বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে সব শিক্ষা দেওয়া হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবতা ও নৈতিকতা বিবর্জিত। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে নৈতিক শিক্ষার খুবই অভাব। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করে তাতে দ্বীনি শিক্ষা ও বাস্তবধর্মী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলেই, যুব সমাজের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। যুব সমাজের অবক্ষয় রোধে সঠিক আকীদা, হারাম হালাল, মানুষের সাথে লেন-দেন, পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা বর্তমানে সময়ের অন্যতম দাবী।

মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদির সভা সেমিনারে যুবকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য উন্মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা এবং প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে তাদের শিক্ষার দানের ব্যবস্থা করা, যাতে তারা তাদের সমস্যাগুলির সমাধান ও তাদের পথ চলার গতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়। মুসলিম যুব সমাজকে সংশোধনের ক্ষেত্রে আলেম-ওলামা, বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম যুব সমাজের মাঝে আর আলেম-ওলামা, বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানীদের মাঝে বিশাল দূরত্ব ও ফাটল পরিলক্ষিত। এটি কোনো সুফল ভয়ে আনতে পারে না এবং শুভ লক্ষণও নয় বরং এটি যুব সমাজের অবক্ষয় ও পতনের অন্যতম কারণ। এর জন্য শুধু যুবকদের দোষারোপ করে বসে থাকলে চলবে না, আলেমদেরই তাদের সংশোধন করা ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

ছেলে মেয়েদের অবাধ মেলা-মেশা রোধ করা:

ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলা-মেশা রোধ করা যুব সমাজের অবক্ষয় হতে বাঁচানোর জন্য খুবই জরুরী। কিন্তু বর্তমান দুনিয়াতে ছেলে মেয়েদের সহাবস্থান মানবতার জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনছে। স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সব ধরনের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছেলে মেয়ে একসাথে বসে লেখা পড়া করছে। শিক্ষক শিক্ষিকা এক সাথে উঠ-বস করছে। এটি যে একটি অপরাধ বা মানব সভ্যতার পরিপন্থী এ অনুভূতিই আজ তাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে এ কথা বলাই যেন একটি অপরাধ। যারা এ ধরনের কথা বলবে, তারা প্রগতি বিরোধী এবং অগ্রগতি ও উন্নতির প্রতিবন্ধক। মেইল, ফ্যাক্টরি ও গার্মেন্টসে ছেলে মেয়ে একত্র ধাক্কা-ধাক্কি করে পঙ্গ পালের মত প্রবেশ করা, উভয় লিঙ্গের বিপরীত শ্রেণীর ছেলে মেয়েদের এক সাথে একান্তে কাজ করা ইত্যাদি দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বনের পশুদেরকেও হার মানিয়েছে।

মনে রাখতে হবে, শরীয়তের বিধান হল, বেগানা নারী-পুরুষের কোনো নির্জন স্থানে একাকী বাস, কিছু ক্ষণের জন্যও লোক-চক্ষুর অন্তরালে, ঘরের ভিতরে, পর্দার আড়ালে একান্তে অবস্থান শরীয়তে হারাম। যেহেতু তা ব্যভিচার না হলেও ব্যভিচারের নিকটবর্তী করে, ব্যভিচারের ভূমিকা অবতারণায় সহায়িকা হয়। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন পুরুষ যেন কোনো নারীর সাথে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়ের কুটনি হয়।”

এ ব্যাপারে সমাজে অধিক শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয় দেওর-ভাবী ও শালী-বুনাই-এর ক্ষেত্রে। অথচ এদের মাঝেই বিপর্যয় ঘটে অধিক। তাই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের পক্ষে তাদের দেবরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন।”

অতএব দেবরের সাথে মায়ের বাড়ি, ডাক্তারখানা, অনুরূপ বুনাই-এর সাথে বোনের বাড়ি, ডাক্তারখানা বা কোনো বিলাস-বিহারে যাওয়া-আসা এক মারাত্মক বিস্ফোরক বিষয়।

