নিয়ে আসার জন্য তারা নিন্দা গায়! অথচ আল্লাহর রসূল (ﷺ) সুহাইল বিন বাইযা ও তার ভায়ের জানাযা মসজিদের ভিতরেই পড়েছেন।” (মুসলিম ৯৭৩নং, তিরমিযী ১৫৪ক, নাসাঈ ১৯৪২ক, প্রমুখ)
তবে আফযাল ও উত্তম হল মসজিদ ছাড়া জানাযার জন্য বিশিষ্ট স্থান। মুসাল্লায় (বা ঈদগাহে - যদি তা কবর স্থানের ধারে বা পথে হয়, তাহলে সেখানে) জানাযার নামায পড়া নবী (ﷺ) এর যুগে জানাযার জন্য বিশিষ্ট মুসাল্লা পরিচিত ছিল। আর আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অধিকাংশ আমলই ছিল এই মুসাল্লায় নামায পড়া।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, একদা ইহুদীরা তাদের একজন (বিবাহিত) পুরুষ ও মহিলাকে ধরে এনে নবী (ﷺ) এর নিকট শাস্তির দাবী করলে তিনি তাদেরকে রজম করে (পাথর ছুঁড়ে) মেরে ফেলতে আদেশ করলেন। সুতরাং তাদেরকে মসজিদের পাশে জানাযার মুসাল্লার নিকট রজম করা হল।” (বুখারী ১২৪৩, ৪১৯০, ৬৭৮৭ক, মুসলিম ৩২১১ক)
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন জাহশ বলেন, একদা আমরা মসজিদের আঙ্গিনায় - যেখানে জানাযা রাখা হয় সেখানে - বসে ছিলাম। আর আল্লাহর রসূল (ﷺ) বসে ছিলেন আমাদের মাঝে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে দৃকপাত করলেন----।' (আহমাদ ২১৪৫৫ ক, হাকেম ২/২৪) আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) যেদিন বাদশা নাজাশী ইন্তেকাল করেন সেদিন তাঁর মৃত্যু-খবর দিলেন এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে মুসাল্লায় বের হয়ে গেলেন। অতঃপর চার তকবীর দিয়ে (গায়েবানা) জানাযা পড়লেন। (বুখারী ১১৬৮ক মুসলিম ১৫৮০ক)
মহিলারা জানাযা নামায পড়তে পারে; তবে মসজিদে। মসজিদের বাইরে কোন স্থানে নয়। যেমন, এর নির্দেশ পূর্বোক্ত আয়েশা (রাঃ)এর হাদীসে রয়েছে।
কবরস্থানে (পুরাতন কবরের উপর কবরস্থান বলে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত জায়গায়), কবরসমূহের মধ্যবর্তী স্থানে অথবা কবরের দিকে মুখ করে বা কবরকে সামনে করে জানাযা পড়া বৈধ ও শুদ্ধ নয়। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) কবরসমূহের মধ্যবর্তী স্থানে জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। (ত্বাবারানীর আউসাত্ব, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৩৬, ইবনে আবী শাইবাহ ২/১৮৫)।
আবু মারসাদ গানাবী বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা কবরের উপরে বসাে না এবং তার দিকে সম্মুখ করে নামায পড়াে না।” (মুসলিম ১৬১৩ তিরমিযী ১৭ ১ক, নাসাঈ ৭৫২প্রমুখ)
অবশ্য এ ক্ষেত্রে যে জানাযা পড়ে নি, তার জন্য কবরস্থ মাইয়্যেতের কবরের উপর জানাযা পড়ার কথা ব্যতিক্রম।
পায়ের জুতা অপবিত্র থাকলে তা খুলে মুসাল্লা থেকে দুরে রাখতে হবে অথবা মাটিতে মেজে-ঘষে তা পবিত্র করে নিতে হবে। পবিত্র সত্ত্বেও জুতা খুলে রেখে নামায পড়তে চাইলে দু পায়ের ফাঁকে রেখে নিতে হবে। ডাইনে অথবা বামে রাখা চলবে না। কারণ, প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যখন কেউ জুতা খুলে রেখে নামায পড়তে চায়, তখন সে যেন জুতা দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেয়। বরং সে যেন তা তার দু পায়ের ফাঁকে রেখে নেয় অথবা পায়ে রেখেই নামায পড়ে।” (আবু দাউদ ৫৫৯, সহীহ আবু দাউদ ৬১০নং)
