এক সঙ্গে একই শ্রেণীর মাইয়্যেত জমায়েত হলে ইমামের কাছাকাছি সেই ব্যক্তিকে রাখা হবে যে অধিক (শুদ্ধভাবে) কুরআন পাঠকারী (হিফযকারী) এবং অধিক দ্বীনদার। কারণ নবী করীম (ﷺ) উহুদের শহীদদেরকে কবরস্থ করার সময় সেই ব্যক্তিকে সর্বাগ্রে কবরে রাখতে আদেশ করেছিলেন, যে ব্যক্তি অধিক কুরআন পাঠকারী (হিফযকারী)। যাতে নির্দেশ রয়েছে যে, সব চেয়ে অধিক কুরআন, সুন্নাহ বা দ্বীন বিষয়ে জ্ঞান রাখে আমল করে। (দেখুন সাবউন সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ১০পৃঃ)।
পরন্তু প্রত্যেক মাইয়্যেতের জন্য পৃথকভাবে পৃথক-পৃথক জানাযাও পড়া যায়। মৌলিক নিয়ম হল এটাই। তাছাড়া উহুদের দিন মহানবী (ﷺ) শহীদদের জানাযা পৃথক-পৃথক ভাবেই পড়েছিলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন হামযা (রাঃ) এর জানাযা পড়ার জন্য দাঁড়ালেন তখন তাঁকে কেবলার দিকে রাখতে আদেশ করলেন। অতঃপর নয় তকবীর দিয়ে তার জানাযা পড়লেন। তারপর অন্যান্য শহীদগণকে তার নিকট আনা হল। এক একজন শহীদকে হামযা (রাঃ) এর পাশে রেখে জানাযা পড়লেন। এভাবে তিনি সকল শহীদগণের সাথে হামযা (রাঃ)-এর উপরও সর্বমোট বাহাত্তর বার জানাযা পড়লেন।” (তাবারানী কাবীর ৩/১০৭-১০৮)
মসজিদের ভিতর জানাযা পড়া বৈধ। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, সা’দ বিন আবী অক্কাসের ইন্তেকাল হলে নবী (ﷺ) এর পত্নীগণ বলে পাঠালেন, যেন তার লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় মসজিদ বেয়ে অতিক্রম করা হয়; যাতে তারা তার উপর জানাযার নামায পড়তে পারেন। সুতরাং লোকেরা তাই করল এবং তাদের হুজরার পাশে লাশ রাখা হলে তারা সকলে জানাযা পড়লেন। অতঃপর তার লাশ নিয়ে লোকেরা মাক্বাইদ (প্রয়োজনে বসা ও ওযুর জন্য নির্ধারিত স্থানে) এর পার্শ্ববর্তী বা-বুল জানাইয’ (জানাযা গেট) দিয়ে বের হয়ে গেল। পরবর্তীকালে নবী (ﷺ) এর পত্নীগণের নিকট খবর পৌছল যে, মসজিদে জানাযা পড়ার দরুন লোকেরা তাদের নিন্দা গাইছে; বলছে, মসজিদে কোন দিন জানাযা প্রবেশ করানো হত না!’ আয়েশা (রাঃ) এর নিকট খবর গেলে তিনি বললেন, ‘লোকেরা এত তাড়াতাড়ি সে বিষয়ে কেন নিন্দা গায়, যে বিষয়ে তাদের মোটেই কোন জ্ঞান নেই?! মসজিদে জানাযা নিয়ে আসার জন্য তারা নিন্দা গায়! অথচ আল্লাহর রসূল (ﷺ) সুহাইল বিন বাইযা ও তার ভায়ের জানাযা মসজিদের ভিতরেই পড়েছেন।” (মুসলিম ৯৭৩নং, তিরমিযী ১৫৪ক, নাসাঈ ১৯৪২ক, প্রমুখ)
তবে আফযাল ও উত্তম হল মসজিদ ছাড়া জানাযার জন্য বিশিষ্ট স্থান। মুসাল্লায় (বা ঈদগাহে - যদি তা কবর স্থানের ধারে বা পথে হয়, তাহলে সেখানে) জানাযার নামায পড়া নবী (ﷺ) এর যুগে জানাযার জন্য বিশিষ্ট মুসাল্লা পরিচিত ছিল। আর আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অধিকাংশ আমলই ছিল এই মুসাল্লায় নামায পড়া।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, একদা ইহুদীরা তাদের একজন (বিবাহিত) পুরুষ ও মহিলাকে ধরে এনে নবী (ﷺ) এর নিকট শাস্তির দাবী করলে তিনি তাদেরকে রজম করে (পাথর ছুঁড়ে) মেরে ফেলতে আদেশ করলেন। সুতরাং তাদেরকে মসজিদের পাশে জানাযার মুসাল্লার নিকট রজম করা হল।” (বুখারী ১২৪৩, ৪১৯০, ৬৭৮৭ক, মুসলিম ৩২১১ক)
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন জাহশ বলেন, একদা আমরা মসজিদের আঙ্গিনায় - যেখানে জানাযা রাখা হয় সেখানে - বসে ছিলাম। আর আল্লাহর রসূল (ﷺ) বসে ছিলেন আমাদের মাঝে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে দৃকপাত করলেন----।' (আহমাদ ২১৪৫৫ ক, হাকেম ২/২৪) আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) যেদিন বাদশা নাজাশী ইন্তেকাল করেন সেদিন তাঁর মৃত্যু-খবর দিলেন এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে মুসাল্লায় বের হয়ে গেলেন। অতঃপর চার তকবীর দিয়ে (গায়েবানা) জানাযা পড়লেন। (বুখারী ১১৬৮ক মুসলিম ১৫৮০ক)
মহিলারা জানাযা নামায পড়তে পারে; তবে মসজিদে। মসজিদের বাইরে কোন স্থানে নয়। যেমন, এর নির্দেশ পূর্বোক্ত আয়েশা (রাঃ)এর হাদীসে রয়েছে।
কবরস্থানে (পুরাতন কবরের উপর কবরস্থান বলে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত জায়গায়), কবরসমূহের মধ্যবর্তী স্থানে অথবা কবরের দিকে মুখ করে বা কবরকে সামনে করে জানাযা পড়া বৈধ ও শুদ্ধ নয়। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) কবরসমূহের মধ্যবর্তী স্থানে জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। (ত্বাবারানীর আউসাত্ব, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৩৬, ইবনে আবী শাইবাহ ২/১৮৫)।
আবু মারসাদ গানাবী বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা কবরের উপরে বসাে না এবং তার দিকে সম্মুখ করে নামায পড়াে না।” (মুসলিম ১৬১৩ তিরমিযী ১৭ ১ক, নাসাঈ ৭৫২প্রমুখ)
অবশ্য এ ক্ষেত্রে যে জানাযা পড়ে নি, তার জন্য কবরস্থ মাইয়্যেতের কবরের উপর জানাযা পড়ার কথা ব্যতিক্রম।
পায়ের জুতা অপবিত্র থাকলে তা খুলে মুসাল্লা থেকে দুরে রাখতে হবে অথবা মাটিতে মেজে-ঘষে তা পবিত্র করে নিতে হবে। পবিত্র সত্ত্বেও জুতা খুলে রেখে নামায পড়তে চাইলে দু পায়ের ফাঁকে রেখে নিতে হবে। ডাইনে অথবা বামে রাখা চলবে না। কারণ, প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যখন কেউ জুতা খুলে রেখে নামায পড়তে চায়, তখন সে যেন জুতা দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেয়। বরং সে যেন তা তার দু পায়ের ফাঁকে রেখে নেয় অথবা পায়ে রেখেই নামায পড়ে।” (আবু দাউদ ৫৫৯, সহীহ আবু দাউদ ৬১০নং)
এ ছাড়া জানাযার নামাযের সময় স্পষ্ট অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকা সত্ত্বেও জুতা খুলে তার উপর দাঁড়িয়ে নামায পড়া বিদআত। (আহকামুল জানাইয অবিদাউহা নং ৭৪)।
মাইয়্যেত পুরুষ হলে ইমাম তার মাথার সােজা এবং মহিলা হলে তার মাঝামাঝি খাড়া হবেন। আবু গালেব খাইয়াত্ব বলেন, একদা আনাস বিন মালেক (রাঃ) এক পুরুষ মাইয়্যেতের জানাযা পড়লেন। আমি সে জামাআতে উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম, তিনি লাশের মাথার নিকট খাড়া হলেন। অতঃপর তা তোলা হলে এক কুরাইশ বা আনসারদের জানাযা পেশ করা হল এবং তাঁর উদ্দেশ্যে বলা হল, হে আবু হামযা! এটা হল অমুকের কন্যা অমুকের জানাযা; এরও নামায পড়ে দিন। সুতরাং তিনি লাশের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে জানাযা পড়লেন। আমাদের উক্ত জামাআতে আলা’ বিন যিয়াদ আদাবীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি পুরুষ ও মহিলার জানাযায় পৃথকরূপে খাড়া হওয়া দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু হামযা! আল্লাহর রসূল (ﷺ) কি পুরুষের জানাযায় আপনি যে জায়গায় দাঁড়ালেন ঐ জায়গাতেই এবং মহিলার জানাযায় যেভাবে দাঁড়ালেন ঐভাবেই দাঁড়াতেন? উত্তরে আনাস (রাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ। অতঃপর আলা’ আমাদের দিকে ফিরে বললেন, 'তোমরা একথা মনে রেখো।' (আবু দাউট ২৭৭৯, তিরমিযী ৯৫৫, ইবনে মাজ্জাহ ১৮৮৩ক, আদ ১২৬৪০ক)
সামুরাহ বিন জুনদুব বলেন, সন্তান প্রসবের পর উম্মে কা’ব মারা গেলে মহানবী (ﷺ) তার জানাযা পড়লেন। তার পিছনে আমিও জানাযা পড়লাম। দেখলাম, আল্লাহর রসূল (ﷺ) তার জানাযা পড়ার উদ্দেশ্যে তার মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ালেন। (বুখারী ৩২০ক, মুসলিম ১৬০২ক, প্রমুখ।
পুরুষ ও মহিলার জানাযা এক সাথে হলে পুরুষের খেয়াল রেখে মাথার দিকে ইমাম দাঁড়াবেন। অবশ্য মহিলার লাশ একটু ডাইনে বাড়িয়ে পুরুষের মাথা তার দেহের মাঝামাঝি করেও দাঁড়াতে পারেন। এ ব্যাপারে উভয় আমল সলফ কর্তৃক বর্ণিত। (ইবনে আবী শাইবাহ ১১৫৫-১১৫৬০নং দ্রষ্টব্য)।
জানাযার নামায পড়ার সময় লাশের মাথা ইমামের ডাইনে (উত্তর দিকে) নাকি বামে (দক্ষিণ দিকে) হবে তার কোন নির্দেশ সুন্নাহতে নেই। এ জন্যই জানাযার ইমামের উচিত, কখনো কখনো লাশের মাথার দিক নিজের বাম দিকে রাখা। যাতে সাধারণ লোক বুঝতে পারে যে, ইমামের ডান দিকে মাথা রাখা ওয়াজেব নয়। কারণ, লোকেরা মনে করে যে, ইমামের ডান দিকে (উত্তর দিকেই) লাশের মাথা হওয়া জরুরী; অথচ এর কোন ভিত্তি নেই।
তবে ডান (উত্তর) দিকে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, কবরে এভাবেই রাখা হয়। আর দাফনের পরে কেউ জানাযা পড়লে লাশের মাথা তার ডাইনে পড়ে। (দেখুন, সাবউনা সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ১৭ পৃঃ)
বড় সম্মেলন বা ইজতিমায় জানাযা হাজির হলে এবং মাইয়্যেত পুরুষ, শিশু, মহিলা তা সকল উপস্থিত ব্যক্তির জানা অসম্ভব হলে, তা সাধারণভাবে ঘোষণা করা বৈধ হবে। তবে অজান্তে যদি মহিলার ক্ষেত্রে দুআর শব্দে পুংলিঙ্গ ব্যবহার করা হয়, তাহলে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, মহিলা জানা সত্ত্বেও তার জন্য দুআর শব্দে পুংলিঙ্গ ব্যবহার করা যায়; যখন উদ্দেশ্য হয় ‘মাইয়্যেত।
যেহেতু আরবী ভাষায় ‘মাইয়্যেত’ শব্দটি উভয় লিঙ্গ। (ঐ, ১১ পৃঃ) অবশ্য না জেনে সকলের ক্ষেত্রে “আল্লাহুম্মাগফির লিহায়্যিনা---” দুআ ব্যবহার করা যায়।
জানাযা মাটিতে থাকা অবস্থায় লাশের কাছে সর্বদা একজনকে লাশ আগলে থাকতে হবে এমন ধারণা যথাযথ নয়। যেমন জানাযার নামাযের পুর্বে লাশের বাঁধন খুলে দেওয়াও বিধেয় নয়।
জানাযার নামায শুরু করার পূর্বে ইমামের নসীহত করার প্রসঙ্গে কোন দলীল নেই। এই সময় নসীহত বিধেয় নয়। কবর ইত্যাদি প্রস্তুত হতে দেরী হলে সেই অবসরে নসীহত করা যায়। যেমন একদা নবী (ﷺ) সাহাবাদের এক ব্যক্তির জানাযায় বের হয়ে কবর খুঁড়তে দেরী হচ্ছিল বলে সেখানে বসে গেলেন। তাঁর আশে-পাশে সকল সাহাবাগণও নিশ্চুপ, ধীর ও শান্তভাবে বসে গেলেন। তখন মহানবী (ﷺ) এর হাতে একটি কাঠের টুকরা ছিল যদ্বারা তিনি (চিন্তিত ব্যক্তিদের ন্যায়) মাটিতে দাগ কাটছিলেন। অতঃপর তিনি মাথা উঠালেন এবং বললেন, “তোমরা আল্লাহর নিকট কবরের আযাব হতে পানাহ চাও।” তিনি এ কথা দুই কি তিনবার বললেন। তারপর বললেন, মুমিন বান্দা যখন দুনিয়াকে ত্যাগ করতে এবং আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তখন তার নিকট আসমান হতে উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট একদল ফিরিশ্তা আসেন; যাদের চেহারা যেন সূর্যস্বরূপ। তাদের সাথে বেহেশতের কাফনসমুহের একটি কাফন (কাপড়) থাকে এবং বেহেস্তের খোশবুসমূহের এক রকম খোশবু থাকে। তারা তার নিকট হতে দৃষ্টি-সীমার দুরে বসেন। অতঃপর মালাকুল মউত তার নিকটে আসেন এবং তার মাথার নিকটে বসে বলেনঃ 'হে পবিত্র রূহ। (আত্মা)! বের হয়ে এস আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তোষের দিকে।
তখন তার রূহ সেই রকম (সহজ) বের হয়ে আসে; যে রকম (সহজে) মশক হতে পানি বের হয়ে আসে। তখন মালাকুল মাওত তা গ্রহণ করেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও নিজের হাতে রাখেন না বরং ঐ সকল অপেক্ষমাণ ফিরিশতা এসে তা গ্রহণ করেন এবং ঐ কাফন ও ঐ খোশবুতে রাখেন। তখন তা হতে পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমস্ত খোশবু অপেক্ষা উত্তম মিশুকের খোশবু বের হতে থাকে। তা নিয়ে ফিরিশ্তাগণ উপরে উঠতে থাকেন এবং যখনই তারা ফিরিশতাদের মধ্যে কোন ফিরিশতাদলের নিকট পৌছেন তারা জিজ্ঞাসা করেন, এই পবিত্র রূহ (আত্মা) কার?’ তখন তাঁরা দুনিয়াতে তাকে লোকেরা যে সকল উপাধি দ্বারা ভূষিত করত, সে সকলের মধ্যে উত্তম উপাধি দ্বারা ভূষিত করে বলেন, 'এটা অমুকের পুত্র অমুকের রূহ। যতক্ষণ তারা প্রথম আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন (এইরূপ প্রশ্নোত্তর চলতে থাকে।) অতঃপর তারা আসমানের দরজা খুলতে চান, আর অমনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন প্রত্যেক আসমানের সম্মানিত ফিরিশ্তাগণ তাদের পশ্চাদগামী হন তার উপরের আসমান পর্যন্ত। এভাবে তারা সপ্তম আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমার বান্দার ঠিকানা ইল্লিয়্যীন’-এ লিখ এবং তাকে (তার কবরে) জমিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কেননা, আমি তাদেরকে জমিন হতে সৃষ্টি করেছি এবং জমিনের দিকেই তাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করব। অতঃপর জমিন হতে আমি তাদেরকে পুনরায় বের করব (হাশরের মাঠে।)” সুতরাং তার রূহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
অতঃপর তার নিকট দুইজন ফিরিশ্তা আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান। তারপর তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার রব কে?” তখন উত্তরে সে বলে, ‘আমার রব আল্লাহ। অতঃপর জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার দ্বীন কি?” তখন সে বলে, আমার দ্বীন হল ইসলাম। আবার তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের মাঝে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? সে উত্তরে বলে, তিনি হলেন আল্লাহর রসূল (ﷺ)। পুনরায় তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি তা কি করে জানতে পারলে?' সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছিলাম। অতঃপর তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলাম এবং তাঁকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করেছিলাম। তখন আসমানের দিক হতে এক শব্দকারী শব্দ করেন, “আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য বেহেস্তের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে বেহেশতের একটি লেবাস পরিয়ে দাও। এ ছাড়া তার জন্য বেহেস্তের দিকে একটি দরজা খুলে দাও!”
তখন তার প্রতি বেহেস্তের সুখ-শান্তি ও বেহেস্তের খোশবু আসতে থাকে এবং তার জন্য তার কবর দৃষ্টিসীমা বরাবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়।
অতঃপর তার নিকট এক সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট সুবেশী ও সুগন্ধিযুক্ত ব্যক্তি আসে এবং তাকে বলে, তোমাকে সন্তুষ্ট করবে এমন জিনিসের সুসংবাদ গ্রহণ কর। এই দিবসেরই তোমাকে ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল। তখন সে তাকে জিজ্ঞাসা করবে, তুমি কে? তোমার চেহারা তো দেখবার মত চেহারা! তা যেন কল্যাণের বার্তা বহন করে। তখন সে বলে, আমি তোমার নেক আমল; যা তুমি দুনিয়াতে করতে। তখন এ বলে, 'হে আল্লাহ! তাড়াতাড়ি কিয়ামত কায়েম কর। যাতে আমি আমার পরিবার ও সম্পদের দিকে ফিরে যেতে পারি। (অর্থাৎ হুর, গিলমান ও বেহেশ্তী সম্পদ তাড়াতাড়ি পেতে পারি)। কিন্তু কাফের বান্দা, যখন সে দুনিয়া ত্যাগ করতে ও আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন তার নিকট আসমান হতে একদল কালো চেহারাবিশিষ্ট ফিরিশ্যা অবতীর্ণ হন। যাদের সাথে শক্ত চট থাকে। তারা তার নিকট হতে দৃষ্টির সীমার দূরে বসেন। অতঃপর মালাকুল-মাওত আসেন এবং তার মাথার নিকটে বসেন। অতঃপর বলেন, 'হে খবীস রূহ (আত্মা)! বের হয়ে আয় আল্লাহর রোষের দিকে।
এ সময় রূহ ভয়ে তার শরীরে এদিক-সেদিক পালাতে থাকে। তখন মালাকুল মাওত তাকে এমনভাবে টেনে বের করেন, যেমন লোহার গরম শলাকা ভিজে পশম হতে টেনে বের করা হয়। (আর তাতে পশম লেগে থাকে।) তখন তিনি তা গ্রহণ করেন। কিন্তু যখন গ্রহণ করেন মুহূর্ত কালের জন্যও নিজের হাতে রাখেন না। বরং তা অপেক্ষমাণ ফিরিশ্তাগণ তাড়াতাড়ি সেই আত্মাকে দুর্গন্ধময় চটে জড়িয়ে নেন। তখন তা হতে এমন দুর্গন্ধ বের হতে থাকে, যা পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমস্ত গলিত শবদেহের দুর্গন্ধ অপেক্ষা বেশী। তা নিয়ে তারা উঠতে থাকেন। কিন্তু যখনই তারা তা নিয়ে ফিরিশ্তাদের কোন দলের নিকট পৌছেন তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন, এই খবীস রূহ কার?' তখন তারা তাকে দুনিয়াতে যে সকল মন্দ উপাধি দ্বারা ভূষিত করা হত তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মন্দ নামটি দ্বারা ভূষিত করে বলেন, 'অমুকের পুত্র অমুকের।” এইভাবে তাকে প্রথম আসমান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। অতঃপর তার জন্য আসমানের দরজা খুলে দিতে চাওয়া হয়; কিন্তু খুলে দেওয়া হয় না। এ সময় নবী (ﷺ) দুর্গ এর সমর্থনে কুরআনের আয়াতটি পাঠ করলেন,
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ
অর্থাৎ, অবশ্যই যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। এরূপে আমি অপরাধীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সুরা আ'রাফ ৪০ আয়াত)।
তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, “তার ঠিকানা সিজ্জীন’-এ লিখ; জমিনের সর্বনিম্ন স্তরে। সুতরাং তার রূহকে জমিনে খুব জোরে নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় মহানবী (ﷺ) এর সমর্থনে এই আয়াতটি পাঠ করলেন,
وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ
অর্থাৎ, যে আল্লাহর সাথে শরীক করেছে সে যেন আকাশ হতে পড়েছে, অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে অথবা ঝা তাকে বহু দুরে নিক্ষিপ্ত করেছে।
সুতরাং তার রূহ তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন তার নিকট দুইজন ফিরিশ্তা আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান। অতঃপর তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার পরওয়ারদেগার কে?' সে বলে, 'হায়, হায়, আমি তো জানি না।
অতঃপর জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার দ্বীন কি? সে বলে, 'হায়, হায়, আমি তো জানি না। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, “তোমাদের মধ্যে যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? সে বলে, 'হায়, হায় আমি তাও তো জানি না।
এ সময় আকাশের দিক হতে আকাশ বাণী হয় (এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন), সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য দোযখের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং দোযখের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। সুতরাং তার দিকে দোযখের উত্তাপ ও লু আসতে থাকে এবং তার কবর তার প্রতি এত সংকুচিত হয়ে যায়, যাতে তার এক দিকের পাঁজরের হাড় অপর দিকে ঢুকে যায়। এ সময় তার নিকট একটা অতি কুৎসিত চেহারাবিশিষ্ট নোংরাবেশী দুর্গন্ধযুক্ত লোক আসে এবং বলে, তোমাকে দুঃখিত করবে এমন জিনিসের দুঃসংবাদ গ্রহণ কর! এই দিবস সম্পর্কেই (দুনিয়াতে) তোমাকে ওয়াদা দেওয়া হত। তখন সে জিজ্ঞাসা করে, 'তুমি কে? কি কুৎসিত তোমার চেহারা; যা মন্দ সংবাদ বহন করে। সে বলে, আমি তোমার সেই বদ আমল; যা তুমি দুনিয়াতে করতে। তখন সে বলে, 'আল্লাহ, কিয়ামত কায়েম করো। (নচেৎ তখন আমার উপায় থাকবে না।) (আহমদ ৪/২৮৭-২৮৮, আবুদাউদ ৪৭৫৩নং)
অনুরূপভাবে আরো একবার তিনি কোন মাইয়্যেত দাফন করার সময় বাকী’তে বসে উপবিষ্ট সাহাবাগণের উদ্দেশ্যে হাদীস বর্ণনা করে বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার জান্নাত অথবা জাহান্নামের ঠিকানা নির্দিষ্টভাবে লিখিত হয়নি---।” (বুখারী ৬৯৯৭, মুসলিম ৪৭৮৬)
কিন্তু এই সময় তিনি কখনো দাঁড়িয়ে খুতবাহ বা বক্তৃতা দেননি বরং স্বাভাবিকভাবে বৈঠকে যেমন কথা বলা হয় তেমনি বলেছিলেন। পরন্তু তিনি সর্বদা এরূপ করতেন না বরং দাফন-কার্যে বিলম্ব থাকলে বসে কথা বলতেন।
অতএব যদি কোন মাইয়্যেতের লাশ কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে দাফন-কার্যে দেরী হলে ইমাম বা কোন আলেম ব্যক্তি নবী (ﷺ) এর অনুরূপ কথা কথাচ্ছলে বলতে পারেন। এমন বলা সুন্নত। দন্ডামান হয়ে বক্তৃতাচ্ছলে নয়। কারণ এখানে খুতবাহ সুন্নত বা নবী (ﷺ) এর তরীকা নয়। (দেখুন সাবউন সুআলান ফী আহকামিল জানাইয ২৬পৃঃ)
তদনুরূপ উক্ত সময়ে মাইয়্যেতের অভিভাবক, ওয়ারেস বা কোন প্রতিনিধি অথবা ইমামের জন্য উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মাইয়্যেতকে খালাস দিতে (ক্ষমা করতে) অনুরোধ জানানো বিধেয় নয়। বরং একাজ বিদআত। সুতরাং সকলের উদ্দেশ্যে একথা বলা যাবে না যে, আপনারা সকলে ওকে খালাস দিন। ওকে মাফ করে দিন--- ইত্যাদি। কারণ, তার সাথে যদি উপস্থিত জনসাধারণের কারো লেন-দেন না থেকে থাকে, তাহলে তো তাদের কারো মনে কিছু থাকার কথা নয়। পক্ষান্তরে যার সাথে লেন-দেন ছিল তার ওয়াজেব হক যদি জীবিতকালে আদায় করে থাকে, তাহলে তারও মনে কোন দাবী থাকার কথা নয়। আর যদি জীবিতকালে তার ওয়াজেব হক আদায় না করে থাকে, তাহলে সে মাইয়্যেতকে করতেও পারে। আবার মুখে মাফ করে মনে মনে তার দাবীও রাখতে পারে অথবা একেবারেই মাফ নাও করতে পারে। পরন্তু নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি লোকেদের মাল (ঋণ) নিয়ে আদায় করার ইচ্ছা রাখে, আল্লাহ তার তরফ থেকে আদায় করে দেন। আর যে ব্যক্তি তা নিয়ে আত্মসাৎ করার ইচ্ছা করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন।” (বুখারী ২২১২ক, ইবনে মাজাহ ২৮০২ক, সাবউন সুলান ৩৫ পৃঃ)।
তাছাড়া আর্থিক অধিকার হলে ওয়ারেসদের জন্য তা আদায় করা ওয়াজেব। যেমন তার ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করাও জরুরী। যদি তার অর্থ বা ওয়ারেস কেউ না থাকে, তবে জীবিতকালে তার আদায়ের নিয়ত থেকে থাকলে আল্লাহ নিজের তরফ থেকে তা আদায় মাফ করার ওয়াদা করেছেন।
সকলের খেয়াল রাখা উচিত, যেন লোকে লাশের উপর ভিড় না জমায়। বিশেষ করে মহিলার লাশ হলে তার বিশেষ মর্যাদার খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য।
পক্ষান্তরে ভয়ে বা অন্য কারণে লাশের কাছ ঘেঁসতে বা সামনে পড়তে দ্বিধা করা এবং কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা করা যথার্থ নয়। বরং তা এক প্রকার কুসংস্কার ও মেয়েলী ধারণা মাত্র।
দাফন করার পূর্বে জানাযা নিয়ে কোন ওলীর কবর, আযার বা আস্তানা দর্শন বা তওয়াফ করা বিদআত ও শির্ক। (আহকামুল জানাইয ২০৫পৃঃ)