পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১১-[১] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! আমার সাহচর্যে আমার সদাচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারী কে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ’’তোমার মা’’। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ’’তোমার মা’’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ’’তোমার মা’’। লোকটি আবারো জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ’’তোমার বাবা’’। অপর এক বর্ণনায় আছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ তোমার মা, অতঃপর তোমার মা, অতঃপর তোমার মা, অতঃপর তোমার বাবা, তারপর তোমার নিকট আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ أَحَقُّ بِحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قَالَ: «أُمَّكَ» . قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: «أُمَّكَ» . قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ «أُمَّكَ» . قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: «أَبُوكَ» . وَفِي رِوَايَةٍ قَالَ: «أُمَّكَ ثُمَّ أُمَّكَ ثُمَّ أُمَّكَ ثُمَّ أَبَاكَ ثمَّ أدناك أدناك» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ (جاء رَجُلٌ) প্রশ্নকারী সাহাবীর নাম সম্ভবত মু‘আবিয়াহ্ ইবনু হায়দাহ্। তিনি বাহয ইবনু হাকীম এর দাদা ছিলেন। ইমাম বুখারী তাঁর ‘‘আল আদাবুল মুফরাদ’’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, মু‘আবিয়াহ্ ইবনু হায়দাহ্ বলেন, قلت : يا رسول الله من أبر ؟ قال : أمك আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সদ্ব্যবহার পেতে কে অগ্রগণ্য? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার মা ....’’- (আল আদাবুল মুফরাদ হাঃ ৩)। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৭১)
(ثُمَّ أَدْنَاكَ أَدْنَاكَ) সর্বপ্রথম সদ্ব্যবহার পাওয়ার হকদার মা, তারপর পিতা, তারপর ছেলে-মেয়ে, তারপর দাদাগণ-নানাগণ, রক্তসম্পর্কীয় মাহরাম আত্মীয়গণ। যেমন : চাচা ও ফুফুগণ, মামা ও খালাগণ। এরপর পর্যায়ক্রমের নিকট আত্মীয়গণ। এরপর রক্তসম্পর্কীয় গায়রে মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ হালাল বা বৈধ) যেমন- চাচতো ভাই, চাচাতো বোন, মামাতো ভাই, মামাতো বোন ইত্যাদি। এরপর শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করতে হবে। এরপর খাদেম বা কর্মচারীদের সাথে স্তর অনুযায়ী। এরপর প্রতিবেশীদের সাথে। এর মধ্যে যার বাড়ীর কাছে সে বেশি হকদার, এভাবে পর্যায়ক্রমে দূরের। (শারহুন নাবাবী ১৬শ খন্ড, হাঃ ১-[২৫৪৮])
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১২-[২] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তার নাক ধুলোয় মলিন হোক, তার নাক ধূলোয় মলিন হোক, তার নাক ধূলোয় মলিন হোক (তথা অপদস্থ হোক)। তিনি জনৈক সাহাবী কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হলেন, হে আল্লাহর রসূল! কে সে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতার কোন একজনকে বা উভয়কে বার্ধক্য অবস্থায় পেল, অথচ (তাদের খিদমাত করে) সে জান্নাতে প্রবেশ করল না। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ» . قِيلَ: مَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «مَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ عِنْدَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا ثمَّ لم يدْخل الْجنَّة» . وَرَاه مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (رَغِمَ أَنْفُهٗ) অর্থাৎ তার নাক ধূলোয় মলিন হোন। এটা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সে ব্যক্তি অপদস্থ হোক। নিহায়াহ্ গ্রন্থে বলা হয়েছে, তাঁর নাক মাটিতে মিলিয়ে দিক। আলোচ্য হাদীসে মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান ধ্বংস হোক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সে নিতান্তই হতভাগা ও কপাল পোড়া। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৯ম খন্ড, হাঃ ৩৫৪৫)
(لَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ) পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার কারণে এবং তাদের অধিকার যথাযথ পালন না করার কারণে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এর অর্থ হলো পিতামাতার বৃদ্ধ বয়সে ও তাদের দুর্বল অবস্থায় তাদের প্রতি খরচ করা ও তাদের খিদমাতের মাধ্যমে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং কোন ব্যক্তি এই কাজে কমতি করলে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘সে জান্নাতে প্রবেশ করল না’; এর অর্থ হলো সে অপমানিত ও লজ্জিত হবেন এবং ধ্বংস হবে। যে ব্যক্তি ঐ সুযোগ পেল যা তাকে সফলতা ও জান্নাত দানে ধন্য করবে এরূপ সুযোগ যে কাজে লাগাতে পারল না। সে মহান আল্লাহর বাণীকে কাজে লাগাতে পারেনি। মহান আল্লাহ বলেন, وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا ‘‘...আর পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন বা তাদের উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে বিরক্তি বা অবজ্ঞাসূচক কথা বলো না...’’- (সূরাহ্ বানী ইসরাঈল ১৭ : ২৩)। তিনি আরো বলেন, وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا ‘‘...বল, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন পালন করেছেন’’- (সূরাহ্ বানী ইসরাঈল ১৭ : ২৪)। এ আয়াতগুলো যাবতীয় হারাম কথা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ করে এবং যাবতীয় ভালো কথা ও কাজ করার প্রতি আদেশ করে। দুনিয়াতে তাদের প্রতি সদয় হও। তাদের খিদমাত করতে ও মৃত্যুর পর তাদের জন্য জান্নাত লাভের দু‘আ করার জন্য নির্দেশ করে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৩-[৩] আসমা বিনতু আবূ বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মা আমার কাছে আসলেন। তিনি ছিলেন মুশরিকা। এ ঘটনা ঐ সময়ের, যখন কুরায়শদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হয়েছিল। আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার মা আমার কাছে এসেছেন, তিনি ইসলামের প্রতি অসন্তুষ্ট। সুতরাং আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করব? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, তার সাথে উত্তম আচরণ করো। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنهُ قَالَتْ: قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِي عَهْدِ قُرَيْشٍ فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّي قَدِمَتْ عَلَيَّ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُهَا؟ قَالَ: «نعم صِليها» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ আসমা (রাঃ)-এর মা আবূ বকর (রাঃ)-এর স্ত্রী মুশরিকা অবস্থায় মক্কা থেকে মদীনায় গিয়ে স্বীয় কন্যা আসমার গৃহে পৌঁছেন। তার আগমনের এ সময়টি ছিল কুরায়শদের সাথে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ এবং একে অপরের নিরাপত্তার সন্ধি চুক্তির মেয়াদকালে। এ সময়ও সে ইসলামের বিমুখ ও বীতশ্রদ্ধ ছিল। কিন্তু স্বামী ও সন্তানাদির বিরহ-বিদ্রোহের লাঞ্ছনাময় জীবনের দুর্বিসহ যন্ত্রণায় ছিল কাতর। আসমা (রাঃ) বলেন, এজন্য সে আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশাবাদী ছিল। সে কমপক্ষ এতটুক আশা করে এসেছিল যাতে আমি তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করি।
মুশরিকা মায়ের এ অবস্থা দেখে আসমা বিনতু আবূ বকর (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি কি আমার এই মায়ের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখব এবং তার সাথে সদাচরণ করব? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ! তুমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ। অর্থাৎ সে যা পেলে খুশী হয়, তুমি তাকে তা দাও। ইমাম ইবনু হাজার ‘আসকালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা মুশরিক নিকটতম আত্মীয়ের সাথেও সদাচরণ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৪-[৪] ’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ অমুকের বাপের সন্তানরা আমার বন্ধু নয়; বরং আমার বন্ধু আল্লাহ তা’আলা এবং পুণ্যবান মু’মিনগণ। তবে হ্যাঁ, তাদের সাথে আমার আত্মীয়তা আছে, আমি তাদের সিক্ততার সাথে সিক্ত করি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ آل فُلَانٍ لَيْسُوا لِي بِأَوْلِيَاءَ إِنَّمَا وَلِيِّيَ اللَّهُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنْ لَهُمْ رَحِمٌ أَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا. مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ لَيْسُوْا لِىْ بِأَوْلِيَاءَ এ কথাটির অর্থ হলো তারা আমার বন্ধুদের দলভুক্ত নয়। ইবনু ত্বীন (রহিমাহুল্লাহ) দাওয়ারদী থেকে বর্ণনা করেছেন, এ কথাটি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তারা যারা তাদের মধ্য থেকে ইসলাম গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ এখানে সম্পূর্ণ বলে আংশিককে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। খত্ত্বাবী বলেনঃ হাদীসের এ অংশে বন্ধুত্বের যে অংশটিকে নিষেধ করা হয়েছে সেটি হলো নিকটাত্মীয় এবং বিশেষ বন্ধুত্বের অংশ। এখানে দীনের বন্ধুত্বকে নিষেধ করা হয়নি। উপরোক্ত দুই মতের প্রথম মতকে ইবনু ত্বীন প্রাধান্য দিয়েছে।
إِنَّمَا وَلِيِّىَ اللهُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যারা সৎ তারাই নবীর বন্ধু যদিও বংশের দিক দিয়ে নবীর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক না থাকে। তারা নবীর কোন বন্ধু নয় যারা সৎ নয় যদিও তারা বংশের দিক দিয়ে নবীর নিকটাত্মীয়। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ হাদীস থেকে বুঝা যায় বন্ধুত্বের মাপকাঠি কেবল দীন। সুতরাং মুসলিমই আমাদের বন্ধু কোন কাফির নয়, যদিও সে নিকটতম আত্মীয় হয় তথাপি সে বন্ধু হতে পারে না কারণ সে কাফির। ইবনু বাত্ত্বল বলেনঃ এ হাদীসে মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে আর কাফিরদের বন্ধুত্ব ছিন্ন করতে বলা হয়েছে যদিও সে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় হয়ে থাকে, কারণ তারা কাফির। তাই বংশসূত্র দাবী করে নিকটাত্মীয়রা যদি একই দীনের অন্তর্ভুক্ত না হয় তাহলে তারা পরস্পর পরস্পরের উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত হবে না এবং কোন বন্ধুত্ব অটুট থাকবে না। ইবনু বাত্ত্বল আরো বলেনঃ হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, আত্মীয়তার যে সম্পর্ক ছিন্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা হলো শার‘ঈ আত্মীয়তার সম্পর্ক। অপরদিকে দীনের খাতিরে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তাই অমুসলিম আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে অবৈধ হবে না এবং সে গুনাহগার হবে না। আত্মীয় যদি অমুসলিম হয়ে থাকে তার সাথে দ্বীনের কোন সম্পর্ক না রেখে দুনিয়াবী সম্পর্ক ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া বৈধ।
হাফিয ইবনু হাজার ‘আস্ক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ হাদীসের বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝা যায় যারা দীনী কর্মকাণ্ড-র ব্যাপারে সৎ নয় তাদের সাথেও বন্ধুত্ব করা যাবে না। কারণ হলো মু’মিন হওয়ায় পাশাপাশি সৎ ‘আমলকারী হতে হবে। কাফির আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার বিষয়টি শর্তযুক্ত, যদি এমন ধারণা হয় যে সে আর কুফরী থেকে ফিরে আসবে না ঠিক কিন্তু তার ঔরসজাত সন্তানের মধ্য থেকে কেউ না কেউ মুসলিম হতে পারে, তাহলে তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা যাবে।
তাফসীর বিশারদগণ صَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ তথা সৎ মু’মিনের ব্যাখ্যায় মতবিরোধ করেছেন।
কেউ বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নবীগণ; কেউ বলেছেন, হলো সাহাবীগণ; কেউ বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য মু’মিনগণ; কেউ কেউ বলেন, আবূ বকর, ‘উমার ও ‘উসমান ; কেউ বলেছেন শুধু আবূ বকর এবং ‘উমার । কেউ বলেছেন, এর দ্বারা শুধুমাত্র আবূ বকরই উদ্দেশ্য। কেউ বলেছেন, এর দ্বারা ‘উমার । কেউ ‘আলী -এর কথা বলেছেন। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৯০)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৫-[৫] মুগীরাহ্ ইবনু শু’বাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য মায়ের অবাধ্যতা, কন্যাদের জীবন্ত প্রোথিতকরণ, কৃপণতা ও ভিক্ষাবৃত্তি হারাম করেছেন। আর তোমাদের জন্য বৃথা তর্কবিতর্ক, অধিক সওয়াল করা ও সম্পদ বিনষ্ট অপছন্দ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَن الْمُغِيرَةِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوقَ الْأُمَّهَاتِ وَوَأْدَ الْبَنَاتِ وَمَنَعَ وَهَاتِ. وَكَرِهَ لَكُمْ قِيلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ (وَوَأْدَ الْبَنَاتِ) এর অর্থ হচ্ছে কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত দাফন করা। জাহিলী যুগের মানুষ নারীদের প্রতি অবজ্ঞাবশতঃ এ কাজ করত। সর্বপ্রথম যে এ কাজটি করে তার নাম কায়স ইবনু ‘আসিম আত্ তামিমী। ঘটনাটি হলো : কায়স ইবনু ‘আসিম-এর কোন শত্রু একদিন তার ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তার কন্যাকে বন্দী করে নিজের স্ত্রী বানিয়েছেন। অতঃপর কোন এক সময় তাদের মাঝে সন্ধি স্থাপিত হয় এবং শত্রুটি তার মেয়েকে স্বাধীনতা দেয়, মেয়েটি তার স্বামীর কাছে থাকতেই পছন্দ করে। এ কারণে কায়স শপথ করে যে, এর পরবর্তীতে যত মেয়ে সন্তান তার জন্ম নিবে সবাইকে সে মাটিতে জিবন্ত পুঁতে ফেলবে। ‘আরব সমাজ তার এ নীতি অনুসরণ করে কন্যা সন্তানদের জীবিত মাটিতে পুঁতে ফেলা শুরু করে দেয়। দ্বিতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা যে কোন সন্তানকেই (ছেলে হোক মেয়ে হোক) হত্যা করত। এর একটি কারণ ছিল যে সন্তান তার সাথে খেলে তার সম্পদ কমে যাবে। তাদের এ ঘৃণ্য স্বভাবকে আল্লাহ রববুল ‘আলামীন কুরআনে কয়েকটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন।
পরবর্তীতে কায়স ইবনু ‘আসিম আত্ তামিমী ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীর মর্যাদা লাভ করেন। উল্লেখিত হাদীসে কন্যা সন্তান বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো সাধারণত কন্যা সন্তানদেরকেই জীবিত কবর দেয়া হত।
(كَثْرَةُ السُّؤَالِ) হাদীসের এ অংশটুকুর ব্যাখ্যায় যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। এটা কি কোন মাল সম্পদ চাওয়া নাকি কোন সমস্যার সমাধান চাওয়া, নাকি এর চেয়ে ব্যাপক কোন বিষয়? এক্ষেত্রে সঠিক কথা হলো বিষয়টিকে ব্যাপক রাখাই শ্রেয়। কেউ কেউ বলেছেন, এ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মানুষের খুঁটিনাটি বিষয়ে বেশি বেশি জিজ্ঞেস করা, অথবা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা। অসম্ভব, অহেতুক বা বিরল কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা অপছন্দনীয়। আল্লাহ রববুল ‘আলামীন বলেনঃ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না যা প্রকাশ হলে তোমাদের ক্ষতি হবে।’’ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সর্বাধিক পাপিষ্ট যে এমন কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল যে বিষয়টি হারাম ছিল না, কিন্তু তার প্রশ্ন করার কারণে হারাম করে দেয়া হয়েছে।
ভিক্ষা করা নিন্দনীয় এবং ভিক্ষা থেকে বিরত থাকা প্রশংসনীয় কাজ। আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন তাদের প্রসংশা করেছেন যারা দরিদ্র হওয়া স্বত্ত্বেও মানুষের কাছে হাত পাতে না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে বান্দা ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ায় কিয়ামতের মাঠে সে এমন অবস্থায় উঠবে যে, তার মুখে কোন গোশত থাকবে না। সহীহ মুসলিমে এসেছে, তিন শ্রেণীর মানুষ ছাড়া কারও জন্য ভিক্ষা করা বৈধ নয়।
১। প্রচণ্ড দারিদ্রে্য জর্জরিত ব্যক্তি; ২। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যে ঋণ প্রতিশোধ করার সাধ্য রাখে না; ৩। যার সম্পদ দুর্ভিক্ষে নষ্ট হয়ে গেছে।
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘উলামায়ে কিরাম এক মত যে, বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষা করা নিষেধ। আমাদের সাথীরা মতবিরোধ করেছেন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ভিক্ষাবৃত্তির বিষয়ে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা সম্পূর্ণ হারাম। কেউ বলেছেন, তিনটি শর্তে এটা অপছন্দনীয়তার সাথে জায়িয। শর্ত তিনটি হলো : ১) চাইতে গিয়ে পিড়াপিড়ি করবে না, ২) চাইতে গিয়ে নিজেকে অপদস্থ করবে না, ৩) দানকারীকে কষ্ট দিবে না। উল্লেখিত তিন শর্তের কোন একটি শর্ত যদি না পাওয়া যায় তাহলে ভিক্ষা করা অবৈধ হারাম হবে।
ফাকিহানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই তাদের কথায়, যারা বলে, মানুষের কাছে চাওয়া কোন অবস্থাতেই বৈধ নয়; অথচ মানুষের কাছে চাওয়ার ব্যাপরটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে প্রমাণিত। পূর্ববর্তী সালাফে সলিহীনদের নিকট থেকেও প্রমাণিত, তাই ইসলামী শারী‘আহ্ এটাকে অপছন্দনীয় বলেনি।
(إِضَاعَةَ الْمَالِ) ধন-সম্পদ নষ্ট করার ব্যাপারে ইসলাম কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কেননা সম্পত্তি হলো মানব কল্যাণের জন্য, তাই তা নষ্ট করা মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড-র শামিল। তবে আখিরাতের সাওয়াবের আশায় জনকল্যাণমূলক কাজে তা অত্যধিক ব্যয় করা খারাপ কিছু নয়। অধিক ব্যয়ের তিনটি দিক হতে পারে। ১) অন্যায় পথে খরচ করা, এটা বিনা সন্দেহে নিষিদ্ধ। ২) ন্যায়ের পথে খরচ করা, যার প্রতি শারী‘আত উৎসাহিত করেছে। ৩) শারী‘আত কর্তৃক বৈধ বিষয়ে খরচ করা। যেমন একটু চাকচিক্যময় জীবন যাপন করা। ইমাম সুবকী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ সম্পদ নষ্টের ব্যাপারে মূলনীতি হলো তা খরচের ব্যাপারে দীনী ও পার্থিব কোন উদ্দেশ্য না থাকা, সম্পদ খরচের ক্ষেত্রে দীনী ও পার্থিব কোন উদ্দেশ্য না থাকলে তা অকাট্য হারাম হবে। ইমাম ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ উত্তম চরিত্রের মূলনীতি হিসেবে হাদীসটি অনেকগুলো ভালো স্বভাবকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৭৫)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৬-[৬] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিজের মাতা-পিতাকে গালি দেয়া কাবীরাহ্ গুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম। সাহাবায়ি কিরাম জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! মানুষ কি তার পিতা-মাতাকে গালি দেয়? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, সে কোন ব্যক্তির বাবা ও মাকে গালি দিল, সেই ব্যক্তিও তার বাবা ও মাকে গালি দিল। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مِنَ الْكَبَائِرِ شَتْمُ الرَّجُلِ وَالِدَيْهِ» . قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَهَلْ يَشْتُمُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ؟ قَالَ: «نَعَمْ يَسُبُّ أَبَا الرَّجُلِ فَيَسُبُّ أَبَاهُ ويسبُّ أمه فيسب أمه» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসে পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার একটি দিক নিয়ে কথা বলা হয়েছে। মনে রাখার বিষয় হলো পিতা মাতাকে গালি দেয়ার কারণ সৃষ্টি করাই যদি সবচেয়ে বড় গুনাহ হয়ে থাকে তা হলো গালি দেয়া আরও বেশি বড় গুনাহ। ‘আদাবুল মুফরাদ’ নামক কিতাবে ‘উরওয়াহ্ ইবনু ইয়াস তিনি ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন। কোন ব্যক্তি তার পিতাকে গালি দিবে এটা কাবীরাহ্ গুনাহের অন্তর্গত। ইমাম মুসলিম ইয়াযীদ ইবনু আল-হাদ এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, পিতামাকে গালি দেয়া কাবীরাহ্ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
(قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ وَهَلْ يَشْتُمُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ؟) হাদীসের এ অংশটিতে পিতা-মাতাকে গালি দেয়ার বিষয়টি সাহাবীদের নিকট আশ্চর্যজনক ছিল। কিন্তু সুস্থ বিবেক এটা মানতে নারাজ, তাই তারা প্রশ্ন করেছিল- মানুষ কি তার পিতামাতাকে গালি দেয়? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি পরিষ্কার করে বর্ণনা করেছেন যে, গালি যদিও দেয় না গালির কারণ সৃষ্টি করতে পারে। ইবনু বাত্ত্বল বলেনঃ এ হাদীসটি পাপের মাধ্যমকে বন্ধ করার ক্ষেত্রে মূলনীতি হিসেবে গৃহীত। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৭৩)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৭-[৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষের সর্বোত্তম অনুগ্রহের কাজ হলো, পিতার মৃত্যুর পর পিতার বন্ধুদের সাথে সদাচরণ করা। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ مِنْ أَبَرِّ الْبِرِّ صِلَةَ الرَّجُلِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ بَعْدَ أَن يولي» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের আর একটি উত্তম পন্থা হলো তারা মৃত্যুর পর তাদের প্রিয় মানুষদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এ হাদীস পিতা-মাতার মরণের পর তাদের আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয় মানুষদের প্রতি সদাচরণকে সর্বোত্তম নেকীর কাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আর এসব লোকের প্রতি সদাচরণের কারণ হলো তারা পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব বা প্রিয় মানুষ। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে এমন সব আত্মীয়কে বুঝায় যাদের মাঝে বংশীয় সম্পর্ক বিদ্যমান, চাই তারা একে অপরের ওয়ারিস হোক বা না হোক। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯০৩)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৮-[৮] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নিজ জীবিকার প্রশস্ততা ও মরণে বিলম্ব কামনা করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ وَيُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَره فَليصل رَحمَه» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ (مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُبْسَطَ لَهٗ فِي رِزْقِه) অন্য বর্ণনায় এসেছে, إن صلة الرحم محبة في الأهل، مثراة في المال، منسأة في الأثر নিশ্চয় আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে রয়েছে পরিবারের ভালোবাসা। সম্পদের বারাকাত এবং হায়াতে বারাকাত। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহিমাহুল্লাহ) ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে মারফূ‘ সনদে বর্ণনা করেছেন :
صلة الرحم وحسن الجوار وحسن الخلق يعمران الديار ويزيدان في الإعمار আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার, উত্তম চরিত্র, সংসার জীবনকে আনন্দঘন করে তোলে এবং জীবনে বারাকাত বয়ে আনে। ‘আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ ‘‘যাওয়ায়িদুল মুসনাদ’’ নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন। ويدفع عنه ميتة السوء মৃতকালীন খারাপ অবস্থা তার থেকে দূর করা হয়। অর্থাৎ যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে তাদের ভালো মৃত্যু প্রদান করা হবে। ইমাম আবী ইয়া‘লা আনাস থেকে মারফূ‘ সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, হাদীসটি হলো্র
إن الصدقة وصلة الرحم يزيد الله بهما في العمر، ويدفع بهما ميتة السوء অর্থাৎ দান খয়রাত করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা- এ দু’টি কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তার হায়াত বৃদ্ধি করে দেয়, অর্থাৎ জীবনে বারাকাত দান করেন। আর খারাপ মৃত্যু দূর করে দেন, অর্থাৎ ভালো মৃত্যু দেন।
ইবনু ত্বীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘‘হায়াত বৃদ্ধি করে দেয়া হয়’’ কথাটির বাহ্যিক দিক কুরআনে কারীমের আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয়, কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ
فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ অর্থাৎ ‘‘...কারো নির্ধারিত সময় এসে গেলে সে সময়েই তার মৃত্যু হবে এর একটুও আগপিছ হবে না।’’ (সূরাহ্ আল আ‘রাফ ৭ : ৩৪)
আর হাদীসে বলা হলো, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে হায়াত বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের দু’টি পদ্ধতি হতে পারে। (১) বয়স বৃদ্ধির অর্থ সময় বৃদ্ধি নয় বরং বয়সে বারাকাত দান করা, বেশী বেশী সৎ ‘আমল করার তাওফীক দেয়া এবং জীবনকে আখিরাতে কল্যাণ লাভ হয় এমন পথে পরিচালনা করা। আর সময়ের অপচয় থেকে হিফাযাত করা। যেমন- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস থেকে প্রমাণ হয়, এ উম্মাতের বয়স পূর্বের উম্মাতদের চেয়ে কম, তবে এ উম্মাতের জীবনে বারাকাত দেয়া হয়েছে। যেমন- লায়লাতুল কদর, যা এক হাজার রাত্রির চেয়ে উত্তম। মোটকথা হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে এর কারণে আল্লাহ ভালো কাজ করার তাওফীক দিবেন আর অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফীক দিবেন। মৃত্যুর পরেও পৃথিবীতে তার ভালো গুনাগুণের আলোচনা অব্যাহত থাকবে, মনে হবে যেন সে মরেনি। ২) দ্বিতীয়টি হলো আসলেই বয়স বৃদ্ধি করা হয়, এটা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ। মালাককে আল্লাহ এভাবে আদেশ দেন যে, অমুক ব্যক্তি যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে তার হায়াত ১০০ বছর আর ছিন্ন করলে ৬০ বছর করে দাও (কিন্তু এ কম বেশীর জ্ঞান কোন সৃষ্টির কাছেই নেই)। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৮৫)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯১৯-[৯] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা সকল মাখলূক সৃষ্টি করলেন। আর যখন তা থেকে অবসর হলেন, তখন রহিম তথা ’’আত্মীয়তা’’ উঠে দাঁড়াল এবং আল্লাহ রহমানুর্ রহীম-এর কোমর ধরল। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ থামো, কি চাও বলো? ’’আত্মীয়তা’’ জিজ্ঞেস করল, এ স্থান তার, যে তোমার কাছে আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ থেকে রেহাই চায়। আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ তুমি কি এ কথায় সম্মত আছ, যে ব্যক্তি তোমাকে বহাল ও সমুন্নত রাখবে, তার সাথে আমিও সম্পর্ক বহাল রাখব; আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব? রহিম তথা আত্মীয়তা উত্তর দিল, হ্যাঁ, রাযি আছি, হে আমার প্রভু! আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ তাহলে তোমার সাথে আমার এ ওয়া’দাই রইল। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خُلِقَ اللَّهُ الْخَلْقَ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَامَتِ الرَّحِمُ فَأَخَذَتْ بِحَقْوَيِ الرَّحْمَنِ فَقَالَ: مَهْ؟ قَالَتْ: هَذَا مقَام العائذ بك من القطيعةِ. قَالَ: أَلَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَا رَبِّ قَالَ: فَذَاك . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ ইবনু আবূ জামরাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এখানে সৃষ্টি দ্বারা সকল মানবকে উদ্দেশ্য হতে পারে। কিংবা শুধুমাত্র মুকাল্লাফিন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত বান্দাগণ উদ্দেশ্য হতে পারে। উক্ত হাদীসের কথাটি আকাশ জমিন সৃষ্টি করার পরও হতে পারে অথবা আকাশ জমিন সৃষ্টির বিষয়টি লাওহে মাহফূযে সংরক্ষেত হওয়ার পরও হতে পারে, অথবা বানী আদামের সকল রূহ সৃষ্টির পরও হতে পারে। হাদীসে বলা হয়েছে ‘‘রহিম তথা আত্মীয়তা বলবে’’- এ কথার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনু আবী জামরাহ্ বলেনঃ সম্ভাবনা আছে রহিম অবস্থা অনুযায়ী কথা বলেছিল, অথবা জবান দ্বারাই কথা বলেছিল। এখানে প্রশ্ন হলো জবান দিয়ে যদি রহিম কথাই বলে তাহলে রহিম-এর রূপ বর্তমানে যে রকম আছে সে রকমই ছিল নাকি আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন কথা বলার সময় তাকে জবান এবং বিবেক দিয়েছিলেন? এর উত্তরে সহীহ কথা হলো যে রকম আছে সে রকমই ছিল কিন্তু আল্লাহ তাকে বলার শক্তি দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, একজন ফেরেশতাই রহিম-এর জবানে কথা বলেছিল।
(أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ) হাদীসের এ অংশটিকে বলা হয়েছে আল্লাহ রহিম তথা আত্মীয়তা-কে বললেন, ‘‘তোমার সম্পর্ক যে বজায় রাখবে আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব, যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’’ ইবনু আবী জামরাহ্ বলেনঃ এখানে সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইহসানের ইঙ্গিত বহন করছে তাদের জন্য যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে। অনুরূপ সম্পর্ক ছিন্ন অর্থ ইহসান থেকে মাহরুম করে দেয়া। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৮৭)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২০-[১০] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ’’রহিম’’ (আত্মীয়তা) শব্দটি আল্লাহ তা’আলার গুণবাচক নাম ’’রহমান’’ থেকে উদ্ভূত। আল্লাহ তা’আলা ’’রহম’’ (আত্মীয়তা)-কে বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তোমাকে সংযোজন করে, আমি তার সাথে সংযোজিত হবো; আর যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (বুখারী)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْهُ
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الرَّحِمُ شِجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ. فَقَالَ اللَّهُ: مَنْ وَصَلَكِ وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَكِ قَطَعْتُهُ . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যাঃ (شِجْنَةٌ) শব্দের অর্থ বিভিন্ন গাছের শিকড়, যা একটি আরেকটির মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। বলা হয়ে থাকে الحديث ذو شجون অর্থাৎ এমন কথা যার এক বাক্য অন্য বাক্যের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। হাদীসে উল্লেখিত শব্দ (مِنَ الرَّحْمٰنِ) অর্থাৎ رحم এর উৎপত্তি মহান আল্লাহর الرَّحْمٰنِ নাম থেকেই। বস্তুতঃ এ ‘রহিম’ হলো আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের দয়ার একটি অংশ, তাই যারা রহিম তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে তারা আল্লাহর দয়া লাভে ধন্য হবে। আর যারা রহিম তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে তারা আল্লাহর রহম বা দয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
ইমাম কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আত্মীয়তার যে সম্পর্কের কথা বজায় রাখতে বলা হয়েছে তা মোটামোটি দু’ শ্রেণীর- ১। عامة তথা ব্যাপক। ২। خاصة বিশেষ কোন সম্পর্ক।
عامة তথা ব্যাপক আত্মীয়তার সম্পর্ক হলো দীনের দিক দিয়ে সকল মুসলিম একে অপরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, একে অন্যের প্রতি ইনসাফ করবে, একে অন্যের আবশ্যিক হক ও প্রয়োজনীয় হক আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। অপরদিকে خاصة তথা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার অর্থ হলো আত্মীয়-স্বজনদের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা, তাদের খোঁজ-খবর নেয়া, ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখা।
ইবনু আবূ জামরাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার কয়েকটি মাধ্যম হতে পারে, যেমন- একে অন্যের কল্যাণে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে, বিপদে সাহায্য করার মাধ্যমে, তার অকল্যাণ দূর করার মাধ্যমে, তার সাথে হাসোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে সাক্ষাতের মাধ্যমে এবং তার জন্য দু‘আ করার মাধ্যমে।
(ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৮৮)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২১-[১১] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ’’রহিম’’ তথা আত্মীয়তা আল্লাহ তা’আলার ’আরশের সাথে ঝুলন্ত আছে এবং বলছে, যে ব্যক্তি আমাকে সংযোজন করবে তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখবে, আল্লাহ তা’আলা তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবেন এবং যে ব্যক্তি আমাকে ছিন্ন করবে আল্লাহ তা’আলা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الرَّحِمُ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تَقُولُ: مَنْ وَصَلَنِي وَصَلَهُ اللَّهُ وَمَنْ قَطَعَنِي قَطَعَهُ الله . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ রহিম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক কিয়ামতের দিন আল্লাহ রহমানের ‘আরশ চেপে ধরে বলবে যে, আমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবেন, আর যে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করবে আল্লাহ তার সম্পর্ক ছিন্ন করবেন।
পূর্বে ৪৯২০ নং হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ রহিম তথা আত্মীয়তা-কে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘‘যে তোমার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবে আমি তার সাথে (আমার রহমাতের) সম্পর্ক রক্ষা করব। যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমি তার সাথে (আমার রহমাতের) সম্পর্ক ছিন্ন করব।’’
‘রহিম’ এ কথা শুনে উৎসাহিত এবং উদ্বৃদ্ধ হয়েই আল্লাহর ‘আরশ ধারণ করে বলেবেন, ‘যে আমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবেন....।’
‘রহিম’-এর এ কথাটি দু‘আ অর্থেও হতে পারে, অর্থাৎ হে আল্লাহ! যে আমার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবে তুমি তার সাথে (তোমার রহমাতের) সম্পর্ক রক্ষা কর।
আল্লাহর সম্পর্ক রক্ষার অর্থ যেমন তার রহমত দ্বারা আবৃত্ত করে নেয়া, ঠিক তেমনি তার প্রতি উত্তম সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এমনকি তার গুনাহখাতা ক্ষমা করা।
পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারীর সাথে আল্লাহর সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ হলো তাকে আল্লাহর খাস রহমত থেকে দূরে রাখা, তার প্রতি দয়াপ্রদর্শন না করা, তাকে সাহায্য না করা, এমনকি ক্ষমা না করা। আল্লাহ তা‘আলার বান্দার সাথে সম্পর্ক রক্ষার আরেক অর্থ হলো তার দিকে এগিয়ে আসা এবং তাকে কবুল বা গ্রহণ করা। আর সম্পর্ক ছিন্নের অর্থ হলো তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এবং তার প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া।
ইমাম ইবনু হাজার ‘আসকালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘রহিম’ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক যা রক্ষা করা ওয়াজিব, তার সীমা নিয়ে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
কেউ কেউ বলেন, রহিম-এর সম্পর্ক তাদের মধ্যে বিদ্যমান যাদের দু’জনের মধ্যে যে কোন একজনকে পুরুষ ধরলে তাদের একে অপরের সাথে বিবাহ হারাম হয়ে যায়। এই সূত্রের ভিত্তিতে চাচার এবং মামার সন্তানেরা রহিম বা আত্মীয় সম্পর্ক সীমার আওতাভুক্ত নয়। তবে কোন নারী তার চাচা এবং মামাকে বিবাহ করতে পারবে না, কিন্তু এদের সন্তানদের সাথে বিবাহ বৈধ।
কেউ কেউ বলেছেন, রহিম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক মীরাসের ক্ষেত্রে যারা যবীলে আরহাম (মায়ের আত্মীয়তার সম্পর্কীয়) তাদের বেলায় প্রযোজ্য, চাই সে মুহরিম হোক, চাই গাইরি মুহরিম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২২-[১২] জুবায়র ইবনু মুত্ব’ইম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ» . مُتَّفِقٌ عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অপরদিকে আবূ মূসা আল আশ্‘আরী (রাঃ) কর্তৃক মারফূ‘ সনদে আছে, لا يدخل الجنة مدمن خمر، ولا مصدق بسحر، ولا قاطع رحم অর্থাৎ মদখোর, যাদু সত্যায়নকারী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
আল আদাবুল মুফরাদে আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে মারফূ‘ হাদীস এসেছে,
إن أعمال بني آدم تعرض كل عشية خميس ليلة جمعة، فلا يقبل عمل قاطع رحم বানী আদামের ‘আমলসমূহ প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করা হয় সবার ‘আমলে কবুল করা হয় শুধু قاطع رحم তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যতীত। ইবনু আবী আওফা (রাঃ) থেকে আর একটি হাদীস এসেছে মারফূ‘ সনদে।
إن الرحمة لا تنزل على قوم فيهم قاطع الرحم অর্থাৎ যে সমাজে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী বিদ্যমান সে সমাজের ওপর রহমত অবতীর্ণ হয় না।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) অত্র হাদীসের বিশ্লেষণে বলেছেন, এখানে ‘রহমত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বৃষ্টি অর্থাৎ যে সমাজে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী থাকবে ঐ সমাজে আল্লাহর রহমত তথা বৃষ্টি অবতীর্ণ হবে না। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৮)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৩-[১৩] ইবনু ’আমর হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী সে নয়, যার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা হচ্ছে; বরং আত্মীয়তা রক্ষাকারী সে, যার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে, আর সে সেই সম্পর্ককে যোজন করে আত্মীয়তার বন্ধন বহাল রেখেছে। (বুখারী)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنِ
ابْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «لَيْسَ الواصِلُ بالمكافىء
وَلَكِنَّ الْوَاصِلَ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যাঃ ভঙ্গুর এবং ক্ষয়িষ্ণু আত্মীয় সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে হাদীসটি চরম গুরুত্বারোপ করেছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন লোকের আত্মীয় যদি তার প্রতি সম্পর্ক বজায় রাখে বিনিময় স্বরূপ সেও যদি সম্পর্ক বজায় রাখে এর নাম সিলাহ রাহেমী তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল নয়, বরং কেউ আত্মীয় সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা বা বজায় রাখতে চেষ্টা করার নামই হলো সিলাহ রহিমী বা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখা।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষকারীর তিনটি স্তর হতে পারে-
১) পূর্ণ সম্পর্ককারী তিনি; যিনি বেশি দেন, নেন কম।
২) বিনিময় প্রদানকারী তিনি, যিনি যা নেন তার চেয়ে বেশি দেন না।
৩) সম্পর্ক ছিন্নকারী তিনি, যিনি নেনও না, দেনও না।
সম্পর্ক রাখা না রাখার বিষয়টি দু’ পক্ষর মধ্যে হয়ে থাকে, সম্পর্ক ছিন্ন বিষয়টিও দু’ পক্ষর মধ্যে হয়ে থাকে। যিনি সম্পর্ক বজায় রাখা শুরু করে তার নাম ওয়াসিল বা সম্পর্ক স্থাপনকারী, যদি অপর কেউ তার বিনিময় দেয় তাকে বলা হয় বিনিময় প্রদানকারী। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৫৯৯১)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৪-[১৪] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! আমার এমন কিছু আত্মীয় আছে, আমি তাদের সাথে সদাচরণ করি; কিন্তু তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করি, তারা আমার ক্ষতিসাধন করে। আমি তাদের প্রতি ধৈর্য ও ক্ষমা প্রদর্শন করি অথচ তারা আমার সাথে বর্বরতা প্রদর্শন করে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি যেরূপ বলছ, যদি তুমি সেরূপ আচরণই করে থাকো, তবে তুমি যেন তাদের প্রতি গরম ছাই নিক্ষেপ করছ। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি এ গুণের উপর বহাল থাকবে, আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার সাথে একজন সাহায্যকারী থাকবেন, তিনি তাদের ক্ষতিকে প্রতিরোধ করবেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْبِرِّ وَالصِّلَةِ
وَعَنْ
أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لي قَرَابةَ أصلهم ويقطعوني وَأحسن إِلَيْهِم ويسيؤون إِلَيّ وأحلم عَلَيْهِم وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ. فَقَالَ: «لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসে বলা হয়েছে, এক সাহাবীর প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয়ের অসৎ ব্যবহারের কথা। তিনি তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখেন, সৎ ব্যবহার করেন কিন্তু তারা তার এ সৎ ব্যবহারের পরও তার সাথে অসৎ আচরণ করে। তার ওপর জুলুম নির্যাতন করে। মূর্খ আচরণ করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি এত ভালো ও উত্তম আচরণ করার পরও তারা তোমার সাথে অসদাচরণ করছে বিষয়টি যেন এমন যে, তুমি তাদের চেহারায় ছাই নিক্ষেপ করছো। আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য সাহায্যকারী মালাক (ফেরেশতা) থাকবেন। যিনি তোমাকে তাদের বিপরীতে সাহায্য করবেন। যতদিন তুমি তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করে যাবে।
‘আল্লামা তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ তাদের প্রতি তোমার ইহসানকে যেহেতু তারা অনিষ্ট দ্বারা মোকাবিলা করছে এটা তাদের অনেক ক্ষতি ডেকে আনবে, এমনকি তুমি যেন তাদেরকে আগুন খাওয়াচ্ছ, বিষয়টি এত ভয়াবহ।
কেউ কেউ বলেছেন, এমন সব লোক যারা ইহসানের শুকরিয়া আদায় করে না উপরন্তু আরো কষ্ট দেয়, এদের প্রতি ইহসান চালিয়ে যাওয়া অর্থ হলো তাদেরকে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার দিকে ঠেলে দেয়া। কেউ কেউ বলেন, তাদের চেহারা গরম বালুর রূপ ধারণ করবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)