যে ব্যক্তি তাওহীদের দাবী পূরণ করবে, সে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে - ১

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ বিনা হিসাবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কোন শাস্তি দিবেন না। হাদীছে এ রকমই বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটি সামনে আসছে। তাওহীদের দাবী পূরণ করার অর্থ হচ্ছে শির্ক-বিদআতের কদর্যতা হতে তাওহীদকে মুক্ত রাখা এবং গুনাহ্র উপর স্থির না থাকা। যার অবস্থা এমন হবে অর্থাৎ শির্ক বর্জন করবে এবং সকল পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে, সেই কেবল তাওহীদের দাবী পূরণ করতে সক্ষম হবে। উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে এ ধরণের লোক খুব কমই পাওয়া যাবে, যারা খাঁটি ঈমানদার, তাদের মধ্যেই তাওহীদের দাবীসমূহ পূরণকারী লোক পাওয়া যাবে। আল্লাহ্ তাআলা সকল সৃষ্টির মধ্য হতে তাদেরকে চয়ন করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইউসুফের ২৪ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ

‘‘নিশ্চয়ই মহিলা তার বিষয়ে চিন্তা করেছিল এবং সেও মহিলার বিষয়ে চিন্তা করেছিল। যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করতো। এমনিভাবে আমি তার কাছ থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি আমার মনোনীত বান্দাদের একজন’’। ইসলামের প্রথম যুগে খাঁটি ঈমানদারদের সংখ্যা ছিল প্রচুর। শেষ যামানায় এদের সংখ্যা কম হয়ে গেছে। তারপরও এরা আল্লাহ্ তাআলার নিকট বিরাট সম্মানের অধিকারী। আল্লাহ্ তাআলা ইবরাহীম খলীল (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘অতঃপর সূর্যকে চক্চক্ করতে দেখে বললঃ এটি আমার প্রতিপালক, এটি বৃহত্তর। অতঃপর যখন তা ডুবে গেল, তখন বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত। আমি একনিষ্ঠ হয়ে স্বীয় চেহারা ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। (সূরা আনআমঃ ৭৮-৭৯) অর্থাৎ আমার দ্বীন ও এবাদতকে ঐ সত্তার জন্য একনিষ্ঠ ও নিবেদিত করছি, যিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং পূর্বের কোন নমুনা ছাড়াই তা তৈরী করেছেন।

হানীফ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ অভিমূখী। হানীফ অবস্থায় তথা শির্ক ছেড়ে দিয়ে পূর্ণরূপে তাওহীদের দিকে ঝুকে পড়েছি। এ জন্যই তিনি বলেছেন وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘‘আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। কুরআন মজীদে এই ধরণের অসংখ্য আয়াত রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নিসার ১২৫ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَنْ أَحْسَنُ دِيناً مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لله وَهُوَ مُحْسِنٌ واتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفاً وَاتَّخَذَ اللّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلاً

‘‘যে আল্লাহ্‌র নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করে, যিনি একনিষ্ঠ হানীফ ছিলেন, তার চেয়ে উত্তম দ্বীন কার? আল্লাহ্ ইবরাহীমকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন’’। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى

‘‘যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করে, সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে। সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহ্‌র দিকে’’। (সূরা লুকমানঃ ২২)

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ এখানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, যে আল্লাহ্ তাআলার জন্য আমলকে খালেস করতঃ তাঁর আদেশাবলীর সামনে মস্তক অবনত করে এবং তাঁর শরীয়তের আনুগত্য করে। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ وهو محسن অর্থাৎ আমল, আনুগত্য, আদেশাবলীর বাস্তবায়ন এবং নিষেধাবলী থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে সে মুখলিস তথা একনিষ্ঠ। সুতরাং এই আয়াতে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে যে, শির্ক বর্জন, শির্ক ও শির্ককারীদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমেই কেবল বান্দার তাওহীদ পূর্ণতা লাভ করে। পূর্বের অধ্যায়ে এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেনঃ

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মত এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না’’। (সূরা নাহলঃ ১২০)

.....................................................

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা এখানে তাঁর একনিষ্ঠ বান্দাদের ইমাম ও রাসূল ইবরাহীম খলীল (আঃ)এর প্রশংসা করছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন, তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না, ইহুদ-নাসারা এবং অগ্নিপূজকদেরও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। এখানে উম্মত[1] বলতে এমন নেতা উদ্দেশ্য যার অনুসরণ করা হয়। আয়াতে বর্ণিত قانت অর্থ হচ্ছে বিনয়ী এবং অনুগত। হানীফ অর্থ শির্ক বর্জন করে তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘‘তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না’’। প্রখ্যাত মুফাস্সির মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ ইবরাহীম একটি উম্মত ছিলেন- এ কথার অর্থ হচ্ছে, সে সময় তিনি একাই ছিলেন মুমিন এবং অন্যান্য সকল মানুষই ছিল কাফের-মুশরিক।

