কসম নক্ষত্রের, যখন তা অস্ত যায়। আল-বায়ান
শপথ তারকার যখন তা অস্ত যায়, তাইসিরুল
শপথ নক্ষত্রের, যখন ওটা হয় অস্তমিত, মুজিবুর রহমান
By the star when it descends, Sahih International
১. শপথ নক্ষত্রের, যখন তা হয় অস্তিমিত(১),
(১) নক্ষত্ৰমাত্রকেই نجم বলা হয় এবং বহুবচন نجوم [ইরাবুল কুরআন]। কখনও এই শব্দটি কয়েকটি নক্ষত্রের সমষ্টি সপ্তর্ষিমণ্ডলের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এই আয়াতেও কেউ কেউ নজমের তফসীর “সুরাইয়া” অর্থাৎ সপ্তর্ষিমণ্ডল দ্বারা করেছেন। সুদ্দী বলেন, এর অর্থ শুক্রগ্রহ (Venus)। [কুরতুবী]। هوى শব্দটি পতিত হওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। নক্ষত্রের পতিত হওয়ার মানে অস্তমিত হওয়া। এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নক্ষত্রের কসম খেয়ে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওহী সত্য, বিশুদ্ধ ও সন্দেহ-সংশয়ের ঊর্ধ্বে। [আদওয়াউল বায়ান, সা'দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১) শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্তমিত হয়। [1]
[1] মুফাসসিরদের কেউ কেউ ‘নক্ষত্র’ বলতে কৃত্তিকা নক্ষত্রকে বুঝিয়েছেন। আবার কেউ কেউ শুকতারাকে বুঝিয়েছেন। অন্যরা সমস্ত তারাকেই বুঝিয়েছেন। هَوَى উপর থেকে নীচে পড়া। অর্থাৎ, যখন তা রাতের শেষে ফজরের সময় পতিত (অদৃশ্য) হয়। অথবা শয়তানদেরকে মারার জন্য তাদের উপর পতিত হয়। অথবা অন্যদের উক্তি অনুযায়ী, কিয়ামতের দিন পতিত হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি। আল-বায়ান
তোমাদের (মাঝে ছোট থেকে বড় হয়েছে সেই) সঙ্গী গুমরাহও নয় আর ভুলপথে পরিচালিতও নয়, তাইসিরুল
তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়, মুজিবুর রহমান
Your companion [Muhammad] has not strayed, nor has he erred, Sahih International
২. তোমাদের সঙ্গী(১) বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়,
(১) মূল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে صَاحِبُكُمْ বা তোমাদের বন্ধু। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে এবং কুরাইশদের সম্বোধন করা হয়েছে। আরবী ভাষায় صَاحِب বলতে বন্ধু, সাথী, নিকটে অবস্থানকারী এবং সাথে উঠা-বসা করে এমন লোককে বুঝায়। এ স্থলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম অথবা নবী শব্দ ব্যবহার করার পরিবর্তে “তোমাদের সঙ্গী” বলে ব্যক্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে থেকে আগত কোন অপরিচিত ব্যক্তি নন, যার সত্যবাদিতায় তোমরা সন্দিগ্ধ হবে। বরং তিনি তোমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। [দেখুন: কুরতুবী; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(২) তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়। [1]
[1] এটা হল কসমের জওয়াব। صَاحِبُكُمْ (তোমাদের সঙ্গী) বলে এখানে নবী করীম (সাঃ)-এর সত্যতাকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, নবুঅতের পূর্বে তিনি চল্লিশ বছর তোমাদের সঙ্গে এবং তোমাদের মাঝে কাটিয়েছেন। তাঁর দিবা-রাত্রির কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ তোমাদের সামনে বিদ্যমান। তাঁর চরিত্র ও নৈতিকতা তোমাদের জানা ও চেনা। সততা ও বিশ্বস্ততা ছাড়া তোমরা তাঁর আচরণে অন্য কিছু কি দেখেছ? এখন চল্লিশ বছর পর যখন তিনি নবুঅতের দাবী করছেন, তখন একটু ভেবে দেখ যে, তিনি কি মিথ্যাবাদী হতে পারেন? অতএব, বাস্তব এটাই যে, তিনি পথভ্রষ্টও নন এবং বিপথগামীও নন। ضَلالة বলা হয়, অজ্ঞতার কারণে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়াকে। আর غَوى বলা হয়, এমন বক্রতাকে, যা জেনে-বুঝে সত্যকে বর্জন করে অবলম্বন করা হয়। মহান আল্লাহ এই উভয় ভ্রষ্টতা থেকে তাঁর নবীকে পাক-পবিত্র ঘোষণা করেছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর সে মনগড়া কথা বলে না। আল-বায়ান
আর সে মনগড়া কথাও বলে না। তাইসিরুল
এবং সে মনগড়া কথাও বলেনা। মুজিবুর রহমান
Nor does he speak from [his own] inclination. Sahih International
