৪৯৩৮

পরিচ্ছেদঃ ১৪. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার

৪৯৩৮-[২৮] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ তিন ব্যক্তি পথ চলছিলেন। হঠাৎ তাঁদেরকে বৃষ্টিতে পেলে তাঁরা এক পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলেন। এ সময় হঠাৎ পর্বত থেকে একটি প্রকাণ্ড পাথর এসে গুহার মুখে পতিত হলো এবং তাঁদের বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল। তাঁদের মধ্য থেকে একজন অপরজনকে বললেন, তোমরা তোমাদের কোন নেক কাজ দেখো, যা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশেই করেছ। আর সে কাজকে উপলক্ষ করে আল্লাহ তা’আলার কাছে এ বিপদ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করো। এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা হয়তো এ পাথর দূর করে দেবেন।

তখন তাঁদের একজন বললেনঃ হে আল্লাহ! আমার অতি বৃদ্ধ মাতা-পিতা ছিলেন এবং কয়েকটি ছোট বাচ্চা ছিল। আমি ছাগল চরাতাম। যখন সন্ধ্যায় তাদের নিকট ফিরে আসতাম, তখন দুধ দোহন করতাম। আমার সন্তানদের পান করানোর আগেই আমার পিতা-মাতাকে দুধ পান করাতাম। ঘটনাক্রমে একদিন চারণ-ক্ষেত্র আমাকে দূরে নিয়ে গেল। অর্থাৎ- ছাগল চরাতে চরাতে এতটা দূরে চলে গেলাম যে, বাড়িতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দেখলাম, আমার মা-বাবা উভয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি প্রতিদিনের মতো আজও দুধ দোহন করলাম এবং দুধের পাত্র নিয়ে মা-বাবার কাছে এসে তাঁদের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তাঁদেরকে ঘুম থেকে জাগানো ভালো মনে করলাম না এবং অপছন্দ করলাম বাচ্চাগুলোকে দুধ পান করাতে তাঁদের পূর্বে, অথচ বাচ্চাগুলো আমার পায়ের কাছে ক্ষুধায় কাঁদছিল। সকাল হওয়া পর্যন্ত আমার ও তাদের এ অবস্থা ছিল। হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাকো যে, আমি এ কাজ একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তবে আমাদের জন্য এতটুকু পথ খুলে দাও, যেন আকাশ দেখতে পাই। তখন আল্লাহ তা’আলা পাথরকে এতটুকু সরিয়ে দিলেন যে, আকাশ দেখা যেতে লাগল।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেনঃ হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। আমি তাকে অত্যধিক ভালোবাসতাম, যতটা কোন পুরুষ কোন মহিলাকে ভালোবাসতে পারে। আমি তাকে উপভোগ করতে চাইলাম। সে এটা অস্বীকার করল, যতক্ষণ না আমি তাকে একশ’ দীনার দেই। তখন আমি জোর প্রচেষ্টা চালালাম এবং একশ’ দীনার যোগাড় করে তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। যখন তার দু’পায়ের মধ্যখানে হাঁটু গেড়ে বসলাম, সে বলল : হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় করো, মোহর অর্থাৎ- কুমারিত্ব নষ্ট করো না। তৎক্ষণাৎ আমি দাঁড়ালাম। হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাকো যে, আমি এ কাজ একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তবে আমাদের জন্য পথ খুলে দাও। তখন আল্লাহ তা’আলা পাথর আরো কিঞ্চিৎ সরিয়ে দিলেন।

তৃতীয় ব্যক্তি বললেনঃ হে আল্লাহ! আমি এক ব্যক্তিকে এক ’’ফারক’’ পরিমাণ খাদ্যের বিনিময়ে মজুর নিয়োগ করলাম। যখন সে ব্যক্তি নিজ কাজ সমাধা করে বলল : আমার পাওনা আমাকে দিয়ে দাও। আমি তাকে প্রাপ্য দিলাম। সে তা ফেলে চলে গেল, তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করল না। আমি তার পাওনা দ্বারা চাষাবাদ আরম্ভ করলাম। সেটার আয় দ্বারা অনেকগুলো গরু ও রাখাল যোগাড় করলাম। তখন একদিন লোকটি আমার কাছে এসে বলল : আল্লাহকে ভয় করো, আমার প্রতি অবিচার করো না। আমাকে আমার পাওনা দিয়ে দাও। আমি বললামঃ এ গরুগুলো এবং তার রাখালসমূহ নিয়ে যাও। সে বলল : আল্লাহকে ভয় করো, আমার সাথে ঠাট্টা করো না। তখন আমি বললামঃ তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না। ঐ গরু ও রাখালগুলো নিয়ে যাও। সুতরাং সে ওগুলো নিয়ে চলে গেল। হে আল্লাহ! যদি তুমি জানো যে, এ কাজ আমি শুধু তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশেই করেছি, তবে এখনো যতটুকু বাকি, সে রাস্তা খুলে দাও। তখন আল্লাহ তা’আলা পাথর সরিয়ে রাস্তা খুলে দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: بَيْنَمَا ثَلَاثَة نفر يماشون أَخَذَهُمُ الْمَطَرُ فَمَالُوا إِلَى غَارٍ فِي الْجَبَلِ فَانْحَطَّتْ عَلَى فَمِ غَارِهِمْ صَخْرَةٌ مِنَ الْجَبَلِ فَأَطْبَقَتْ عَلَيْهِمْ فَقَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ: انْظُرُوا أَعْمَالًا عَمِلْتُمُوهَا لِلَّهِ صَالِحَةً فَادْعُوا اللَّهَ بِهَا لَعَلَّهُ يُفَرِّجُهَا. فَقَالَ أَحَدُهُمْ: اللَّهُمَّ إِنَّهُ كَانَ لِي وَالِدَانِ شَيْخَانِ كَبِيرَانِ وَلِي صِبْيَةٌ صِغَارٌ كُنْتُ أَرْعَى عَلَيْهِمْ فَإِذَا رُحْتُ عَلَيْهِمْ فَحَلَبْتُ بَدَأْتُ بِوَالِدَيَّ أَسْقِيهِمَا قَبْلَ وَلَدِي وَإِنَّهُ قَدْ نَأَى بِي الشَّجَرُ فَمَا أَتَيْتُ حَتَّى أَمْسَيْتُ فَوَجَدْتُهُمَا قَدْ نَامَا فَحَلَبْتُ كَمَا كُنْتُ أَحْلُبُ فَجِئْتُ بِالْحِلَابِ فَقُمْتُ عِنْدَ رُؤُوسِهِمَا أَكْرَهُ أَنْ أُوقِظَهُمَا وَأَكْرَهُ أَنْ أَبْدَأَ بِالصِّبْيَةِ قَبْلَهُمَا وَالصِّبْيَةُ يَتَضَاغَوْنَ عِنْدَ قَدَمَيَّ فَلَمْ يَزَلْ ذَلِكَ دَأْبِي وَدَأْبَهُمْ حَتَّى طَلَعَ الْفَجْرُ فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ لَنَا فُرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ فَفَرَجَ اللَّهُ لَهُمْ حَتَّى يرَوْنَ السماءَ
قَالَ الثَّانِي: اللَّهُمَّ إِنَّه كَانَ لِي بِنْتُ عَمٍّ أُحِبُّهَا كَأَشَدِّ مَا يُحِبُّ الرِّجَالُ النِّسَاءَ فَطَلَبْتُ إِلَيْهَا نَفْسَهَا فَأَبَتْ حَتَّى آتيها بِمِائَة دِينَار فلقيتها بِهَا فَلَمَّا قَعَدْتُ بَيْنَ رِجْلَيْهَا. قَالَتْ: يَا عَبْدَ اللَّهِ اتَّقِ اللَّهَ وَلَا تَفْتَحِ الْخَاتَمَ فَقُمْتُ عَنْهَا. اللَّهُمَّ فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ لَنَا مِنْهَا فَفَرَجَ لَهُمْ فُرْجَةً
وَقَالَ الْآخَرُ: اللَّهُمَّ إِنِّي كُنْتُ اسْتَأْجَرْتُ أَجِيرًا بِفَرْقِ أَرُزٍّ فَلَمَّا قَضَى عَمَلَهُ قَالَ: أَعْطِنِي حَقِّي. فَعَرَضْتُ عَلَيْهِ حَقَّهُ فَتَرَكَهُ وَرَغِبَ عَنْهُ فَلَمْ أَزَلْ أَزْرَعُهُ حَتَّى جَمَعْتُ مِنْهُ بَقَرًا وَرَاعِيَهَا فَجَاءَنِي فَقَالَ: اتَّقِ اللَّهَ وَلَا تَظْلِمْنِي وَأَعْطِنِي حَقِّي. فَقُلْتُ: اذْهَبْ إِلَى ذَلِكَ الْبَقْرِ وَرَاعِيهَا فَقَالَ: اتَّقِ اللَّهَ وَلَا تَهْزَأْ بِي. فَقُلْتُ: إِنِّي لَا أَهْزَأُ بكَ فخذْ ذلكَ البقرَ وراعيها فَأخذ فَانْطَلَقَ بِهَا. فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ مَا بَقِيَ فَفَرَجَ الله عَنْهُم . مُتَّفق عَلَيْهِ

عن ابن عمر عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: بينما ثلاثة نفر يماشون اخذهم المطر فمالوا الى غار في الجبل فانحطت على فم غارهم صخرة من الجبل فاطبقت عليهم فقال بعضهم لبعض: انظروا اعمالا عملتموها لله صالحة فادعوا الله بها لعله يفرجها. فقال احدهم: اللهم انه كان لي والدان شيخان كبيران ولي صبية صغار كنت ارعى عليهم فاذا رحت عليهم فحلبت بدات بوالدي اسقيهما قبل ولدي وانه قد ناى بي الشجر فما اتيت حتى امسيت فوجدتهما قد ناما فحلبت كما كنت احلب فجىت بالحلاب فقمت عند رووسهما اكره ان اوقظهما واكره ان ابدا بالصبية قبلهما والصبية يتضاغون عند قدمي فلم يزل ذلك دابي ودابهم حتى طلع الفجر فان كنت تعلم اني فعلت ذلك ابتغاء وجهك فافرج لنا فرجة نرى منها السماء ففرج الله لهم حتى يرون السماء قال الثاني: اللهم انه كان لي بنت عم احبها كاشد ما يحب الرجال النساء فطلبت اليها نفسها فابت حتى اتيها بماىة دينار فلقيتها بها فلما قعدت بين رجليها. قالت: يا عبد الله اتق الله ولا تفتح الخاتم فقمت عنها. اللهم فان كنت تعلم اني فعلت ذلك ابتغاء وجهك فافرج لنا منها ففرج لهم فرجة وقال الاخر: اللهم اني كنت استاجرت اجيرا بفرق ارز فلما قضى عمله قال: اعطني حقي. فعرضت عليه حقه فتركه ورغب عنه فلم ازل ازرعه حتى جمعت منه بقرا وراعيها فجاءني فقال: اتق الله ولا تظلمني واعطني حقي. فقلت: اذهب الى ذلك البقر وراعيها فقال: اتق الله ولا تهزا بي. فقلت: اني لا اهزا بك فخذ ذلك البقر وراعيها فاخذ فانطلق بها. فان كنت تعلم اني فعلت ذلك ابتغاء وجهك فافرج ما بقي ففرج الله عنهم . متفق عليه

ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসটি সৎ ‘আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার এক উজ্জ্বল নমুনা। মানুষ বিপদে পড়লে আল্লাহর নিকট দু‘আ করবে। বৃষ্টি প্রার্থনাসহ সব দু‘আর ক্ষেত্রেই। নিজ নিজ সৎ ‘আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দু‘আ করবে। উক্ত তিন ব্যক্তি নিজ নিজ সৎ ‘আমলের মাধ্যমে দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের দু‘আ কবুল করলেন।

অত্র হাদীস থেকে পিতা-মাতার সেবার বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, তাদের সেবা করলে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ পাওয়া যায়। আর পিতা-মাতাকে সন্তানাদির চেয়ে বেশী অগ্রাধিকার দিতে হবে এমনকি স্ত্রীর চেয়েও বেশী।

অত্র হাদীস থেকে আরো বুঝা যায় যে, আমাদের সব সময় হারাম কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, যদিও কেউ তা না দেখে। কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখেন। হারাম কাজ ছাড়তে হবে কেবল আল্লাহর উদ্দেশে এবং তাকে খুশি করার লক্ষ্যে।

অত্র হাদীস থেকে আরো বুঝা যায় নিজ কাজের জন্য কেউ কর্মচারী নিয়োগ দিলে কর্মচারীর সাথে সৎ ব্যবহার করতে হবে, তার সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে। আমানাতদারিতার প্রমাণ দিতে হবে এবং কর্ম ক্ষেত্রে উদারতা সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

অত্র হাদীসের মৌলিক শিক্ষা হলো তাওয়াস্সুল হলো সৎ আমলের মাধ্যমে দু‘আ করা, এই দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন। (শারহে মুসলিম ১৭ খন্ড, হাঃ ২৭৪৩)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)