লগইন করুন
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৬৯৮-[১] ’ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁর কাছে বানূ তামীম-এর কিছু লোক আসলো। তিনি (সা.) বললেন, হে বানূ তামীম! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। উত্তরে তারা বলল, আপনি শুভ সংবাদ তো শুনিয়েছেন, এবার আমাদেরকে কিছু দান করুন। পরক্ষণে তাঁর কাছে ইয়ামানের কিছু লোক আসলো। তিনি তাদেরকে বললেন, হে ইয়ামানবাসী! শুভ সংবাদ গ্রহণ কর। কেননা বানূ তামীম তা গ্রহণ করেনি। তারা উত্তর দিল, আমরা তা কবুল করলাম। অবশ্য আমরা দীনের বিধান সম্পর্কে কিছু অবহিত হওয়ার জন্য আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি। আমরা এ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে কিছু অবগত হওয়ার জন্য আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি। আমরা আপনাকে এ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে চাই, সর্বপ্রথম কি ছিল? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, আদিতে একমাত্র আল্লাহই ছিলেন এবং তার আগে কিছুই ছিল না। আর তার আরশ স্থাপিত ছিল পানির উপরে।
অতঃপর তিনি আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেন এবং লাওহে মাহফুযে প্রত্যেক জিনিসের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) বলেন, এ সময় এক লোক এসে আমাকে বলল, হে ’ইমরান! তুমি তোমার উষ্ট্রীর খোঁজ কর, তা তো পালিয়েছে। অতএব আমি তার খোঁজে চলে গেলাম। আল্লাহর শপথ! যদি উষ্ট্রীটি চলে যেত আর আমি তথা হতে উঠে না যেতাম, তাই আমার কাছে প্রিয় ছিল। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب بدءالخلق وَذِكْرِ الْأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ)
عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ: إِنِّي كُنْتُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَ قومٌ منْ بَني تميمٍ فَقَالَ: «اقْبَلُوا الْبُشْرَى يَا بَنِي تَمِيمٍ» قَالُوا: بَشَّرْتَنَا فَأَعْطِنَا فَدَخَلَ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ الْيَمَنِ فَقَالَ: «اقْبَلُوا الْبُشْرَى يَا أَهْلَ الْيَمَنِ إِذْ لَمْ يَقْبَلْهَا بَنُو تَمِيمٍ» . قَالُوا: قَبِلْنَا جِئْنَاكَ لِنَتَفَقَّهَ فِي الدِّينِ وَلِنَسْأَلَكَ عَنْ أَوَّلِ هَذَا الْأَمْرِ مَا كَانَ؟ قَالَ: «كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ قَبْلَهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كلَّ شيءٍ» ثُمَّ أَتَانِي رَجُلٌ فَقَالَ: يَا عِمْرَانُ أَدْرِكْ ناقتَكَ فقدْ ذهبتْ فانطلقتُ أطلبُها وايمُ اللَّهِ لَوَدِدْتُ أَنَّهَا قَدْ ذَهَبَتْ وَلَمْ أَقُمْ. رَوَاهُ البُخَارِيّ رواہ البخاری (7418) ۔ (صَحِيح)
ব্যাখ্যা: বানূ তামীম আরবের একটি বড় প্রসিদ্ধ গোত্র। তাদের একটি দল রাসূল (সা.) -এর কাছে এলে তিনি তাদেরকে সুসংবাদ গ্রহণের উপদেশ দেন। কিন্তু তারা এই সুসংবাদের প্রকৃত মর্ম বুঝে উঠতে পারেনি। তাই তারা বলে উঠে, সুসংবাদ তো দিলেন, এখন আমাদের দান করুন। তারা সুসংবাদ দ্বারা জাগতিক ও আর্থিক কোন দান বুঝেছে। তাই তারা বাহ্যিক দান চেয়েছে। এটা তাদের দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ এবং আখিরাত থেকে উদাসীন থাকার প্রমাণ বহন করে। প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক পাত্র তাই ছিটায় যা তার মাঝে থাকে। কুরআনে এই প্রবাদের মর্ম যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে- অর্থাৎ- “প্রত্যেকে তার নিজ নিজ পানি সংগ্রহের স্থান চিনে নিলো”- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২: ৬০)। আরেকটি আয়াতে বলেন- অর্থাৎ “প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত”- (সূরাহ্ আল মু'মিনূন ২৩: ৬০), (সূরাহ্ আবূ রূম ৩০: ৩২)। আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসের অর্থ হলো, তোমরা আমার নিকট হতে এমন জিনিস গ্রহণ করো যা গ্রহণ করলে জান্নাত লাভ করে আনন্দিত হবে। এই জিনিস হলো দীনের বুঝ ও তদনুযায়ী ‘আমাল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “সুসংবাদ তো দিলেন”; এতে বুঝা যায় তারা মুসলিম ছিল। তবে তারা দুনিয়া কামানোর আশা করেছে এবং আখিরাত কামানো থেকে উদাসীন রয়েছে। তবে নবী (সা.) তাদের ওপর রাগ এবং সুসংবাদ গ্রহণ করাকে অস্বীকৃতির কারণ হলো, রাসূল (সা.) তাদের জ্ঞানের অভাব এবং যোগ্যতার অভাব টের পেয়েছেন; কেননা তারা তাদের আশাকে অস্থায়ী দুনিয়ার সাথে জুড়ে দিয়েছে এবং দীন অর্জন করে আখিরাতের স্থায়ী বিনিময় গ্রহণ করা থেকে পিছু হটেছে।
কিরমানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাদের কথা “সুসংবাদ তো দিলেনই”; এর দ্বারা বুঝা যায়, তারা রাসূল (সা.) -এর কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে এমন নয়। বরং মোটামুটিভাবে তা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর সাথে তারা কিছু দুনিয়ার বস্তু চেয়েছে। তাই তাদের গ্রহণ করাকে ঢালাওভাবে নাকচ করা নয়। তারপরও রাসূল (সা.)-এর রাগ করার কারণ হলো, তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে কবুল করেনি। যার কারণে তারা মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন করার বেলায় গুরুত্ব দেয়নি। অথচ তাদের উচিত ছিল কালিমায়ে তাওহীদের তাৎপর্য, ইহকাল, পরকাল এবং তার ওয়াজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা এবং এগুলো ধারণ করা। (ফাতহুল বারী, অধ্যায়: তাওহীদ, হা. ৬৯৮২)
(اقْبَلُوا الْبُشْرَى يَا أَهْلَ الْيَمَنِ...) “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো হে ইয়ামানবাসী...।” বানূ তামীম-এর উত্তর রাসূল (সা.)-এর পছন্দ না হওয়াতে তিনি ইয়ামানবাসীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তারা উত্তরে বলল, আমরা গ্রহণ করলাম। আমরা তো এসেছি দীনের জ্ঞান অর্জনের জন্য এ বিষয়ের সূচনা সম্পর্কে আপনার কাছে জিজ্ঞাসার জন্য। অর্থাৎ তাদের আসার কারণ ছিল দুটি। [এক] দীনী জ্ঞান অর্জন, [দুই] পৃথিবীর সূচনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ। দীনী জ্ঞান অর্জনের প্রতি উৎসাহিতকারী আয়াত তাদের আগমনের কারণ হতে পারে। কেননা আল্লাহ তা'আলা বলেন
(فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّهُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَهُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ یَحۡذَرُوۡنَ) “তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে তারা দীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।” (সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯: ১২২)
অর্থাৎ এ আয়াত আমাদেরকে আপনার কাছে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। দীনী জ্ঞান অর্জনের বেলায় তাদের নিয়্যাত বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল ছিল। দুনিয়ার কোন লোভ তাদের মাঝে ছিল না। তাই তাদের জন্য সুসংবাদ, দীন কবুল, দীনের জ্ঞান, তদনুযায়ী আমাল ও লক্ষ্যে পৌছা সবই হয়েছে। আর প্রথম দল সুসংবাদ থেকে বঞ্চিত থাকার সাথে সাথে দুনিয়ার তুচ্ছ স্বার্থ অর্জন থেকেও বঞ্চিত থেকেছে। অতএব উচ্চ সাহস ও নিয়্যাতই মানুষকে উচ্চ মর্যাদায় পৌছায়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
তাদের আসার দ্বিতীয় কারণটি ছিল, পৃথিবীর সূচনা ও সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জানা। অর্থাৎ সূচনালগ্নে এই পৃথিবীর অবস্থা ও সৃষ্টির অবস্থা কী ছিল? রাসূল (সা.) এর উত্তরে বলেন, আল্লাহ তা'আলা ছিলেন এবং তার পূর্বে কিছুই ছিল না। অর্থাৎ অনাদি অনন্তকাল থেকে তিনি ছিলেন। তাঁর কোন সূচনা ও শেষ নেই। তিনি সর্বদা আছেন এবং সর্বদা থাকবেন। সৃষ্টি ও পরিবর্তনের গুণ তার মাঝে নেই। বরং এগুলো বান্দা ও সৃষ্টির গুণ। তার পূর্বে কিছু ছিল না। কেননা তিনি প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা এবং অস্তিত্বের ধারণকারী। অতএব কোন বস্তু তার পূর্বে বিদ্যমান থাকা সম্ভব নয়। মোটকথা, প্রত্যেক বস্তুর পূর্বে যিনি ছিলেন তিনি মহান আল্লাহ তা'আলা। তার পূর্বে না কিছু ছিল, আর না কোন কিছু থাকা সম্ভব। তিনি অনাদি তার শুরু নেই। তিনি সর্বশেষ তার সমাপ্তি নেই। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
কুরআনে এ মর্মটি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে
(هُوَ الۡاَوَّلُ وَ الۡاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الۡبَاطِنُ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ) “তিনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।” (সূরা আল হাদীদ ৫৭ : ৩)
(وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ) “তার ‘আরশ পানির উপর ছিল।” এটা হলো সৃষ্টির সূচনা। আল্লাহ তা'আলার পূর্বে কোন সৃষ্টি ছিল না। আবার তার কোন পূর্ব নেই। তিনি অনাদি অনন্ত। তবে তিনি সর্বপ্রথম সৃষ্টির সূচনা করেন ‘আরশ ও পানির দ্বারা। আসমান জমিন সৃষ্টির পূর্বেই এ দুইয়ের সৃষ্টি করেছেন। তবে এ দুয়ের মাঝে পানি আগে সৃষ্টি বলে ইঙ্গিত বহন করে। তবে সহীহ সনদে তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে- (إنَّ أَوَّلَمَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ لَهُ اكْتُبْ) “আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, লিখ।” (তিরমিযী- অধ্যায়: তাফসীর, সূরাহ্ কলমের তাফসীর অনুচ্ছেদ)
এ হাদীসে বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি কলম। উভয় হাদীসের সমন্বয়ে ‘উলামায়ে কিরাম বলেন, কলমের প্রথম সৃষ্টি তুলনামূলক। অর্থাৎ ‘আরশ ও পানির পর সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা এ হাদীসে কলম প্রথম সৃষ্টি তা বলা হয়নি। বরং প্রথম সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম তাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেটি ছিল, লিখ। আবূল আ'লা আল হামদানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রথম সৃষ্টি ‘আরশ নাকি কলম; এ ব্যাপারে ‘উলামাদের দুটি মত রয়েছে অধিকাংশের মতে ‘আরশ প্রথমে সৃষ্টি করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৬/২৮৯)
(لَوَدِدْتُ أَنَّهَا قَدْ ذَهَبَتْ وَلَمْ أَقُمْ) “আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল যদি একেবারে চলে যেত আর আমি উঠতাম না।”
উষ্ট্রির রশি ছুটে উষ্ট্রি চলে গেছে। তাকে পাওয়ার আশায় আমাকে রাসূল (সা.)-এর মাজলিস ছেড়ে আসতে হলো। এর চেয়ে যদি উষ্ট্রিটি একেবারে চলে যেত এবং পাওয়ার আশা থাকত না, সেটাই ভালো হত। কেননা পাওয়ার আশা না থাকলে উঠতাম না এবং ইয়ামানবাসীদের সাথে রাসূল (সা.) ও বাকী কথাগুলো শুনা থেকে বঞ্চিত থাকতাম না।
(بَشَّرْتَنَا فَأَعْطِنَا) তারা এ কথা বলার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তারা আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছে, তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়ামানবাসীদেরকে বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর যেহেতু বানূ তামীম গ্রহণ করল না।
(كَانَ اللَّهُ) আল্লাহ অনন্তকাল থেকেই ছিলেন এবং থাকবেন কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন ছাড়াই।
(وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ) এ কথাটি স্পষ্ট দলীল বহন করে যে, ‘আরশ এবং পানি আসমান জমিন সৃষ্টির পূর্বেই তিনি সৃষ্টি করেছেন।
ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, এখানে পানি দ্বারা সমুদ্রের পানি উদ্দেশ্য নয় বরং এটা ‘আরশের নিচের পানি, আল্লাহ ভালো জানেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)