৩. আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না।(১)
(১) অর্থাৎ সেসব কথা তার মনগড়া নয় কিংবা তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ঐ সবের উৎস নয়। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে তার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং হচ্ছে। একইভাবে ইসলামের এ আন্দোলন, তাওহীদের এ শিক্ষা, আখেরাত, হাশর-নাশর এবং কাজকর্মের প্রতিদানের এ খবর মহাবিশ্ব ও মানুষ সম্পর্কে এসব সত্য ও তথ্য এবং পবিত্র জীবন যাপন করার জন্য যেসব নীতিমালা তিনি পেশা করছেন এসবও তার নিজের রচিত দর্শন নয়। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]।
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) এবং সে মনগড়া কথাও বলে না।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়। আল-বায়ান
তাতো ওয়াহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়, তাইসিরুল
এটাতো অহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। মুজিবুর রহমান
It is not but a revelation revealed, Sahih International
৪. তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরিত হয়,
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) তা তো অহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। [1]
[1] অর্থাৎ, তিনি পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী কি করে হতে পারেন?! তিনি তো আল্লাহর প্রত্যাদেশ ছাড়া মুখই খুলেন না। এমনকি রহস্য ও হাসি-ঠাট্টার সময়ও তাঁর পবিত্র জবান থেকে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না (তিরমিযীঃ বির্র্ অধ্যায়) অনুরূপ ক্রোধের সময়ও তাঁর স্বীয় আবেগ ও উত্তেজনার উপর এত নিয়ন্ত্রণ ছিল যে, তাঁর জবান থেকে কোন কথা বাস্তবের বিপরীত বের হয়নি। (আবূ দাউদঃ শিক্ষা অধ্যায়)
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতাকে শিক্ষা দিয়েছে প্রবল শক্তিধর, আল-বায়ান
তাকে শিক্ষা দেয় শক্তিশালী, তাইসিরুল
তাকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী – মুজিবুর রহমান
Taught to him by one intense in strength - Sahih International
৫. তাকে শিক্ষা দান করেছেন প্ৰচণ্ড শক্তিশালী(১),
(১) অর্থাৎ তাকে শিক্ষাদানকারী কোন মানুষ নয়, যা তোমরা মনে করে থাকো। মানব সত্তার ঊর্ধ্বের একটি মাধ্যম থেকে তিনি এ জ্ঞান লাভ করছেন। তাফসীরকারদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ ব্যাপারে একমত যে, “মহাশক্তির অধিকারী” এর অর্থ জিবরীল আলাইহিস সালাম। [ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) তাকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী, (ফিরিশতা জিবরীল)।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ানপ্রজ্ঞার অধিকারী*। অতঃপর সে স্থির হয়েছিল, আল-বায়ান
প্রজ্ঞার অধিকারী (জিবরাঈল) সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়ে ছিল, তাইসিরুল
প্রজ্ঞা সম্পন্ন; সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল, মুজিবুর রহমান
One of soundness. And he rose to [his] true form Sahih International
* জিবরীল।
৬. সৌন্দর্যপূর্ণ সত্তা(১)। অতঃপর তিনি স্থির হয়েছিলেন(২),
(১) এর দ্বারা বোঝা যায় যে, ফেরেশতাগণ অত্যন্ত সুন্দর। তারা যেমন সুন্দর তাদের চরিত্ৰও তেমনি। তাই তারা কোন খারাপ সুরত গ্রহণ করেন না। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরিন সার্বিকভাবে তারা সুন্দর। কোন কোন মুফাসসির مرة শব্দটির অর্থ করেছেন, শক্তিশালী হওয়া। জিবরাঈলের অধিক শক্তি বর্ণনা করার জন্যে এটাও তারই বিশেষণ। এতে করে এই ধারণার অবকাশ থাকে না, ওহী নিয়ে আগমনকারী ফেরেশতার কাজে কোন শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আবার কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ করেছেন, প্রজ্ঞাসম্পন্ন, বিবেকবান। আবার কেউ কেউ অর্থ করেছেন, শারিরীক ও মানসিক সুস্থতা। এসবগুলোই মূলত: ফেরেশতাদের গুণ। [দেখুন: কুরতুবী]
