এই কারণটা ছাহাবীগণের পরবর্তী যুগের মানুষের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ নয়; বরং ছাহাবী এবং তৎপরবর্তীগণের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আমরা দুটো উদাহরণ পেশ করব- যা ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ঘটে গেছে।
প্রথম উদাহরণঃ- আমরা ছহীহ বুখারী এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে জানি যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন এবং পথিমধ্যে তাঁকে বলা হল, সেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে, তখন তিনি থেমে গেলেন এবং ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতে লাগলেন। তিনি মুহাজির ও আনছারগণের সাথে পরামর্শ করলেন এবং তাঁরা এ বিষয়ে ভিন্ন দুটো মত পোষণ করলেন। তবে ওখান থেকে ফিরে আসার অভিমতটাই ছিল বেশী অগ্রাধিকারযোগ্য। মতবিনিময় সভার এক পর্যায়ে আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু আসলেন- তিনি তাঁর কোন প্রয়োজনে অনুপস্থিত ছিলেন। অতঃপর বললেন, এ বিষয়ে আমার জ্ঞান রয়েছে, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন তোমরা কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনবে, তখন সেখানে যাবে না। কিন্তু যদি তা তোমাদের সেখানে থাকা অবস্থায় দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে তোমরা বেরিয়ে যাবে না’।[1] বুঝা গেল, মুহাজির ও আনছারের বড় বড় ছাহাবীর রাযিয়াল্লাহু আনহুম এই হুকুম অজানা ছিল। অতঃপর আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহু এসে তাঁদেরকে এই হাদীছটা সম্পর্কে খবর দিলেন।
দ্বিতীয় উদাহরণঃ- আলী ইবন আবু তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতে, কোন গর্ভবতীর স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা বাচ্চা প্রসবের দিন- এই দুই সময়ের মধ্যে দীর্ঘতম সময় পর্যন্ত সে ইদ্দত পালন করবে। অতএব, যদি সে চার মাস দশ দিনের আগে বাচ্চা প্রসব করে, তাহলে তাঁদের নিকট তার ইদ্দত পালনের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। [অর্থাৎ বাচ্চা প্রসব সত্ত্বেও তাকে ইদ্দত পালন অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে চার মাস দশ দিন দীর্ঘতম সময়]। আর যদি বাচ্চা প্রসবের আগে চার মাস দশ দিন শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত সে ইদ্দত পালন করতে থাকবে। [যেহেতু এক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসবের সময় হচ্ছে দীর্ঘতম সময়]। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’।[2]
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের বিধবাগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে’।[3]
উভয় আয়াতের মধ্যে ‘আম খাছ ওয়াজহী’[4] عموم وخصوص وجهي-এর সম্পর্ক। আর এমন সম্পর্কযুক্ত দুই আয়াত বা হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পদ্ধতি হল, এমনভাবে হুকুম গ্রহণ করতে হবে- যাতে উভয় আয়াত বা হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। তবে তা করতে গেলে আলী ও ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর পদ্ধতি মেনে নেওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
কিন্তু সুন্নাত এসবেরই ঊর্দ্ধে। ‘সুবায়আ আল-আসলামিইয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি সুবায়আ তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরে প্রসূতি অবস্থায় পতিত হলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁকে আবার বিয়ে করার অনুমতি দেন’।[5] এর অর্থ এই যে, আমরা সূরা ত্বালাকের উক্ত আয়াতের অনুসরণ করব- যে সূরাকে ‘ছোট সূরা নিসা’ বলা হয়। আর এই আয়াতে আল্লাহর সাধারণ ঘোষণা হচ্ছে, ‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’।[6]আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, যদি এই হাদীছ আলী ও ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা পর্যন্ত পৌঁছত, তাহলে তাঁরা নিশ্চয়ই তা মেনে নিতেন এবং নিজেদের মত ব্যক্ত করতে যেতেন না।
>[2] . সূরা আত-ত্বালাক ৪।
[3] . সূরা আল-বাক্বারাহ ২৩৪।
[4] এটি উসূলে ফিক্বহ-এর একটা পরিভাষা। দুইটা আয়াত বা হাদীছের প্রত্যেকটাতে একই সময়ে একদিক বিবেচনায় ‘আম’ عام এবং অন্যদিক বিবেচনায় ‘খাছ’ خاص হুকুম পাওয়া গেলে তাকে ‘আম-খাছ ওয়াজহী’ বলে। আর যা দুই বা ততোধিক বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে, তাকে ‘আম’ عام বলে এবং যা দুই বা ততোধিক বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে না, তাকে ‘খাছ’ خاص বলে।
আম-খাছ ওয়াজহী-এর উদাহরণ:
মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের বিধবাগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে’ [বাক্বারাহ ২৩৪]। অত্র আয়াত সবধরনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘আম’। সুতরাং গর্ভবতী মহিলা, গর্ভবতী নয় এমন মহিলা, বিয়ের পর সহবাস করা হয়েছে এমন মহিলা এবং সহবাস করা হয়নি এমন মহিলা সবাই এই আয়াতের আওতাভুক্ত হবে। এই দিক বিবেচনায় আয়াতটা ‘আম’। কিন্তু যে স্ত্রীর স্বামী মারা গেছে, তার ক্ষেত্রে আয়াতটা ‘খাছ’।
‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’ [আত-ত্বালাক্ব ৪]। অত্র আয়াত তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘আম’। কিন্তু গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে ‘খাছ’। সুতরাং প্রথম আয়াতের ‘আম’ হুকুম দ্বিতীয় আয়াতের ‘খাছ’ হুকুমের উপর এবং দ্বিতীয় আয়াতের ‘আম’ হুকুম প্রথম আয়াতের ‘খাছ’ হুকুমের উপর বহন করতে হবে। তখন অর্থ দাঁড়াবে, গর্ভবতী ব্যতীত স্বামী মারা গেছে এমন সব মহিলা চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবে। আর গর্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।-অনুবাদক।
[5] . বুখারী, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/৫৩১৮-৫৩২০; মুসলিম, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/১৪৮৪।
[6] . সূরা আত-তালাক্ব ৪।
এখন আমরা স্বয়ং ছাহাবীগণের মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন একটা ঘটনা দিয়ে উদাহরণ পেশ করবঃ
ফাতিমা বিনতে ক্বায়স রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে তাঁর স্বামী তিন ত্বালাকের সর্বশেষ ত্বালাক দিয়ে দেন। অতঃপর তিনি তাঁর [ফাতিমার] নিকট তাঁর [ফাতিমার স্বামীর] প্রতিনিধির মাধ্যমে কিছু যব ইদ্দতকালীন সময়ে তাঁর খোরপোষ হিসাবে পাঠান। কিন্তু ফাতিমা বিনতে ক্বায়স রাযিয়াল্লাহু আনহা এতে ক্রোধান্বিত হন এবং তা নিতে অস্বীকার করেন। অতঃপর এক পর্যায়ে তাঁরা বিষয়টা নিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যান এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উক্ত মহিলাকে এ মর্মে খবর দেন যে, ‘তাঁর জন্য ভরণপোষণের কোন খরচ নেই এবং নেই কোন আবাসন ব্যবস্থা’।[1] কেননা তিনি [ফাতিমার স্বামী] তাঁর স্ত্রীকে ‘বায়েন ত্বালাক’[2] দিয়ে দিয়েছেন। আর বায়েন ত্বালাকপ্রাপ্তার ভরণপোষণ ও আবাসনের দায়িত্ব তার স্বামীর উপর থাকে না। তবে যদি ঐ মহিলা গর্ভবতী হয়, [তাহলে খোরপোষ ও আবাসন দুটোই দিতে হবে]।
এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা গর্ভবতী থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করবে’।[3]ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানের কথা বলার অবকাশ নেই। অথচ তাঁর মত মানুষের এই সুন্নাতটা অজানা ছিল। সেজন্য ঐ মহিলার খোরপোষ ও আবাসনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন এবং ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহা ভুলে গেছেন-এই সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে তাঁর হাদীছ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এমনকি তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মহিলার কথার উপর ভিত্তি করে আমরা কি আমাদের প্রতিপালকের কথা পরিত্যাগ করব- অথচ আমরা জানি না যে, তার মনে আছে নাকি ভুলে গেছে?’ আর একথার অর্থ এই যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এই দলীলের প্রতি আস্থাশীল হতে পারেন নি। এমন ঘটনা যেমন ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু, অন্যান্য ছাহাবীবর্গ রাযিয়াল্লাহু আনহুম এবং তাবেঈন রহেমাহুমুল্লাহ-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে, তেমনিভাবে তাবে‘ তাবেঈন রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এমনিভাবে আমাদের যুগেও অনুরূপ ঘটছে; বরং ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষ কোন কোন দলীলের বিশুদ্ধতার উপর এভাবে অনাস্থাশীল হতে থাকবে। বিদ্বানগণের কত অভিমতের পক্ষেই তো আমরা হাদীছ দেখতে পাই। কিন্তু কেউ কেউ সেই হাদীছকে ছহীহ জেনে ঐ অভমত গ্রহণ করেন। আবার কেউ কেউ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থেকে ঐ হাদীছের বর্ণনার প্রতি আস্থাশীল না হয়ে উহাকে দুর্বল মনে করতঃ ঐ অভিমত গ্রহণ করেন না।
[2] ‘তালাক্ব বায়েন’ طلاق بائن দুই প্রকারঃ ১- ‘ছোট বায়েন তালাক্ব’ طلاق بائن بينونة صغرى: যে তালাক্বের পরে স্বামী তার স্ত্রীকে তার স্ত্রীর সম্মতিতে নতুন বিয়ে ও মোহরের মাধ্যমে আবার ফেরৎ নিতে পারে এবং অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে তালাক্বপ্রাপ্তা হওয়ার শর্ত না থাকে, তাকে ‘ছোট বায়েন তালাক’ طلاق بائن بينونة صغرى বলে। যেমনঃ এক বা দুই তালাক্ব দেওয়ার পর স্ত্রী ইদ্দত থেকে বের হয়ে গেলে। ২- ‘বড় বায়েন তালাক্ব’ طلاق بائن بينونة كبرى: যে তালাক্বের পরে স্বামী তার স্ত্রীর সম্মতি এবং নতুন বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তাকে স্ত্রীকে ফেরৎ নিতে পারে না; বরং স্ত্রীর অন্য জায়গায় স্বাভাবিক বিয়ে হিল্লা বিয়ে নয় এবং উভয়ের সহবাস হতে হয়। অতঃপর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটতে হয় এবং স্ত্রীকে ইদ্দত পালন করতে হয়, তাকে ‘বড় বায়েন তালাক্ব’ طلاق بائن بينونة كبرى বলে।–অনুবাদক।
[3]. সূরা আত-তালাক্ব ৬।
কত মানুষ আছেন- যিনি হাদীছ ভুলে যান; এমনকি কখনও আয়াতও ভুলে যান। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম একদিন ছাহাবীগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুম-কে নিয়ে নামায পড়েন এবং নামাযে তিনি ভুলক্রমে একটা আয়াত ছেড়ে দেন। তাঁর সাথে ছিলেন উবাই ইবনে কাব রাযিয়াল্লাহু আনহু। নামায শেষে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি কি আমাকে আয়াতটা স্মরণ করিয়ে দিতে পারনি!’[1] অথচ তাঁর উপর অহী নাযিল হয়েছে এবং তাঁকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাবো। ফলে তুমি ভুলবে না। তবে আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন, তা ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত বিষয় পরিজ্ঞাত আছেন’।[2]
আর হাদীছ পৌঁছার পর তা ভুলে যাওয়ার এই কারণটার উদাহরণসমূহের মধ্যে আম্মার ইবন ইয়াসির রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘটনা অন্যতম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁদের দু’জনকে কোন এক প্রয়োজনে পাঠালে তাঁরা উভয়েই নাপাক হয়ে যান। এরপর আম্মার গবেষণা করে দেখেন যে, মাটি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের মতই। ফলে তিনি মাটিতে গড়াগড়ি দেন- যেমনিভাবে পশু গড়াগড়ি দেয়। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল, সারা দেহে মাটি মাখিয়ে দেওয়া- যেমনিভাবে পানি মাখাতে হয়। এরপর তিনি নামায আদায় করেন। অপরদিকে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নামাযই আদায় করলেন না।…
অতঃপর তাঁরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আসলে তিনি তাঁদেরকে সঠিক নিয়ম বলে দেন। আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তিনি বলেন, ‘দুই হাত দিয়ে এরকম করলেই তোমার জন্য যথেষ্ট হত’। [একথা বলে] তিনি তাঁর দুই হাত একবার মাটিতে মারলেন। অতঃপর বাম হাতকে ডান হাতের উপর বুলিয়ে উভয় হাতের তালু এবং মুখমণ্ডল মাসাহ করলেন। আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফতকালে এবং তারও আগে এই হাদীছটা বর্ণনা করতেন। ইতিমধ্যে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে একদিন ডেকে পাঠান এবং তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি এটা কি ধরনের হাদীছ বর্ণনা করছ? অতঃপর আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আপনার কি মনে পড়ে- রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে কোন এক প্রয়োজনে পাঠালে আমরা নাপাক হয়ে যাই। ফলে আপনি নামায আদায় করেছিলেন না; কিন্তু আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছিলাম।
এরপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘দুই হাত দিয়ে এরকম করলেই তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল’। কিন্তু ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘটনাটা স্মরণ করতে পারলেন না; বরং বললেন, আল্লাহকে ভয় কর হে আম্মার! অতঃপর আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, আমার উপর আপনার অনুসরণ করা যেহেতু আল্লাহ আবশ্যক করে দিয়েছেন, সেহেতু আপনি যদি চান যে, এই হাদীছটা আমি আর বর্ণনা করব না, তাহলে তাই করব। তখন ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, আমি যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছি, তোমাকেও সে দায়িত্ব অর্পণ করলাম’[3]। -অর্থাৎ তুমি এই হাদীছ মানুষকে বর্ণনা কর-। তাহলে দেখা গেল, ছোট অপবিত্র অবস্থায় যে তায়াম্মুম রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নির্ধারণ করেছেন, ঠিক ঐ একই তায়াম্মুম বীর্যস্খলন জনিত কারণে অপবিত্র অবস্থায়ও নির্ধারণ করেছেন- একথাটা ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ভুলে গেছেন এবং তিনি এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পক্ষেই ছিলেন।
আর আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাঝে এ বিষয়ে বিতর্কও হয়েছে। বিতর্কে আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্দেশ্যে বলা আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উক্তিটা পেশ করেন। তখন ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তুমি কি দেখনি যে, ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথায় পরিতুষ্ট হতে পারেননি? অতঃপর আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ঠিক আছে আম্মার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু এই আয়াত সম্পর্কে তুমি কি বলবে?-অর্থাৎ সূরা আল–মায়েদার আয়াত-।
জবাবে ইবনে মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কিছুই বললেন না। যাহোক, নিঃসন্দেহে এখানে অধিকাংশ বিদ্বানের কথাই সঠিক-যারা বলছেন, বীর্যপাত জনিত কারণে অপবিত্র ব্যক্তি তায়াম্মুম করতে পারে-যেমনিভাবে ছোট নাপাকীর কারণে অপবিত্র ব্যক্তি তায়াম্মুম করতে পারে।এ ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ ভুলে যেতে পারে এবং শার‘ঈ কোন হুকুম তার কাছে অজানা থেকে যেতে পারে। ফলে সে যদি কিছু [ভুল] বলে, তাহলে সে ওযরগ্রস্ত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি দলীল জানবে, সে তো ওযরগ্রস্ত হিসাবে পরিগণিত হবে না।
>[2]. সূরা আল-আ'লা ৬-৭।
[3]. বুখারী, ‘তায়াম্মুম’ অধ্যায়, হা/৩৩৮, ৩৪৫, ৩৪৬; মুসলিম, ‘ঋতুস্রাব’ অধ্যায়, হা/৩৬৮।
আমরা এর দুটো উদাহরণ পেশ করবঃ একটা কুরআন থেকে এবং অপরটা হাদীছ থেকে।
১. কুরআন থেকেঃ মহান আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা যদি রোগগ্রস্ত হও কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে কিংবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও’।[1]
বিদ্বানগণ ‘কিংবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ কর’ আয়াতাংশের অর্থ করতে গিয়ে মতভেদ করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ বুঝেছেন, ‘স্বাভাবিক স্পর্শ’। কেউ কেউ বুঝেছেন, ‘যৌন উত্তেজনার সহিত স্পর্শ’। আবার কেউ কেউ বুঝেছেন, ‘সহবাস’। আর এটা [শেষেরটা] ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অভিমত।
এখন আপনি যদি আয়াতটা নিয়ে ভালভাবে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন যে, যাঁরা আয়াতাংশের অর্থ করেছেন ‘সহবাস’ তাঁদের কথাই ঠিক। কেননা মহান আল্লাহ পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে দুই প্রকার পবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন। একটা ছোট অপবিত্রতা الحدث الأصغر থেকে পবিত্রতা অর্জন এবং অপরটা বড় অপবিত্রতা الحدث الأكبر থেকে পবিত্রতা অর্জন। ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণী হচ্ছে, ‘তোমাদের মুখমণ্ডল ধৌত কর এবং হাতগুলোকে কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও। আর মাথা মাসাহ কর এবং পাগুলোকে টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে ফেল’।[2]
আর বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর বাণী হচ্ছে, ‘কিন্তু যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তাহলে বিশেষভাবে পবিত্র হবে’।[3]
এক্ষণে পবিত্র কুরআনের বালাগাত ও ফাছাহাত তথা ভাষালঙ্কার ও ভাষাশৈলির দাবী হচ্ছে, তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রেও দুই প্রকার পবিত্রতার কথা উল্লেখ করা। অতএব মহান আল্লাহর বাণী, ‘অথবা তোমাদের কেউ যদি পায়খানা থেকে আসে’ দ্বারা ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে… এবং ‘কিংবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ কর’ দ্বারা বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।… সে কারণে এখানে আমরা যদি ‘স্পর্শ’ الملامسة-কে [‘সহবাস’ অর্থে না নিয়ে] ‘স্পর্শ’ অর্থে নিই, তাহলে দেখা যায়, উক্ত আয়াতে ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের কারণসমূহের দুটো কারণ উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন কিছুরই উল্লেখ নেই। আর এটা পবিত্র কুরআনের বালাগাতের পরিপন্থী। যাহোক, যারা আয়াতাংশের অর্থ ‘সাধারণ স্পর্শ’ বুঝেছেন, তারা বলেছেন, কোন পুরুষ যদি স্ত্রীর চামড়া স্পর্শ করে, তাহলে তার অযু ভেঙ্গে যাবে। অথবা যদি সে যৌন কামনা নিয়ে স্ত্রীর চামড়া স্পর্শ করে, তাহলে অযু ভাঙবে আর যৌন কামনা ছাড়াই স্পর্শ করলে অযু ভাঙবে না। অথচ সঠিক কথা হল, উভয় অবস্থাতেই অযু ভাঙবে না। কেননা হাদীছে এসেছে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর কোন এক স্ত্রীকে চুম্বন করতঃ নামায পড়তে গেলেন অথচ অযু করলেন না।[4] আর এই বর্ণনাটা কয়েকটা সূত্রে এসেছে- যার একটা অপরটাকে শক্তিশালী করে।
২. হাদীছ থেকেঃ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম যখন আহযাবের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে যুদ্ধের প্রস্তুতি ক্ষান্ত করলেন, তখন জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এসে তাঁকে বললেন, আমরা অস্ত্র সমর্পণ করিনি। সুতরাং আপনি বনী ক্বুরাইযা-এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। ফলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর ছাহাবীগণকে রাযিয়াল্লাহু আনহুম বেরিয়ে পড়ার আদেশ করলেন এবং বললেন, ‘কেউ যেন বনী ক্কুরাইযা ছাড়া অন্য কোথাও আছরের নামায না পড়ে’। [দেখা গেল,] ছাহাবীবর্গ এই হাদীছটা বুঝার ক্ষেত্রে মতভেদ করলেন। তাঁদের কেউ কেউ বুঝলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর উদ্দেশ্য হল, দ্রুত রওয়ানা করা- যাতে আছরের সময় হওয়ার আগেই তাঁরা বনী ক্কুরাইযাতে উপস্থিত থাকেন। সেজন্য তাঁরা রাস্তায় থাকা অবস্থায় যখন আছরের নামাযের সময় হল, তখন তাঁরা নামায আদায় করে নিলেন এবং নামাযের সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত নামাযকে বিলম্বিত করলেন না। আবার তাঁদের অনেকেই বুঝলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর উদ্দেশ্য হল, তাঁরা যেন বনী ক্কুরাইযায় না পৌঁছে নামায আদায় না করে। সেজন্য তারা নামাযকে বনী ক্কুরাইযাতে পৌঁছার সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করলেন- এমনকি নামাযের ওয়াক্তও শেষ হয়ে গেল।[5]নিঃসন্দেহে যাঁরা সঠিক সময়ে নামায আদায় করেছেন, তাঁদের বুঝটাই ছিল সঠিক। কেননা সময়মত নামায ওয়াজিব হওয়ার উদ্ধৃতিগুলো ‘সুস্পষ্ট’ محكمة। পক্ষান্তরে এই উদ্ধৃতিটা হচ্ছে ‘অস্পষ্ট’ متشابهة। আর নিয়ম হচ্ছে, মুহকাম নির্দেশ মুতাশাবেহ- নির্দেশের উপর প্রাধান্য পাবে। অতএব, বুঝা গেল, কোন দলীলকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর উদ্দেশ্যের উল্টা বুঝা মতানৈক্যের অন্যতম কারণ। আর এটাই হচ্ছে চার নম্বর কারণ।
>[2] . সূরা আল-মায়েদাহ ৬।
[3] . প্রাগুক্ত।
[4] . আবু দাঊদ, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/১৭৮, ১৭৯; তিরমিযী, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/৮৬; ইবনু মাজাহ, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, হা/৫০২, ৫০৩।
[5] . বুখারী, ‘ভীতি’ অধ্যায়, হা/৯৪৬; মুসলিম, ‘যুদ্ধবিগ্রহ’ অধ্যায়, হা/১৭৭০। ছহীহ মুসলিমে এসেছে এভাবে, ‘কেউ বনী ক্বুরায়যায় না পৌঁছে যেন আছরের নামায আদায় না করে’।
সুতরাং এখানে হাদীছটা ছহীহ এবং উহার অর্থ ও তাৎপর্যও বোধগম্য; কিন্তু তা রহিত। আর উক্ত আলেম যেহেতু হাদীছটা রহিত হওয়ার বিষয়ে জানেন না, সেহেতু সেটা তার জন্য ওযর হিসাবে গণ্য হবে। কেননা [শরঈ বিধানের ক্ষেত্রে] আসল হল, রহিত না হওয়া, যতক্ষণ না রহিতকারী নতুন বিধান সম্পর্কে জানা যায়।
এই কারণে মুছল্লী রুকূতে যেয়ে কিভাবে তার হস্তদ্বয় রাখবে, সে বিষয়ে ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ভিন্নমত পোষণ করেছেন। [ঘটনা হচ্ছে], ইসলামের প্রাথমিক যুগে [রুকূতে] মুছল্লীর জন্য নিয়ম ছিল, দুই হাত একত্রে করে দুই হাঁটুর মাঝখানে রাখা। কিন্তু পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে নতুন বিধান চালু হয়। নতুন বিধান হচ্ছে, দুই হাত দুই হাঁটুর উপরে রাখা। ছহীহ বুখারীসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে রহিত হওয়ার বিষয়টা প্রমাণিত হয়েছে।[1] কিন্তু ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রহিত হওয়ার বিষয়টা জানতেন না। ফলে, তিনি দুই হাত একত্রে করে দুই হাঁটুর মাঝখানেই রাখতেন। [একদিন] তাঁর পাশে আলক্বামা ও আল–আসওয়াদ রাযিয়াল্লাহু আনহুমা নামায পড়তে দাঁড়ালেন এবং তাঁরা তাঁদের দুই হাত দুই হাঁটুর উপর রাখলেন। কিন্তু ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁদেরকে অনুরূপ করতে নিষেধ করলেন এবং দুই হাতকে একত্র করতঃ দুই হাঁটুর মাঝখানে রাখার আদেশ করলেন।[2] কিন্তু কেন?
কারণ তিনি রহিত হওয়ার বিষয়টা জানতে পারেন নি। আর মানুষের উপর তার সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপানো হয়নি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। সে তাই পায়, যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায়, যা সে করে। হে আমাদের পালনকর্তা! যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ। হে আমাদের প্রভু! আমাদের দ্বারা এমন বোঝা বহন করাইও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর’।[3]
>[2]. মুসলিম, ‘মসজিদসমূহ’ অধ্যায়, হা/৫৩৪।
[3] . সূরা আল-বাক্বারাহ ২৮৬।
অর্থাৎ দলীল পেশকারীর কাছে দলীল পৌঁছেছে; কিন্তু তাঁর মতে, উক্ত দলীল সেটার চেয়ে শক্তিশালী উদ্ধৃতি বা ইজমার বিরোধী। আর আলেমগণের মতানৈক্যের পেছনে এই কারণটার ভূমিকা অনেক বেশী। সেজন্য আমরা কোন কোন আলেমকে ইজমার উদ্ধৃতি দিতে শুনি। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তা ইজমা নয়।
ইজমার উদ্ধৃতি পেশের ক্ষেত্রে অদ্ভুত উদাহরণ হচ্ছে: কেউ কেউ বলেন, দাসের সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা একমত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, দাসের সাক্ষ্য গ্রহণীয় নয় মর্মে তাঁরা একমত হয়েছেন। এটা অদ্ভুত একটা বর্ণনা! কেননা কেউ কেউ যখন তাঁর আশেপাশের সবাইকে কোন বিষয়ে একমত হতে দেখেন, তখন সেই বিষয়টা উদ্ধৃতিসমূহের [কুরআন-হাদীছের উদ্ধৃতি] অনুকূলে ভাবেন এবং মনে করেন, তাঁদের বিরোধী কোন দলীল নেই। সেজন্য তাঁর ব্রেইনে দুই ধরনের দলীলের সমাবেশ ঘটে [কুরআন-হাদীছের] উদ্ধৃতি ও ইজমা। এমনকি তিনি মনে করেন, ঐ বিষয়টা সঠিক ক্বিয়াস এবং দৃষ্টিভঙ্গিরও অনুকূলে। ফলে, তিনি ঐ বিষয়ে মতানৈক্য না থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং সঠিক ক্বিয়াসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উদ্ধৃতির বিরোধী কোন দলীল আছে বলে তিনি মনে করেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বিষয়টা ছিল উল্টা।
আমরা ‘রিবাল ফায্ল’[1] رِبَا الْفَضْلِ এর ক্ষেত্রে ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা- এর অভিমতটাকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করতে পারিঃ-
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সুদ শুধুমাত্র ‘রিবান-নাসীআহ’[2] رِبَا النَسِيْئَةِ-এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ’।[3] উবাদাহ ইবনু ছামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু সহ অন্যান্য ছাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীছে প্রমাণিত হয়েছে, ‘রিবান-নাসীআহ’ এবং ‘রিবাল ফায্ল’ উভয় ক্ষেত্রেই সুদ হবে’।[4]
ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরে সকল আলেম একমত হয়েছেন যে, সুদ দুই প্রকারঃ ১ ‘রিবাল ফায্ল’ ربا الفضل ও ২ ‘রিবান নাসীআহ’ ربا النسيئة। কিন্তু ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু নাসীআহ ব্যতীত অন্য কিছুতে সুদ হওয়ার বিষয়টা অস্বীকার করেছেন। যেমনঃ যদি তুমি হাতে হাতে এক ছা গম দুই ছা গমের বিনিময়ে বিক্রয় কর, তাহলে ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর নিকটে কোন সমস্যাই নেই। কেননা তাঁর মতে, সুদ কেবলমাত্র নাসীআহ-এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।
অনুরূপভাবে, যদি তুমি দুই ‘মিছক্বাল’ [সোনার ওযন বিশেষ] সোনার বিনিময়ে এক ‘মিছক্বাল’ সোনা হাতে হাতে বিক্রয় কর, তাহলে তাঁর নিকটে সুদ হবে না। তবে যদি গ্রহণ করতে দেরী কর অর্থাৎ তুমি আমাকে যদি এক ‘মিছক্বাল’ সোনা দাও কিন্তু আমি তার মূল্য যদি তোমাকে এখন না দিয়ে উভয়ে বেচাকেনার বৈঠক থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে দেই, তাহলে সেটা সুদ হবে। কেননা ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতে, হাদীছে উল্লেখিত এই সীমাবদ্ধতা [নাসীআহ ছাড়া] অন্য কিছুতে সুদ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আর আসলেই إنما শব্দটা সীমাবদ্ধতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং তা [নাসীআহ] ছাড়া অন্য কিছুতে সুদ হবে না।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উবাদাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীছ প্রমাণ করে যে, ‘রিবাল ফায্ল’ও সুদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশী দিল বা নিল, সে সুদী কারবার করল’।[5]
এক্ষণে, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক দলীল হিসাবে পেশকৃত হাদীছের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কি হবে?আমাদের ভূমিকা হবে, হাদীছটাকে আমরা এমন অর্থে গ্রহণ করব, যাতে ‘রিবাল ফায্ল’-কে সুদ গণ্যকারী হাদীছের সাথে এই হাদীছও মিলে যায়। সেজন্য আমরা বলব: মারাত্মক সুদ হচ্ছে, ‘রিবান নাসীআহ’- যার কারবার জাহেলীযুগের লোকেরা করত এবং যে সম্পর্কে কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেওনা’।[6] তবে ‘রিবাল ফায্ল’ তদ্রুপ মারাত্মক নয়[7]। সে কারণে ইবনুল ক্বাইয়িম রহেমাহুল্লাহ তাঁর [জগদ্বিখ্যাত] গ্রন্থ ‘এ‘লামুল মুওয়াক্কেঈন’ إعلام الموقعين-এ বলেন, মূল সুদের অন্যতম মাধ্যম হওয়ার কারণে ‘রিবাল ফায্ল’-কে হারাম করা হয়েছে। সেটাই যে মূল সুদ, সে হিসাবে নয়।
>[2] نسيئة-অর্থঃ বিলম্ব, দেরী। এই প্রকার সূদে লেনদেনকৃত দুটো বস্তুর একটা মূল বস্তুর চেয়ে বেশী পরিমাণে আদান-প্রদান হয় এবং সেই অতিরিক্ত বস্তুটা মূলধনকে দেরীতে অল্প হলেও পরিশোধের বিনিময়ে হয়ে থাকে বলে একে ‘রিবান-নাসীআহ’ ربا النسيئةবলে। আর এটা সাধারণতঃ পরিমাপ পাত্র দ্বারা মাপ করা হয় এমন অথবা বাটখারা দ্বারা ওযন করা হয় এমন বস্তু অথবা একই শ্রেণীর অন্য যেকোন বস্তুর লেনদেনের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, অন্য ক্ষেত্রে নয়। সেজন্য লেনদেনকৃত দুটো বস্তুর একটা যদি টাকা-পয়সা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে সূদ হবে না। [অনুবাদক]
[3] . ইমাম বুখারী হাদীছটা নিম্নোক্ত শব্দে বর্ণনা করেছেন, ‘নাসীআর ক্ষেত্রে ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে সূদ নেই’। ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, হা/২১৭৮-২১৭৯; মুসলিম, ‘বরগা চাষ’ অধ্যায়, হা/১৫৯৬; ইবনু মাজাহ, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য’ অধ্যায়, হা/২২৫৭।
[4] . মুসলিম, ‘বরগা চাষ’ অধ্যায়, হা/১৫৮৭।
[5] . মুসলিম, ‘বরগা চাষ’ অধ্যায়, হা/১৫৮৮।
[6] . সূরা আলে-ইমরান ১৩০।
[7] ‘রিবাল ফাযল’ ‘রিবান নাসীআহ’-এর মত মারাত্মক না হলেও তা হারাম। সুতরাং কেউ যেন ইহাকে তুচ্ছজ্ঞান করে কোনক্রমেই সূদী কারবারে জড়িয়ে না পড়ে। কেননা, অপেক্ষাকৃত ছোট পাপ করতে করতে মানুষ কখন যে নিজের অজান্তেই অনেক বড় পাপ করে বসে, তা বলা যায় না। মনে রাখতে হবে, পরকালে সুদী কারবারের পরিণতি বড় কঠিন হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন!– [অনুবাদক]।
আর এমন ঘটনা বহু ঘটে থাকে। যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল পেশের অন্যতম একটা উদাহরণ হচ্ছে, কোন কোন আলেম ‘ছালাতুত্ তাসবীহ’-কে উত্তম বলেন। ‘ছালাতুত্ তাসবীহ’ হচ্ছে, দুই রাক‘আত নামায আদায়- যাতে দণ্ডায়মান অবস্থায় সূরা ফাতিহা এবং ১৫ বার তাসবীহ পাঠ করা হয়। অনুরূপভাবে রূকূ ও সিজদাহ সহ নামাযের শেষ পর্যন্ত সব জায়গায় তাসবীহ পাঠ করা হয়। আসলে ঐ নামাযের নিয়ম-কানুন আমি ভালভাবে রপ্ত করিনি। কারণ শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সেটাকে ঠিক মনে করি না। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘ছালাতুত্ তাসবীহ’ জঘন্য বিদআত এবং এ মর্মের হাদীছ ছহীহ নয়। ইমাম আহমাদ রহেমাহুল্লাহ এ মতের পক্ষে। তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থেকে উহা সাব্যস্ত নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ রহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘ছালাতুত্ তাসবীহ’ সংক্রান্ত হাদীছ হলো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর উপর মিথ্যা রটনা। আর বাস্তবেই যিনি এ সম্পর্কে গবেষণা করবেন, তিনি দেখবেন যে, এমনকি শরী‘আতের দৃষ্টিকোণ থেকেও ইহা অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম একটা বিধান।
কেননা ইবাদত হয় অন্তরের জন্য উপকারী হবে নতুবা উপকারী হবে না। আর উপকারী হলে সব সময় এবং সব জায়গায় তা শরীআতসম্মত হবে। পক্ষান্তরে উপকারী না হলে শরীআতসম্মত হবে না। আর যে হাদীছে এই নামায সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, মানুষ প্রত্যেক দিন, অথবা সপ্তাহে একদিন অথবা মাসে একদিন বা জীবনে অন্ততঃ একদিন আদায় করবে। ইসলামী শরী‘আতে এরকম আর কোন ইবাদত নেই। সেজন্য এ সংক্রান্ত হাদীছ সনদ এবং মতন উভয় দিক থেকেই ব্যতিক্রম এবং শায়খুল ইসলামের মত যিনি সেগুলোকে মিথ্যা বলেছেন, তাঁর বক্তব্যই সঠিক। আর সেকারণেই শায়খুল ইসলাম বলেন, কোন আলেমই এই নামাযকে উত্তম বলেন নি। নারী-পুরুষ কর্তৃক ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় বলে আমি এই উদাহরণটা পেশ করেছি। এই বিদ‘আতী আমল শরীআতসম্মত গণ্য করা হবে মর্মে আমি ভয় পেয়েছি। কিছু কিছু মানুষের কাছে ভারী মনে হতে পারে ভেবেও আমি উহাকে বিদ‘আতই বলছি। কেননা কুরআন ও হাদীছে নেই এমন যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, তা-ই বিদআত।
দলীল শক্তিশালী কিন্তু দলীলের বুঝ বা উপলদ্ধিটা দুর্বল হওয়ার উদাহরণঃ হাদীছে এসেছে, ‘গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করাই হল গর্ভস্থ বাচ্চাকে যবেহ করা’।[1] আলেম সমাজের নিকট এই হাদীছের প্রসিদ্ধ অর্থ হল, যদি গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করা হয়, তাহলে সেই যবেহ গর্ভস্থ বাচ্চার জন্যও যবেহ হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ মাকে যবেহ করার পর যখন বাচ্চাকে পেট থেকে বের করা হবে, তখন তাকে আর যবেহ করার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা বাচ্চা ইতিমধ্যে মারা গেছে। আর মারা যাওয়ার পর যবেহ করায় কোন লাভ নেই।
আবার কেউ কেউ হাদীছটার অর্থ এরূপ বুঝেছেন যে, গর্ভস্থ বাচ্চাকে তার মায়ের মত করেই যবেহ করতে হবে। ঘাড়ের দুই রগ কেটে দিতে হবে এবং রক্ত প্রবাহিত করতে হবে। কিন্তু এটা অবাস্তব। কারণ মৃত্যুর পর রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার রক্ত প্রবাহিত করা হয় এবং আল্লাহর নামে যবেহ করা হয়, তা খাও’।[2] আর একথা স্পষ্ট যে, মৃত্যুর পরে রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়।
কিনারা বিহীন সাগরের মত অসংখ্য কারণের মধ্যে উক্ত কারণগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমি ভাল মনে করেছি। কিন্তু এত কিছুর পরে আমাদের ভূমিকা কি হবে?
আমি আলোচনার শুরুতেই বলেছি, শ্রবণযোগ্য, পঠনযোগ্য, দর্শনযোগ্য ইত্যাকার নানা প্রচার মাধ্যম এবং এই প্রচার মাধ্যমগুলোতে আলেম ও বক্তাগণের মতানৈক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সন্দীহান হয়ে পড়ছে আর বলছে, আমরা কার অনুসরণ করব? [কবি বলেন,]
تكاثرت الظباء على خراش
فما يدري خراش ما يصيد
অর্থাৎ: ‘শিকারী কুকুরের নিকট হরিণ এতই বেশী হয়ে গেছে যে, সে কোন্টা ছেড়ে কোন্টা শিকার করবে তা বুঝতেই পারছে না’।
>[2] . বুখারী, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৫৪৯৮; মুসলিম, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/১৯৬৮; আবু দাঊদ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/২৮২৭; নাসাঈ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/৪৪০৩-৪৪০৪; ইবনু মাজাহ, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৩১৭৮।