নাস্তিক্যবাদ একজন মানুষের জীবনে যেসব অভিশাপ আর সর্বনাশ ডেকে আনে তার ভেতরে সবার প্রথমেই আসে মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও পেরেশানী, মনের চাঞ্চল্য ও অস্থিরতা। প্রত্যেকটি মানুষের ভেতরে সহজাতভাবে কিছু প্রশ্ন জাগবে এটাই স্বাভাবিক? কেন আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে? কে আমাকে সৃষ্টি করেছেন? আর আমি যাব-ই বা কোথায়? এটা ঠিক যে যান্ত্রিক জীবনের অবিরাম ঘূর্ণন মানুষকে অধিকাংশ সময়ই এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় দেয় না। কিন্তু তারপরেও কখনো কখনো মানুষ জীবনে চলার পথে ধাক্কা খেয়ে নিজের অজান্তেই এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকে। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ আর রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কিংবা বন্ধু-বান্ধব ও কাছের মানুষ হারিয়ে হঠাৎ মানুষের মনখানি ব্যাকুল ও উদাস হয়ে ওঠে। এভাবে ছন্দময় জীবনে হঠাৎ যখন ছন্দপতন ঘটে, তখন মানুষ নিজের অস্তিত্ব ও গন্তব্য নিয়ে চিন্তা-ফিকির করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আল্লাহর স্তিঅস্তিত্বে অস্বীকারের তথাকথিত নড়বড়ে ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা নাস্তিক্যবাদ যেহেতু এসব প্রশ্ন ও তার জবাব সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ, সেহেতু এটা কোনো দিনও মানুষকে এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে সক্ষম হয় না। ফলে জীবনের এসব প্রশ্ন মানুষের মনে ধাঁধা হয়ে ভয়-ভীতি ও পেরেশানীর জন্ম দেয়। এটা সর্বদাই তার বিবেককে যন্ত্রণার আগুনে জ্বালাতে থাকে।
একসময় পৃথিবীর মানুষ দৈনন্দিন কাজ-কর্মের বিরতিতে আকাশ-পাহাড়, সাগর-নদী আর বন-বনানী নিয়ে মেতে উঠতো। ফুলের বাগান আর ফুলের সঙ্গে সখ্যতা গড়তো। বনের পাখির সঙ্গে গান গাইতো। প্রাকৃতিক এসব সৌন্দর্য কখনো কখনো তাকে নিজ স্রষ্টা আর রবের পরিচয় পেতে সাহায্য করতো। এগুলোর পরশ পেয়ে এক সময় সে আপন প্রভুর সান্নিধ্যের শিহরণে ধন্য হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আজ মানুষের পুরো সমাজ ও আশপাশের সবকিছুই যান্ত্রিকতায় পরিণত হয়েছে। আজ মানুষ তার চারপাশের যেদিকেই তাকায় আকাশচুম্বী দালান-কোঠা, যানবাহনের কান-ফাটা চেঁচামেচি ছাড়া কিছুই দেখতে ও শুনতে পায় না। সড়কের চোখ ধাঁধানো আলোকমালা তার মনের আভাটুকু কখন কেড়ে নিয়ে গেছে তা সে নিজেও জানে না। আর এভাবেই সে তার রব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার প্রাকৃতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তার পেরেশানী কেবল বাড়তেই থাকে।
প্রাচীন কালের সমাজ ব্যবস্থায়ও ছিল সহজতা আর সারল্যের এক অনুপম সৌন্দর্যের শোভা। সেখানে পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতা ছিল সুন্দর সমাজের একটি অনস্বীকার্য উপাদান। বিপদ-আপদে একে অপরের কাছে ছুটে আসা, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সুখ ও দুঃখকে পরস্পর ভাগাভাগি করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেঁচে থাকা ছিল সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র। কিন্তু আধুনিক সমাজে মানুষ নিজের দুঃখের কাহিনী শোনানোর জন্য কাউকে খুঁজে পায় না। নিজের অস্থিরতার কথাগুলো বলার জন্য কোনো সুহৃদ দেখতে পায় না। জীবন পথে চলতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে কেউ যে তাকে হাত ধরে উঠাবে এমন কোনো আশার আলো তার চোখে পড়ে না। আর সেকারণেই ভবিষ্যৎ নিয়ে তার এতটা ভয়, এতটা অনাস্থা। সেই ধারাবাহিকতায় সমাজের সবগুলো মানুষ কেবল নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন-নিয়ে দুই হাত ভরে ধন-সম্পদ উপার্জনের জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। এখানে বোঝার চেষ্টা করুন, যদি এই অবস্থায় মানুষ আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করতো, তবে সে ভবিষ্যতের জন্য এতটা পেরেশান আর ব্যাকুল হয়ে উঠতো না। কারণ সে আল্লাহর ওপর ভরসা করে স্বাভাবিক গতিতেই পথ চলতো। আর এই বিশাল সমস্যার সমাধানও হয়ে যেতো অতি সহজে। কিন্তু নাস্তিক্যবাদ এই সমস্যার কোনো সমাধানই দিতে পারেনি। কারণ এর মতে, মানুষই তো তার সবকিছুর স্রষ্টা। সুতরাং এসব সমস্যার সমাধানও তাকেই বের করতে হবে। আর এভাবেই সমাজের প্রত্যেকটি মানুষই ব্যক্তিচিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে চরম স্বার্থপর।