সপ্তম অধিকার: তাদের ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা এবং এ ব্যাপারে কিছু মনে আসলে চক্ষু অবনত করে এড়িয়ে যাওয়া

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শরী‘আত অনুমোদিত পদ্ধতিতে মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। তারা অতি বাড়াবাড়ি, কট্টরতা, ছাড়াছাড়ি ও নানা দলে বিভক্ত হওয়া থেকে সর্বোচ্চ দূরে অবস্থানকারী মানুষ। এ কারণেই তারা বিশ্বাস করেন যে, সাহাবীগণের উচ্চ মর্যাদা হওয়া মানে এটা নয় যে, তারা গুনাহ থেকে মুক্ত; তাদের ন্যায়পরায়ণতা সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি তাদের ভুল-ত্রুটিতে পতিত হওয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

তা সত্ত্বেও তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো অন্যদের ভুলের সাথে তুলনা করা যাবে না। তাদের ও অন্যদের জীবন চরিত যারা জানেন তারা এ দুয়ের মধ্যকার পার্থক্য ভালোভাবেই বুঝতে পারেন।

তাছাড়া তাদের মধ্যকার যেসব ভুল বা অপরাধ ধারণা করা হয়ে থাকে তার অধিকাংশই বাড়তি কিংবা কমতি বর্ণনা থেকে মুক্ত নয় অথবা এসব বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। বরং এসব বর্ণনার অধিকাংশই অনুরূপ।[1] সুতরাং নির্দ্বিধায় এসব বর্ণনা প্রত্যাখাত ও নিক্ষিপ্ত।

আবার কিছু বর্ণনার সূত্র সঠিক হলেও সে সব বর্ণনার সুন্দর ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যাখ্যাটি নির্দিষ্টভাবে ধর্তব্য হবে।

যেহেতু মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যান্য সাধারণ মুসলিমের ব্যাপারে সুন্দর ধারণা পোষণ করতে আদেশ করা হয়েছে, তাহলে মুমিনদের সর্বোত্তম ও নেতৃবর্গের ব্যাপারে (সাহাবীগণের ব্যাপারে) তাদের কীরূপ ধারণা পোষণ করা উচিৎ একটু চিন্তা করে দেখুন।

দুর্বলতম ঈমানের অধিকারীগণও তাদের ব্যাপারে এ ধারণা করবে যে, তাদের থেকে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তা তাদের নিজস্ব গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা অথবা ভুল ও অসচেতনা বশত: হয়েছে অথবা সেটি তাদের ইজতিহাদ ছিল, যাতে ব্যক্তি সঠিকতায় পৌঁছলে দুটি সাওয়াব আর ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হলে একটি সাওয়াবের অধিকারী হয়। [2]

যা হোক, তাদের থেকে যে সব ভুল-ত্রুটি ও গুনাহ সংঘটিত হয়েছে তা পাঁচ ভাগে সীমাবদ্ধ:[3]

প্রথমত: সেসব ভুলের ব্যাপারে তারা তাওবা করেছেন। আর একথা কারোই অজানা নয় যে, ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে সাহাবীরা সবচেয়ে দ্রুত তাওবাকারী। আর সকলেই জানে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ، كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ».

“গুনাহ থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তিতুল্য।”[4]

আর আল্লাহর কাছে অন্যদের তুলনায় তাদের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের কারণে তাদের তাওবা সবচেয়ে বেশি কবুল হওয়ার যোগ্য।

দ্বিতীয়ত: তাদের অপরিসীম সৎকাজের কারণে তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। সৎকাজসমূহ গুনাহসমূহকে মোচন করে দেয়। সাহাবীগণের সৎকাজসমূহের (পূর্বে যা আলোচনা করা হয়েছে) পরিমাণ অনেক বেশি ও এর প্রতিদানও অনেক বড়। এ ব্যাপারে আগে আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয়ত: ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে শরিক হওয়ার কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে বলেছেন,

«مَا يُدْرِيكَ، لَعَلَّ اللَّهَ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ: اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ».