এ ছাড়া জানাযার নামাযের সময় স্পষ্ট অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকা সত্ত্বেও জুতা খুলে তার উপর দাঁড়িয়ে নামায পড়া বিদআত। (আহকামুল জানাইয অবিদাউহা নং ৭৪)।
মাইয়্যেত পুরুষ হলে ইমাম তার মাথার সােজা এবং মহিলা হলে তার মাঝামাঝি খাড়া হবেন। আবু গালেব খাইয়াত্ব বলেন, একদা আনাস বিন মালেক (রাঃ) এক পুরুষ মাইয়্যেতের জানাযা পড়লেন। আমি সে জামাআতে উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম, তিনি লাশের মাথার নিকট খাড়া হলেন। অতঃপর তা তোলা হলে এক কুরাইশ বা আনসারদের জানাযা পেশ করা হল এবং তাঁর উদ্দেশ্যে বলা হল, হে আবু হামযা! এটা হল অমুকের কন্যা অমুকের জানাযা; এরও নামায পড়ে দিন। সুতরাং তিনি লাশের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে জানাযা পড়লেন। আমাদের উক্ত জামাআতে আলা’ বিন যিয়াদ আদাবীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি পুরুষ ও মহিলার জানাযায় পৃথকরূপে খাড়া হওয়া দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু হামযা! আল্লাহর রসূল (ﷺ) কি পুরুষের জানাযায় আপনি যে জায়গায় দাঁড়ালেন ঐ জায়গাতেই এবং মহিলার জানাযায় যেভাবে দাঁড়ালেন ঐভাবেই দাঁড়াতেন? উত্তরে আনাস (রাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ। অতঃপর আলা’ আমাদের দিকে ফিরে বললেন, 'তোমরা একথা মনে রেখো।' (আবু দাউট ২৭৭৯, তিরমিযী ৯৫৫, ইবনে মাজ্জাহ ১৮৮৩ক, আদ ১২৬৪০ক)
সামুরাহ বিন জুনদুব বলেন, সন্তান প্রসবের পর উম্মে কা’ব মারা গেলে মহানবী (ﷺ) তার জানাযা পড়লেন। তার পিছনে আমিও জানাযা পড়লাম। দেখলাম, আল্লাহর রসূল (ﷺ) তার জানাযা পড়ার উদ্দেশ্যে তার মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ালেন। (বুখারী ৩২০ক, মুসলিম ১৬০২ক, প্রমুখ।
পুরুষ ও মহিলার জানাযা এক সাথে হলে পুরুষের খেয়াল রেখে মাথার দিকে ইমাম দাঁড়াবেন। অবশ্য মহিলার লাশ একটু ডাইনে বাড়িয়ে পুরুষের মাথা তার দেহের মাঝামাঝি করেও দাঁড়াতে পারেন। এ ব্যাপারে উভয় আমল সলফ কর্তৃক বর্ণিত। (ইবনে আবী শাইবাহ ১১৫৫-১১৫৬০নং দ্রষ্টব্য)।
জানাযার নামায পড়ার সময় লাশের মাথা ইমামের ডাইনে (উত্তর দিকে) নাকি বামে (দক্ষিণ দিকে) হবে তার কোন নির্দেশ সুন্নাহতে নেই। এ জন্যই জানাযার ইমামের উচিত, কখনো কখনো লাশের মাথার দিক নিজের বাম দিকে রাখা। যাতে সাধারণ লোক বুঝতে পারে যে, ইমামের ডান দিকে মাথা রাখা ওয়াজেব নয়। কারণ, লোকেরা মনে করে যে, ইমামের ডান দিকে (উত্তর দিকেই) লাশের মাথা হওয়া জরুরী; অথচ এর কোন ভিত্তি নেই।
তবে ডান (উত্তর) দিকে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, কবরে এভাবেই রাখা হয়। আর দাফনের পরে কেউ জানাযা পড়লে লাশের মাথা তার ডাইনে পড়ে। (দেখুন, সাবউনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ১৭ পৃঃ)
বড় সম্মেলন বা ইজতিমায় জানাযা হাজির হলে এবং মাইয়্যেত পুরুষ, শিশু, মহিলা তা সকল উপস্থিত ব্যক্তির জানা অসম্ভব হলে, তা সাধারণভাবে ঘোষণা করা বৈধ হবে। তবে অজান্তে যদি মহিলার ক্ষেত্রে দুআর শব্দে পুংলিঙ্গ ব্যবহার করা হয়, তাহলে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, মহিলা জানা সত্ত্বেও তার জন্য দুআর শব্দে পুংলিঙ্গ ব্যবহার করা যায়; যখন উদ্দেশ্য হয় ‘মাইয়্যেত।
যেহেতু আরবী ভাষায় ‘মাইয়্যেত’ শব্দটি উভয় লিঙ্গ। (ঐ, ১১ পৃঃ) অবশ্য না জেনে সকলের ক্ষেত্রে “আল্লাহুম্মাগফির লিহায়্যিনা---” দুআ ব্যবহার করা যায়।
জানাযা মাটিতে থাকা অবস্থায় লাশের কাছে সর্বদা একজনকে লাশ আগলে থাকতে হবে এমন ধারণা যথাযথ নয়। যেমন জানাযার নামাযের পুর্বে লাশের বাঁধন খুলে দেওয়াও বিধেয় নয়।
জানাযার নামায শুরু করার পূর্বে ইমামের নসীহত করার প্রসঙ্গে কোন দলীল নেই। এই সময় নসীহত বিধেয় নয়। কবর ইত্যাদি প্রস্তুত হতে দেরী হলে সেই অবসরে নসীহত করা যায়। যেমন একদা নবী (ﷺ) সাহাবাদের এক ব্যক্তির জানাযায় বের হয়ে কবর খুঁড়তে দেরী হচ্ছিল বলে সেখানে বসে গেলেন। তাঁর আশে-পাশে সকল সাহাবাগণও নিশ্চুপ, ধীর ও শান্তভাবে বসে গেলেন। তখন মহানবী (ﷺ) এর হাতে একটি কাঠের টুকরা ছিল যদ্বারা তিনি (চিন্তিত ব্যক্তিদের ন্যায়) মাটিতে দাগ কাটছিলেন। অতঃপর তিনি মাথা উঠালেন এবং বললেন, “তোমরা আল্লাহর নিকট কবরের আযাব হতে পানাহ চাও।” তিনি এ কথা দুই কি তিনবার বললেন। তারপর বললেন, মুমিন বান্দা যখন দুনিয়াকে ত্যাগ করতে এবং আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তখন তার নিকট আসমান হতে উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট একদল ফিরিশ্তা আসেন; যাদের চেহারা যেন সূর্যস্বরূপ। তাদের সাথে বেহেশতের কাফনসমুহের একটি কাফন (কাপড়) থাকে এবং বেহেস্তের খোশবুসমূহের এক রকম খোশবু থাকে। তারা তার নিকট হতে দৃষ্টি-সীমার দুরে বসেন। অতঃপর মালাকুল মউত তার নিকটে আসেন এবং তার মাথার নিকটে বসে বলেনঃ 'হে পবিত্র রূহ। (আত্মা)! বের হয়ে এস আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তোষের দিকে।
তখন তার রূহ সেই রকম (সহজ) বের হয়ে আসে; যে রকম (সহজে) মশক হতে পানি বের হয়ে আসে। তখন মালাকুল মাওত তা গ্রহণ করেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও নিজের হাতে রাখেন না বরং ঐ সকল অপেক্ষমাণ ফিরিশতা এসে তা গ্রহণ করেন এবং ঐ কাফন ও ঐ খোশবুতে রাখেন। তখন তা হতে পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমস্ত খোশবু অপেক্ষা উত্তম মিশুকের খোশবু বের হতে থাকে। তা নিয়ে ফিরিশ্তাগণ উপরে উঠতে থাকেন এবং যখনই তারা ফিরিশতাদের মধ্যে কোন ফিরিশতাদলের নিকট পৌছেন তারা জিজ্ঞাসা করেন, এই পবিত্র রূহ (আত্মা) কার?’ তখন তাঁরা দুনিয়াতে তাকে লোকেরা যে সকল উপাধি দ্বারা ভূষিত করত, সে সকলের মধ্যে উত্তম উপাধি দ্বারা ভূষিত করে বলেন, 'এটা অমুকের পুত্র অমুকের রূহ। যতক্ষণ তারা প্রথম আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন (এইরূপ প্রশ্নোত্তর চলতে থাকে।) অতঃপর তারা আসমানের দরজা খুলতে চান, আর অমনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন প্রত্যেক আসমানের সম্মানিত ফিরিশ্তাগণ তাদের পশ্চাদগামী হন তার উপরের আসমান পর্যন্ত। এভাবে তারা সপ্তম আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমার বান্দার ঠিকানা ইল্লিয়্যীন’-এ লিখ এবং তাকে (তার কবরে) জমিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কেননা, আমি তাদেরকে জমিন হতে সৃষ্টি করেছি এবং জমিনের দিকেই তাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করব। অতঃপর জমিন হতে আমি তাদেরকে পুনরায় বের করব (হাশরের মাঠে।)” সুতরাং তার রূহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
অতঃপর তার নিকট দুইজন ফিরিশ্তা আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান। তারপর তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার রব কে?” তখন উত্তরে সে বলে, ‘আমার রব আল্লাহ। অতঃপর জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার দ্বীন কি?” তখন সে বলে, আমার দ্বীন হল ইসলাম। আবার তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের মাঝে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? সে উত্তরে বলে, তিনি হলেন আল্লাহর রসূল (ﷺ)। পুনরায় তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি তা কি করে জানতে পারলে?' সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছিলাম। অতঃপর তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলাম এবং তাঁকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করেছিলাম। তখন আসমানের দিক হতে এক শব্দকারী শব্দ করেন, “আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য বেহেস্তের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে বেহেশতের একটি লেবাস পরিয়ে দাও। এ ছাড়া তার জন্য বেহেস্তের দিকে একটি দরজা খুলে দাও!”
তখন তার প্রতি বেহেস্তের সুখ-শান্তি ও বেহেস্তের খোশবু আসতে থাকে এবং তার জন্য তার কবর দৃষ্টিসীমা বরাবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়।
অতঃপর তার নিকট এক সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট সুবেশী ও সুগন্ধিযুক্ত ব্যক্তি আসে এবং তাকে বলে, তোমাকে সন্তুষ্ট করবে এমন জিনিসের সুসংবাদ গ্রহণ কর। এই দিবসেরই তোমাকে ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল। তখন সে তাকে জিজ্ঞাসা করবে, তুমি কে? তোমার চেহারা তো দেখবার মত চেহারা! তা যেন কল্যাণের বার্তা বহন করে। তখন সে বলে, আমি তোমার নেক আমল; যা তুমি দুনিয়াতে করতে। তখন এ বলে, 'হে আল্লাহ! তাড়াতাড়ি কিয়ামত কায়েম কর। যাতে আমি আমার পরিবার ও সম্পদের দিকে ফিরে যেতে পারি। (অর্থাৎ হুর, গিলমান ও বেহেশ্তী সম্পদ তাড়াতাড়ি পেতে পারি)। কিন্তু কাফের বান্দা, যখন সে দুনিয়া ত্যাগ করতে ও আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন তার নিকট আসমান হতে একদল কালো চেহারাবিশিষ্ট ফিরিশ্যা অবতীর্ণ হন। যাদের সাথে শক্ত চট থাকে। তারা তার নিকট হতে দৃষ্টির সীমার দূরে বসেন। অতঃপর মালাকুল-মাওত আসেন এবং তার মাথার নিকটে বসেন। অতঃপর বলেন, 'হে খবীস রূহ (আত্মা)! বের হয়ে আয় আল্লাহর রোষের দিকে।
এ সময় রূহ ভয়ে তার শরীরে এদিক-সেদিক পালাতে থাকে। তখন মালাকুল মাওত তাকে এমনভাবে টেনে বের করেন, যেমন লোহার গরম শলাকা ভিজে পশম হতে টেনে বের করা হয়। (আর তাতে পশম লেগে থাকে।) তখন তিনি তা গ্রহণ করেন। কিন্তু যখন গ্রহণ করেন মুহূর্ত কালের জন্যও নিজের হাতে রাখেন না। বরং তা অপেক্ষমাণ ফিরিশ্তাগণ তাড়াতাড়ি সেই আত্মাকে দুর্গন্ধময় চটে জড়িয়ে নেন। তখন তা হতে এমন দুর্গন্ধ বের হতে থাকে, যা পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমস্ত গলিত শবদেহের দুর্গন্ধ অপেক্ষা বেশী। তা নিয়ে তারা উঠতে থাকেন। কিন্তু যখনই তারা তা নিয়ে ফিরিশ্তাদের কোন দলের নিকট পৌছেন তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন, এই খবীস রূহ কার?' তখন তারা তাকে দুনিয়াতে যে সকল মন্দ উপাধি দ্বারা ভূষিত করা হত তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মন্দ নামটি দ্বারা ভূষিত করে বলেন, 'অমুকের পুত্র অমুকের।” এইভাবে তাকে প্রথম আসমান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। অতঃপর তার জন্য আসমানের দরজা খুলে দিতে চাওয়া হয়; কিন্তু খুলে দেওয়া হয় না। এ সময় নবী (ﷺ) দুর্গ এর সমর্থনে কুরআনের আয়াতটি পাঠ করলেন,
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ
অর্থাৎ, অবশ্যই যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। এরূপে আমি অপরাধীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সুরা আ'রাফ ৪০ আয়াত)।
তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, “তার ঠিকানা সিজ্জীন’-এ লিখ; জমিনের সর্বনিম্ন স্তরে। সুতরাং তার রূহকে জমিনে খুব জোরে নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় মহানবী (ﷺ) এর সমর্থনে এই আয়াতটি পাঠ করলেন,
وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ
অর্থাৎ, যে আল্লাহর সাথে শরীক করেছে সে যেন আকাশ হতে পড়েছে, অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে অথবা ঝা তাকে বহু দুরে নিক্ষিপ্ত করেছে।
সুতরাং তার রূহ তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন তার নিকট দুইজন ফিরিশ্তা আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান। অতঃপর তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার পরওয়ারদেগার কে?' সে বলে, 'হায়, হায়, আমি তো জানি না।
অতঃপর জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার দ্বীন কি? সে বলে, 'হায়, হায়, আমি তো জানি না। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, “তোমাদের মধ্যে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? সে বলে, 'হায়, হায় আমি তাও তো জানি না।
এ সময় আকাশের দিক হতে আকাশ বাণী হয় (এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন), সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য দোযখের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং দোযখের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। সুতরাং তার দিকে দোযখের উত্তাপ ও লু আসতে থাকে এবং তার কবর তার প্রতি এত সংকুচিত হয়ে যায়, যাতে তার এক দিকের পাঁজরের হাড় অপর দিকে ঢুকে যায়। এ সময় তার নিকট একটা অতি কুৎসিত চেহারাবিশিষ্ট নোংরাবেশী দুর্গন্ধযুক্ত লোক আসে এবং বলে, তোমাকে দুঃখিত করবে এমন জিনিসের দুঃসংবাদ গ্রহণ কর! এই দিবস সম্পর্কেই (দুনিয়াতে) তোমাকে ওয়াদা দেওয়া হত। তখন সে জিজ্ঞাসা করে, 'তুমি কে? কি কুৎসিত তোমার চেহারা; যা মন্দ সংবাদ বহন করে। সে বলে, আমি তোমার সেই বদ আমল; যা তুমি দুনিয়াতে করতে। তখন সে বলে, 'আল্লাহ, কিয়ামত কায়েম করো। (নচেৎ তখন আমার উপায় থাকবে না।) (আহমদ ৪/২৮৭-২৮৮, আবুদাউদ ৪৭৫৩নং)
অনুরূপভাবে আরো একবার তিনি কোন মাইয়্যেত দাফন করার সময় বাকী’তে বসে উপবিষ্ট সাহাবাগণের উদ্দেশ্যে হাদীস বর্ণনা করে বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার জান্নাত অথবা জাহান্নামের ঠিকানা নির্দিষ্টভাবে লিখিত হয়নি---।” (বুখারী ৬৯৯৭, মুসলিম ৪৭৮৬)
কিন্তু এই সময় তিনি কখনো দাঁড়িয়ে খুতবাহ বা বক্তৃতা দেননি বরং স্বাভাবিকভাবে বৈঠকে যেমন কথা বলা হয় তেমনি বলেছিলেন। পরন্তু তিনি সর্বদা এরূপ করতেন না বরং দাফন-কার্যে বিলম্ব থাকলে বসে কথা বলতেন।
অতএব যদি কোন মাইয়্যেতের লাশ কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে দাফন-কার্যে দেরী হলে ইমাম বা কোন আলেম ব্যক্তি নবী (ﷺ) এর অনুরূপ কথা কথাচ্ছলে বলতে পারেন। এমন বলা সুন্নত। দন্ডামান হয়ে বক্তৃতাচ্ছলে নয়। কারণ এখানে খুতবাহ সুন্নত বা নবী (ﷺ) এর তরীকা নয়। (দেখুন সাবউন সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ২৬পৃঃ)
তদনুরূপ উক্ত সময়ে মাইয়্যেতের অভিভাবক, ওয়ারেস বা কোন প্রতিনিধি অথবা ইমামের জন্য উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মাইয়্যেতকে খালাস দিতে (ক্ষমা করতে) অনুরোধ জানানো বিধেয় নয়। বরং একাজ বিদআত। সুতরাং সকলের উদ্দেশ্যে একথা বলা যাবে না যে, আপনারা সকলে ওকে খালাস দিন। ওকে মাফ করে দিন--- ইত্যাদি। কারণ, তার সাথে যদি উপস্থিত জনসাধারণের কারো লেন-দেন না থেকে থাকে, তাহলে তো তাদের কারো মনে কিছু থাকার কথা নয়। পক্ষান্তরে যার সাথে লেন-দেন ছিল তার ওয়াজেব হক যদি জীবিতকালে আদায় করে থাকে, তাহলে তারও মনে কোন দাবী থাকার কথা নয়। আর যদি জীবিতকালে তার ওয়াজেব হক আদায় না করে থাকে, তাহলে সে মাইয়্যেতকে করতেও পারে। আবার মুখে মাফ করে মনে মনে তার দাবীও রাখতে পারে অথবা একেবারেই মাফ নাও করতে পারে। পরন্তু নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি লোকেদের মাল (ঋণ) নিয়ে আদায় করার ইচ্ছা রাখে, আল্লাহ তার তরফ থেকে আদায় করে দেন। আর যে ব্যক্তি তা নিয়ে আত্মসাৎ করার ইচ্ছা করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন।” (বুখারী ২২১২ক, ইবনে মাজাহ ২৮০২ক, সাবউন সুলান ৩৫ পৃঃ)।
তাছাড়া আর্থিক অধিকার হলে ওয়ারেসদের জন্য তা আদায় করা ওয়াজেব। যেমন তার ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করাও জরুরী। যদি তার অর্থ বা ওয়ারেস কেউ না থাকে, তবে জীবিতকালে তার আদায়ের নিয়ত থেকে থাকলে আল্লাহ নিজের তরফ থেকে তা আদায় মাফ করার ওয়াদা করেছেন।
সকলের খেয়াল রাখা উচিত, যেন লোকে লাশের উপর ভিড় না জমায়। বিশেষ করে মহিলার লাশ হলে তার বিশেষ মর্যাদার খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য।
পক্ষান্তরে ভয়ে বা অন্য কারণে লাশের কাছ ঘেঁসতে বা সামনে পড়তে দ্বিধা করা এবং কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা করা যথার্থ নয়। বরং তা এক প্রকার কুসংস্কার ও মেয়েলী ধারণা মাত্র।
দাফন করার পূর্বে জানাযা নিয়ে কোন ওলীর কবর, আযার বা আস্তানা দর্শন বা তওয়াফ করা বিদআত ও শির্ক। (আহকামুল জানাইয ২০৫পৃঃ)