তদনুরূপ তাদের সাথে কোনো কামরা বা স্থানে নির্জনতা অবলম্বন, বাড়ির দাসী বা দাসের সাথে গৃহকর্তা বা কর্ত্রী অথবা তাদের ছেলে-মেয়ের সাথে নিভৃত বাস, বাগদত্তা বরকনের একান্তে আলাপ বা গমন, বন্ধু-বান্ধবীর একত্রে নির্জন বাস, লিফটে কোনো বেগানা যুবক-যুবতীর একান্তে উঠা-নামা, ডাক্তার ও নার্সের একান্তে চেম্বারে অবস্থান, টিউটর ও ছাত্রীর একান্তে নির্জন বাস ও পড়াশোনা, স্বামীর অবর্তমানে কোনো বেগানা আত্মীয় বা বন্ধুর সাথে নির্জন বাস, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে বা রিক্সায় রিক্সাচালকের সাথে নির্জনে গমন, পীর ও মহিলা মুরীদদের একান্তে বায়াত ও তা’লীম প্রভৃতি একই পর্যায়ের; যাদের মাঝে শয়তান কুটনি সেজে অবৈধ বাসনা ও কামনা জাগ্রত করে কোনো পাপ সংঘটিত করতে চেষ্টা করে।

বারুদের নিকট আগুন রাখা হলে বিস্ফোরণ তো হতেই পারে। যেহেতু মানুষের মন বড় মন্দ প্রবণ এবং দুর্নিবার কামনা ও বাসনা মানুষকে অন্ধ ও বধির করে তোলে। তা ছাড়া নারীর মাঝে রয়েছে মনোরম কমনীয়তা, মহনীয়টা এবং চপলতা। আর শয়তান তো মানুষকে অসৎ কাজে ফাঁসিয়ে দিয়ে আনন্দ বোধ করে থাকে।

সালাত মানুষের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম হাতিয়ার। সালাত মানুষকে খারাব ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে এবং ভালো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এ কারণে একজন বাচ্চা যখন ভালো মন্দ বিচার করতে পারে, তখন থেকেই তাকে সালাত আদায় করার আদেশ দিতে হবে। যাতে সে সালাত আদায়ে অভ্যস্ত হয় এবং বড় হয়ে সালাত আদায়ের প্রতি যত্নবান হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ»

“তোমাদের বাচ্চাদের সাত বছর বয়সে সালাত আদায়ের আদেশ দাও এবং বছর বয়সে সালাত আদায় না করার জন্য তাদের প্রহার কর। আর তোমরা তাদের বিছানা আলাদা করে দাও”।[1]

হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় ইসলাম যুবকদের অধিক গুরুত্ব দেয়। যুবকদের বয়সের পরিবর্তনের সাথে তাদের নির্দেশনাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী ইসলাম যুবকদের দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى المِلَّةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُشَرِّكَانِهِ»

“প্রতিটি নবজাতক ইসলামী ফিতরাতের উপর জন্মলাভ করে। কিন্তু তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহুদী, খৃষ্টান অথবা মুশরিক বানায়”।[2]

>
[1] আবু দাউদ: ৪৯৫

[2] তিরমিযি, হাদিস: ২১৩৮
যথা সময়ে বিবাহ করার প্রতি গুরুত্ব দেয়া:

যুব সমাজের যত সব সমস্যা আছে তার মধ্যে বিবাহ না করা বা দেরিতে বিবাহ করা এটি একটি অন্যতম সমস্যা। সুতরাং যুবকদের সমস্যার প্রতিকারের জন্য অবশ্যই বিবাহ সম্পর্কে যুবকদের মধ্যে যে আতঙ্ক রয়েছে তা দূর করতে হবে এবং যথা সময়ে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। নিম্নে আমরা বিবাহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরব।

যুব সমাজ ও বিবাহ

যুবকদের অন্যতম সমস্যা হল, সময়মত বিবাহ না করা। এটি একটি মারাত্মক সমস্যা, যার কারণে যুব সমাজকে এত বেশি ও অসংখ্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যা কেবল আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। বিবাহ না করার তারা বিভিন্ন কারণ দেখায়। যেমন-

এক- তাড়া-তাড়ি বিবাহ করলে, পড়া লেখার ক্ষতি এবং ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়।

দুই- দ্রুত বিবাহ করা দ্বারা তার উপর স্ত্রী সন্তানের খরচ করার দায়িত্ব বর্তায়, যা তার জন্য কঠিন হয়।

তিন- যুবকদের বিবাহ করা হতে দূরে থাকার সবচেয়ে ক্ষতিকর বিবাহ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা। যেমন, অধিক খরচ, যা অনেক সময় একজন যুবক বহন করতে সক্ষম হয় না। এটি আমার দৃষ্টিতে যুবকদেরকে বিবাহ হতে দূরে রাখার সবচেয়ে বড় সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা।

আমরা আন্তরিক হলে, যুবকদের এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা খুব সহজ এবং সহনীয়। প্রথমত: বিবাহ করার মধ্যে একজন যুবকের জন্য কি কি কল্যাণ, সাওয়াব, নেকী ও গুণাগুণ রয়েছে, তার বর্ণনা যুবকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। দুনিয়াতে সব কিছুরই ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। অনুরূপভাবে বিবাহও। আমি বলি না যে, এর কোনো খারাপ দিক নাই। কিন্তু বিবাহের ভালো দিক, খারাপ দিকের তুলনায় অধিক উত্তম, ভালো, কল্যাণকর ও অগ্রগণ্য। সুতরাং, একজন যুবককে বিবাহের কল্যাণকর দিকগুলো বুঝাবে এবং বিবাহ করার প্রতি উৎসাহ দেবে, যাতে তারা বিবাহের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

বিবাহের উপকারিতা:

এক- বিবাহ লজ্জাস্থানের হেফাযত এবং চোখের হেফাযত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، عَلَيْكُمْ بِالبَاءَةِ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، فَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّ الصَّوْمَ لَهُ وِجَاءٌ»

“হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যার ক্ষমতা আছে, সে যেন বিবাহ করে। কারণ, এটি চোখের জন্য নিরাপদ এবং লজ্জা-স্থানের হেফাযত। আর যদি কোনো ব্যক্তি অক্ষম হয়, সে যেন রোযা রাখে। কারণ, রোযা তার জন্য প্রতিষেধক”।[1]

বর্তমানে আমাদের এ যুগে অধিকাংশ যুবকই বিবাহ করতে সক্ষম। সুতরাং, তাদের বিবাহের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার গড়িমসি করা উচিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِفُرُوجِهِمۡ حَٰفِظُونَ ٢٩ إِلَّا عَلَىٰٓ أَزۡوَٰجِهِمۡ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُمۡ فَإِنَّهُمۡ غَيۡرُ مَلُومِينَ ٣٠ ﴾ [المعارج: ٢٩، ٣٠]

আর যারা তাদের যৌনাঙ্গসমূহের হিফাযতকারী, তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে, সে দাসীগণের ক্ষেত্র ছাড়া। তাহলে তারা সে ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হবে না।[2]

বিবাহ লজ্জা-স্থানের জন্য নিরাপদ। অর্থাৎ বিবাহ তোমাকে মহা ক্ষতি-লজ্জা-স্থানের বিপদ-থেকে নিরাপত্তা দেবে। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বিবাহ লজ্জা-স্থানের হেফাজত এবং চোখের নিরাপত্তা। বিবাহ একজন যুবকের চোখকে ঠাণ্ডা করে এবং বিবাহ করার কারণে একজন যুবক এদিক সেদিক তাকায়-না অথবা আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তার প্রতি কোনো প্রকার কর্ণপাত করে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাকে হালালের মাধ্যমে হারাম হতে ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তার অনুগ্রহ ও দয়া দ্বারা অন্য সবকিছু হতে তাকে যথেষ্ট করেছে।

দুই- বিবাহ দ্বারা আত্মার তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]

“আর তার নিদর্শনা বলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নির্দেশাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা চিন্তা করে”।[3]

যখন কোনো যুবক বিবাহ করে, তখন তার খারাপ আত্মা ও কু-প্রবৃত্তি খামুশ হয়ে যায়, দিক-বেদিক ছুটা-ছুটি করা হতে বিরত থাকে এবং তার অন্তর প্রশান্তি পায়। একজন যুবক অনেক সময় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানিতে থাকে। কিন্তু যখন সে বিবাহ করে, তখন তার আত্মা শান্তি ও নিরাপদ থাকে। মোটকথা, বিবাহ করা, একজন যুবকের জন্য অসংখ্য কল্যাণের কারণ হয়ে থাকে।

দ্রুত বিবাহ করার উপকারিতা:

দ্রুত বিবাহ করার অন্যতম উপকারিতা হল, সন্তান লাভ করা যা একজন মানুষের চোখের শীতলতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿وَٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا٧٤ ﴾ [الفرقان: ٧٤]

“আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’।[4]

আয়াত দ্বারা বুঝা যায় স্ত্রী সন্তানরা মানুষের চোখের শীতলতা। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দেন যে, বিবাহের দ্বারা চোখের শীতলতা লাভ হয়। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যুবকদের বিবাহ করার প্রতি উৎসাহ দেন এবং বিবাহ করার জন্য সাহস দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,

﴿هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤﴾ [الفرقان: ٧٤]

“আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’।[5]

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿ٱلۡمَالُ وَٱلۡبَنُونَ زِينَةُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَٱلۡبَٰقِيَٰتُ ٱلصَّٰلِحَٰتُ خَيۡرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابٗا وَخَيۡرٌ أَمَلٗا ٤٦﴾ [الكهف: ٤٦]

“সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা। আর স্থায়ী সৎকাজ তোমার রবের নিকট প্রতিদানে উত্তম এবং প্রত্যাশাতেও উত্তম”[6]।

সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য। আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, সন্তান দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য। আর মানুষ দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্যের প্রেমিক। একজন মানুষ যেভাবে ধন-সম্পদ তালাশ করে অনুরূপভাবে সে সন্তান-সন্ততিও তালাশ করে। কারণ, মাল যেমন দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য এমনিভাবে সন্তানও দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য। আর আখিরাতে নেক সন্তানের নেক আমলের সাওয়াব মাতা-পিতার উপরও বর্তাবে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: صَدَقَةٌ جَارِيَةٌ، وَعِلْمٌ يُنْتَفَعُ بِهِ، وَوَلَدٌ صَالِحٌ يَدْعُو لَهُ »

“যখন আদম সন্তান মারা যায় তখন তার তিনটি আমল ছাড়া সব আমলের সাওয়াব বন্ধ হয়ে যায়। উপকারী ইলম যা দ্বারা মানুষ উপকার লাভ করতে থাকে, সদকায়ে জারিয়া এবং নেক সন্তান যারা তাদের জন্য দু’আ করতে থাকে”।[7] সুতরাং সন্তান-সন্ততির মধ্যে দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের জীবন উভয় জাহানের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অনুরূপভাবে যৌবনের শুরুতে বিবাহ করা দ্বারা যখন অধিক সন্তান লাভ হবে, তখন উম্মতে মুসলিমার সংখ্যা ও মুসলিম সমাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আর মানুষ ইসলামী সমাজ গঠনের বিষয়ে অবশ্যই দায়িত্বশীল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَمَ»

“তোমরা বিবাহ কর এমন স্ত্রীদের যারা অধিক মহব্বত করে এবং অধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কারণ কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের আধিক্যকে নিয়ে গর্ব করব”।[8]

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও বিবাহ করাতে অনেক কল্যাণ নিহিত। যখন তুমি একজন যুবকের সামনে এ ধরনের বিষয়গুলো তুলে ধরবে, তখন তার সামনে বিবাহ হতে বিরত রাখে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও বাধা দূর হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি বলে, দ্রুত বিবাহ করা দ্বারা পড়া লেখার ক্ষতি হয় বা উচ্চ ডিগ্রি লাভ করতে বাধা হয়, সে আসলে তোমাকে সঠিক কথা বলে নি। বরং সঠিক কথা হলো এর বিপরীত। কারণ, বিবাহ করার যে সব ফায়দা লাভ ও বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উপরে উল্লেখ করলাম, এগুলোর সাথে সাথে বিবাহ দ্বারা আরও যা লাভ হয়, তা হল, আত্মার প্রশান্তি, অন্তরের শান্তি ও চোখের শীতলতা। আর যখন কোনো মানুষের মন শান্ত থাকে, আত্মা পরিতৃপ্ত এবং চোখের শীতলতা থাকে, তখন তার জন্য সব কিছুই সহজ হয় এবং শিক্ষা লাভ করা সহজ হয়। আর বিবাহ বিলম্ব করা বা না করা দ্বারা মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য তথা অধিক জ্ঞান অর্জন করাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় না। কিন্তু যখন বিবাহ করে, তখন তার প্রবৃত্তি শান্ত হয় এবং সে একটি বিশ্রাম স্থল লাভে ধন্য হয় এবং এমন একজন স্ত্রী লাভে সক্ষম হয়, যে তাকে শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে এবং বাড়ি ফিরলে তার খেদমত ও সেবা যত্ন করবে। সুতরাং, আল্লাহ তা‘আলা যখন তাড়াতাড়ি বিবাহ করার সুযোগ করে দেয়, তা অবশ্যই করা উচিত, কাল ক্ষেপণ করা কোনো ক্রমেই উচিত না। কারণ, এটি একজন ছাত্রকে তার জ্ঞান অর্জনে সহযোগিতা করে। আর বিবাহ করাতে পড়া লেখা ও জ্ঞান অর্জনে বিঘ্ন ঘটে এ ধরনের ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। অনুরূপভাবে তাড়াতাড়ি বিবাহ করার কারণে একজন ছাত্র বা যুবক স্ত্রী সন্তানের খরচ বহন করার দায়িত্ব নিতে হয় যার কারণে অতিরিক্ত চাপ বহন করতে হয়, এ ধরনের কথা বলাও অমূলক। কারণ, বিবাহ করা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা বরকত ও কল্যাণ দান করবেন। বিবাহ হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুকরণ ও আনুগত্য করা। আর এটি একটি সাওয়াবের কাজ ও উত্তম কাজ। যখন কোনো যুবক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশের অনুকরণ করার উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, বিবাহ করাতে যে সব বরকতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার অনুসন্ধান করে এবং তার নিয়ত খাটি হয়, তাহলে অবশ্যই এ বিবাহ তার জন্য কল্যাণের কারণ হবে। আর মনে রাখতে হবে, রিযকের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ বলেন,

﴿۞وَمَا مِن دَآبَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِ رِزۡقُهَا وَيَعۡلَمُ مُسۡتَقَرَّهَا وَمُسۡتَوۡدَعَهَاۚ كُلّٞ فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٦ ﴾ [هود: ٦]

“আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিযকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল”। [সূরা হুদ, আয়াত: ৬] আল্লাহ তা‘আলা যাকে বিবাহ করার তাওফিক দেন তার জন্য ও তার স্ত্রী সন্তানের রিযকের ব্যবস্থা তিনিই করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُم مِّنۡ إِمۡلَٰقٖ نَّحۡنُ نَرۡزُقُكُمۡ وَإِيَّاهُمۡۖ ١٥١﴾ [الانعام: ١٥١]

“আর তোমরা দারিদ্রের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিও তোমাদেরকে রিযক দেই এবং তাদেরকেও”।[9] সুতরাং, মনে রাখতে হবে, কোনো যুবককে তার ক্ষমতার অতিরিক্ত কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এটি নিছক একটি ধারনা বৈ আর কিছু নয়। কারণ, বিবাহের কারণে বরকত হয় এবং কল্যাণ নিশ্চিত হয়। বিবাহ মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত চিরন্তন একটি বিধান। বিবাহ করা মানুষের জন্য কোনো প্রকার আতঙ্ক বা দুঃখ কষ্টের কারণ নয়। যদি মানুষের নিয়ত ভালো হয়, তাহলে বিবাহ কল্যাণ লাভের মাধ্যমসমূহ হতে একটি অন্যতম মাধ্যম। আর বর্তমানে মানুষ বিবাহের ক্ষেত্রে যে সমস্যা ও অসুবিধার কারণ দেখায়, এগুলো সবই মানুষের –নিন্দনীয়- আবিষ্কার। কারণ, বিবাহতে এ ধরনের কোনো অসুবিধা বা সমস্যা বিবাহের সাথে সম্পৃক্ত নয়। যেমন, বড় অংকের মোহর নির্ধারণ করা, বড় করে অনুষ্ঠান করা, অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অধিক টাকা পয়সার অপচয় করা ইত্যাদি যেগুলো বর্তমানে মানুষ করে থাকে, এগুলো করার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার বিধানে নেই। বরং, বিবাহ শাদিকে সহজকরণই ইসলামী শরিয়তের মূল লক্ষ্য। বিবাহ শাদিতে যে সব অনৈতিক ও অনর্থক কাজ করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে যে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাদের কোনো উপকারে আসে না বরং তা তাদের স্ত্রী সন্তানদের ক্ষতির কারণ হয়। সুতরাং, এগুলোর সংস্কার করতে হবে এবং বিবাহ শাদিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে না হয়, বিবাহ যাতে সহজ হয়, বিবাহতে খরচ কমিয়ে আনা যায় তার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। আর অতিরিক্ত ব্যয়, অনুষ্ঠানাদি ইত্যাদি অনৈতিক ও অনর্থক বিষয়গুলো দূর করার উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে বিবাহ শাদি তার আপন অবস্থা-সহজ পদ্ধতি কম খরচ-এর প্রতি ফিরে আসে। আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমাদের কামনা তিনি যেন, আমাদের সবার প্রতি দয়া করেন এবং আমাদেরকে সঠিক পথের দিক হিদায়েত দেন। আর তিনি যেন, মুসলিমদের অবস্থা ও মুসলিম যুবকদের অবস্থা সংশোধন করে দেন। আরও কামনা করি আল্লাহ যেন মুসলিমদেরকে তাদের হারানো ইজ্জত, সম্মান ও গৌরবকে ফিরিয়ে দেন, তাদের অবস্থার উন্নতি দান করেন। আল্লাহর নিকট কামনা, আল্লাহ যেন, মুসলিমদের তাদের দ্বীনের বিষয়ে সাহায্য করেন এবং তাদেরকে তাদের দুশমনদের অনিষ্টতা থেকে হেফাযত করার ক্ষেত্রে তিনিই যথেষ্ট হন। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার পরিবার পরিজন ও তার সব সাথীদের উপর। আর যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক।

>
[1] বুখারি, হাদিস: ৫০৬৬, মুসলিম, হাদিস: ১৪০০

[2] সূরা মায়ারেয, আয়াত: ২৯, ৩০

[3] সূরা রুম, আয়াত: ২১

[4] সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭৪

[5] সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭৪

[6] সূরা কাহাফ, আয়াত: ৪৬

[7] তিরমিযি, হাদিস: ১৩৭৬, নাসায়ী হাদিস: ৩৬৫১

[8] আবু দাউদ, হাদিস:২০৫০, আহমদ: ১৩৫৬৯

[9] সূরা আনআম, আয়াত: ১৫১

যুব সমাজ ধ্বংসের অন্যতম কারণ হলো দৃষ্টি। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার সর্বত্র উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ ও নগ্ন ছবি দেখে যুব সমাজ তাদের চরিত্রকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে প্রতি নিয়ত। এ ছাড়া ঘরে বসে টিভির পর্দায় বিভিন্ন ধরনের জোন উত্তেজক নাটক সিনেমা দেখে দেখে তারা ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। তাই যুব সমাজকে ধ্বংস ও অপ মৃত্যুর হাত থেকে বাচাতে হলে, অবশ্যই এ সব খারাপ দৃশ্য ও নগ্ন নাটক সিনেমা থেকে চোখকে হেফাযত করতে হবে। চোখ মানবাত্মার অন্তরে কোনো কিছু প্রবেশ করা বা উদ্রেকের জন্য বড় ধরণের সু-রঙ্গ ও প্রবেশদ্বার। ইমাম কুরতবী রহ. বলেন, চোখ অন্তরে কোনো কিছু প্রবেশের বড় দরজা। চোখের কারণেই মানুষের পদস্খলনটি বেশি হয়। ফলে চোখ থেকে অধিক সতর্ক হতে হবে। চক্ষুকে নিষিদ্ধ বস্তু ও ফিতনার আশংকা থাকে এমন সব বস্তুর দিক তাকানো হতে অবনত রাখতে হবে। আর চক্ষু অবনত রাখার অর্থ, একজন মুসলিম নিষিদ্ধ বস্তুর দিক তাকানো হতে বিরত থাকবে, সে শুধু বৈধ বিষয়সমূহ দেখবে। আর যদি অনিচ্ছায় কোনো নিষিদ্ধ বস্তুর দিক নজর পড়ে যায়, তবে সাথে সাথে তা ফিরিয়ে নেবে। দৃষ্টিকে দীর্ঘায়ত করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا يَصۡنَعُونَ ٣٠ ﴾ [النور : ٣٠]

“মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জা স্থানের হিফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত”।[1]

আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে লজ্জা স্থানের হেফাজতের পূর্বে চোখের হেফাজত করার নির্দেশ দেন। কারণ, যাবতীয় দূর্ঘটনা ও বিপদের মূল হলো দৃষ্টি। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় হাদিসে আমাদেরকে চক্ষু অবনত রাখতে নির্দেশ দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত তিনি বলেন,

اضمنوا لي ستا من أنفسكم أضمن لكم الجنة: اصدقوا إذا حدثتم، وأوفوا إذا عاهدتم، وأدوا إذا ائتمنتم، واحفظوا فروجكم، وغضوا أبصاركم، وكفوا أيديكم".

“তোমরা আমার জন্য ছয়টি জিনিসের জিনিসের দায়িত্ব নিলে, আমি তোমাদের জান্নাতের দায়িত্ব নিব। যখন কথা বল, সত্য বল। যখন প্রতিশ্রুতি দেবে তা পুরো করবে, আর যখন তোমার নিকট আমানত রাখা হবে, তা রক্ষা করবে। আর তোমরা তোমাদের লজ্‌জাস্থানের হেফাজত করবে, তোমাদের চক্ষুকে অবনত করবে এবং তোমরা তোমাদের হাতকে বিরত রাখবে”।[2]

বরং অপর একটি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম চক্ষু অবনত রাখাকে রাস্তার হক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি তার সাথীদেরকে বলেন,

" إياكم والجلوس في الطرقات، فقالوا: يا رسول الله مالنا من مجالسنا بُدٌّ نتحدث فيها. فقال: " فإذا أبيتم إلا المجلس فأعطوا الطريق حقه. قالوا: وما حق الطريق يا رسول الله؟ قال: غض البصر، وكف الأذى ، ورد السلام، والأمر بالمعروف، والنهي عن المنكر".

“তোমরা রাস্তা বা মানুষের চলাচলের পথে বসা থেকে বিরত থাক। সাহাবীরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তায় বসা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নাই আমরা রাস্তায় বসে কথা-বার্তা বলি-আলোচনা করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমাদের বসতেই হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহর হক আদায় কর। তারা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কি? তিনি বললেন, চক্ষু অবনত করা, কষ্ট দায়ক বস্তু পথের থেকে সরানো, সালামের উত্তর দেয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা”।[3]

وقد وجد النبي صلى الله عليه وسلم الفضل بن عباس رضي الله عنهما ينظر إلى امرأة جاءت تستفتيه صلى الله عليه وسلم فأخذ بذقن الفضل فعدل وجهه عن النظر إليها.

একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একজন মহিলা ফতোয়া জানতে আসলে, তার দিক ফযল ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে তাকাতে দেখলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থুতনী নীচে ধরে তার চেহারাকে অন্যদিক ফিরিয়ে দেন।[4] আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রহ. বলেন, এ কাজটি হল, তাকে এ ধরনের দৃষ্টি হতে নিষেধ করা এবং কাজটি থেকে বারণ করা। যদি এ ধরনের কাজ বৈধ হত, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিত।

>
[1] সূরা নূর, আয়াত: ৩০

[2] আহমদ, হাদিস: ২২৭৫৭

[3] মুসলিম, হাদিস: ২১২১

[4] বুখারি, হাদিস: ৬২২৮
হঠাৎ কোনো খারাপ কিছুর দিক দৃষ্টি দেয়া:

অনেক সময় একজন মানুষ এমন কোনো স্থান বা পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তখন ইচ্ছা না থাকলেও নিষিদ্ধ বস্তু সমূহের উপর তার দৃষ্টি পড়ে, যাকে আমরা ‘হঠাৎ দৃষ্টি পড়া’ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে করনীয় হল, দৃষ্টিকে সাথে সাথে ফিরিয়ে নেয়া। জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন,

سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن نظر الفجأة فأمرني أن أصرف بصري".

“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হঠাৎ দৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি আমাকে আমার চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।[1] কোনো নিষিদ্ধ বস্তুর উপর দৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে দীর্ঘায়িত না করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াই হল, সর্বাধিক উপকারী ও দ্রুত চিকিৎসা। দৃষ্টিকে দীর্ঘায়িত করা হলে অপরাধী ও গুনাহগার বলে সাব্যস্ত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يا عليُّ لا تتبع النظرة النظرة فإن لك الأولى وليست لك الآخرة».

“হে আলী, তুমি দৃষ্টির পুনরাবৃত্তি করবে না, কারণ, প্রথম দৃষ্টি তোমার পক্ষে, কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য নয়”[2]।

>
[1] মুসলিম, হাদিস: ২১৫৯, তিরমিযি, হাদিস: ২৭৭৬

[2] তিরমিযি, হাদিস: ২৭৭৭, আবুদাউদ, হাদিস: ২১৪৯, আহমদ: ২২৯৯১

নারীরাও চক্ষুকে অবনত রাখতে নির্দেশিত। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا يَصۡنَعُونَ ٣٠﴾ [النور : ٣٠]

“মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত”।[1]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ﴾ [النور: ٣١]

“আর আপনি মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিশক্তিকে নত করে”। [সূরা আন-নূর: ৩১]

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‌আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وخير صفوف النساء المؤخر، وشرها المقدم، يا معشر النساء إذا سجد الرجال فاغضضن أبصاركن..» الحديث.

“নারীদের জন্য উত্তম কাতার শেষের কাতার আর নিকৃষ্ট কাতার হলো সামনের কাতার। হে নারীর দল! যখন পরুষেরা সেজদা করে, তখন তোমরা তোমাদের চক্ষুকে অবনত রাখ”[2]

সালফে সালেহীন তথা এ উম্মতের ভালো পূর্বসূরীগণ চক্ষুকে অবনত রাখা বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকতেন। আমরা তাদের থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন ওয়াজ নসিহত শুনতে পাই এবং তাদের অবস্থান বুঝতে পারি, যা আমাদেরকে তাদের সাহসিকতা বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেন। যেমন, আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

إذا مرت بك امرأة فغمض عينيك حتى تجاوزك".

“যদি তোমার পাশ দিয়ে কোনো নারী অতিক্রম করে, তখন অতিক্রম না করা পর্যন্ত তুমি তোমার চোখকে অবনত রাখ।”

কেউ কেউ বলেন,

من حفظ بصره أورثه الله نورا في بصيرته.

“যে ব্যক্তি তার দৃষ্টির হেফাযত করে, আল্লাহ তা‘আলা তার দূর-দৃষ্টির মধ্যে নূর ঢেলে দেন।”

আর সুফিয়ান রহ. যখন ঈদের দিন ঘর থেকে বের হতেন, তখন তিনি বলতেন,

«إن أول ما نبدأ به اليوم غض أبصارنا»

আজকের দিন আমি সর্বপ্রথম যে জিনিসটি দিয়ে শুরু করব, তা আমরা আমাদের চক্ষুকে অবনত রাখব।

এক ব্যক্তি যখন হাসান বসরীকে বলল, অনারব নারীরা তাদের বক্ষ ও মাথাকে খোলা রাখে, তখন সে বলল, اصرف بصرك. তুমি তোমার চোখকে বিরত রাখ। রবী ইবন খাসইয়াম তিনি সর্বদা দৃষ্টিকে নিচু করে রাখতেন। একদিন তার পাশ দিয়ে কতক নারী অতিক্রম করলে, তিনি তার মাথাকে নিচু করে তার বুক পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তখন মহিলা মনে করল, তিনি অন্ধ, ফলে তার অন্ধত্ব থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করল।

>
[1] সূরা নূর, আয়াত: ৩০

[2] আহমদ, হাদিস: ১৫১৬১
দৃষ্টির হেফাজত করার কয়েকটি উপকারিতা:

চক্ষুকে অবনত রাখার কয়েকটি উপকারিতা ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহ. বর্ণনা করেন:

এক- আফসোসের যন্ত্রণা ও না পাওয়ার বেদনা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা। কারণ, যে ব্যক্তি তার দৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়, তার আফসোস আর না পাওয়ার বেদনা লেগেই থাকে।

দুই- দৃষ্টির হেফাযত মানুষের অন্তরে নূর ও আলো সৃষ্টি করে। অনুরূপভাবে দৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া দ্বারা অন্তর, চেহারা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

তিন- দৃষ্টির হেফাযত করা দ্বারা একজন মানুষের দূরদর্শিতা বৃদ্ধি পায় এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়। যেমন আল্লামা কিরমানী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি তার বাহ্যিক দিকসমূহকে সুন্নাত দারা সাজায়, আর সবসময় অন্তর দিয়ে আল্লাহর কথা চিন্তা করে, নিষিদ্ধ বস্তু হতে চোখকে হেফাযত করে, প্রবৃত্তিকে অন্যায় কর্ম হতে বিরত রাখে এবং হালাল খায় সে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কখনোই অক্ষম হবে না।

চার- তার জন্য ইলমের পথ ও দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে এবং ইলমের উপকরণসমূহ তার জন্য সহজ হবে। আর এটি অন্তরের নূরের কারণেই হয়ে থাকে। কারণ, যখন অন্তর নূর দ্বারা আলোকিত হবে, তখন তার মধ্যে সব কিছুর হাকিকত স্পষ্ট হবে। আর যে ব্যক্তি তার দৃষ্টিকে যেভাবে ইচ্ছা ছেড়ে দেবে, তার অন্তর অন্ধকার ও আবর্জনাময় হবে।

পাঁচ- চোখের হেফাযত করা দ্বারা মানুষের আত্মার শক্তি, দৃঢ়তা ও সাহসিকতা বৃদ্ধি পায়।

ছয়- চোখের হেফাযত করা মানুষের অন্তরে তৃপ্তি, আনন্দ ও উজ্জ্বলতাকে বৃদ্ধি করে। চোখে দেখে কোনো কিছু উপভোগ করার লজ্জা হতে, অন্তরের আনন্দ ও খুশি অনুভব করা অনেক বড়।

সাত- চোখের হেফাযত একজন মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে। কারণ, খারাপ বস্তুর দিক তাকানো মানুষকে অশ্লীল কর্মের দিকে ধাবিত করে। আর যখন কোনো ব্যক্তি তার চোখের হেফাযত করে, সে অশ্লীল কাজের মধ্যে পতিত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে। আর যখন সে তার দৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবে, তখন তার ধ্বংস অনিবার্য।

পরিশেষে আমরা বলব, আজ আমাদের যুব সমাজের সমস্যা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করছে। তারা আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। যুব সমাজকে যদি রক্ষা করা সম্ভব না হয়, তাহলে সমাজের অবক্ষয় দূর করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। তাই আমরা সবাই সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের যুব সমাজকে রক্ষা করতে এবং তাদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো প্রাণপণ চেষ্টা যেন চালিয়ে যাই।

আল্লাহর নিকট আমাদের কামনা আল্লাহ তা‘আলা যেন, আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে আমাদেরকে একটি সুন্দর সমাজ উপহার দেন। আমীন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৮ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে