ইসলামের দাওয়াতের ভিত্তিমূলই হলো আল্লাহ তাআলার একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করা, গোটা সৃষ্টি জগতের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া। আরও আগে বেড়ে বলা যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সকল রাসূলের রিসালতের শুরু ও শেষ কথাই ছিল আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل: ٣٦]
“আর আমরা প্রত্যেক উম্মতের কাছে একজন করে রাসূল প্রেরণ করেছি এই বলে যে, আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো।” [সূরা আন-নাহল: ৩৬] অন্যত্র আরও বলেন,
﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥ ﴾ [البينة: ٥]
“আর তারা এ ভিন্ন আদিষ্ট হয়নি যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে দীনে তার প্রতি বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে, একনিষ্ঠভাবে, আর সালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ: ৫]
পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন এভাবে,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]
“আর আমি মানুষ ও জিনকে- আমার ইবাদত করবে- এজন্য ছাড়া সৃষ্টি করি নি।” [সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬]
আর এভাবেই ইসলামী শরীয়তে মানুষের পৃথিবীতে অস্তিত্বের একমাত্র কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে এক আল্লাহর ইবাদত করা আর তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। এবিষয়টি নিয়ে ইসলামে কোনো অস্পষ্টতা রাখা হয় নি। ফলে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্নভাবে মানুষের সামনে আপন অস্তিত্বের বিষয়টি তুলে ধরেছেন যাতে করে মানুষের মনে এতটুকু সন্দেহ না থাকে। আল্লাহ তাআলা বিশাল আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন, যেন মানুষ এগুলোর মাধ্যমে তার রবের স্তিঅস্তিত্বের সন্ধান লাভ করে। এজন্য তিনি মানুষকে নভোমন্ডল-ভূমন্ডল ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে ভেবে দেখতে বলেছেন। আর তিনি মানুষকে এমন সব নির্দশন দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা তাকে ঈমান ও সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করবে,
﴿سَنُرِيهِمۡ ءَايَٰتِنَا فِي ٱلۡأٓفَاقِ وَفِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّۗ ﴾ [فصلت: ٥٣]
“আমি অচিরেই তাদের দেখাবো আমার নিদর্শনাবলী দিগদিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মাঝেও, যাতে করে তাদের সামনে স্পষ্ট যায় যে এটা ধ্রুবসত্য।” [সূরা ফুস্সিলাত: ৫৩]
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরার জন্য কেবল সৃষ্টির মাঝে নিহিত তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শনাবলীর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি; বরং নিজ একত্ববাদের সুস্পষ্ট আহ্বান নিয়ে যুগে যুগে মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন পুণ্যাত্মা নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালামদের। তারা এসে মানুষকে বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র প্রতিপালক ও ইবাদতের উপযুক্ত। তিনি গোটা বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা। ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র রবও তিনিই। নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলী শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান-কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে পারে। সর্বোত্তম পন্থায় তার ইবাদত ও আরাধনা করে। আর এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি নিজ অস্তিত্বের সকল ‘প্রমাণ’ পূর্ণ করে দেন। অতঃপর সেগুলোর বাস্তবায়নের জন্য মানুষের জীবন-বিধান স্বরূপ নির্বাচিত করেন ইসলামকে। যাতে করে সালাত, সিয়াম ও হজ্জ ইত্যাদি ইবাদতের মধ্য দিয়ে সদা-সর্বদা মানুষের মনে আল্লাহর স্তিঅস্তিত্বের বাস্তবতা চির জাগরূগ থাকে। মানুষ সবসময়ই নিজ রবকে একান্তই কাছে অনুভব করে। মূলত একারণেই ইসলামের সকল ইবাদতে একনিষ্ঠতা ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ নিবেদনকে সাফল্যের মৌলিক শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ সন্দেহ নেই, একজন মানুষ যখন দিন-রাতের চব্বিশ ঘন্টায় আল্লাহর সামনে পাঁচবার সালাতের মাধ্যমে মাথা নত করবে, তখন বাকি সময়টাও তার মন ও মস্তিষ্ক আল্লাহর সমীপে অবনত থাকবে।
এভাবেই স্বীয় রবের সঙ্গে সান্নি্ধ্যের সুনিবিড় বন্ধন গড়ে দেওয়ার মাধ্যমে ইসলাম একজন মানুষকে নাস্তিক্যবাদ থেকে মুক্ত রাখতে পারে। পারে মানুষ ও তাঁর রবের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এমন সবকিছু থেকে তাকে দূরে রাখতে।
মানবতাকে কেবল তাওহীদের শিক্ষা দিয়েই ইসলাম ক্ষান্ত থাকে নি; বরং পৃথিবীতে আদল ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা, গোটা বিশ্ব মানবতার পর্থিব জীবনের শান্তি ও সফলতা নিশ্চিত করার বিষয়টিও ইসলাম পরম গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সে কারণে মুসলিমদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিজেরা কল্যাণ ও সফলতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন অন্যান্য মানুষকেও এর প্রতি আহ্বান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤﴾ [ال عمران: ١٠٤]
“আর তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকা চাই যারা আহ্বান করবে কল্যাণের প্রতি, নির্দেশ দিবে ন্যায়ের, আর নিষেধ করবে অন্যায় থেকে। আর তারাই হচ্ছে সফলকাম।” [সূরা আল-ইমরান: ১০৪]
অন্যত্র বলেন,
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ﴾ [ال عمران: ١١٠]
“তোমরাই মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠ জাতিরূপে উত্থিত হয়েছো- তোমরা ন্যায়ের পথে নির্দেশ দাও ও অন্যায় থেকে নিষেধ করো, আর আল্লাহতে বিশ্বাস রাখো। [সূরা আল-ইমরান: ১১০]
অতঃপর দাওয়াতের এপথে চলতে গিয়ে ধেয়ে আসা সকল বিপদ-আপদের মুখে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের ধৈর্য ও সবরের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে বিমুখতার পথ বেছে না নেয়। পাশাপাশি নির্দেশ দিয়েছেন বিতর্কের ক্ষেত্রে যেন তারা হিকমত ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করে। এভাবে মুমিনদের হৃদয় মানুষের মুহাব্বত ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকবে, সর্বদা তাদের শির্ক ও অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে হিদায়াতের আলোর পথে নিয়ে আসার চিন্তায় বিভোর থাকবে।
ইসলাম নিজ অনুসারীদের কাফের ও মুশরিকসহ পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে আদল ও ইনসাফ, দয়া ও করুণা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। দীন ও উম্মাহর কল্যাণ ও মঙ্গলের খাতিরে বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে আসা সকল যুলুম-নির্যাতনের ক্ষেত্রে সবর কিংবা বেশির থেকে বেশি হলে ইনসাফপূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বলেছে। আল্লাহ বলেন,
﴿وَقَٰتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يُقَٰتِلُونَكُمۡ وَلَا تَعۡتَدُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ١٩٠﴾ [البقرة: ١٩٠]
“আর আল্লাহর পথে তোমরা যুদ্ধ করো তাদের সঙ্গে যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। আর সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-বাক্বারা: ১৯০]
একইভাবে কাফেরদের জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنََٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ ٱعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ٨ ﴾ [المائدة: ٨]
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর জন্য দৃঢ় প্রতিষ্ঠাতা হও, ন্যায়-বিচারে সাক্ষ্যদাতা হও, আর কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন ন্যায়াচরণ না করতে প্ররোচিত না করে। ন্যায়াচরণ করো, এটিই হচ্ছে তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটতর। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো। নিঃসন্দেহে তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিক-হাল।” [সূরা আল-মায়িদাহ: ৮]
মূলত ইসলাম গোটা মানবতার জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ পৃথিবীতে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের নবীকেও ‘রহমতের নবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الانبياء: ١٠٧]
“আর আমরা তো কেবল আপনাকে গোটা সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।”[সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭]
এরপর ইসলাম মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন ও অভাবী মানুষের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিবেশীদের পরস্পরের ওপর বিভিন্ন অধিকার নির্ধারণ করেছে। বন্ধুর ওপর বন্ধুর অধিকার দিয়েছে। নিজের আশ-পাশের মানুষের অধিকারের কথাও বাদ রাখে নি। আরও আগে বেড়ে বলা যায়, পৃথিবীর সকল মুসলিমের একে অপরের ওপর বিভিন্ন অধিকার সাব্যস্ত করেছে। সালামের জবাব, হাঁচির উত্তর কিংবা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার মাধ্যমেও এসব অধিকার পূর্ণ হয়ে থাকে। এসবের পাশাপাশি ইসলাম একজন মুসলিমকে অপর মুসলিমের ওপর জুলুম করতে নিষেধ করছে। কাউকে ঘৃণা বা অপমান করতে বারণ করেছে। তিনদিন কারও সঙ্গে কথা না বলে থাকতে নিষেধ করেছে। কারও দরাদরির ওপর দরাদরি, বিয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব করতে বারণ করেছে। অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-সমালোচনা থেকে দূরে থাকতে বলেছে। এগুলো অমান্যকারীর জন্য ঘোষণা করেছে কঠোর শাস্তি। এভাবেই ইসলাম পরিণত হয়েছে একটি পরিপূর্ণ মানবতার পয়গামে। যা এর অনুসারীকে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে ন্যায় ও কল্যাণের বীজ বপনের নির্দেশ দেয়। জগতের প্রত্যেকটি মানুষের সঙ্গে দয়া ও করুণার দীক্ষা দেয়।
মানবতার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শনের এসব দীক্ষা নিয়ে একজন সত্যিকার মুসলিম সহজাতভাবেই সম্পূর্ণ সুনির্মল ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী একজন সুন্দর মানুষে পরিণত হয়। আর এগুলো করতে গিয়ে যখন সে সবসময় স্বীয় রবের ধ্যান ও খেয়াল হৃদয়ে জাগ্রত রাখবে, সন্দেহ নেই কুফর, অবিশ্বাস আর নাস্তিক্যবাদ থেকে সে অনেক দূরে থাকবে। পরিণত হবে মহান প্রভুর নিতান্ত কাছের একজন মানুষে।
এভাবে ইসলামের সঠিক চর্চার মাধ্যমে একজন মুসলিম হয়ে ওঠে ভূপৃষ্ঠের ওপর চলমান সবার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ هُمۡ خَيۡرُ ٱلۡبَرِيَّةِ ٧ ﴾ [البينة: ٧]
“নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারা গোটা সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বোত্তম।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ: ৭]
পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হতে পারি যে, পৃথিবীতে ইসলামের আগমনের অন্যতম দু’টি মৌলিক উদ্দেশ্য হলো: নিষ্ঠা ও পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক তাঁর ইবাদতে আত্মনিবেদন করা এবং গোটা মানবতার কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য কাজ করা। অথচ নাস্তিক্যবাদ এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে গোটা পৃথিবীতে কেবল অশান্তি আর নৈরাজ্য সৃষ্টি করতেই অধিকতর সিদ্ধহস্ত।
কুফর ও অবিশ্বাস হলো বাস্তবতাবিবর্জিত ও অন্তঃসারশূন্য একটি মতবাদ। কারণ আল্লাহর অস্তিত্বে অস্বীকার, পরকাল ও জান্নাত-জাহান্নামে অবিশ্বাস, নবী-রাসূলগণের রিসালতের ওপর অনাস্থা সম্পর্কে একজন মানুষ মুখে মুখে শত তর্ক করলেও হৃদয় ও মনোজগতে সে কখনোই পরিতৃপ্ত হতে পারে না। আর সেকারণে একজন অবিশ্বাসীর কাছে ‘অজ্ঞতা’ই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। সে যা জানে না, সেটাই সত্য বলে মানবে না- এটাই তার কাছে পৃথিবীর সবকিছু বিচার-বিবেচনার মাপকাঠি। পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা বলতে কাউকে আমি দেখি না বা চিনি না। পরকাল ও জান্নাত-জাহান্নাম বলতে কিছু আছে বলে মনে হয় না- এসব ‘অজ্ঞতা’ আর ‘অনুমান’ হচ্ছে তার দর্শনের মূল ভিত্তি। অথচ তার এটাও জানা নেই যে, ‘অজ্ঞতা’ ও ‘অনুমান’ কখনো বিচারের মানদণ্ড হতে পারে না।
কিন্তু তাদের অবিশ্বাসের মূল কারণ কিন্তু এটা নয় যে, আল্লাহর অস্তিত্বের নির্দশনাবলী তাদের চোখে পড়ে না; বরং গোপন কিছু স্বার্থসিদ্ধি আর গরজ হাসিলের জন্য তারা অবিশ্বাসের পথ বেছে নেয়। কারণ তাদের খুব ভালো করে জানা আছে, ঈমান ও বিশ্বাসের পথ বেছে নিলে সেটা তাদের কৃপ্রবৃত্তির নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। স্বেচ্ছাচারিতার সব দুয়ার বন্ধ করে দিবে। তখন যথেচ্ছভাবে জীবন ও যিন্দিগির পথে হাঁটা যাবে না। যা কিছু ভালো লাগে তা-ই করতে হবে এমন সুযোগ থাকবে না। আর এগুলিই মূলত যুগে যুগে কাফির ও অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস থেকে বিমুখতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে মূল নিয়ামকের কাজ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَمَا تَهۡوَى ٱلۡأَنفُسُۖ وَلَقَدۡ جَآءَهُم مِّن رَّبِّهِمُ ٱلۡهُدَىٰٓ﴾ [النجم: ٢٣]
“তারা তো শুধু অনুমান এবং তাদের প্রবৃত্তি যা কামনা করে তারই অনুসরণ করে। অথচ তাদের প্রভুর কাছ থেকে অবশ্যই তাদের নিকট পথনির্দেশ এসেছে।” [সূরা আন-নাজম: ২৩]
সুতরাং একজন অবিশ্বাসী কখনোই আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারের ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত হতে পারে না। কেননা একজন অবিশ্বাসীর কাছে ‘অজ্ঞতা’ আর ‘অনুমান’ ব্যতীত অবিশ্বাসের কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ থাকে না। যেমন না আছে তার কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জগতের সকল আম্বিয়ায়ে কিরামের মিথ্যা হওয়ার কোনো প্রমাণ; আর না আছে কোনো দলীল যে, নবী-রাসূলগণ অসত্যের দাওয়াত দিয়েছেন এবং লোকদের আহ্বান করেছেন কল্পিত জান্নাত-জাহান্নামের দিকে; অথচ বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। ঠিক তেমনিভাবে না কোনো অবিশ্বাসী সদুত্তর দিতে পারে দাওয়াত ও হিদায়াতের পথে নবী-রাসূলগণের অবর্ণনীয় জুলুম ও লোমহর্ষক নির্যাতন সহ্য করার রহস্য সম্পকে। প্রকৃতপক্ষে আমরা আগেই বলেছি, একজন কাফিরের কাছে তার কুফরের মূলভিত্তিই হচ্ছে ‘অজ্ঞতা’। আর ‘অজ্ঞতা’ ভালো-মন্দ কিংবা সত্য-মিথ্যার মাপকাঠি হতে পারে না।
কিন্তু কোনো কিছু কেবল সত্য বলেই দুনিয়ার সকল মানুষ সেটাকে গ্রহণ করবে- এমন কোনো মূলনীতি নেই। বরং সত্য ও বাস্তবসম্মত হওয়ার পরেও বাস্তবতাকে জগতবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষের চোখের সামনে প্রমাণ দিতে হবে স্বীয় বাস্তবতা ও গ্রহণযোগ্যতার। তবেই মানুষ তাকে বাহু প্রসারিত করে বুকে তুলে নিবে। একইভাবে কোনো কিছু মিথ্যা হওয়ার কারণেই মানুষ তাকে ঘৃণাভরে পরিহার করবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বরং মিথ্যা ও অসুন্দর কখনো কখনো সত্য ও সুন্দরের আবরণে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে মন ও মগজ আচ্ছন্ন করে নেয়। আর তখন মানুষও সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যাকেই ভালোবাসতে থাকে। আর এটা অধিকাংশ সময়ই হয়ে থাকে সত্যের অনুপস্থিতিতে কিংবা সত্যের পক্ষের লোকদের দুর্বলতা, গাফলতী ও উদাসীনতার সুযোগে। মানুষের সামনে মিথ্যার গোমর ফাঁস করা ও নাস্তিকদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত লোকের অভাবে। আমাদের পার্থিব জীবনেও এটার ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে। বাপ-দাদা থেকে ওয়ারিশসূত্রে পাওয়া সম্পত্তিও অনেক সময় ওয়ারিসের দুর্বলতা ও উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী ও ধুরন্ধর শত্রু দখল করে নেয়। অথচ জমির মালিকই সত্যের ওপর আর বিপরীত পক্ষ মিথ্যার ওপর। কিন্তু মিথ্যাবাদী তার মিথ্যার ওপর সত্যতা ও দলীল-প্রমাণের এমন নিশ্ছিদ্র আবরণ তুলে দেয় যে, বিচারক সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হন। কারণ মানুষকে পৃথিবীতে চোখের দেখা ও সামনে উপস্থিত দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে বিচার করতে হয়। আর মূলত সেই একই কারণে আজ আমাদের সত্যের পক্ষের লোকেরা হকের ওপর হওয়া সত্ত্বেও অবিশ্বাসী আর নাস্তিক্যবাদের সামনে অসহায়। যেন পৃথিবীর সব দুর্বলতা আর জড়তা তাদেরকে পেয়ে বসেছে। অথচ তাদের দুশমন নিয়ত উদ্যম আর উন্নতির পথে অবিরাম হাঁটছে। আর মূলত এভাবেই নাস্তিক্যবাদও গোটা পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। যদিও মিথ্যা কখনো মানুষকে মানসিক পরিতৃপ্তি দিতে পারে না। তথাপিও মিথ্যার ওপর যখন সত্যের প্রলেপ দিয়ে সেটাকে ঢেকে ফেলা হয়, তখন মানুষের হৃদয় ও মন খুব সহজেই সেটা গ্রহণ করে নেয়।
নাস্তিক্যবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহের আরও একটি কারণ হলো এর ভেতরের আযাদ যিন্দিগির হাতছানি। কারণ নাস্তিক্যবাদ এর অনুসারীর জন্য পৃথিবীর সবকিছু হালাল ও বৈধ ঘোষণা করে। তার মন যা চায় তা-ই সে করতে পারবে- তাকে এমন স্বাধীনতার গ্যারাণ্টি ও নিশ্চয়তা প্রদান করে। অথচ এর বিপরীতে ঈমান মানুষের সামনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার রেখা টেনে দেয়। এটা তাকে বলে দেয়, তুমি এটা করতে পারবে, আর ওটা করতে পারবে না। পাশাপাশি ঈমান মানুষকে পরকালে সুখের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়। পক্ষান্তরে নাস্তিক্যবাদ মানুষকে এই জীবনেই স্বর্গ-সুখের মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়। আর যেহেতু মানুষ সহজাতভাবেই বাকির ওপর নগদকে অগ্রাধিকার দিতে অভ্যস্ত। তাই সে খুব সহজেই নাস্তিক্যবাদ ও অবিশ্বাসের পথে হাঁটতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক করে তোলে সত্যের পথে আহ্বানকারীদের ক্ষমাহীন অক্ষমতা ও দুর্বলতা। কারণ তারা মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে, পরকালের সুখই মূলত প্রকৃত সুখ। অবিশ্বাসীরা যে পার্থিব জীবনের সুখ-স্বর্গের স্বপ্ন দেখায় তা মূলত অশান্তির কারাগার। আর এই বোধশক্তি ও সচেতনতাটুকু মানুষের ভেতর জাগ্রত করে না দিতে পারার কারণে নাস্তিক্যবাদের অন্ধকারের সামনে তাওহীদের আলো ধীরে ধীরে ক্ষীয়মান হয়ে নিবে যাওয়ার উপক্রম হয়।
পেছনের আলোচনা দ্বারা কেউ যেন এটা মনে না করেন যে, কেবল ‘যুক্তি-তর্ক’, ‘বাকযুদ্ধ’ আর ‘দলীল-প্রমাণ’ এর মাধ্যমে আমরা পৃথিবীতে নাস্তিক্যবাদের বিস্তার রোধ করবো। কারণ ইসলাম ও তাওহীদ নিছক কোনো মৌখিক শব্দমালার নাম নয়; বরং এটি জীবনের ময়দানে বাস্তব প্রয়োগের নাম। আর তাই ইসলামের সত্যতার প্রমাণ কেবল মুখে নয়; কাজের মাধ্যমেও দেওয়া অপরিহার্য। উদাহরণত, কেউ ইসলামকে ‘পশ্চাৎপদ’ ও ‘প্রগতিবিরোধী’ বলে অপবাদ দিলো। তাহলে এই অপবাদের দাঁত-ভাঙা জবাব দিতে হবে মুসলিমদের শক্তিশালী, উন্নত ও ‘সুস্থ’ প্রগতির ধারক-বাহক হওয়ার মধ্য দিয়ে। একইভাবে কেউ যদি বলে যে, ইসলাম আধুনিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে এই অভিযোগ পরিপূর্ণ অর্থে খণ্ডন করতে হলে জীবনের ময়দানে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এভাবেই পৃথিবীতে সত্য সত্যরূপে আর মিথ্যা মিথ্যারূপে প্রকাশ পাবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, আধুনিক যুগের নাস্তিক্যবাদ মুকাবিলা করতে হলে আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কেবল কথা-বার্তা, যুক্তি-তর্ক আর বই-পুস্তক দিয়ে নয়; জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ও উপযোগী বলে প্রমাণ করতে হবে। নতুবা এই যুদ্ধে আমাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।
নাস্তিক্যবাদের কথার জবাব যেমন মুখে দিতে হবে। তেমনি কাজের জবাব কাজের মাধ্যমেই দিতে হবে। সমাজে নাস্তিক্যবাদ যদি বিকৃতি, বিশৃঙ্খলা, ভঙ্গুরতা ও আবিলতার অন্ধকার জন্ম দেয়, তবে তাওহীদের সেখানে সুস্থতা, শৃঙ্খলা, স্থিতি ও নির্মলতার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। একইভাবে নাস্তিক্যবাদের প্রকাশ যদি হয় জুলুমের দ্বারা, তবে তাওহীদের প্রকাশ ঘটাতে হবে অর্থ হতে হবে ইনসাফের মাধ্যমে। একইভাবে ইসলামের পতাকাবাহীরা যদি এই দাবি করেন যে, ইসলাম হলো পৃথিবীর একমাত্র বাস্তবসম্মত দীন ও প্রকৃত সফলতার পথ, তবে কেবল চেঁচামেচি না করে ইসলামের বস্তুনিষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সত্যিকারার্থে সুখী ও আদর্শ সমাজ পৃথিবীকে উপহার দিয়ে দাবির যথার্থতা ও ন্যায্যতার প্রমাণ দিতে হবে।
এভাবেই যদি আজকের মুসলিম জাতি নাস্তিক্যবাদের সকল সন্দেহের জবাব দিতে সক্ষম হয়, কেবল কথার পরিবর্তে কাজের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর আস্থার জায়গাটুকু অধিকার করে নেয়, তবে একদিন না একদিন অবশ্যই আমাদের পৃথিবী থেকে নাস্তিক্যবাদ উন্মূলিত হবে। বিশ্বাসের ফুল বাগান অবিশ্বাসের হুতোম পেঁচা থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি পাবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সহায় হোন। আমীন।