(২) এর অর্থ সোজা হয়ে গেলেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য যদি জিবরীল আলাইহিস সালাম হয়, তখন অর্থ হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীলকে যখন প্রথম দেখেন, তখন তিনি আকাশ থেকে নিচে অবতরণ করছিলেন। অবতরণের পর তিনি উর্ধ্ব দিগন্তে সোজা হয়ে বসে যান। রাসূলকে দেখা দেওয়ার পর পুনরায় তিনি তার জায়গায় ফিরে যান। অথবা সোজা হয়ে যাওয়ার অর্থ জিবরীল তার সৃষ্ট সঠিক রূপে দাঁড়িয়ে গেলেন। যে প্রকৃত রূপে আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি সে প্রকৃত রূপে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে উপস্থিত হলেন। আর যদি এখানে সোজা হয়ে যাওয়া দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য নেয়া হয় তখন আয়াতের অর্থ হবে, তারপর কুরআন রাসূলের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। আর যদি এখানে সোজা হওয়া দ্বারা আল্লাহকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়ে থাকে তখন এর অর্থ হবে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর আরশের উপর উঠলেন। এ সব তাফসীর সবগুলিই সালফে সালেহীন থেকে বর্ণিত আছে এবং সবগুলিই উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) প্রজ্ঞাসম্পন্ন,[1] সে (জিবরীল নিজ আকৃতিতে) স্থির হয়েছিল,
[1] এর দ্বিতীয় অর্থঃ বলবান। এ থেকে ফিরিশতা জিবরীল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে; যিনি প্রচন্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী। এই ফিরিশতাই নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট অহী নিয়ে এসেছেন এবং তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে। আল-বায়ান
আর সে ছিল ঊর্ধ্ব দিগন্তে, তাইসিরুল
তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে। মুজিবুর রহমান
While he was in the higher [part of the] horizon. Sahih International
৭. আর তিনি ছিলেন ঊর্ধ্বদিগন্তে(১),
(১) এ আয়াতে জিবরীলকে আসল আকৃতিতে দেখার বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। দিগন্ত অর্থ আসমানের পূর্ব প্রান্ত যেখানে সূর্য উদিত হয় এবং দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূরা আত-তাকভীরের ২৩ আয়াতে একেই পরিষ্কার দিগন্ত বলা হয়েছে। দুটি আয়াত থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমবার যখন জিবরীল আলাইহিস সালামকে দেখেন তখন তিনি আসমানের পূর্ব প্রান্ত থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। মূলত: মহাশক্তিশালী, সহজাত শক্তিসম্পন্ন বা প্রজ্ঞাবান, সৌন্দর্যমণ্ডিত, সোজা হওয়া, এবং নিকটবর্তী হওয়া এগুলো সব জিবরীলের বিশেষণ। এই তফসীরের পক্ষে অনেক সঙ্গত কারণ রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক দিয়েও সূরা আন-নাজম সম্পূর্ণ প্রাথমিক সূরাসমূহের অন্যতম। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় সর্বপ্রথম যে সূরা প্রকাশ্যে পাঠ করেন তা সূরা আন-নাজম। বাহ্যত মে'রাজের ঘটনা এরপরে সংঘটিত হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ এই যে, হাদীসে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব আয়াতের যে তফসীর করেছেন, তাতে জিবরীলকে দেখার কথা উল্লেখিত আছে। ইমাম শা'বী তার উস্তাদ মাসরূক থেকে বর্ণনা করেন- তিনি একদিন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার কাছে ছিলেন এবং আল্লাহ তা'আলাকে দেখা সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। মাসরূক বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, (وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ) এবং (وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, মুসলিমদের মধ্যে সর্বপ্রথম আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি উত্তরে বলেছেন, আয়াতে যাকে দেখার কথা বলা হয়েছে, সে জিবরীল আলাইহিস সালাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মাত্র দু’বার আসল আকৃতিতে দেখেছেন। আয়াতে বর্ণিত দেখার অর্থ এই যে, তিনি জিবরীলকে আকাশ থেকে ভূমির দিকে অবতরণ করতে দেখেছেন। তার দেহাকৃতি আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী শূন্যমণ্ডলকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল। [বুখারী: ৪৬১২, ৪৮৫৫, মুসলিম: ১৭৭/২৮৭, ২৮৮, ২৮৯, তিরমিযী: ৩০৬৮, মুসনাদে আহমাদ: ৬/২৪১]
অন্য বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ এই আয়াত সম্পর্কে সর্বপ্রথম আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, আপনি আপনার পালনকর্তাকে দেখেছেন কি? তিনি বললেনঃ না, বরং আমি জিবরীলকে নিচে অবতরণ করতে দেখেছি। [মুসনাদে আহমাদ: ৬/২৩৬] অনুরূপভাবে শায়বানী বর্ণনা করেন যে, তিনি আবু যরকে এই আয়াতের অর্থ জিজ্ঞাসা করেন, তিনি জওয়াবে বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীলকে ছয়শত ডানাবিশিষ্ট দেখেছেন। [বুখারী: ৪৮৫৬] ইবনে জারীর রাহেমাহুল্লাহ আবদুল্লাহ ইবনে-মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীলকে রফরফের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেছেন। তাঁর অস্তিত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী শূন্যমণ্ডলকে ভরে রেখেছিল। [তাফসীর তাবারী: ৩২৪৭০]
এ সব বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সূরা নাজমের উল্লেখিত আয়াতসমূহ দেখা ও নিকটবর্তী হওয়া বলে জিবরীলকে দেখা ও নিকটবর্তী হওয়া বোঝানো হয়েছে। আয়েশা, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু যর গেফারী, আবু হুরায়রা প্রমুখ সাহাবীর এই উক্তি। তাই ইবনে-কাসীর আয়াতসমূহের তফসীরে বলেনঃ আয়াতসমূহে উল্লেখিত দেখা ও নিকটবর্তী হওয়ার অর্থ জিবরীলকে দেখা ও জিবরাঈলের নিকটবর্তী হওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রথমবার আসল আকৃতিতে দেখেছিলেন এবং দ্বিতীয়বার মে'রাজের রাত্রিতে সিদরাতুল-মুন্তাহার নিকটে দেখেছিলেন। প্রথমবারে দেখা নবুওয়তের সম্পূর্ণ প্রাথমিক যমানায় হয়েছিল।
তখন জিবরীল সূরা ইকরার প্রাথমিক আয়াতসমূহের প্রত্যাদেশ নিয়ে প্রথমবার আগমন করেছিলেন। এরপর একদিন জিবরীল আলাইহিস সালাম মক্কার উন্মুক্ত ময়দানে তার আসল আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। তার ছয়শত বাহু ছিল এবং তিনি গোটা দিগন্তকে ঘিরে রেখেছিলেন। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আসেন এবং তাকে ওহী পৌছান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জিবরাঈলের মাহাত্ম্য এবং আল্লাহ তা’আলার দরবারে তার সুউচ্চ মর্যাদার স্বরূপ ফুটে ওঠে। সারকথা এই যে, এই প্রথম দেখা এ জগতেই মক্কার দিগন্তে হয়েছিল। দ্বিতীয়বার দেখার কথা (وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ) আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে। মে'রাজের রাত্ৰিতে এই দেখা হয়।
উল্লেখিত কারণসমূহের ভিত্তিতে সুস্পষ্টভাবে এটাই বলা যায় যে, সূরা আন-নাজমের শুরুভাগের আয়াতসমূহে আল্লাহ তা’আলাকে দেখার কথা আলোচিত হয়নি; বরং জিবরীলকে দেখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জিবরীলকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজস্ব আকৃতিতে দু’বার দেখেছেন। প্রথমবার নবুওয়াতের প্রারম্ভে। আর দ্বিতীয়টি মি'রাজের রাত্ৰিতে, সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে। [দেখুন: বুখারী: ৪৮৫৫, ৪৮৫৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) তখন সে ঊর্ধ্বদিগন্তে। [1]
[1] অর্থাৎ, জিবরীল (আঃ)। অর্থাৎ, অহী শিক্ষা দেওয়ার পর আকাশের দিগন্তে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতারপর সে নিকটবর্তী হল, অতঃপর আরো কাছে এল। আল-বায়ান
অতঃপর সে (নবীর) নিকটবর্তী হল, অতঃপর আসলো আরো নিকটে, তাইসিরুল
অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হল, অতি নিকটবর্তী। মুজিবুর রহমান
Then he approached and descended Sahih International
৮. তারপর তিনি তার কাছাকাছি হলেন, অতঃপর খুব কাছাকাছি,
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) অতঃপর সে তার (রসূল)এর নিকটবর্তী হল, অতি নিকটবর্তী। [1]
[1] অর্থাৎ, অতঃপর যমীনে অবতরণ করলেন এবং ধীরে ধীরে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকটবর্তী হলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতখন সে নৈকট্য ছিল দু’ ধনুকের পরিমাণ, অথবা তারও কম। আল-বায়ান
ফলে [নবী (সাঃ) ও জিবরাঈলের মাঝে] দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা আরো কম। তাইসিরুল
ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল, অথবা তারও কম। মুজিবুর রহমান
And was at a distance of two bow lengths or nearer. Sahih International
৯. ফলে তাদের মধ্যে দু ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম।(১)
(১) دَنَا শব্দের অর্থ নিকটবর্তী হল এবং فَتَدَلَّىٰ শব্দের অর্থ বুলে গেল। অর্থাৎ ঝুঁকে পড়ে নিকটবর্তী হল। ধনুকের কাঠ এবং এর বিপরীতে ধনুকের সুতার মধ্যবর্তী ব্যাবধানকে قاب বলা হয়। এই ব্যবধান আনুমানিক একহাত হয়ে থাকে। [কুরতুবী] আলোচ্য আয়াতসমূহে জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর অধিকতর নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি বর্ণনা করার কারণ এদিকে ইঙ্গিত করা যে, তিনি যে ওহী পৌঁছিয়েছেন তা শ্রবণে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। [দেখুন: কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। [1]
[1] কেউ কেউ অনুবাদ করেছেন দুই হাত পরিমাণ। এখানে নবী করীম (সাঃ) এবং জিবরীল (আঃ)-এর পারস্পরিক নিকটবর্তিতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। মহান আল্লাহ এবং নবী করীম (সাঃ)-এর কাছাকাছি হওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। যেমন কেউ কেউ এটাই বুঝাতে চেষ্টা করেন। আয়াতগুলোর প্রাসঙ্গিক আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, এতে কেবল জিবরীল এবং নবী করীম (সাঃ)-এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই নিকটবর্তিতার সময়ই নবী করীম (সাঃ) জিবরীল (আঃ)-কে তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেন। আর এটা হল নবুঅত প্রাপ্তির প্রথম দিকের সেই ঘটনা, যার আলোচনা এই আয়াতগুলোতে করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার আসল আকৃতিতে দর্শন করেন মি’রাজের রাতে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানঅতঃপর তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন। আল-বায়ান
তখন (আল্লাহ) তাঁর বান্দাহর প্রতি ওয়াহী করলেন যা ওয়াহী করার ছিল। তাইসিরুল
তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা অহী করার তা অহী করলেন। মুজিবুর রহমান
And he revealed to His Servant what he revealed. Sahih International
১০. তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন।(১)
(১) এখানে أوْحٰى (বা ওহী প্রেরণ করেন) ক্রিয়াপদের কর্তা স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা এবং عَبْدُه (বা তার বান্দা) এর সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ্ তা'আলাকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে প্রেরণ করে আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি ওহী নাযিল করলেন। [দেখুন: আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর, তাবারী]। এক হাদীসে এসেছে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনটি জিনিস দেয়া হয়। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, সূরা আল-বাকারাহ এর শেষ আয়াতসমূহ এবং তার উম্মতের মধ্যে যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করবে না তাদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা। [মুসলিম: ১৭৩]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) তখন আল্লাহ তাঁর দাসের প্রতি যা অহী করার তা অহী করলেন। [1]
[1] এর দ্বিতীয় অর্থঃ জিবরীল (আঃ) আল্লাহর বান্দা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জন্য যে অহী অথবা বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, সেটা তিনি তাঁর কাছে পৌঁছে দিলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান