পরিচ্ছেদঃ ২. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৬৩-[৪১] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গুনাহ হতে তওবাকারী ঐ ব্যক্তির মতো যার কোন গুনাহ নেই। (ইবনু মাজাহ।)
আর বায়হাক্বী শু’আবূল ঈমান-এ বলেন, নাহরানী এটা একাই বর্ণনা করেছেন, যদিও তিনি মাজহূল ব্যক্তি। আর শারহুস্ সুন্নাহ্’য় ইমাম বাগাবী এটাকে মাওকূফ [’আবদুল্লাহ-এর কথা] হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি [’আবদুল্লাহ] বলেছেন, ’’অনুশোচনাই হলো তওবা্, আর তওবাকারী হলো ঐ ব্যক্তির মতো যার কোন গুনাহ নেই’’।)[1]
                      وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «التَّائِبَ مِنَ الذَّنْبِ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ» . رَوَاهُ ابْنُ مَاجَهْ وَالْبَيْهَقِيُّ فِي شُعَبِ الْإِيمَانِ وَقَالَ تَفَرَّدَ بِهِ النَّهْرَانَيُّ وَهُوَ مَجْهُولٌ. وَفِي (شَرْحِ السُّنَّةِ)
رَوَى عَنْهُ مَوْقُوفًا قَالَ: النَّدَمُ تَوْبَةٌ والتَّائبُ كمن لَا ذَنْبَ لَهُ
                    
ব্যাখ্যা: (اَلتَّائِبَ مِنَ الذَّنْبِ) অর্থাৎ- বিশুদ্ধ তাওবাহ্। আর গুনাহের ব্যাপকতার ব্যবহার সকল প্রকার গুনাহকে অন্তর্ভুক্ত করছে। সুতরাং হাদীসটি ঐ কথার উপর প্রমাণ বহন করছে যে, তাওবাহ্ যে কোন গুনাহের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। আর হাদীসটির বাহ্যিকতা ঐ কথার উপর প্রমাণ বহন করছে যে, তাওবাহ্ যখন তার সকল শর্তসহ বিশুদ্ধতা লাভ করবে তখন তা গৃহীত হবে।
(كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَه) অর্থাৎ- ক্ষতি সাধন না হওয়ার ক্ষেত্রে বেগুনাহ ব্যক্তির মতো। সিনদী বলেন, এর বাহ্যিক দিক হল গুনাহকে তওবাহকারীর ‘আমলনামা থেকে উঠিয়ে দেয়া হবে অথবা শাস্তি না হওয়ার ক্ষেত্রে গুনাহমুক্ত ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্য। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
ইমাম ত্বীবী বলেন, এটা হল, আধিক্যতা স্বরূপ অপূর্ণাঙ্গকে পূর্ণাঙ্গের সাথে মিলিয়ে দেয়া অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। যেমন বলা হয়, যায়দ সিংহের মতো। কেননা কোন সন্দেহ নেই যে, তাওবাহকারী মুশরিক ব্যক্তি গুনাহমুক্ত নাবীর মতো না।
ইবনু হাজার আসকালানী এ কথার পেছনে ঐ কথা টেনেছেন যে, যার কোন গুনাহ নেই- এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তি গুনাহের সম্মুখীন হবে তবে গুনাহ থেকে তাকে সংরক্ষণ করা হবে। সুতরাং এ ধরনের তাশবীহ থেকে নাবী এবং মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) বের হয়ে গেছে, এ ধরনের তাশবীহ বা সাদৃশ্য দ্বারা তারা উদ্দেশ্য না।
কারী বলেন, সুতরাং মতানৈক্য শাব্দিক। যে ব্যক্তি গুনাহ করে তা থেকে তাওবাহ্ করবে এবং যে ব্যক্তি মূলত গুনাহ্ই করবে না এদের দু’জনের ক্ষেত্রে বিদ্বানগণ মতানৈক্য করেছেন যে, এদের দু’জনের মাঝে কে উত্তম? লাম্‘আত গ্রন্থকার বলেন, এর দৃষ্টিকোণ বিভিন্ন ধরনের।
ইবনুল কইয়্যিম মাদারিজুস্ সালিক্বীনের ১ম খণ্ডে ১৬৩ পৃষ্ঠাতে বলেন, অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়নি এমন আনুগত্যশীল ব্যক্তি কি ঐ অবাধ্য ব্যক্তি হতে উত্তম, যে আল্লাহর কাছে প্রকৃত তাওবাহ্ করেছে? মোটকথা এ তাওবাহকারী কি এ অবাধ্যতায় লিপ্ত না হওয়া ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম? এ ব্যাপারে মতানৈক্য করা হয়েছে। অতঃপর একদল অবাধ্যতায় লিপ্ত না হওয়া ব্যক্তিকে অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে বিশুদ্ধ তাওবাহকারী ব্যক্তির ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে তারা দলীল দিয়েছেন এরপর তা উল্লেখ করেছেন যার সীমা দশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এরপর ইবনুল কইয়্যিম বলেন, একদল তাওবাহকারীকে প্রাধান্য দিয়েছেন যদিও এ দল প্রথম ব্যক্তির অধিক পুণ্যের অধিকারী হওয়াকে অস্বীকার করেনি। তারাও এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রমাণ স্বরূপ তা উল্লেখ করেছেন যার পরিমাণও দশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায় সে আলোচনা এখানে ছেড়ে দেয়া হল। মাস্আলাটি অতি সূক্ষ্ম ও মহৎ মাস্আলাহ্। সুতরাং ব্যক্তির উপর আবশ্যক মাদারিজ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা যাতে এ ব্যাপারে তার নিকটে অন্য একটি মাস্আলাহ্ স্পষ্ট হয়ে যায়। সে ব্যাপারেও মতানৈক্যকারীরা মতানৈক্য করেছেন। আর তা হল বান্দা যখন গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করবে তখন সে কি ঐ মর্যাদার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে গুনাহের পূর্বে যে মর্যাদার উপর ছিল, যে মর্যাদা থেকে তার গুনাহ তাকে নামিয়ে দিয়েছে? নাকি প্রত্যাবর্তন করবে না?
ইবনুল কইয়্যিম মাদারিজুস্ সালিক্বীনে ১ম খণ্ড- ১৬১ পৃষ্ঠাতে বলেন, একদল বলেন, সে তার পূর্ব মর্যাদায় ফিরে যাবে। কেননা তাওবাহ্ তার গুনাহকে পূর্ণাঙ্গভাবে বাতিল করে দিবে এবং গুনাহকে এমন করে দিবে যেন গুনাহ ছিল না। মর্যাদার কারণে ব্যক্তির পূর্বের ঈমান ও সৎ ‘আমলকে দাবী করা হবে। সুতরাং ব্যক্তি তাওবার কারণে পূর্বের মর্যাদায় ফিরে আসবে। তারা বলেন, কেননা তাওবাহ্ একটি মহা পুণ্য এবং সৎ ‘আমল। সুতরাং ব্যক্তির গুনাহ যখন ব্যক্তিকে তার মর্যাদা থেকে নামিয়ে দিয়েছিল এখন তাওবার কারণে তার পুণ্য তাকে সে মর্যাদায় আরোহণ করাবে। আর এটা ঐ ব্যক্তির মতো যে ব্যক্তি কোন কূপে পতিত হল, এমতাবস্থায় তার একজন দয়ালু সাথী আছে সে তার কাছে একটি রশি ফেলল, ফলে কূপে পতিত ব্যক্তি সে রশি ধরে তার স্বস্থানে উঠে আসলো। এভাবে তাওবাহ্ হল সৎ ‘আমল যা এ সৎসাথী এবং দয়ালু ভাইয়ের মতো। একদল বলেন, সে তার পূর্বের অবস্থা ও মর্যাদায় ফিরে যেতে পারবে না, কেননা সে গুনাহতে থেমে ছিল না, সে গুনাহতে আরোহণ করছিল। সুতরাং গুনাহের কারণে সে নিম্নের দিকে যাবে।
অতঃপর বান্দা যখন তাওবাহ্ করবে তখন ঐ গুনাহের পরিমাণ কমে যাবে, যা তাকে উন্নতির দিকে আরোহণে প্রস্ত্তত করবে। তারা বলেন, এর উদাহারণ হল একটি পথে একই ভ্রমণে ভ্রমণকারী দু’ব্যক্তির ন্যায় যাদের একজনের সামনে এমন কিছু জিনিস উপস্থিত হল যা তাকে পেছনের দিকে ফিরিয়ে দিল অথবা তাকে থামিয়ে দিল এমতাবস্থায় তার সাথী অবিরাম চলছেই। অতঃপর যখন এ ব্যক্তি তার সাথীর প্রত্যাবর্তন ও বিরতি কামনা করল এবং তার সাথীর পেছনে চলল, কিন্তু কোন মতেই তার সাথীকে পেল না। কেননা যখনই সে একধাপ ভ্রমণ করে তখন তার সাথী আরো একধাপ এগিয়ে যায়। তারা বলেন, প্রথম ব্যক্তি সে তার ‘আমলসমূহ এবং ঈমানের শক্তিতে ভ্রমণ করে। যখন সে বেশি ভ্রমণ করে তখন তার শক্তিও বৃদ্ধি হয় এবং ঐ থামা ব্যক্তি যে ভ্রমণ থেকে বিরত ছিল তার থেমে থাকার কারণে তার ভ্রমণ ও ঈমানের শক্তি দুর্বল হয়ে যায়।
(تَوْبَةٌ) এর অর্থ হল, নিশ্চয়ই লজ্জিত হওয়া তাওবার একটি বড় অংশ এবং তাতে স্বভাবত তাওবার অবশিষ্ট অংশগুলোকে আবশ্যককারী। কেননা লজ্জিত ব্যক্তি স্বভাবত বর্তমানকালে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে ভবিষ্যতে ঐ গুনাহতে প্রত্যাবর্তন না করার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করে আর এ অনুসারে তাওবাহ্ পূর্ণতা লাভ করে। তবে ঐ ফরযসমূহের ক্ষেত্রে ছাড়া যা পূরণ করা আবশ্যক। তখন ফরযসমূহের ক্ষেত্রে তাওবাহ্ ফরযসমূহ আদায় করার মুখাপেক্ষী হবে। অন্যথায় বান্দার অধিকারসমূহের ক্ষেত্রে তাওবাহকারী বান্দার অধিকারসমূহ ফেরত দেয়ার এবং লজ্জিত হওয়ার মুখাপেক্ষী হবে। এ উক্তিটি সিনদী করেছেন।
কারী বলেন, (النَّدَمُ تَوْبَةٌ) অর্থাৎ- তাওবার সর্বাধিক বড় রুকন হল লজ্জিত হওয়া। কেননা পাপ কাজ বর্জন করা এবং তার দিকে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করার মাধ্যমে তাওবার অবশিষ্ট রুকনগুলোকে এর উপর ধার্য করা হয়। আর সম্ভব অনুযায়ী বান্দার অধিকারসমূহের ক্ষতিপূরণ দেয়া, ঠিক ঐ রুকন যেমন হাজ্জের রুকনসমূহের ক্ষেত্রে ‘আরাফায় অবস্থান করা তবে তা পূর্ণাঙ্গভাবে বিপরীত। আর অবাধ্য কাজের ব্যাপারে লজ্জিত হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হল সেটি অবাধ্য কাজ, এ দৃষ্টিকোণ থেকে লজ্জিত হওয়া অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে না।
‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, বিদ্বানগণ তাওবার সংজ্ঞার ক্ষেত্রে মতানৈক্য করেছেন। অতঃপর তাদের কেউ বলেছেন, নিশ্চয়ই তা হল লজ্জিত হওয়া। কেউ বলেন, নিশ্চয়ই তা হল পুনরায় অবাধ্যতায় জড়িত না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করা। কেউ বলেন, তা হল গুনাহ থেকে সরে আসা। তাদের কেউ আবার তাওবাকে তিনটি বিষয়ের মাঝে একত্র করেন আর তা হল তাওবার মাঝে পূর্ণাঙ্গ তাওবাহ্। হাফেয এবং অন্য কেউ বলেন, তাওবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে গুনাহ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তি লজ্জিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া কেননা লজ্জা গুনাহ থেকে সরে আসা এবং পুনরায় সে গুনাহতে লিপ্ত না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্তকে আবশ্যক করে- এ বিষয় দু’টি লজ্জা থেকেই সৃষ্টি হয়। এ দু’টি লজ্জার সাথে কোন মৌলিক বিষয় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই হাদীসে এসেছে, (النَّدَمُ تَوْبَةٌ) আর এটি ইবনু মাস্‘ঊদ-এর হাদীস কর্তৃক একটি হাসান হাদীস।
(والتَّائبُ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَه) অর্থাৎ- বান্দা যখন বিশুদ্ধ তাওবাহ্ করবে তখন সে গুনাহ থেকে ঐ দিনের ন্যায় বের হয়ে যায় যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। ইমাম হাকিম তার কিতাবের ৪র্থ খণ্ডে ২৪৩ পৃষ্ঠাতে সংক্ষিপ্তভাবে একে সংকলন করেছেন, অর্থাৎ- (والتَّائبُ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَه) এ অংশটুকু ছাড়া।