জওয়াব:প্রত্যেকসুস্থমস্তিষ্কবালেগমুসলিমেরওপররমযানেরসাওম পালন করাফরয।আল্লাহতা‘আলাবলেন,
﴿ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“সুতরাংতোমাদেরমধ্যেযেব্যক্তিইএমাসপাবেসেযেনঅবশ্যইসাওমপালন করে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত:১৮৫]
জওয়াব: সাওম ফরয হওয়ার শর্ত হলো:
১ - ইসলাম: অতএব, অমুসলিমের ওপর সাওম পালন ফরয নয়।
২ - প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া: অতএব, অপ্রাপ্তবয়স্কের ওপর সাওম পালন ফরয নয়। তবে যদি অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকা সাওম পালন করতে সক্ষম হয় তবে সাওম পালনের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য এ ব্যাপারে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
৩- সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া: অতএব, পাগলের ওপর সাওম পালন ফরয নয়।
৪ - সাওম পালন রাখতে সক্ষম হওয়া: অতএব, যে সাওম পালন করতে অপারগ তার ওপর সাওম পালন ফরয নয়।
জওয়াব: সাওমের প্রকারভেদ। সাওম প্রথমত দু’প্রকার:
১- বাধ্যতামূলক সাওম। আর তা দু’প্রকার:
ক. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বান্দার ওপর মৌলিকভাবে ফরয করে দেওয়া সাওম আর তা হলো রমযানের সাওম। এ সাওম ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি।
খ. এমন সাওম যা বান্দা নিজের ওপর ওয়াজিব করে নিয়েছে, যেমন মানত ও কাফফারার সাওম।
২- মুস্তাহাব সাওম। আর তা হলো প্রত্যেক ওই সাওম যা শরী‘আত প্রবর্তকের কাছে পছন্দনীয়। যেমন সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সাওম, প্রতিমাসে তিন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের সাওম, আশুরার সাওম, যিলহজ মাসের প্রথম দশকের সাওম ও ‘আরাফা দিবসের সাওম।
জওয়াব: ফরয ও ওয়াজিব সাওমর ক্ষেত্রে রাত থেকে সাওমর নিয়ত করা আবশ্যক। আর যদি নফল সাওম হয়, তবে রাত থেকে নিয়ত করা ওয়াজিব নয়; বরং দিনের বেলায় সূর্য ঢলে যাওয়ার পূর্বে নিয়ত করে নিলেই সাওম রাখা শুদ্ধ হবে, যদি সুবেহ সাদেকের পর থেকে এমনকিছু গ্রহণ না করা হয় যা সাওম ভেঙ্গে দেয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আসলেন ও জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের কাছে কি কোনো (খাবার) আছে?’ আমরা বললাম, ‘না, নেই।’ তিনি বললেন, তাহলে আমি সাওম রাখলাম।’ (সহীহ মুসলিম)।
জওয়াব: সন্দেহের দিন বলতে শা‘বান মাসের ৩০ তারিখকে বুঝায়। ঐ দিন সতর্কতা অবলম্বন করে সাওম পালনের হুকুম সম্পর্কে বিশুদ্ধতম মত হলো ঐ দিন সাওম পালন হারাম। আম্মার বিন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন,
«من صام اليوم الذي يشك فيه فقد عصى أبا القاسم صلى الله عليه وسلم»
“যে ব্যক্তি সন্দেহের দিন সাওম পালন করল সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হলো”।
তাছাড়া সন্দেহের দিন সাওম পালনকারী আল্লাহর দেওয়া সীমা অতিক্রম করল। কেননা আল্লাহ তা‘আলার সীমা হলো, কেহ রমযানের চাঁদ না দেখে বা চাঁদ প্রমাণিত না হলে রমযানের সাওম পালন করবে না। তাই তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لا يتقدمن أحدكم رمضان بصيام يوم أو يومين، إلا رجل كان يصوم صوما فليصمه»
“তোমাদের কেহ যেন রমযান মাসকে এক বা দু‘দিন বাড়িয়ে না দেয়। তবে যার অন্য কোনো নিয়মিত সাওম সে দিনে হয়ে যায়, তার কথা আলাদা”। (রমযানের ১লা তারিখ সন্দেহ করে সাওম পালন করা যাবে না)
জওয়াব: যদি সাওম পালনে তার ক্ষতি হয়, তার জন্য সাওম পালন জায়েয নয়। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا﴾ [النساء: ٢٩]
“তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের প্রতি দয়াশীল।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন আরো বলেন,
﴿وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ﴾ [البقرة: ١٩٥]
“তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫]
তাই যে বৃদ্ধ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের জন্য সাওম ক্ষতিকর তার জন্য সাওম পালন জায়েয নয়। এর সাথে ভবিষ্যতে সাওম পালনের সামর্থ্যবান হওয়ার সম্ভাবনা যদি না থাকে তাহলে সে প্রত্যেকটি সাওমের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে বা দান করবে। এতেই সে সিয়ামের দায় থেকে মুক্ত হবে।
জওয়াব: সাওমের রুকনসমূহ:
১- সুবেহ সাদেক উদয় হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাওমভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ বলেছেন,
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ﴾ [البقرة: ١٨٧]
“এবং তোমরা আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সাওম পূর্ণ কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭]
সাদা ও কালো রেখার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, দিনের শুভ্রতা ও রাতের কৃষ্ণতা।
২- নিয়ত। অর্থাৎ সাওমদার ব্যক্তি সাওমভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করার নিয়ত করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল আর প্রত্যেকের জন্য তাই নির্ধারিত যা সে নিয়ত করেছে।’
জওয়াব: সাওম অবস্থায় যা যা করা বৈধ:
১ - গোসল করা, ঠাণ্ডা পানিতে বসা।
২ – মুখের থুতু ও কাশ গিলে ফেলা।
৩ - জিহ্বা দিয়ে কোনো খাদ্যের কেবল স্বাদ পরীক্ষা করে দেখা। তবে শর্ত হলো কোনোকিছুই যেন কন্ঠের নিচে প্রবেশ না করে।
৪- আতর-সুগন্ধি ইত্যাদির ঘ্রাণ নেওয়া।
৫- সাওমদারের মিসওয়াক ব্যবহার। যেকোনো সময় মিসওয়াক ব্যবহার করা বৈধ, হোক তা সূর্যে ঢলে যাওয়ার পূর্বে অথবা পরে। হোক তা তাজা অথবা শুষ্ক। তবে মিসওয়াক তাজা হওয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন কন্ঠের নিচে চলে না যায়। কেননা এরূপ হলে সাওম ভেঙ্গে যাবে।
জওয়াব: সাওমের সুন্নত ও মুস্তাহাবসমূহ:
১ - সাহরী খাওয়া এবং তা দেরী করে ফজরের আযানের কিছু সময় পূর্বে খাওয়া।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সাহরী খাও। কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে।’
২ - দ্রুত ইফতার করা।
সাওমদারের জন্য মুস্তাহাব হলো দ্রুত ইফতার করা। অর্থাৎ সূর্যাস্ত যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে সাথে সাথে ইফতার করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ ভালো থাকবে যতক্ষণ তারা দ্রুত ইফতার করে যাবে।’
তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব। তাজা খেজুর না পাওয়া গেলে শুকনো খেজুর দিয়ে ইফতার করা। খেজুর বেজোড় সংখ্যায় হওয়া। যদি খেজুর না পাওয়া যায় তবে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করা। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের পূর্বে বেজোড় সংখ্যক তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর খেজুর না পেলে তিনি কয়েক ঢোক পানি পান করে ইফতার করতেন।’
৩- ইফতারের সময় দো‘আ পড়া। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন, বলতেন,
«ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ»
“তৃষ্ণা চলে গেছে, শিরাগুলো আদ্র হয়েছে আর ছাওয়াব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনত্র বলেছেন, ‘নিশ্চয় ইফতারের সময় সাওমদারের দো‘আ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ (আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫৭। আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।)
৪- অহেতুক ও অশ্লীল কথা পরিত্যাগ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ،وَلاَ يَصْخَبْ ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ، أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ: إِنِّى امْرُؤٌ صَائِمٌ».
“তোমাদের কেউ যখন সাওম পালন করবে তখন সে যেন অশ্লীল কথা, ঝগড়া ও হট্টগোল বর্জন করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখন সে যেন বলে, আমি সাওম পালনকারী।”
৫- বেশি বেশি ইবাদত করা। যেমন, কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকর করা, তারাবীর সালাত পড়া, তাহাজ্জুদের সালাত পড়া, লাইলাতুল কদর যাপন করা, ফরয সালাতের আগে-পড়ের সুন্নতগুলো আদায় করা, দান-সদকা করা, ভালো কাজ সম্পাদনে অর্থ ও শ্রম ব্যয় করা, সাওমদারদেরকে ইফতার করানো ও মাহে রমযানে উমরা আদায় করা; কেননা মাহে রমযানে নেক আমলের ছাওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ইবন ‘আব্বাস রারিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব থেকে বেশি দানশীল ছিলেন, আর তিনি রমযান মাসে সমধিক দানশীল থেকেন, যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে কুরআন চর্চা করাতেন। যখন জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি দান খয়রাতে উন্মুক্ত বাতাস থেকেও অধিক বেগবান থেকেন।
জওয়াব: সাওম অবস্থায় যেসব কাজ করা মাকরূহ:
১ - কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ায় অতিরঞ্জিত করা। কেননা এরূপ করলে পেটে পানি চলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এতদসংক্রান্ত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَبَالِغْ في الاِسْتِنْشَاقِ إِلاَّ أَنْ تَكُونَ صَائِمًا ».
“আর নাকে পানি দেওয়ায় তুমি অতিরঞ্জিত করো, তবে যদি সাওমদার হও।”
২ - যৌনোত্তেজনাসহ চুম্বন করা। সাওমদার ব্যক্তি যদি বীর্যপাত অথবা উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তবে তার পক্ষে চুম্বন করা মাকরূহ হবে। আর সাওমদার ব্যক্তির উচিত হবে এমন সব বিষয় বর্জন করা যার দ্বারা যৌনাত্তেজনা আন্দোলিত হয়। হ্যাঁ, যদি সাওম ভঙ্গ হবে না বলে আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে তার কথা ভিন্ন। ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النبي يُقَبِّلُ، وَيُبَاشِرُ وَهُوَ صَائِمٌ، وَكَانَ أَمْلَكَكُمْ لإِرْبِهِ»
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম রাখা অবস্থায় চুম্বন করতেন, আলিঙ্গন করতেন। আর তিনি ছিলেন তোমাদের মধ্যে সব থেকে বেশি তার প্রয়োজনকে নিয়ন্ত্রণকারী।” এ কারণেই যুবকদের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের সাথে জড়িয়ে থাকা মাকরূহ। অবশ্য বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মাকরূহ নয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের সাথে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অন্য এক ব্যক্তি এসে অভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল, তবে তিনি তাকে নিষেধ করলেন। দেখা গেল, তিনি যাকে অনুমতি দিলেন সে ছিল বৃদ্ধ। আর যাকে অনুমতি দিলেন না সে ছিল যুবক।’