৩২৭৪

পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - খুল্‘ই (খুলা‘ তালাক) ও তালাক প্রসঙ্গে

খুলা’ শব্দটি ’আরবী خُلْعُِ الثوب থেকে নেয়া হয়েছে, ’আরবেরা এ কথা তখনই বলে اذا ازاله যখন কাপড় খুলে ফেলানো হয়। কেননা নারী পুরুষের পোষাক স্বরূপ, অনুরূপ পুরুষও নারীর পোষাক স্বরূপ। আল্লাহর বাণী : ’’স্ত্রীগণ তোমাদের পোষাক স্বরূপ তোমরাও তাদের পোষাক।’’ (সূরা আল বাকারাহ্ ২ : ১৮৭)

ইসলামের পরিভাষায় মহিলা তার স্বামীর নিকট থেকে কোনো কিছুর (মোহরের) বিনিময়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়াকে খুলা’ বলা হয়।

কুরআন ও সহীহ হাদীসে খুলা’ করার বৈধতা রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ’’অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি কিছু বিনিময় দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তবে উভয়ের কারো পাপ হবে না।’’ (সূরা আল বাকারহ্ ২ : ১২৯)

নিম্নের বিশুদ্ধ হাদীসটিসহ একাধিক বিশুদ্ধ হাদীসও খুলা’ বৈধ হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। খুলা’ তালাক কিনা? এ নিয়ে ফুকাহায়ে কিরামের মাঝে ইখতিলাফ বিদ্যমান।

ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ)-সহ কতিপয় ইমামের মতে খুলা’ তালাক। পক্ষান্তরে ইমাম আহমাদসহ আরো কতিপয় ফকীহরে মতে খুলা’ তালাক নয়। বরং ’ফাস্খে নিকাহ’ বা বিবাহ বাতিল করা। পূর্বে উল্লেখিত আভিধানিক অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখেও বলা যায়। খুলা’ হলো বিবাহ খুলে ফেলানো।

মিশকাতের আধুনিক ভাষ্যগ্রন্থ আনোয়ারুল মিশকাতের ব্যাখ্যাকার ইমাম আহমাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তিনি বলেছেন, খুলা’ তালাক নয়, বরং ’বিচ্ছেদ।’ কেননা আল্লাহর কালামে বলা হয়েছে- অর্থাৎ ’’তালাক দু’বার ..., অতঃপর সে যদি তালাক দেয়’’- (সূরা আত্ব তালাক ৬৫ : ২৯-৩০)। এ শেষ বাক্যের পূর্বে খুলা’র কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, খুলা’ তালাক নয়। কেননা প্রথমে ২ তালাক, খুলা’কে যদি তালাক ধরা হয় তাহলে সেটা এক তালাক, পরের বাক্যে (এক) তালাক উল্লেখ হয়েছে, এতে মোট ৪ তালাক হয়। অথচ এটা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং খুলা’ তালাক নয় বরং ’ফাসখে নিকাহ’ বা বিবাহ ভঙ্গ মাত্র। অবশ্য খুলা’কে ত্বলাক (তালাক)ের বর্ণনার মধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র।

তালাক ও তাহলীল গ্রন্থকার হাফিয ইবনু কইয়িম-এর বরাত দিয়ে লিখেছেন, তিনি বলেন, খুলা’ যে তালাক নয়, তার প্রমাণ হলো ত্বলাক (তালাক)ের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলা যে তিনটি বিধানের কথা বলেছেন, যেগুলোর সব কটি খুলা’তে পাওয়া যায় না। সে তিনটি নিম্নরূপ :

(১) ত্বলাক (তালাক)ে রজ্’ই-এর পর স্বামী তার স্ত্রীকে ’ইদ্দাতের মধ্যে বিনা বিবাহ ও (বিনা বাধায়) ফিরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু খুলা’ হলে স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত তা পারবে না।

(২) ’তালাক’ তিন পর্যন্ত সীমিত। তালাক সংখ্যা পূর্ণ হয়ে গেলে স্ত্রীর অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ ও মিলন না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু খুলা’য় স্ত্রীকে অপর কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই প্রথম স্বামীর কাছে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরে যেতে পারবে।

(৩) খুলা’র ’ইদ্দত হলো এক ঋতু। পক্ষান্তরে সহবাসকৃত স্ত্রীর ’ইদ্দত হলো তিন তুহর।

(’তালাক ও তাহলীল’ ১১-১২ পৃঃ, ড. আসাদুল্লাহ আল গালীব)

এ ছাড়াও ঋতুকালে কিংবা পবিত্রকালে, ঋতু পরবর্তী সহবাসকৃত কিংবা সহবাসহীন, সকল অবস্থায়ই খুলা’ করতে পারে, কিন্তু ঋতুকালে তালাক দেয়ার বিধান নেই। অনুরূপ ঋতুর পর সহবাসের পূর্বে তালাক দিতে হবে সহবাসের পরে নয়।

স্বামী স্ত্রী উভয়ের যদি দাম্পত্য জীবন মনোমালিন্য, অসহনীয় এবং অপছন্দনীয় হয়; স্বামী যদি বিচ্ছিন্ন হতে চায় তবে সেটা তার হাতে এবং সে তা প্রয়োগ করবে। আর যদি স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হতে চায়, তবে তার হাতে রয়েছে খুলা’ এবং সে এটা প্রয়োগ করবে। সুতরাং খুলা’ ও তালাক ভিন্ন বস্তু তা স্পষ্ট।

(ফিকহুস্ সুন্নাহ্ ২য় খন্ড, পৃঃ ২৯৯, বৈরুত)


৩২৭৪-[১] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাবিত ইবনু কয়স-এর স্ত্রী (হাবীবাহ্ বিনতু সাহল) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! সাবিত ইবনু কয়স-এর আচার-ব্যবহার ও দীনদারীর ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু ইসলামের ছায়ায় থেকে আমার দ্বারা স্বামীর অবাধ্যতা (কুফরী) মোটেই অনুচিত। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি (মোহরে প্রাপ্ত) খেজুরের বাগান তাকে ফিরিয়ে দিতে সম্মত আছ? সে বলল- জি, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্বামীকে বললেন, তুমি তোমার খেজুরের বাগান ফেরত নিয়ে তাকে এক তালাক দিয়ে দাও। (বুখারী)[1]

بَابُ الْخُلْعِ وَالطَّلَاقِ

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ امْرَأَةَ ثَابِتِ بْنِ قِيسٍ أَتَتِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ ثَابِتُ بْنُ قَيْسٍ مَا أَعْتِبُ عَلَيْهِ فِي خُلُقٍ وَلَا دِينٍ وَلَكِنِّي أَكْرَهُ الْكُفْرَ فِي الْإِسْلَامِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَتَرُدِّينَ عَلَيْهِ حَدِيقَتَهُ؟» قَالَتْ: نَعَمْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «اقْبَلِ الْحَدِيقَةَ وَطَلِّقْهَا تَطْلِيقَةً» . رَوَاهُ البُخَارِيّ

عن ابن عباس: ان امراة ثابت بن قيس اتت النبي صلى الله عليه وسلم فقالت: يا رسول الله ثابت بن قيس ما اعتب عليه في خلق ولا دين ولكني اكره الكفر في الاسلام فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «اتردين عليه حديقته؟» قالت: نعم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «اقبل الحديقة وطلقها تطليقة» . رواه البخاري

ব্যাখ্যা: সাবিত ইবনু কায়স-এর স্ত্রীর নামের ব্যাপারে ইখতিলাফ রয়েছে। অধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো তার নাম হাবীবাহ্ বিনতু সাহল। ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) ‘তাকরীব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন তিনি সাহবিয়্যাহ্ ছিলেন, তিনি তার স্বামী সাবিত ইবনু কয়স-এর সাথে খুলা‘ করেন। এর পর উবাই ইবনু কা‘ব তাকে বিবাহ করেন।

সাবিত-এর স্ত্রী হাবীবাহ্ বিনতু সাহল (রাঃ) তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার স্বামীর মোহর বাবদ দেয়া দু’টি খেজুর বাগান ফেরত দেয়া, অতঃপর সাবিতকে তা গ্রহণপূর্বক তাকে তালাক দেয়ার নির্দেশ করেন।

এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর أمْر বা নির্দেশ واجب (আবশ্যক) অর্থে নয়, বরং إرشادإصلاح তথা দিক নির্দেশনা ও সংশোধন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেনঃ এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, খুলা‘ ‘ফাসখে নিকাহ’ নয়, বরং ‘তালাক’। (মিরকাতুল মাফাতীহ)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১৩: বিবাহ (كتاب النكاح)