“তুমি জান কি? অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা আহলে বদর সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত রয়েছেন এবং তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যেমন ইচ্ছা আমল করো।”[5]

চতুর্থত: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশের কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তাঁর শাফা‘আত তাওহীদবাদিরা প্রাপ্ত হবেন, যারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শির্ক করেন না,[6] তাহলে যারা সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ তাওহীদবাদি এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাধিক নিকটবর্তী লোক তাদের ব্যাপারে আপনার ধারণা কীরূপ হতে পারে?। নিঃসন্দেহে তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ প্রাপ্তিতে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক অগ্রগামী মানুষ।

পঞ্চমত: দুনিয়াতে তারা যেসব বালা-মুসিবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন সে কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। আর শরী‘আতের নিয়মানুযায়ী বালা-মুসিবত গুনাহ মোচনকারী।

উপরোক্ত আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা বর্ণনা করা যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের ব্যাপারে তাদের অন্তর ও মুখের ভাষা পবিত্র ও নিরাপদ রাখতে হবে।[7] সুতরাং এখানে একটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে সাব্যস্ত হচ্ছে যে, মুসলিমের অন্তর ও তার মুখের ভাষা সাহাবীগণের মধ্যকার সংঘটিত ব্যাপারে সমালোচনা ও নিন্দা করা থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকবে। যার অন্তর কলুষিত সে ব্যতীত এ সরল সঠিক পথ থেকে কেউ বিমূখ হয় না।

সুফইয়ান ইবন ‘উয়াইনা রহ. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের কোনো ব্যাপারে মুখ খুলবে (সমালোচনা করবে) সে প্রবৃত্তি পূজারীদের অন্তর্ভুক্ত’।[8] ইমাম আহমাদ রহ. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সাহাবীর ব্যাপারে সমালোচনা করবে, অথবা তাদের কোনো ঘটনার কারণে তাদের কাউকে অপছন্দ করবে অথবা দোষ-ত্রুটি ও অসৌজন্যতার সাথে তাদের কারো নাম উল্লেখ করবে, সে ব্যক্তি বিদ‘আতী; যতক্ষণ না সে সাহাবীদের সকলের জন্য আল্লাহর রহমতের দো‘আ না করবে। আর এর মাধ্যমে তার অন্তর তাদের (সাহাবীগণের) ব্যাপারে পবিত্র ও নিরাপদ হবে।’[9]

>
[1] দেখুন, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৯৩।

[2] মাজমু‘উল ফাতাওয়া (‘আল-ওয়াসিতিয়্যাহ’), ৩/১৫৫।

[3] শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. পূর্বোক্ত কিতাবে এ পাঁচটি বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে ইঙ্গিত করেছেন।

[4] ইবন মাজাহ মারফু‘ সূত্রে তার সুনানে বর্ণনা করেছেন, ২/১৪১৯, হাদীস নং ৪২৫০, হাদীসটি ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। ইবন হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারী ১৩/৪৭১ এ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

[5] সহীহ বুখারী, কিতাব: ফাদায়েলুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার, বাব: আল-জাসূস, ২/৩৬০, হাদীস নং ৩০০৭; সহীহ মুসলিম, কিতাব : ফাদায়েলুস সাহাবাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, বাব : ফাদায়েলু আহলি বদর, ৪/১৯৪১, হাদীস নং ৩৪৯৪, হাদীসটি আলী ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত।

[6] যেমন, সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত আছে। সহীহ মুসলিম, ১/১৮৯, হাদীস নং ১৯৯।

[7] মাজমু‘উল ফাতাওয়া ‘আল-ওয়াসিতিয়্যাহ’, ৩/১৫২।

[8] শরহিস সুন্নাহ, বারবাহারী, পৃষ্ঠা ৭৫।

[9] শরহি উসূলি ‘ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, লালকায়ী, ১/১৬৯।