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আমি মনে করি উভয় কথাই সঠিক। ইবরাহীম খলীল (আঃ) সে রকমই ছিলেন। তিনি ছিলেন একাই একটি উম্মত এবং অনুসরণীয় নেতা। মুজাহিদের কথার তাৎপর্য হল, দাওয়াত, নবুওয়াত ও রিসালাতের শুরুর দিকে ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন একমাত্র মুমিন। মুশরিকদের থেকে আলাদা হওয়ার কারণে সে সময় আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা মারইয়ামের ৪১-৪২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقاً نَّبِيّاً إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنكَ شَيْئاً

‘‘তুমি এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী নবী। যখন তিনি তার পিতাকে বললেনঃ হে আমার পিতা! যে শুনেনা, দেখেনা এবং তোমার কোন উপকারে আসেনা, তার এবাদত কেন কর? আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ

وَإِنَّ مِن شِيعَتِهِ لَإِبْرَاهِيمَ إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

‘‘আর নূহ-এর দলেরই একজন ছিলেন ইবরাহীম। যখন সে তার পালনকর্তার নিকট বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন’’। (সূরা আস্ সাফফাতঃ ৮৩-৮৪) এই আয়াতসমূহে ইবরাহীম (আঃ)এর দাওয়াতের প্রাথমিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। সে সময় তিনি ব্যতীত পৃথিবীতে অন্য কোন মুমিন ছিলনা। সহীহ হাদীছ দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত।

وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন নাঃ অর্থাৎ তিনি অন্তর, জবান এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে মুশরিকদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তারা আল্লাহর এবাদতে যে সমস্ত বস্ত্তকে শরীক করত, সেগুলোর সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন, মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেছেন এবং আল্লাহর রাস্তায় যেসব নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে সবর করেছেন। আর এভাবেই তিনি দ্বীনের মূল বুনিয়াদ ও তাওহীদের দাবী পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। সূরা বাকারার ১৩১ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘স্মরণ করো, যখন তাকে তার প্রতিপালক বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম’’। যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে এবং মুসলিম হওয়ার দাবী করে, তাদের অধিকাংশই আল্লাহর এবাদতে অন্যদেরকে শরীক করে এবং মৃত ও অনুপস্থিত অলী-আওলীয়া, তাগুত, জিন এবং অন্যান্য এমন বস্ত্তকে আহবান করে, যা মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ করার মালিক নয়। শুধু তাই নয়, তারা এগুলোকে ভালোবাসে, বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে, তাদেরকে ভয় করে, তাদের কাছে কল্যাণ কামনা করে এবং যারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করে ও আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত বর্জন করার আহবান জানায় তাদের বিরোধীতা করে। তারা তাওহীদপন্থীদের দাওয়াতকে বিদআত ও গোমরাহী মনে করে, যারা তাওহীদের উপর আমল করে, তাওহীদকে ভালবাসে, শির্কের প্রতিবাদ করে এবং শির্ককে ঘৃণা করে তারা তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে। বিদআতীদের কোন কোন লোক তাওহীদের ইল্মকে ইলম বলেই স্বীকৃতি দেয়না এবং মূর্খরা তাওহীদের প্রতি মনেপ্রাণে ভালবাসা পোষণ না করার কারণে এদিকে ফিরেও তাকায় না। এ সব বিষয়ের অবসানের জন্য আমরা আল্লাহর আশ্রয় চাই।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ هُمْ مِنْ خَشْيَةِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآيَاتِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُونَ وَالَّذِينَ هُمْ بِرَبِّهِمْ لا يُشْرِكُونَ

‘‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত, যারা তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে, আর যারা তাদের রবের সাথে শিরক করেনা’’। (সূরা মুমিনুনঃ ৫৭-৫৯)

....................................................................

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ নেক ও সৎ আমল করার পরও তারা আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কের মধ্যে থাকে এবং আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ভীত থাকে। হাসান বসরী[2] (রঃ) বলেনঃ মুমিন হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে নেক আমল করার সাথে সাথে আল্লাহ্কে ভয় করে। আর মুনাফিক হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে পাপ কাজ করে এবং নির্ভয়ে থাকে। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেঃ এ দ্বারা সৃষ্টি ও শরীয়তের নিদর্শন উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ্ তাআলা মারইয়াম (আঃ) সম্পর্কে সূরা তাহরীমের ১২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنَ الْقَانِتِينَ

‘‘তিনি তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাবকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি ছিলেন বিনয়ীদের অন্তর্ভূক্ত’’। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, তাঁর যে সন্তান হয়েছিল তা আল্লাহর সৃষ্টিগত নির্ধারণ ও ফয়সালা অনুপাতেই হয়েছিল। আল্লাহর শরীয়তে যে সমস্ত আদেশ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হওয়া তিনি পছন্দ করেন। আর যে সমস্ত নিষেধ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হওয়াকে তিনি ঘৃণা ও অপছন্দ করেন। আর দয়াময় আল্লাহর শরীয়তে যে সমস্ত খবর রয়েছে তা সত্য।

আর যারা তাদের রবের সাথে শির্ক করেনাঃ অর্থাৎ তারা আল্লাহর এবাদতে অন্যকে শরীক করেনা; বরং তারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করে এবং বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক এবং অমূখাপেক্ষী। তিনি কোনো স্ত্রী ও সন্তান গ্রহণ করেন নি। তার সমকক্ষ কেউ নেই।

ব্যাখ্যাকারী বলেনঃ আমি বলছি, শির্ক বর্জন করা ব্যতীত তাওহীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা, এর যথাযথ পরিচয় লাভ করা, তাওহীদের প্রতি ভালবাসা, তাওহীদকে কবুল করে নেওয়া এবং তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ

‘‘বলোঃ আমাকে এরূপ আদেশই দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন আল্লাহ্‌র এবাদত করি এবং তার সাথে যেন কাউকে অংশীদার না করি’’। আমি তার দিকেই দাওয়াত দেই এবং তার কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা রা’দঃ ৩৬) এই আয়াতে পূর্ণাঙ্গ তাওহীদের বিবরণ দেয়া হয়েছে। আমরা আল্লাহর কাছে এই পরিপূর্ণ তাওহীদ বাস্তবায়নের তাওফীক চাচ্ছি।

হুসাইন বিন আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ

كُنْتُ عِنْدَ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ فَقَالَ أَيُّكُمْ رَأَى الْكَوْكَبَ الَّذِى انْقَضَّ الْبَارِحَةَ قُلْتُ أَنَا ثُمَّ قُلْتُ أَمَا إِنِّى لَمْ أَكُنْ فِى صَلاَةٍ وَلَكِنِّى لُدِغْتُ.قَالَ فَمَاذَا صَنَعْتَ قُلْتُ اسْتَرْقَيْتُ قَالَ فَمَا حَمَلَكَ عَلَى ذَلِكَ قُلْتُ حَدِيثٌ حَدَّثَنَاهُ الشَّعْبِىُّ فَقَالَ وَمَا حَدَّثَكُمُ الشَّعْبِىُّ قُلْتُ حَدَّثَنَا عَنْ بُرَيْدَةَ بْنِ حُصَيْبٍ الأَسْلَمِىِّ أَنَّهُ قَالَ لاَ رُقْيَةَ إِلاَّ مِنْ عَيْنٍ أَوْ حُمَةٍ فَقَالَ قَدْ أَحْسَنَ مَنِ انْتَهَى إِلَى مَا سَمِعَ وَلَكِنْ حَدَّثَنَا ابْنُ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ «عُرِضَتْ عَلَىَّ الأُمَمُ فَرَأَيْتُ النَّبِىَّ وَمَعَهُ الرُّهَيْطُ وَالنَّبِىَّ وَمَعَهُ الرَّجُلُ وَالرَّجُلاَنِ وَالنَّبِىَّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ إِذْ رُفِعَ لِى سَوَادٌ عَظِيمٌ فَظَنَنْتُ أَنَّهُمْ أُمَّتِى فَقِيلَ لِى هَذَا مُوسَى صلى الله عليه وسلم وَقَوْمُهُ وَلَكِنِ انْظُرْ إِلَى الأُفُقِ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ فَقِيلَ لِى انْظُرْ إِلَى الأُفُقِ الآخَرِ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ فَقِيلَ لِى هَذِهِ أُمَّتُكَ وَمَعَهُمْ سَبْعُونَ أَلْفًا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَلاَ عَذَابٍ» ثُمَّ نَهَضَ فَدَخَلَ مَنْزِلَهُ فَخَاضَ النَّاسُ فِى أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَلاَ عَذَابٍ فَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمُ الَّذِينَ صَحِبُوا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمُ الَّذِينَ وُلِدُوا فِى الإِسْلاَمِ وَلَمْ يُشْرِكُوا بِاللَّهِ. وَذَكَرُوا أَشْيَاءَ فَخَرَجَ عَلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ «مَا الَّذِى تَخُوضُونَ فِيهِ ». فَأَخْبَرُوهُ فَقَالَ « هُمُ الَّذِينَ لاَ يَرْقُونَ وَلاَ يَسْتَرْقُونَ وَلاَ يَتَطَيَّرُونَ وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ» فَقَامَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ «أَنْتَ مِنْهُمْ» ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ آخَرُ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ «سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ»

‘‘একবার আমি সাঈদ বিন জুবাইরের কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, গতকাল রাত্রে যে নক্ষত্রটি ছিটকে পড়েছিল তা তোমাদের মধ্য হতে কে দেখতে পেয়েছ? তখন বললাম, আমি। তবে আমি নামাযরত ছিলামনা। তারপর আমি বললাম, আমি বিষাক্ত প্রাণী কর্তৃক দংশিত হয়েছিলাম। তিনি বললেনঃ তুমি কি চিকিৎসা করেছো? আমি বললাম ঝাড় ফুঁক করেছি। তিনি বললেন, কিসে তোমাকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? আমি বললাম, একটি হাদিছ আমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে যা শা’বী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। তিনি বললেন, তিনি তোমাদেরকে কী বর্ণনা করেছেন? আমি বললাম তিনি বুরাইদা বিন হুসাইব থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, বদ নযর এবং বিষাক্ত পোঁকার কামড় ব্যতীত অন্য কোন রোগে ঝাড়-ফুঁক নেই। তিনি বললেন, ‘সে ব্যক্তিই উত্তম কাজ করেছে, যে শ্রুত কথা অনুযায়ী আমল করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে’। কিন্তু ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার সম্মুখে সমস্ত জাতিকে উপস্থাপন করা হল। তখন এমন নবীকে দেখতে পেলাম, যার সাথে অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে। এমন নবীকেও দেখতে পেলাম, যার সাথে মাত্র একজন বা দুইজন লোক রয়েছে। আবার এমন নবীকেও দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেই। এমন সময় আমার সামনে বিরাট একটি জামাআত পেশ করা হল। আমি তখন ভাবলামঃ এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল, এরা হচ্ছে মূসা (আঃ) এবং তাঁর উম্মত।

এরপর আরো একটি বিরাট জামাআতের দিকে আমি তাকালাম। তখন আমাকে বলা হল, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তর হাজার লোক রয়েছে, যারা বিনা হিসেবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ কথা বলে তিনি উঠে বাড়ীর অভ্যন্তরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা ঐ সব ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করল। কেউ বললঃ তারা বোধ হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচার্য লাভকারী ব্যক্তিগণ। আবার কেউ বললঃ তারা বোধ হয় সেই সব লোক, যারা মুসলিম মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি। তারা এ ধরনের আরো অনেক কথা বলাবলি করল। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে উপস্থিত হলে বিষয়টি তাঁকে জানানো হল। তিনি তখন বললেনঃ

«هم الذين لا يسترقون ولا يتطيرون ولا يكتون وعلى ربهم يتوكلون»

‘‘তারা হচ্ছে ঐসব লোক যারা ঝাড়-ফুক করেনা। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করেনা। শরীরে ছেঁকা বা দাগ দেয় না। আর তাদের রবের উপর তারা ভরসা করে’’। এ কথা শুনে উক্কাশা বিন মিহসান দাড়িয়ে বলল, আপনি আমার জন্য দুআ করুন যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভূক্ত করে নেন। তিনি বললেনঃ তুমি তাদের দলভুক্ত। অতঃপর অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে বললঃ আল্লাহর কাছে আমার জন্যও দুআ করুন তিনি যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তিনি বললেনঃ তোমার পূর্বেই উক্কাশা সে সুযোগ নিয়ে গেছে’’।[3]

..............................................................

ব্যাখ্যাঃ তবে আমি নামাযরত ছিলামনাঃ এখানে সালাফদের সতর্কতার প্রমাণ পাওয়া যায়। শ্রোতাগণ যেন এটি না বুঝেন যে, তিনি রাতে নামাযের জন্য ঘুম থেকে উঠেছিলেন, তাই তিনি এ কথাটি বলেছিলেন। বিষয়টি খোলাসা না করলে এমন সম্ভাবনা রয়ে যেত যে, তিনি নিজের জন্য এমন কাজ করার দাবী করছেন, যা তিনি করেন নি। এতে সাহাবী ও তাবেঈদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার শির্ক থেকে দূরে থাকার প্রমাণ রয়েছে। তাদের কেউ এমন আমল দ্বারা প্রশংসিত হতে পছন্দ করতেন না, যা তিনি করেন নি।

বদ নযর এবং বিষাক্ত পোঁকার কামড় ব্যতীত অন্য কোন রোগে ঝাড়-ফুঁক নেইঃ এটি ছিল ইসলামের প্রথম দিকে। পরবর্তীতে অন্যান্য বিষয়েও ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি দেয়া হয়, যদি তা কুরআনের আয়াত, সহীহ হাদীছ এবং শির্কমুক্ত দুআ দ্বারা করা হয়।

যে ব্যক্তি শ্রুত বিষয় অনুযায়ী আমল করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে সে উত্তম কাজই করেছেঃ এই বাক্যে ইল্ম ও আহলে ইল্মদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। যে কেউ কোন আমল করবে, তার কাছে সেই আমলের দলীল চাওয়া হবে। আরও জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তিনি এ ব্যাপারে দলীলের আশ্রয় নিয়েছেন কি না? যার সাথে কোন শরঈ দলীল পাওয়া যাবেনা, তার সেই আমলে কোন অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবেনা। এ জন্যই ইবনু আব্দিল বার্ (রঃ) বলেছেনঃ আলেমগণ একমত হয়েছেন যে, মুকাল্লিদ[4] আলেম নয়। ইবনু আব্দিল বার্ (রঃ)এর কথাটি ভালভাবে অনুধাবন করা উচিৎ।

আমার সামনে অনেক উম্মত পেশ করা হলঃ এর ব্যাখ্যায় শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহই ভাল জানেন, কখন পেশ করা হয়েছিল? তবে আমাদের জানা মতে পেশ করার অর্থ হল, কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত নবী ও তাদের অনুসারীগণ উপস্থিত হবে, তখন যে সমস্ত উম্মত হাজির হবে, আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে সেই পরিমাণ উম্মত দেখিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নাজাত পাবে, সে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং নবীদের সাথে প্রেরিত দ্বীন ও শরীয়তের অনুসরণের কারণে তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা, তিনি ছাড়া অন্যের এবাদত বর্জন করার কারণে, আল্লাহর হুকুম মান্য করার কারণে এবং তাঁর নিষেধ থেকে বিরত থাকার কারণেই নাজাত পাবে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নূহের ২ ও ৩ নং আয়াতে বলেনঃ

قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُّبِينٌ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ

‘‘তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্যে স্পষ্ট সতর্ককারী। এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য করো’’। এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার মাধ্যমেই আল্লাহর তাওহীদ বাস্তবায়ন হয়ে থাকে, তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন এবং তাঁর নিষেধ হতে দূরে থাকার মাধ্যমেই তাকওয়া অর্জিত হয়। সেই সঙ্গে তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা জরুরী। এটিই হচ্ছে দ্বীন। দ্বীনের মূল কথা হচ্ছে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত করা যাবেনা, তাঁর শরীয়ত অনুযায়ীই তাঁর এবাদত করা হবে, চাই আদেশসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হোক কিংবা নিষেধ থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে হোক এবং নিজের ইচ্ছা ও পছন্দের উপর রাসূলের আনুগত্যকে প্রাধান্য দিবে।

আবার এমন নবীকেও দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেইঃ অর্থাৎ যে জাতির কাছে তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদের মধ্য হতে একজনও ঈমান আনয়ন করেনি। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হিজরের ১০ ও ১১ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ فِي شِيَعِ الأَوَّلِينَ وَمَا يَأْتِيهِم مِّن رَّسُولٍ إِلاَّ كَانُواْ بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ

‘‘আমি তোমার আগে পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি। তবে ওদের কাছে এমন কোন রাসূল আসেনি, যাদের সাথে ওরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেনি’’। উপরোক্ত হাদীছ থেকে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রত্যেক যামানাতেই নাজাত প্রাপ্ত লোকের সংখ্যা কম হয়ে থাকে। অধিকাংশের মধ্যেই মানবীয় স্বভাব প্রবল হওয়ার কারণে রাসূলদের বিরোধীতা করে ধ্বংস হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللّهِ

‘‘আর তুমি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নাও, তবে তারা তোমাকে আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে’’। (সূরা আনআমঃ ১১৬) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَا وَجَدْنَا لأَكْثَرِهِم مِّنْ عَهْدٍ وَإِن وَجَدْنَا أَكْثَرَهُمْ لَفَاسِقِينَ

‘‘আর তাদের অধিকাংশ লোককেই আমি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারীরূপে পাইনি; বরং তাদের অধিকাংশকেই পেয়েছি ফাসেক’’। (সূরা আরাফঃ ১০২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ

‘‘বলোঃ তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে’’। (সূরা রোমঃ ৪২) কুরআনে এ ধরণের আরো অনেক আয়াত রয়েছে।[5] জাহান্নাম থেকে নাজাতপ্রাপ্ত দলের লোকের সংখ্যা খুব অল্প হলেও তাদের জামআতটি বড় হবে। তারা হবে মর্যাদার দিক দিয়ে আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বড়। যদিও তারা সংখ্যায় খুব কম। সুতরাং সংখ্যাধিক্য দেখে যেন কেউ বিভ্রান্ত না হয়। অধিক সংখ্যক লোকের অনুসরণ করতে গিয়ে জ্ঞান চর্চার দাবীদার কতিপয় লোকও বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা দ্বীনি বিষয়ে এমন এমন বিশ্বাস পোষণ করতে লাগল, যেরূপ বিশ্বাস করে থাকে মূর্খ ও গোমরাহ লোকেরা। এ বিষয়ে তারা কুরআন ও সুন্নাতের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি।

[1] - কুরআন ও হাদীছে উম্মত শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (১) একদল মানুষ। এ কথার দলীল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ

وَلَمَّا وَرَدَ مَاءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِنَ النَّاسِ يَسْقُونَ وَوَجَدَ مِنْ دُونِهِمُ امْرَأتَيْنِ تَذُودَانِ قَالَ مَا خَطْبُكُمَا قَالَتَا لَا نَسْقِي حَتَّى يُصْدِرَ الرِّعَاءُ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ

‘‘যখন তিনি মাদইয়ানের কুপের ধারে পৌঁছলেন, তখন কুপের কাছে একটি উম্মতকে (একদল লোককে) পেলেন তারা তাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাচ্ছিল এবং তাদের পশ্চাতে দু’জন স্ত্রীলোককে দেখলেন তারা তাদের জন্তুগুলোকে আগলিয়ে রাখছিল। তিনি বললেন, তোমাদের কী ব্যাপার? তারা বলল, আমরা আমাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাতে পারিনা, যে পর্যন্ত রাখালরা তাদের জন্তুগুলোকে নিয়ে সরে না যায়। আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ। (সূরা কাসাসঃ ২৩)

২) উম্মত শব্দটি নির্দিষ্ট একটি সময়ের অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَقَالَ الَّذِي نَجَا مِنْهُمَا وَادَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ أَنَا أُنَبِّئُكُمْ بِتَأْوِيلِهِ فَأَرْسِلُونِ

‘‘দু’জন কারাবন্দির মধ্য থেকে যে মুক্তি পেয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পর স্মরণ হলে সে বলল, আমি তোমাদেরকে এর ব্যাখ্যা বলছি। তোমরা আমাকে প্রেরণ করো’’। (সূরা ইউসূফঃ ৪৫)

৩) কতিপয় মুফাসসিরের মতে উম্মত শব্দটি আবার কখনো দ্বীন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ

‘‘তোমাদের এই উম্মত (দ্বীন) আসলে একই উম্মত এবং আমি তোমাদের প্রতিপালক। অতএব তোমরা কেবল আমারই এবাদত করো’’।

৪) দ্বীনে হানীফের অনুসারী এবং বুদ্ধিতে পরিপক্ক মাত্র একজন লোককেও উম্মত বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একই একটি পরিপূর্ণ উম্মত, সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহ্‌রই অনুগত এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না’’। (সূরা নাহলঃ ১২০)

অর্থাৎ তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মতের সমান। যখন দুনিয়ায় কোন মুসলমান ছিলনা তখন একদিকে তিনি একাই ছিলেন ইসলামের পতাকাবাহী এবং অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানুষ ছিল কুফুরীর পতাকাবাহী। আল্লাহর এই একক বান্দা তখন এমন কাজ করলেন, যা করার জন্য একটি উম্মতের প্রয়োজন ছিল। সেই হিসাবে তিনি একজন ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।

[2] - তিনি হচ্ছেন আবু সাঈদ হাসান বিন হাসান ইয়াসার আলবসরী। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ, এবাদত গুজার এবং আখেরাতমুখী। ১১০ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। বিস্তারিত দেখুনঃ ( العبر 1/103، النهاية 9/278)

[3] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ এই উম্মতের একদল মুসলিমের বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ।

[4] - التقليد (তাকলীদ)শব্দ হতে মুকাল্লিদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। শরীয়তের মাসায়েলের ক্ষেত্রে দলীল না জেনেই চোখ বন্ধ করে অন্যের অনুসরণ করাকে তাকলীদ বলা হয়। সুতরাং বিনা দলীলে কারো কথা মেনে নেওয়া ইসলামে বৈধ নয়। আলেমদের উচিৎ দলীল সহকারে শরীয়তের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করা। আর সাধারণ মুসলমানদের উচিৎ দলীল জেনেই কারো অনুসরণ করা। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[5] - যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ ‘‘আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ’’। (সূরা সাবাঃ ১৩) আল্লাহ তাআলা সূরা ইউসূফের ১০৩ নং আয়াতে আরো বলেনঃ وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ‘‘তুমি যতই চাও, অধিকাংশ লোক বিশ্বাসকারী নয়’’।
যে ব্যক্তি তাওহীদের দাবী পূরণ করবে, সে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে - ২

এমন সময় আমার সামনে এক বিরাট জামাআত পেশ করা হল। তখন আমি ভাবলাম, এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হলো, এরা হচ্ছে মূসা (আঃ) এবং তাঁর জাতিঃ এখানে বনী ইসরাঈলের ঐ সমস্ত লোকের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যারা মূসা (আঃ) এর প্রতি, অন্যান্য নবী-রাসূলের প্রতি এবং তাওরাত, ইঞ্জিল, যবুর এবং ফুরকানসহ অন্যান্য আসমানি কিতাবের উপর ঈমান আনয়ন করেছিল। দলে দলে বিভক্ত হওয়ার পূর্বে বনী ইসরাঈলের লোক সংখ্যা অনেক ছিল। তাদের মধ্যে অনেক নবীও ছিলেন। অতঃপর ইহুদীরা নানা অপকর্মে লিপ্ত হল। এ হাদীছটি প্রমাণ করে যে, মুসা (আঃ)এর অনুসারীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। আল্লাহ্ তাআলা সূরা যাছিয়ার ১৬ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلَقَدْ آتَيْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ

‘‘আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওয়াত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে উৎকৃষ্ট রিযিক দিয়েছিলাম এবং বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম’’। অর্থাৎ তাদের যামানায় তাদেরকে অন্যান্য জাতির উপর প্রাধান্য দিয়েছিলাম। কেননা তাদের যামানায় এবং তাদের পূর্বে অসংখ্য লোক কুফুরী করেছিল। তাদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। যেমন জালুত, বখতে নসর এবং তাদের ন্যায় অন্যান্যরা। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা বনী ইসরাঈলকে ঈমানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এর মাধ্যমেই তারা সমসাময়িক লোকদের তুলনায় অধিক সম্মানিত হয়েছিল। অতঃপর তাদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল, যার বিবরণ আল্লাহ্ তাআলা সূরা বাকারা এবং অন্যান্য সূরাতে প্রদান করেছেন। অর্থাৎ তারা নবীদের নাফরমানী করেছিল এবং দ্বীন নিয়ে মতবিরোধ করেছিল। আল্লাহ্ তাআলা এই কথা আলোচনা করে ঐ সমস্ত ইহুদীদের প্রতিবাদ করেছেন, যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কুফরী করেছিল। সম্মানিত পাঠকগণের উচিৎ ইহুদীদের ঐ সমস্ত অবস্থা নিয়ে চিন্তা করা, যা মতবিরোধে লিপ্ত হওয়ার পর তাদের উপর আপতিত হয়েছিল।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি উপরের দিকে মাথা উঠিয়ে একটি বড় জামাআতকে দেখতে পেলাম। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সংখ্যাধিক্যের কারণে দলটি আকাশের দিগন্তকে ভরে দিয়েছিল। আমাকে বলা হল এটি আপনার উম্মত। তাদের মধ্যে রয়েছে সত্তর হাজার লোক। তারা বিনা আযাবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবেঃ এই হাদীছে উম্মতে মুহাম্মাদীর ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যে সমস্ত উম্মত নবীদের অনুসরণ করেছে, তার মধ্যে উম্মতে মুহাম্মাদীর সংখ্যাই হবে সর্বাধিক। সাহাবায়ে কেরাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং তাদের পরবর্তী যুগেই মুসলমানদের সংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে গ্রাম, শহর এবং ময়দান ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছিল। জ্ঞান চর্চা ও বিভিন্ন উপকারী শিল্পকর্মে তারা উন্নতি সাধন করেছিল। উপরোক্ত তিনটি সম্মানিত যামানার লোকজন কিতাব ও সুন্নাতের উপর কায়েম ছিল। কিন্তু আখেরী যামানায় জ্ঞানী ও বিজ্ঞ মুসলমানদের সংখ্যা খুব কম হয়ে গিয়েছে। আমাদের সম্মানিত শাইখ এ ক্ষেত্রে বলেনঃ এই হাদীছ দ্বারা উম্মাতে মুহাম্মাদীর ফযীলত প্রমাণিত হয়। কাইফিয়াত ও কাম্মিয়াত (মান ও পরিমাণ) উভয় দিক থেকেই উম্মতে মুহাম্মাদী ফযীলতময়। তাদের সংখ্যা হবে অত্যাধিক এবং তাদের বৈশিষ্ট-গুণাবলীও হবে উত্তম। উপরের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে সত্তর হাজার লোক। তারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

