সাহাবীগণের মধ্যে যে সব ফিতনা, জিহাদ, ঝগড়া-ঝাটি ও বিতর্ক সংঘটিত হয়েছিল সে ব্যাপারে প্রত্যেক মুমিনের উচিৎ সেসব ব্যাপার থেকে মুখ ফিরিয়ে নীরব থাকা, এড়িয়ে যাওয়া ও সেগুলো নিয়ে বেশি মাতামাতি না করা।
কবির ভাষায়,
‘তাদের মধ্যে যা ঘটেছিল সে ব্যাপারে আমরা নীরব থাকব,
ইজতিহাদের সাওয়াব তাদের জন্য আমরা সাব্যস্ত করব।’[1]
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কিতাবসমূহে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের মধ্যকার সংঘটিত বিরোধপূর্ণ ব্যাপারে অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হতে নিষেধ করা হয়েছে। সাথে সাথে এ বিশ্বাস রাখার কথা বলা হয়েছে যে, এগুলো ছিলো তাদের ইজতিহাদ, যাতে ভুল হলে ব্যক্তি একটি সাওয়াব আর সঠিক হলে দু’টি সাওয়াবের অধিকারী হয়।
কবি বলেছেন,
‘বাস্তব কথা হলো সাহাবীগণের মধ্যাকার ঘটিত ফিতনার ব্যাপারে নীরব থাকা,
কেননা এ সব কিছু ছিলো তাদের ইজতিহাদ।’ [2]
বস্তুত নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় আমাদেরকে উক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে নির্দেশনা দিচ্ছে। তা হলো:
প্রথমত: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ মান্য করা ও সে অনুযায়ী আমল করা। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَإِذَا ذُكِرَ أَصْحَابِي فَأَمْسِكُوا».
“যখন তোমাদের সম্মুখে আমার সাহাবীগণের ব্যাপারে কোনো সমালোচনা করা হবে তখন তোমরা সমালোচনা থেকে বিরত থাকবে।”[3]
দ্বিতীয়ত: এ সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় কোনো ফায়েদা নেই, ইলমী দিকেও কোনো উপকার লাভ হয় না, আমলের বিবেচনায়ও কোনো উপকার অর্জিত হয় না। আর ব্যক্তির সুন্দর ইসলাম হচ্ছে অনর্থক বিষয় পরিহার করা।[4] কেননা সাহাবীগণের মধ্যে যে সব যুদ্ধ ও ফিতনা সংঘটিত হয়েছিল তা মূলত তাদের ইজতিহাদ থেকেই উৎসারিত হয়েছিলো। প্রত্যেকেই তাদের মতানুযায়ী হকের উপরে ছিলো এবং সত্যের বিজয় করতে লড়েছেন। এতে তারা কেউ কারো ওপর হিংসা-হানাহানি, প্রতিশোধ বা সম্মানহানী করতে লড়েন নি। এর উপমা এমন যে, বিচারক কাউকে আদব শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রহার করেছে। সে সব ঘটনার পরে তাদের মধ্যকার বিদ্বেষ দূর হয়ে গেছে বলেই ধারণা করা উচিৎ। তাদের পরে যারা এসেছে তাদের সাথে এসব ঘটনার কী সম্পর্ক? তারা তো এ ঘটনার ব্যাপারে ‘বানিজ্য কাফেলাও নন, যুদ্ধে আগত বাহিনীও নন’।[5]
এ ব্যাপারে উমার ইবন আব্দুল আযীয রহ. এর কথাটি সর্বাধিক সুন্দর। তিনি বলেছেন, ‘সে রক্তপাত থেকে আল্লাহ আমাদের হাতকে পবিত্র রেখেছেন। অতএব, আমি আমার যবানকে (মুখের ভাষাকে) এ ব্যাপারে সমালোচনা করে রঙিন করতে (কলুষিত করতে) চাই না।’ [6]
তৃতীয়ত: এ সব বিষয়ে গভীর আলোচনা কেউ করলে তা সে ব্যক্তিকে নিন্দনীয় পরিণামে নিয়ে যায়। ফলে দৃঢ় হওয়ার পরও তার পদস্খলন ঘটে। এতে তার অন্তরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সাহাবীর ব্যাপারে খারাপ ধারণা জন্মায়। এ হচ্ছে এক মহা বিপর্যয়। এর চেয়ে মারাত্মক সঙ্কট আর কী হতে পারে? আর কোনো খারাপ পরিণতির পন্থা শুরু থেকেই বন্ধ করে দেওয়া ইসলামী শরী‘আতের অন্যতম একটি মূলনীতি।
বারবাহারী রহ. বলেছেন, ‘সাহাবীগণের কোনো প্রকার পদস্খলন, তাদের কোনো যুদ্ধ, আর যে বিষয়ের জ্ঞান তোমার কাছে অনুপস্থিত, সেসবের কোনো কিছুই আলোচনা করবে না। এ সব দোষ-ত্রুটি কেউ বর্ণনা করলেও শুনবে না। কেননা এসব ব্যাপার শুনলে ব্যক্তির অন্তরে তাদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা জন্মাতে পারে।’[7]
কবি বলেছেন,
তাদের মধ্যকার সংঘটিত ব্যাপারে সমালোচনা থেকে সাবধান থাকো, যা তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে। কেননা সেগুলো তাদের ইজতিহাদ থেকে নির্গত হয়েছে, এর মাধ্যমে তুমি নিজেকে নিরাপদ রাখ; যে কেউ তাদেরকে পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।’[8]
চতুর্থত: মিথ্যাবাদি, মুনাফিক ও বিদ‘আতীরা এসব ব্যাপারে অনেক বানোয়াট তথ্য ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে।
তাহলে আপনি সেসব ব্যাপারে কীভাবে বিশুদ্ধ হুকুম দিবেন, যে সব বর্ণনার অধিকাংশই মিথ্যাবাদী ও দুর্বল লোকদের মাধ্যমে এসেছে?
যেহেতু ইতিহাসের গ্রন্থই সাহাবীগণের মধ্যকার সংঘটিত ফিতনা বর্ণনার উৎস। আর এ কথা সকলেরই জানা যে, ইতিহাসের কিতাব ভালো-মন্দ, সহীহ-দুর্বল সব ধরণের ঘটনাই বর্ণনা করে থাকে। আর তাদের অভ্যাস হচ্ছে মানুষের কাছে যা কিছু পায় তা বিচার বিবেচনা ছাড়াই যোগ করে দেয়া। তাহলে এ ধরণের স্পর্শকাতর ঘটনায় কীভাবে প্রবৃত্তি পূজারীদের লালসার শিকার হওয়া তথ্যে বিশ্বাস করা যেতে পারে?
এ ছাড়া যে সামান্য কিছু বর্ণনা সহীহ সূত্রে এসেছে তা তাদের সম্মান ও মর্যাদা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যায়। ইতোপূর্বে সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
ইবন দাক্বীক আল-‘ঈদ রহ. বলেছেন, ‘সাহাবীগণের মধ্যকার সংঘটিত বিভেদসমূহ সম্পর্কে যে সব বর্ণনা এসেছে আর তাতে তারা বিভিন্ন ধরনের মত দিয়েছে, সেসব বর্ণনার অধিকাংশই বাতিল ও মিথ্যা। এগুলোর দিকে তাকানোই যাবে না। আর যে সব ঘটনা সহীহ সেগুলোকে আমরা তাদের মর্যাদা অনুযায়ী সুন্দর ব্যাখ্যা করব। কেননা তাদের ব্যাপারে আল্লাহর প্রশংসা এ সব ঘটনার আগেই সন্দেহাতীতভাবে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে তাদের ব্যাপারে পরবর্তীতে যে সব ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোতে ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। আর নিয়ম হচ্ছে যে, সন্দেহযুক্ত ও ধারণানির্ভর কিছু দ্বারা অকাট্য ও সঠিকভাবে জ্ঞাত বিষয়কে বাতিল করা যায় না।’[9]
পঞ্চমত: তাদের মধ্যে যা সংঘটিত হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবতা জানা কষ্টসাধ্য; কেননা সে সময়টি ছিলো ফিতনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সময়। এ ধরণের অবস্থায় যে কোনো ব্যাপার ভালো-মন্দে মিশ্রিত হয়ে যায় এবং সঠিক ব্যাপার হুবহু জানা যায় না। অতএব, এ ধরণের ব্যাপার সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। সুতরাং যে ব্যক্তি তার দীনের ব্যাপারে দোষ-ত্রুটি মুক্ত থাকতে চায় সে যেন এ সব বিষয়ের সমালোচনায় নিজেকে নিমজ্জিত করা থেকে দূরে রাখে; বরং তাদের ভালোবাসা দ্বারা যেন তার অন্তর পরিপূর্ণ করে নেয়, তাদের পক্ষ থেকে ওযর (ই‘তিযার) পেশ করে এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম (আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন)।
>[2] আল-জাওয়াহিরুল ফারীদাহ ফি তাহকীকিল আক্বীদাহ, পৃষ্ঠা ৪৩, পংক্তি ২৩৯।
[3] আল-‘মুজামুল-কাবীর, তাবরানী, ২/৯৬, হাদীস নং ১৪২৭, ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস; ইরাকী রহ. ইহইয়া উলুমুদ্দীনে (১/৫০, মুদ্রণ: আস-সাকাফাহ আল-ইসলামিয়া) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন; সিলসিলাতুস সহীহাহ, ১/৫৭, হাদীস নং ৩৪।
[4] ইমাম আহমাদ রহ. তার মুসনাদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, ২/৩৫২, হাদীস নং ১৭৩৭। এ হাদীসটি সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপারে অনেক দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। হাদীসটির হুকুমের ব্যাপারে সবচেয়ে সুন্দর কথা একত্রিত করেছেন ইবন রজব হাম্বলী রহ. তার ‘জামে‘উল ‘উলুম ওয়াল হিকাম’ ১/১১৩ কিতাবে।
[5] তাহির ইবন ‘আশূর, আত-তাহরীর ওয়াত-তানওয়ীর, ২৮/৯৮।
[6] আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৯/১১৪।
[7] শরহিস সুন্নাহ, বারবাহারী, পৃষ্ঠা ১১২-১১৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৯২।
[8] আদ-দুররাতুল মুদিয়্যাহ -মা‘আ শারহেহা লাওয়ামি‘উল আনওয়ার, ২/৩৮৫।
[9] মুল্লা ‘আলী কারী রহ. তার ‘শরহুল ফিকহিল আকবর’ কিতাবে পৃষ্ঠা ১০২ এ উল্লেখ করেছেন।