অতঃপর তিনি উঠে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর সাহাবীগণ ঐ সত্তর হাজার লোক সম্পর্কে আলোচনা শুরু করল।

এই হাদীছে ইল্মে দ্বীন চর্চায় সাহাবীদের সুউচ্চ মর্যাদা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ বুঝতে ও তার প্রতি আমল করতে তাদের আগ্রহের প্রমাণ রয়েছে। এতে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কোন বিষয়ে দলীল পাওয়া না গেলে ইজতেহাদ করা জায়েয আছে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরে প্রবেশের পর তারা ইজতেহাদ করে অনেক কথাই বলেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কোন প্রতিবাদ করেন নি। তবে কথা হচ্ছে, মুজতাহিদের নিকট যদি কোন দলীল না থাকে, তাহলে তার মতকে নিশ্চিতভাবে সঠিক বলা জায়েয নেই। তার এভাবে বলা উচিৎ যে, সম্ভবত হুকুমটি হবে এ রকম এ রকম। যেমন সাহাবীগণ এই হাদীছের ক্ষেত্রে বলেছিলেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকট বের হয়ে এসে বললেনঃ তারা হচ্ছে ঐসব লোক যারা ঝাড়-ফুঁক করেনা, পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করেনা এবং লোহা গরম করে শরীরে উহা দ্বারা দাগ দেয় না। বরং তারা তাদের রবের উপর ভরসা করেঃ অর্থাৎ তারা কারো নিকট গিয়ে ঝাড়-ফুঁক করার আবেদন জানায়না এবং তাদের শরীরে যদি এমন কোন রোগ থাকে, যা দাগ দেয়া ব্যতীত ভাল হওয়ার নয়, তারপরও তারা নিজেদের শরীরে দাগ লাগায় না। তারা পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করেনা। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করা শির্ক। তাই তারা এ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকে। সেই সঙ্গে তারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য অপরের নিকট আবেদন করেনা। ঝাড়-ফুঁক বা অন্য যে কোনো প্রয়োজনই হোক না কেন। আরোগ্যের জন্য হলেও তারা শরীরে দাগ লাগায় না। আল্লাহর উপর তাদের মজবুত ভরসা এবং তাদের সকল-কাজকর্ম আল্লাহর নিকট সোপর্দ করার কারণেই তারা এরূপ করেন। আল্লাহ্ তাআলা তাদের নসীবে যা কিছু রেখেছেন এবং তাদের জন্য যা কিছু নির্ধারণ করেছেন, সে বিষয়ে তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দ্বারস্থ হয়না। সুতরাং তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও কাছে কিছুই কামনা করেন না, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেন না। তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন, যে রোগ বা অন্য কোন মসীবত তাদের নিকট আপতিত হয়েছে, তা কেবল আল্লাহর নির্ধারণ ও ইচ্ছা অনুযায়ীই হয়েছে। সুতরাং ক্ষতি ও অকল্যাণ দূর করার জন্য তারা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট গমণ করেনা। আল্লাহ্ তাআলা ইয়াকুব (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

‘‘আমি তো আমার দুঃখ ও দুর্দশার অভিযোগ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছে করছিনা এবং আমি আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে এমন কিছু জানি, যা তোমরা জান না’’। (সূরা ইউসুফঃ ৮৬)

উক্কাশা বিন মিহসান[6] দাড়িয়ে বলল, আপনি আমার জন্য দুআ করুন। আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভূক্ত করে নেনঃ এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, জীবিত ব্যক্তি কর্তৃক কারো জন্য শাফাআত করার অর্থ হল, যার কাছে দুআ করার আবেদন করা হবে, তিনি শাফাআত প্রার্থনাকারীর জন্য দুআ করবেন। আর মৃত কোন কারও জন্য সুপারিশ করতে অক্ষম। জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিকট এর কারণগুলো মোটেই অস্পষ্ট নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি মৃত কিংবা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে কিছু প্রার্থনা করল, সে তার কাছে এমন জিনিষ প্রার্থনা করল, যার মালিক সে নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট এমন জিনিষ প্রার্থনা করল, যার মালিক একমাত্র আল্লাহ্, সে তাকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করল। মক্কার মুশরিকদের কাজ এ রকমই ছিল। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

فَلاَ تَجْعَلُواْ لِلّهِ أَندَاداً وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

‘‘অতএব তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ করোনা’’। (সূরা বাকারাঃ ২২) অর্থাৎ তোমরা অবগত আছ যে, তিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রভু। তিনি তোমাদেরকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নেয়ামত দান করেছেন। সুতরাং তোমরা তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যের দিকে মনোনিবেশ করোনা। বরং একনিষ্ঠভাবে সকল এবাদত তাঁর জন্যই সম্পাদন করো। কম বা বেশী যা কিছু চাও, কেবল আল্লাহর কাছেই চাও।

তুমি তাদের অন্তর্ভূক্তঃ এ কথা বলার কারণ এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উকাশার ঈমান, ফযীলত এবং জিহাদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আল্লাহ্ তাআলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই তিনি বলেছেনঃ তোমাদের যা ইচ্ছা করতে পার। আল্লাহ্ তাআলা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

অন্য একজন দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন, তিনি যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ এ ব্যাপারে উক্কাশা তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছেঃ এ কথা দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য লোকদের জন্য এই পথ বন্ধ করতে চেয়েছেন। যাতে একের পর এক লোকেরা এই আবেদন করতে না থাকে যে, আমার জন্য দুআ করুন, আল্লাহ্ যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সম্ভবতঃ এমন ব্যক্তিও একই আবেদন করে ফেলবে, যার উপযুক্ত সে নয়। উপরোক্ত উক্তির দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) তাওহীদের ব্যাপারে মানুষের বিভিন্ন স্তর থাকার কথা জানা গেল।

২) নবী ইবরাহীম (আঃ) মুশরিক ছিলেন না বলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা।

৩) তাওহীদের দাবী পূর্ণ করার তাৎপর্য কী, তা জানা গেল।

৪) বড় বড় আওলীয়ায়ে কেরাম শির্ক থেকে মুক্ত ছিলেন বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জবানে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা।

৫) ঝাড়-ফুঁক থেকে বিরত থাকা এবং ছেঁকা গ্রহণ পরিত্যাগ করা তাওহীদপন্থী হওয়ার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

৬) আল্লাহর উপর ভরসাই বান্দার মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলীর সমাবেশ ঘটায়।

৭) বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারী সৌভাগ্যবান লোকেরা কোন আমল ব্যতীত উক্ত মর্যাদা লাভ করেন নি, এটা জানার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের জ্ঞানের গভীরতা।

৮) কল্যাণ অর্জনের প্রতি তাঁদের অপরিসীম আগ্রহ।

৯) সংখ্যা ও গুণাবলীর দিক থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল।

১০) নবী মূসা (আঃ) এর উম্মতের মর্যাদা।

১১) সব উম্মতকে তাদের নবীসহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।

১২) প্রত্যেক উম্মতই নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথকভাবে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে।

১৩) খুব অল্প সংখ্যক লোকই নবীগণের আহবানে সাড়া দিয়েছিল।

১৪) যে নবীর দাওয়াত কেউ গ্রহণ করেনি তিনি একাই হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন।

১৫) এ জ্ঞানের শিক্ষা হচ্ছে, সংখ্যাধিক্যের দ্বারা ধোঁকা না খাওয়া আবার সংখ্যাল্পতার কারণে অবহেলা না করা।

১৬) বদনযর লাগা এবং বিষাক্ত কীট-পতঙ্গের কামড়ের চিকিৎসার জন্য ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি পাওয়া গেল।

১৭) সালাফে সালেহীনের জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে জানা গেল। قد أحسن من انتهى إلى ما سمع ‘‘সে ব্যক্তি ভাল কাজ করেছে, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শুনেছে তাই আমল করেছে’’ -এ কথাই তার প্রমাণ। তাই প্রথম হাদীছ দ্বিতীয় হাদীছের বিরোধী নয়।

১৮) মানুষের মধ্যে যে গুণ নেই তার প্রশংসা থেকে সালাফে সালেহীনগণ বিরত থাকতেন।

১৯) أنت منهم ‘‘তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত’’ -উক্কাশার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা তাঁর নবুওয়াতেরই প্রমাণ।

২০) উক্কাশা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা ও ফযীলত।

২১) কোনো কথা সরাসরি না বলে হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করা।

২২) ইঙ্গিতের মাধ্যমে কথা বলা জায়েয।

২৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম চরিত্রের বর্ণনা।

[6] - উক্কাশা বিন মিহসান ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। তিনি বদরসহ সকল যুদ্ধেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি বনী আসাদ বিন খুজায়মার অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। রিদ্দার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তুলাইহা বিন খুওয়াইলিদ তাঁকে হত্যা করে।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে