পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৫৯-[১] আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন (১০ যিলহাজ্জ) আমাদের উদ্দেশে এক বক্তৃতা দিলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, বছর ঘুরে এসেছে সে তারিখের পুনরাবৃত্তি অনুযায়ী, যে তারিখে আল্লাহ তা’আলা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। বছর বারো মাসে, তন্মধ্যে চার মাস হারাম বা সম্মানিত মাস। তিন মাস পরপর এক সাথেই তথা যিলকদ, যিলহজ্জ ও মুহাররম। চতুর্থ মাস মুযার গোত্রের রজব মাস। যে মাস জমাদিউল উখরা ও শা’বানের মাঝখানে। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ এটা কোন্ মাস? আমরা উত্তর দিলাম- আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলই এ ব্যাপারে বেশি ভালো জানেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হয়ত এ মাসের অন্য কোন নাম বলবেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ মাস কি যিলহজ্জ মাস নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ, এ মাস যিলহজ্জ মাস।
এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটি কোন্ শহর? আমরা বললাম, আল্লাহর রসূলই ভালো জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। এতে আমরা ভাবলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মনে হয় এ শহরের অন্য কোন নাম বলবেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটি কি (মক্কা) শহর নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ, এটি মক্কা শহর, হে আল্লাহর রসূল! এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা কোন্ দিন? উত্তরে আমরা বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলই তা ভালো জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। এতে আমরা ভাবলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মনে হয় এর অন্য কোন নাম বলবেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা কি কুরবানীর দিন নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ, কুরবানীর দিন।
তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’তোমাদের জীবন, সম্পদ ও সম্মান তোমাদের জন্য পবিত্র; যেমন তোমাদের এ মাস, এ শহর, এ দিন পবিত্র। তোমরা খুব তাড়াতাড়ি আল্লাহর কাছে পৌঁছবে, আর তিনি তোমাদেরকে কর্মকান্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! আমার পর তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে এক অন্যের প্রাণনাশ করো না। তোমরা বলো, আমি কি তোমাদের নিকট (আল্লাহর নির্দেশ) পৌঁছিয়ে দেইনি? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো। (এরপর বললেন) প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে এ কথা পৌঁছিয়ে দেয়। কেননা এমন অনেক ব্যক্তি আছে, যাকে পরে পৌঁছানো হয় কিন্তু সে আসল শ্রোতা হতেও বেশি উপলব্ধিকারী ও সংরক্ষণকারী হতে পারে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: خَطَبَنَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ النَّحْرِ قَالَ: «إِنَّ الزَّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ثَلَاثٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ» وَقَالَ: «أَيُّ شَهْرٍ هَذَا؟» قُلْنَا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ فَسَكَتَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ فَقَالَ: «أَلَيْسَ ذَا الْحِجَّةِ؟» قُلْنَا: بَلَى. قَالَ: «أَيُّ بَلَدٍ هَذَا؟» قُلْنَا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ فَسَكَتَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ قَالَ: «أَلَيْسَ الْبَلْدَةَ؟» قُلْنَا: بَلَى قَالَ «فَأَيُّ يَوْمٍ هَذَا؟» قُلْنَا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ فَسَكَتَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ. قَالَ: «أَلَيْسَ يَوْمَ النَّحْرِ؟» قُلْنَا: بَلَى. قَالَ: «فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي بَلَدِكُمْ هَذَا فِي شَهْرِكُمْ هَذَا وَسَتَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ فَيَسْأَلُكُمْ عَنْ أَعْمَالِكُمْ أَلَا فَلَا تَرْجِعُوا بِعْدِي ضُلَّالًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ أَلَا هَلْ بَلَّغْتُ؟» قَالُوا: نَعَمْ. قَالَ: «اللَّهُمَّ اشْهَدْ فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ»
ব্যাখ্যা: (عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ) এ সাহাবীর নাম নুফাই বিন হারিস ।
(خَطَبَنَا النَّبِىُّ ﷺ يَوْمَ النَّحْرِ) হাদীসের এ অংশটির মাধ্যমে বুঝা যায় কুরবানীর দিন খুৎবা দেয়া শারী‘আতসম্মত। ঠিক এ রকমই একটি হাদীস ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বর্ণনায় ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) থেকে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন বিদায় হজ্জের সময় জামারায়ে ‘আক্বাবার মাঝখানে অবস্থান করে বললেন, আজকে কোনদিন?----- এভাবে হাদীসের শেষ পর্যন্ত।
অনুরূপভাবে বুখারী ও অন্যান্য ইমামগণ ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিনে মানবতাকে লক্ষ্য করে ভাষণ প্রদান করলেন এবং তিনি বললেন, হে মানুষেরা! আজকে কোনদিন? অনুরূপ ইমাম আহমাদ (রহঃ) জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন আমাদেরকে খুতবাহ প্রদান করলেন এবং তিনি বললেন, আজ কোনদিন সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? আর হিরমাস বিন যিয়াদ আল বাহিলী (রাঃ)-এর হাদীস, তিনি বলেন, আমি কুরবানীর দিন মিনাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খুৎবা দিতে দেখেছি।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮৫; ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭)
অনুরূপভাবে ইমাম আবূ দাঊদ আবূ উমামাহ্ (রাঃ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিনায় কুরবানীর দিন খুৎবা দিতে শুনেছি। এছাড়া আরো একটি হাদীস যা পরবর্তী দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আসবে যা রাফি' বিন ‘আমর আল মুযানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের দিন তার শাহবা নামক খচ্চরের উপর উঠে খুৎবা প্রদান করেছেন। ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আস কর্তৃক বর্ণিত হাদীস তিনি অবলোকন করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুরবানীর দিন খুৎবা দিতে। আর সে সময় তার নিকট একজন প্রশ্ন করতে এসেছিলেন। যে হাদীসটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সহ অনেকে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং অত্র হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, কুরবানীর দিন খুৎবা দেয়া শারী‘আতসম্মত এবং হাদীসগুলো তাদের মতকে খণ্ডন করে যারা বলেন কুরবানীর দিন হাজী সাহেবের উদ্দেশে কোন খুৎবা দেয়া শরীয়াতে নেই। আর এ হাদীসগুলোর খুৎবা দ্বারা الوصايا العامة তথা সাধারণ নাসীহাত উদ্দেশ্য। তাদের এ কথা মোটেই ঠিক নয় কারণ অত্র হাদীসগুলোর বর্ণনাকারী সকলেই এটাকে খুৎবা বলেই উল্লেখ করেছেন। যেমনভাবে ‘আরাফার ময়দানের ক্ষেত্রে খুৎবা শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন। আর ‘আরাফাতে খুৎবা দেয়ার ক্ষেত্রে সকলের ঐকমত্য রয়েছে।
কুরবানীর দিন খুৎবা নেই বলে মত দিয়েছেন মালিকী ও হানাফীগণ। তারা বলেছেন হজ্জের খুৎবা তিনটি যথাঃ ১. জিলহজ্জ মাসের সাত তারিখ। ২. ‘আরাফার দিন। ৩. কুরবানীর দ্বিতীয় দিন। শাফি‘ঈ মতাবলম্বীগণও একই কথা বলেছেন, তবে তারা কুরবানীর দ্বিতীয় দিনের স্থানে তৃতীয় দিনের কথা বলেছেন এবং চতুর্থ আরেকটি খুতবার কথা বলেছেন তা হচ্ছে কুরবানীর দিন।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন, কুরবানীর দিন খুৎবা দেয়ার পর একটি প্রয়োজন রয়েছে যাতে করে মানুষেরা কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী, মাথা হলক এবং তাওয়াফ সহ বিভিন্ন কাজগুলো শিখে নিতে পারেন।
তবে ইমাম ত্বহাবী (রহঃ) ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) কর্তৃক উল্লেখিত চতুর্থ খুতবাটি আসলে হজ্জের কৃতকলাপের সাথে সংশিস্নষ্ট বিষয়ে হয় না, কারণ সেখানে হজ্জের কোন কাজ সম্পর্কেই আলোচনা হয় না, এটা শুধুমাত্র সাধারণ নাসীহাতকেই বুঝাবে। তিনি আরো বলেন, এ খুতবাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা কোন সাহাবী হজ্জের রীতিনীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
‘আল্লামা ইবনুল ক্বিসার (রহঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করার কারণ হলো, সারা পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে মানবতা সেখানে জমা হয়েছেন তাই তাদেরকে তিনি কিছু নাসীহাত করেছেন। সুতরাং এটা কোন খুৎবা ছিল না। তবে যারা তাকে এ কাজ করতে দেখেছেন তারা ধারণা করেছেন যে, এটা খুৎবা ছিল।
‘আল্লামা ইবনুল ক্বিসার আরো বলেন, ইমাম শাফি‘ঈর কথা যেমন তিনি বলেছেন চতুর্থ খুতবাটির মাধ্যমে মানুষেরা কিছু হজ্জের কাজকর্ম শিখতে পারেন এজন্য দেয়া প্রয়োজন ‘‘আমি এ কথার উত্তরে বলি এটা আবশ্যক নয় কারণ হজ্জের কাজগুলো তো মানুষেরা ‘আরাফার দিন ইমামের খুৎবা থেকে শিক্ষা করতে পারে।
‘আল্লামা ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী (রহঃ) বলেন, ইবনুল কিসার সহ অন্যান্যদের উত্তরে বলা যায়। চতুর্থ খুতবাটির প্রয়োজন রয়েছে কারণ সেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন, যিলহজ্জ মাস এবং মক্কা মুকাররামার মর্যাদা সম্পর্কে উপস্থিত জনতাকে সতর্ক করেছেন। আর এটাকে সহাবায়ে কিরাম খুৎবা নামেই আখ্যা দিয়েছেন। তাই এটা খুৎবাই হবে অন্য কিছু নয়।
(يَوْمَ خَلَقَ اللّٰهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ) অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা আসমানসমূহ ও জমিনসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন-এর মধ্যে এমন এক শক্তি যার মাধ্যমে-এর দিন রাত, বছর ও মাসসমূহকে পার্থক্য করা যায়। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা এ আসমান-জমিনকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর মাঝে আসমান জমিনের উপর দিয়ে বহুকাল বহু বছর বহু মাস অতিবাহিত হওয়ার পর তা আবার সে স্থানে ফিরে যাবে তথা তার মূলে ফিরে যাবে যেখানে আল্লাহ চাইবেন ফিরে যেতে সেখানেই ফিরে যাবে।
আর কিছু হানাফী বিদ্বান এর ব্যাখ্যায় বলেন, আসমান ও জমিন সেখান দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে বা করবে যেখান থেকে আল্লাহ চেয়েছেন। আর তা হল প্রতি ১২ মাসে এক বছর আর প্রতি মাসে ২৯/৩০ দিন হবে। তদানীন্তন ‘আরবরা এ হিসাবকে পরিবর্তন করে কোন বছরকে তারা ১২ মাসে ধরতো আবার কোন বছরকে তারা ১৩ মাস ধরতো। আর তারা প্রতি দু’বছরে এ হজ্জ/হজকে তার স্বীয় মাস থেকে পরবর্তী মাস পর্যন্ত বিলম্ব করতো আর যে মাসকে তারা বিলম্ব করতো তারা সেটাকে বাতিল বলতো। আর এমনিভাবে মাসের সংখ্যা বছরে ১৩ টি করতো ফলে বছরের মাস সংখ্যা পরিবর্তন হয়ে যেত আর এ সুযোগে তারা الاشتهر الحرم তথা সম্মানিত মাসসমূহ (যে মাসগুলো যুদ্ধবিগ্রহ হারাম)-কে উল্টা-পাল্টা করে ফেলতো অর্থাৎ- চারটি মাসকে হারাম মানতো ঠিকই কিন্তু আল্লাহর দেয়া মতে নয় নিজের মন মতো, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের মতাদর্শকে বাতিল করে আয়াত নাযিল করলেন, إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ অর্থাৎ- ‘‘এ ধরনের কাজকর্ম সব কাফিরদের কাজ।’’ (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ৩৭)
আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কাজকে বাতিল করে মাস এবং বছরের হিসাব সেভাবেই প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন যেভাবে আকাশ-জমিন সৃষ্টির শুরুতে ছিল। সুতরাং আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বছর বিদায় হজ্জ/হজ করেন সে সময় জিলহজ্জ মাস তার স্বীয় স্থানে ফিরে এসেছিল। তাইতো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ان الزمان قد استدار كهيئته) অর্থাৎ- সময় তার স্বীয় অবস্থায় ফিরে এসেছে। আর যুলহিজ্জাহ্ মাস এখন এটাই আল্লাহ আদেশ করেছেন। সুতরাং তোমরা জিলহজ্জ মাসকে এখানেই রাখ তার সময়কে সংরক্ষণ কর জাহিলিয়্যাতের মতো পরিবর্তন করে ফেলো না।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, হাদীসের উক্ত অংশটির ব্যাখ্যা হল জাহিলী যুগে মক্কার মুশরিকরা الاشهر الحرم তথা হারাম মাসসমূহের ক্ষেত্রে ইব্রাহীম (আঃ) মিল্লাতের কড়া অনুসারী ছিলেন। তবে ধারাবাহিকভাবে তিনমাস (যুলকাদা, জিলহজ্জ ও মুহাররম) যুদ্ধ বিরতি দিয়ে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই তারা যখন এসব মাসেও যুদ্ধের প্রয়োজনবোধ করতো তখন মুহাররম মাসের হারামকে পরবর্তী সফর মাসের জন্য নির্ধারণ করতো আর মুহাররম মাসে যুদ্ধ করতো। আর পরবর্তী বছরে আরো একমাস পিছিয়ে নিত। এভাবে তারা বছরের পর বছর এ রকম করতে থাকে। অবশেষে তাদের নিকট হারাম মাসের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোলমাল হয়ে যায় এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ ধরনের কর্মকান্ডের মধ্যে আকস্মিক পরিবর্তন আনেন এবং আল্লাহর নির্দেশ জিলহজ্জ মাসকে তার স্বীয় স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
আবূ ‘উবায়দ (রহঃ)-ও ঠিক একই রকম ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, তারা ينسون অর্থ يؤخرون তথা বিলম্ব করা যেমনটা আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেছেন, إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ৩৭) কখনো কখনো তারা মুহাররম মাসে যুদ্ধের খুব প্রয়োজনবোধ করতো আর তাইতো মুহাররামের হারামকে বিলম্ব করে ‘‘সফর’’ মাসে নিয়ে যেত। তারপর পরবর্তী বছরে আবার সফর মাসকে পরবর্তী মাসে নিয়ে যেত।
ইমাম বায়যাবী (রহঃ) ‘আরবের জাহিলী যুগের লোকেরা যখন যুদ্ধ করতো ঠিক সে মুহূর্তে কোন হারাম মাস আসলে (অর্থাৎ- যখন যুদ্ধ করা হারাম) তারা হারাম মাসটিকে পরিবর্তন করে পরবর্তী মাসের জন্য নির্ধারণ করতো। তাই তারা হারাম মাস হারাম করার উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে গিয়েছিল কিন্তু হারাম মাসের সংখ্যা চারটি তারা সংরক্ষণ করতো।
(السنة) এখানে বছর অর্থ ‘আরাবী চন্দ্রের হিসাবের বছর। তা হবে ১২ মাস।
(منها اربعة حرم) এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ সুতরাং এ হারাম চারটি মাসে তোমরা তোমাদের নিজের ওপর অত্যাচার করিও না। (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ৩৬)
ইমাম বায়যাবী (রহঃ)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, (بهتك حرمتها وارتكاب حرامها) অর্থাৎ- তার সম্মান ভঙ্গ করে ও হারাম (নিষিদ্ধ) কাজে জড়িত হয়ে এর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে না।
‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, (فلا تظالموا فيهن انفسكم) অর্থাৎ- যুদ্ধ-বিগ্রহ করো না। আবার কেউ বলেছেন, অবৈধ কাজের সাথে জড়িত হয়ো না।
‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, (ذكرها من سنتين لمصلحة التوالى بين الثلاثة) অর্থাৎ- গণনাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’বছর থেকে উল্লেখ করেছেন যাতে করে ধারাবাহিকতা রক্ষা পায়। অন্যথায় যদি তিনি মুহাররম থেকে গণনা শুরু করতেন তাহলে ধারাবাহিকতা রক্ষা হতো না। আর এটা থেকে আরো বুঝা যায় যে, জাহিলী যুগে ‘আরবরা যে কিছু কিছু মাসকে তাদের মনমতো বিলম্ব করে নিত তা বাতিল হিসেবে প্রমাণিত, কেননা তারা ঐ চারটি হারাম মাসের কখনো কখনো মুহাররমকে সফর আবার সফরকে মুহাররম করতো ধারাবাহিকতার ভঙ্গনের লক্ষ্যে, কারণ ধারাবাহিকতা তিন মাস যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম متواليات তথা ধারাবাহিক শব্দ উল্লেখ করে তাদের বিশ্বাস বাতিল করে দিলেন।
আর এ মাসগুলোর হারামের বিষয়ে উলট পালট করার ক্ষেত্রে তারা কয়েক শ্রেণীর ছিল। যেমনঃ তাদের একদল মুহাররম মাসকেই সফর নাম দেয় আর সেখানে তারা যুদ্ধ করে আর সফরকে মুহাররম নাম দেয় সেখানে তারা যুদ্ধ করে না। অপর আরেকটি দল এক বছর এমন করে আবার পরের বছর অন্য রকম করে। আরেকদল এটিকে দু’বছর অন্তর অন্তর করে। আবার আরেকদল সফরকে বিলম্ব করতে করতে রবিউল আওয়াল পর্যন্ত নিয়ে যায় আর রবিউল আওয়ালকে নিয়ে যায় তার পরের মাসে আর এমনভাবে পিছাতে পিছাতে শাও্ওয়াল হয়ে যায় যুলকাদা আর যুলকাদা হয়ে যায় জিলহজ্জ।
(ورجب مضرمضر) শব্দটি غير منصرف (ই‘রাব অপরবির্তনীয়) এটা ‘আরবের একটি প্রসিদ্ধ গোত্রের নাম।
(رجب) ‘রজব’ মাসকে এ গোত্রের দিকে সম্পৃক্ত করার কারণ হলো, এ গোত্রটি ‘আরবের সব গোত্রের চেয়ে বেশি সংরক্ষণকারী ছিল رجب মাসের সম্মানের ক্ষেত্রে।
رجب ‘রজব’ মাসের আরেকটি গুণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আর তা হলো রজব মাস জামাদিউস্ সানী ও শা‘বানের মাঝে হবে। এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করা এবং জোড়ালোভাবে বলা। যেমনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (اسنان الصدقة) বা সদাক্বার উটের বয়স সংক্রান্ত বিষয়ে বললেন, যদি ابنة مخاض না থাকে তাহলে একটি পুরুষ ابن لبون দিতে হবে অথচ আমরা জানি ابن لبون পুরুষ ছাড়া হয় না তারপরও নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ শব্দটি অতিরিক্ত বলে বিষয়টি আরো বেশি পরিষ্কার করেছেন। তবে এর আরো একটি কারণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আর তা হলো, যাতে করে তদানীন্তন জাহিলী যুগের মানুষেরা তাদের মনমতো হিসাবে মাস গণনা করতো তা বন্ধ করা।
‘আল্লামা নাবাবী (রহঃ) বলেন, এ ব্যাপারে সকল ‘আলিম ঐকমত্য যে, হারাম চারটি মাস সেই চারটিই যা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে চারটি মাস কিভাবে গণনা করা ভাল (مستحب) সে বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। সুতরাং কূফার একদল ‘আলিম বলেন, গণনাটি হবে এমন মুহাররম, রজব, যুলকাদা ও জিলহজ্জ। অর্থাৎ- মুহাররম দিয়ে শুরু আর যিলহিজ্জাহ্ দিয়ে শেষ হবে যাতে করে চারটি মাস একই বছরে হয়। অপরদিকে মদীনাহ্ বাসরার অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের মত হচ্ছে, যুলকাদা, জিলহজ্জ, মুহাররম ও সর্বশেষ রজব, অর্থাৎ- তিনটি ধারাবাহিক আর একটি ধারাবাহিকতাবিহীন। আর এটাই সহীহ যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
‘উলামায়ে কিরামের কেউ কেউ আবার এ ‘আরাবী মাসগুলোর রহস্য উদঘাটনেরও প্রচেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, মুহাররম মাসকে বছরের প্রথমে নিয়ে আসার কারণ হলো, যাতে করে বছরের প্রথম মাসটিই যেন সম্মানসূচক হয় আর শেষটিও সম্মানসূচক হয় আর মাঝখানে রজব তাও সম্মানসূচক কেননা (انما الاعمال بالخواتيم) শেষের উপর ‘আমল নির্ভরশীল।
মোট কথা হলো, বারো মাসের ভিতর এ চারটি মাস হচ্ছে মর্যাদাশীল গুরুত্বপূর্ণ, তাই সঙ্গত কারণেই তাদের দ্বারা বছরের গণনা শুরু, মাঝখান এমনকি শেষ হতে পারে।
(وَقَالَ: أَىُّ شَهْرٍ هٰذَا؟) এ প্রশ্নটির মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ভাল করে ঐ মাসটি, শহরটি এবং দিনটি সম্পর্কে এবং তার মর্যাদা সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করতে বলেছেন।
‘আল্লামা কুরতুবী (রহঃ) বলেন, দিনটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে চুপ করে থাকার ভিতর হিকমাত হলো উপস্থিত জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ। যাতে করে এর পরের বাক্যটির দিকে তারা মনোযোগী হয়।
(قُلْنَا: اللّٰهُ وَرَسُولُه أَعْلَمُ) ‘আল্লামা তুরবিশতী (রহঃ) বলেন, উত্তর দিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তা আল্লাহ ও তার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ন্যাস্ত করা, এটি একটি আদব তথা শিষ্টাচার। আর তারা ভেবেছেন যে, আমরা এমন উত্তর দিতে পারি যার চেয়ে বেশি আরো উত্তর থাকতে পারে। তাই প্রথমে তারা উত্তরের বিষয়টিকে علام الغيوب তথা মহান আল্লাহর দিকে ন্যাস্ত করেছেন। পরক্ষণে আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে ফিরিয়েছেন কারণ তিনি অবশ্যই তাদের চেয়ে ভাল জানেন।
(الْبَلْدَةَ) ‘আল্লামা খিত্বাবী (রহঃ) বলেছেন, এখানে بلدة (শহর) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো পবিত্র মক্কা নগরী। যেমনঃ মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, অর্থাৎ- ‘‘নিশ্চয়ই আমি এ শহরের রবের ‘ইবাদাত করতে আদিষ্ট হয়েছি।’’ (সূরা আন্ নামল ২৭ : ৯১)
‘আল্লামা ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, فلا ترجعوا بعدي كفارا অর্থাৎ- তোমরা আমার মৃত্যুর পর কাফির হয়ে যেয়ো না- এ কথাটির সাতটি ব্যাখ্যা হতে পারে।
১. ان ذلك كفر فى حق المستحل بغير حق অর্থাৎ- অন্যায়ভাবে বস্ত্ততঃই কাফির বনে যাওয়া।
২. ان ذلك كفر النعمة وحق الاسلام অর্থাৎ- সেটা হচ্ছে আল্লাহর নি‘আমাত ও ইসলামের হাক্বের কুফরী।
৩. انه يقرب من الكفر ويودى إليه অর্থাৎ- এটা কুফরের পর্যায়ভুক্ত।
৪. انه فعل كفعل الكفار অর্থাৎ- এটা কুফরী না তবে কুফরীর মতো।
৫. حقيقة الكفر অর্থাৎ- বস্ত্ততই কুফরী-এর অর্থ হলো তোমরা আমার পর কাফির হয়ে যেয়ো না, বরং মুসলিম থেকো।
৬. ইমাম খিত্বাবী (রহঃ) বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, (المتكبرون بالسلام)
৭. তোমরা একে অপরকে কাফির বলিও না।
উল্লেখ্য যে, চতুর্থ মতটি এখানে প্রণিধানযোগ্য যেমনটা বলেছেন, কাযী ‘ইয়ায (রহঃ)।
(فَرُبَّ مُبَلَّغٍ) হাদীসের এ অংশটিতে ‘ইলম প্রচারের বিষয়ে উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং এ হাদীস থেকে বুঝা যায় পূর্ণযোগ্যতা আসার আগেও ‘ইলম অর্জন করা যায় এবং আরো বুঝা যায় ‘ইলমে প্রচার করাও فرض كفاية (ফারযে কিফায়াহ্) তবে কিছু কিছু মানুষের জন্য তা فرض عين (ফারযে ‘আয়ন) হয়ে যায়।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬০-[২] ওয়াবারাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোন্ দিন পাথর মারবো? তিনি বললেন, তোমার ইমাম যেদিন মারবে তুমিও সেদিন পাথর মারবে। আবার আমি তাঁকে এ মাসআলাটি জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, আমরা সময়ের অপেক্ষায় থাকতাম, যখন সূর্যাস্ত হলো তখন আমরা পাথর মারতাম। (বুখারী)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَن وَبرةَ قَالَ: سَأَلْتُ ابْنَ عُمَرَ: مَتَى أَرْمِي الْجِمَارَ؟ قَالَ: إِذَا رَمَى إِمَامُكَ فَارْمِهِ فَأَعَدْتُ عَلَيْهِ الْمَسْأَلَةَ. فَقَالَ: كُنَّا نَتَحَيَّنُ فَإِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ رمينَا. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (وَعَنْ وَبَرَةَ) তার প্রকৃত নাম হলো ওয়াবারাহ্ বিন ‘আব্দুর রহমান আল মাসলামী তার কুন্ইয়্যাত হলো আবূ খুযায়মাহ্ অথবা আবুল ‘আব্বাস আল কূফী তিনি সিক্বাহ রাবী। তিনি একজন তাবি‘ঈ ১১৬ হিজরীতে খালিদ বিন ‘আবদুল্লাহ আল কাসরীর শাসনামলে কূফায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, اذا رمى امامك فارمه হাদীসের এ অংশে বলা হয়েছে ইমাম কংকর নিক্ষেপ করলে কংকর নিক্ষেপ করার কথা, আর এখানে ইমাম দ্বারা হজ্জের ইমাম উদ্দেশ্য। ইবনু ‘উমার যেন ভয় করছিলেন যে, প্রশ্নকারী হয়তো ইমামের বিপরীত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, তাই তাকে এ ধরনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। কিন্তু প্রশ্নকারী যখন প্রশ্নটি পুনঃরায় করলেন তখন ইবনু ‘উমার (রাঃ) আর ‘ইলম গোপন রাখলেন না, বরং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জামানায় তারা যেভাবে কংকর নিক্ষেপ করতেন তা ব্যাখ্যা করে বললেন।
এ সম্পর্কিত আরো একটি বর্ণনা রয়েছে সুফিয়ান ইবনু ‘উয়াইনাহ্ মিস্‘আর থেকে আর মিস্‘আর ওয়াবারার সূত্রে ওয়াবারাহ্ ইবনু ‘উমার (রাঃ) এর সূত্রে সেখানে রয়েছে। প্রশ্নকারী লোকটি ইবনু ‘উমার (রাঃ)-কে বললেন, আমার ইমাম যদি কংকর নিক্ষেপ করতে দেরী করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে আপনার মতামত কি? পরবর্তীতে ইবনু ‘উমার (রাঃ) তার উত্তরে বিস্তারিত বললেন। হাদীসটি ইবনু আবী ‘উমার তার মুসনাদে বর্ণনা করেছেন।
(فَأَعَدْتُ عَلَيْهِ الْمَسْأَلَةَ) অর্থাৎ- এখানে প্রশ্নকারী কংকর নিক্ষেপ করার সময়টিকে নিশ্চিতভাবে জানতে চেয়েছিলেন।
(كُنَّا نَتَحَيَّنُ) এ শব্দটি حين থেকে باب مفاعلة থেকে নির্গত আর حين অর্থ সময়। সুতরাং نتحين অর্থ হবে আমরা কংকর নিক্ষেপ করার জন্য সূর্য ঢলে যাওয়ার সময় পর্যবেক্ষণে রাখতাম। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, আমরা কংকর নিক্ষেপ করার সময়ের অপেক্ষায় থাকতাম।
‘আল্লামা তাবারী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো, كنا نطلب حينها والحين الوقت অর্থাৎ- আমরা কংকর নিক্ষেপ করার সময়ের অনুসন্ধান করতাম। এর থেকেই অন্য বর্ণনায় শব্দ এসেছে, كانوا يتحينون وقت الصلاة তারা (সহাবায়ে কিরাম) সালাতের প্রহর গুণতেন।
আর অত্র হাদীসটিই ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) (كنا نتحين زوال الشمس) শব্দে বর্ণনা করেছেন।
(فَإِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ رَمَيْنَا) আমরা যুহরের সালাতের পূর্বেই কংকর নিক্ষেপ করতাম। অবশ্যই ইমাম ইবনু মাজাহ হাকাম-এর সনদে মিকসাম থেকে, তিনি ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলে যাওয়ার পর জামারায়ে ‘আক্বাবাতে কংকর নিক্ষেপ করতেন এবং কংকর নিক্ষেপ হলেই যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করতেন।
‘আল্লামা সিনদী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীসটি প্রমাণ করছে যে, নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলে যাওয়ার পর প্রথমেই কংকর নিক্ষেপ করতেন, তারপর যুহরের সালাত আদায় করতেন।
অত্র হাদীস থেকে আরো বুঝা যায় ঈদুল আযহার ব্যতীত অন্যান্য দিনে কংকর নিক্ষেপ করার সময় হলো সূর্য ঢলার পর আর কেউ যদি সূর্য ঢলার পূর্বেই কংকর নিক্ষেপ করে তাহলে তা যথেষ্ট হবে না। আর এমনটাই অধিকাংশ ‘আলিমের মতামত। তবে ‘আত্বা, ত্বাউস (রহঃ) সহ অনেকেই এ মতের বিপরীত বলেছেন। কিন্তু এদের কথা ঠিক নয়, কারণ হাদীস তাদের বিপরীতে অবস্থান করছে।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬১-[৩] সালিম (রহঃ) (তাঁর পিতা) ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তিনি [’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ)] প্রথম জামারায় (নিকটবর্তী জামারায়) সাতটি পাথর মারতেন এবং প্রত্যেক পাথরের মারার সময় ’আল্লা-হু আকবার’ বলতেন। তারপর তিনি কিছু দূর আগে বেড়ে নরম মাটিতে যেতেন এবং সেখানে কিবলার দিকে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় হাত তুলে দু’আ করতেন। তারপর জামারায়ে উস্ত্বা’য় (মধ্যম জামারায়) এসে আবার সাতটি পাথর মারতেন। প্রত্যেক (ছোট) পাথর মারার সাথে ’আল্লা-হু আকবার’ বলতেন। তারপর বামদিকে কিছু দূর এগিয়ে নরম মাটিতে পৌঁছে কিবলার দিকে দাঁড়িয়ে দু’আ করতেন। এরপর জামারাতুল ’আক্বাবায় গিয়ে বাত্বনি ওয়াদী (খোলা নিচু জায়গা) হতে সাতটি পাথর মারতেন। প্রত্যেক পাথর মারার সাথে ’আল্লা-হু আকবার’ বলতেন। কিন্তু এখানে দাঁড়াতেন না, বরং (গন্তব্য পথে) চলে যেতেন এবং বলতেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এভাবে পাথর (কঙ্কর) মারতে দেখেছি। (বুখারী)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَن سالمٍ عَن ابنِ عمر: أَنَّهُ كَانَ يَرْمِي جَمْرَةَ الدُّنْيَا بِسَبْعِ حَصَيَاتٍ يُكبِّرُ على إِثْرَ كُلِّ حَصَاةٍ ثُمَّ يَتَقَدَّمُ حَتَّى يُسْهِلَ فَيَقُومُ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ طَوِيلًا وَيَدْعُو وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ ثُمَّ يَرْمِي الْوُسْطَى بِسَبْعِ حَصَيَاتٍ يُكَبِّرُ كُلَّمَا رَمَى بِحَصَاةٍ ثُمَّ يَأْخُذُ بِذَاتِ الشِّمَالِ فَيُسْهِلُ وَيَقُومُ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ ثُمَّ يَدْعُو وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ وَيَقُومُ طَوِيلًا ثُمَّ يَرْمِي جَمْرَةَ ذَاتِ الْعَقَبَةِ مِنْ بَطْنِ الْوَادِي بِسَبْعِ حَصَيَاتٍ يُكَبِّرُ عِنْدَ كُلِّ حَصَاةٍ وَلَا يَقِفُ عِنْدَهَا ثُمَّ يَنْصَرِفُ فَيَقُولُ: هَكَذَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْعَله. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (كَانَ يَرْمِىْ جَمْرَةَ الدُّنْيَا) এ রকম বর্ণনাই সবগুলো নুসখা (পান্ডুলিপি)-তে রয়েছে এমনকি মিশকাতুল মাসাবীহ-তেও অর্থাৎ- জামারা শব্দটিকে الدنيا শব্দের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তবে সহীহুল বুখারীতে রয়েছে ভিন্নরূপ সেখানে (الجمرة الدنيا) রয়েছে।
ইমাম তুরবিশতী (রহঃ) বলেন, الجمرة শব্দটি একবচনের শব্দ আর জামারাহ্ মূলত তিনটি তার অন্যতম হলো যাতুল ‘আক্বাবাহ্ যা মক্কা নগরীর নিকটে অবস্থিত। আর কুরবানীর দিন শুধু-ই এ যাতুল ‘আক্বাবাতে কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। আর কুরবানীর পরের দিন তিনটি কংকর নিক্ষেপ করতে হয় এ ক্ষেত্রে নিয়ম তাই যা অত্র হাদীসে উল্লেখ হয়েছে।
جمرة الدنيا একে جمرة الدنيا নামকরণের কারণ হলো মাসজিদুল খায়ফ-এ যারা সেখানে অবতীর্ণ হন সে অবতীর্ণ হওয়ার স্থানসমূহের নিকটবর্তী স্থানে এটি অবস্থিত আর دنيا শব্দের অর্থই হলো নিকটবর্তী। আর এ স্থানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উট বসাতেন। এ জামারাটিকে ‘‘দুনিয়া’’ শব্দের দিকে ইযাফাতের বিষয়টি اضافة ال صفة إلى الموصوف এর ন্যায়। যেমনঃ মাসজিদ শব্দটিকে الجامع-এর দিকে সম্পৃক্ত করে مسجد الجامع তথা জামি' মাসজিদ নামকরণ করা হয়।
(يُكبِّرُ عَلٰى إِثْرَ كُلِّ حَصَاةٍ) অর্থাৎ- اثر শব্দটি হামযাহতে যের ও ‘‘সা’’-কে সাকিন দিয়ে اثر অথবা হামযা ও ‘‘সা’’ উভয়টিকে যবর দিয়ে اثر-ও পড়া যায়। এর অর্থ হল প্রতিটি কংকর নিক্ষেপ করার পর الله أكبر বলতে হবে। আর হাদীসের বাহ্যিক থেকে বুঝা যায়, কংকর নিক্ষেপ করার পরই الله أكبر বলতে হবে। অপরদিকে ইমাম আহমাদ-এর এক বর্ণনায় (মুসনাদে আহমাদ ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৫২) আছে।
(كبر مع كل حصاة) তথা প্রতি কংকরের সাথে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলার কথা। ঠিক এ রকমই বর্ণিত হয়েছে ইমাম মুসলিম কর্তৃক জাবির (রাঃ)-এর বর্ণনা ও অন্যান্য বর্ণনায় এবং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম কর্তৃক ‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনাও ঠিক এ রকম এবং আসছে যে হাদীসটি ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাতে রয়েছে (يكبر عند كل حصاة)-এর কথা। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) যাকে বেশি ‘‘আম্’’ ব্যাপক অর্থজ্ঞাপক বলেছেন।
অপরদিকে যে হাদীসে مع তথা কংকর নিক্ষেপের সাথে সাথে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলার কথা বর্ণিত হয়েছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কংকরটি হাত থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই তাকবীর বলতে হবে এখানে সাথে অর্থ হলো যেহেতু কংকরটি তার নিকট থেকে বের হয়ে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত তা তার সাথেই রয়েছে। কেউ কেউ اثر كل حصاة এর ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন এভাবে যে, এখানে উদ্দেশ্য হলো কংকর নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করার পর।
معية তথা একই সাথে হতে হবে বলে মত দিয়েছেন চার ইমামের অনুসারী তথা ছাত্ররা যেমনঃ এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, ইমাম বাজী, ইবনু কুদামাহ্ ও ইমাম নাবাবী (রহঃ)। ইমাম দাসূকী (রহঃ) বলেন, এ বিষয়ে ‘‘আল মুদাওয়ানাহ্’’ গ্রন্থে যা সন্নিবেশিত হয়েছে তার বাহ্যিক থেকে বুঝা যায় (إن التكبير مع كل حصاة سنة) তথা প্রত্যেক কংকরের সাথে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলা সুন্নাহ। অপরদিকে ‘‘আল হিদায়া’’ নামক কিতাবেও (يكبر مع كل حصاة)-এর কথা এসেছে। আর এমন বর্ণনাই এসেছে ‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ ও ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ)-এর বর্ণনায়।
(ثُمَّ يَتَقَدَّمُ) অর্থাৎ- যে স্থানে ছিলেন সেখান থেকে একটু সরে গেলেন। অন্য বর্ণনায় এসছে, (ثم تقدم امامها) তথা একটু সামনে বাড়লেন।
(حَتّٰى يُسْهِلَ) ‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এখানে উদ্দেশ্য হলো সমতল ভূমি যেখানে কোন প্রকার উঁচু নিচু নেই।
‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, المكان السهل বলতে নরম মাটি যা শক্ত নয় এমন মাটিকে বুঝানো হয়।
(ثُمَّ يَرْمِى الْوُسْطٰى) অন্য বর্ণনায় আছে, ثم يرمى الجمرة الوسطى التى الاولى والأخرى
‘আল্লামা ইবনুল হুমাম (রহঃ) বলেন, জামারাতে কংকর নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করাটি আবশ্যক না উত্তম- এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে তবে আমার নিকট উত্তম, আবশ্যক নয়। (আল্লাহই ভালো জানেন)
‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, তারতীব তথা ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই যুক্তিসঙ্গত কারণ তা ইমাম শাফি‘ঈসহ অন্যান্যদের মতে ওয়াজিব এবং الموالاة তথা অবিচ্ছিন্নভাবে কংকর নিক্ষেপ করা سنة। যেমনঃ উযূর ক্ষেত্রে উযূর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধোয়ার ক্ষেত্রে موالاة করা سنة মালিকী মাযহাব অনুপাতে।
‘আল্লামা ইবনু কুদামাহ (রহঃ) বলেন, (মুগনী তৃতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৫২)
والترتيب فى هذه الجمرات واجب على ما وقع فى حديث ابن عمر وحديث عائشة عند أبى داودزد....................................
অর্থাৎ- এ জামারাগুলোতে কংকর নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব যা বুঝা যায় ইমাম আবূ দাঊদ কর্তৃক বর্ণিত ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) ও ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর হাদীস দ্বারা। তবে যদি কেউ উল্টিয়ে করতে চায় তাহলে প্রথমে শুরু করবে জামারায়ে ‘আক্বাবাহ্ থেকে, তারপর দ্বিতীয়টি, অতঃপর প্রথমটি অথবা শুরু করবে দ্বিতীয়টি দ্বারা এবং তিনটি করে কংকর নিক্ষেপ করা যথেষ্ট হবে না যতক্ষণ না প্রথমটিতে মারবে এবং মাঝখানের ও প্রান্তেরটির নিক্ষেপ না করবে- এমনটাই বলেছিলেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)। আর যদি শেষ প্রান্তেরটি নিক্ষেপ করে অতঃপর প্রথমটি এবং তারপর মাঝখানেরটি তাহলে প্রান্তেরটি পুনঃরায় করবে- এমনই বলেছেন ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)।
হাসান বাসরী ও ‘আত্বা বলেন, তারতীব তথা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব নয় এবং এটাই ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর কথা। কেননা তার যুক্তি হলো, যদি কেউ উল্টাভাবে কংকর নিক্ষেপ করে তাহলে তার উচিত হলো পুনরায় করা আর যদি পুনরায় না করে তাহলে কোন অসুবিধা নেই।
হানাফী বিদ্বানের কেউ কেউ দলীল হিসেবে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নোক্ত হাদীসটি পেশ করে থাকেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (من قدم نسكا يدي نسك فلا حرج) অর্থাৎ- একটি ‘ইবাদাত আগে আরেকটি করাতে কোন অসুবিধা নেই। এ হাদীসটিতে ‘ইবাদাত বলতে জামারায় কংকর নিক্ষেপ উদ্দেশ্য। আর যেহেতু এ জামারায় কংকর নিক্ষেপ করার বিষয়টি একই সময় বিভিন্ন স্থানে হয়ে থাকে যার একটির সাথে আরেকটির কোনই সম্পর্ক নেই, তাই এক্ষেত্রে তীর নিক্ষেপ ও কুরবানীর মতো ধারাবাহিকতা রক্ষার শর্ত করা হয়নি। আর আমরা (জমহূর ‘উলামাহগণ) বলি ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে কারণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং বলেছেন, (خذاء عنى منامككم) অর্থাৎ- তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জের বিধানগুলো আকড়ে ধর। হানাফী বিদ্বানগণ যে হাদীসটি দলীল হিসেবে পেশ করেছেন তা সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে যিনি একটি কুরবানীর পর আরেকটি কুরবানী করেন, কুরবানী আগে-পিছে করলে কোন অসুবিধা নেই- এ অর্থে হাদীসটি গ্রহণ করা ঠিক হবে না। পক্ষান্তরে তাওয়াফ ও সা‘ঈ করার ক্ষেত্রে তাদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কারণে তাদের বক্তব্য স্ববিরোধী হয়ে যায় এবং তাদের তথাকথিত অযৌক্তিক ক্বিয়াস বাতিল বলে পরিগণিত হয়।
‘আল্লামা শানক্বীতী (রহঃ) বলেন,
اعلم انه يجب الترتيب فى رمى من الجمار ايام التشريق فيبدأ بالجمرة الاولى التى بلى مسجدا الخيف..................
অর্থাৎ- জেনে রেখ আইয়্যামে তাশরীক্ব যে জামারাগুলোতে কংকর নিক্ষেপ করা হয়, এক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আবশ্যক, সুতরাং (হাজী সাহব) প্রথমে (الجمرة الاولى) প্রথম জামারার মাধ্যমে যা মাসজিদুল খায়ফ-এর নিকট অবস্থিত সেখান থেকে শুরু করবেন আর সেখানে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করবেন প্রত্যেকটির সাথে ‘‘আল্লাহু আকবার’’ বলবেন তারপর সেখান থেকে ফিরে الجمرة الوسطى তথা মধ্যবর্তী জামারার নিকটে আসবেন সেখানেও পূর্বের মতই নিক্ষেপ করবেন। আর শেষে জামারায় ‘আক্বাবাতে এসেও তেমনি নিক্ষেপ করবে। আর এ তারতীব (ধারাবাহিকতা) যা আমরা উল্লেখ করলাম এটাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাজ তিনি এভাবেই করেছেন আর আমাদের এভাবে করতে আদেশ করেছেন। সুতরাং আমাদের উচিত তার অনুসরণ করা। অতঃপর ‘আল্লামা শানক্বীতী ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে যার ব্যাখ্যা আমরা এখন করছি তা দলীল হিসেবে উল্লেখ করেন।
অতঃপর বলেন, ইমাম বুখারী (রহঃ) এ হাদীস সম্পর্কে পরপর তিনটি করে (অধ্যায়) উল্লেখ করেছেন। যা ধারাবাহিকতা রক্ষার পক্ষে বিশুদ্ধ এবং স্পষ্ট প্রমাণ। অপরদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তার এ রীতি অনুসরণ করতে বলেছেন, তিনি বলেছেন, (خذ عنى مناسككم) তোমরা আমার থেকে এর নিয়ম গ্রহণ কর। সুতরাং কেউ যদি ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে আগ-পিছ করে জামারায় কংকর নিক্ষেপ করে থাকে তাহলে তা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাতিল বলে গণ্য হবে। অন্য এক হাদীসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (من عمل عملا ليس عليه امرنا فهو رد)
যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করলো যা আমাদের নির্দেশনার মধ্যে নেই তা পরিত্যাজ্য। আর জামারায় কংকর নিক্ষেপে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনার মধ্যে নেই তাই তাও পরিত্যাজ্য। এটাই ইমাম শাফি‘ঈ, মালিক ও অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের অভিমত।
অত্র হাদীসটি থেকে বুঝা যায় প্রত্যেক কংকরের সাথে তাকবীর দেয়া বিধি সুন্নাত। সকল ‘আলিমের ঐকমত্য যদি কেউ তাকবীর না দেয় তাহলে তার কোনই কাফফারাহ দেয়া লাগবে না তবে সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) বলেছেন ভিন্ন কথা, তিনি বলেছেন, সে খাদ্য খাওয়াবে তবে একটি কুরবানী দিয়ে ক্ষতি পূরণ আমার নিকট সর্বোত্তম।
‘উলামাহগণ আরো একমত হয়েছেন যে, কংকর নিক্ষেপের সংখ্যা সাতটি হওয়ার ব্যাপারে এবং কংকর নিক্ষেপের মুহূর্তে কিবলামুখী হওয়া ও প্রথম এবং দ্বিতীয় জামারার নিকটে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ও বিনয়ী হওয়ার ব্যাপারে। এ হাদীস থেকে আরো বুঝা যায় কংকর নিক্ষেপের পর দু‘আ করার সময় কংকর নিক্ষেপের স্থান থেকে সরে গিয়ে দু‘আ করতে হবে যাতে করে অন্যের কংকর এসে নিজের শরীরে না লাগে।
এ হাদীস থেকে কংকর নিক্ষেপের সময় দু‘আর ক্ষেত্রে রফ্‘উল ইয়াদায়ন তথা দু’হাত উঁচু করার কথা বুঝা যায়। দু‘আ না করার কথাও বুঝা যায় এবং বুঝা যায় জামারায় ‘আক্বাবাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।
‘আল্লামা ইবনু কুদামাহ্ (রহঃ) বলেন,
لا نعلم لما تضمنه حديث ابن عمر هذا مخالفا الا ما روى عن مالك أنه ترك رفع اليدين عند الدعاء بعد رمى الجمار.
অর্থাৎ- আমাদের জানা মতে এ দু‘আর ক্ষেত্রে কংকর নিক্ষেপের পর দু‘আর সময় দু’হাত উত্তোলন করতে হবে এতে কোন বিরোধ নেই। তবে ইমাম মালিক (রহঃ)-এর বিপরীত অবস্থান গ্রহই করেছেন।
‘আল্লামা ইবনুল মুনযীর (রহঃ) বলেন, (لا أعلم أحدا انكر رفع اليدين فى الدعاء عند الجمرة الا ما حكاه ابن القاسم عن مالك) জামারার নিকটে দু‘আর সময় রফ্‘উল ইয়াদায়ন করতে হবে এতে কারো দ্বিমত নেই তবে ইবনুল কাসিম ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে যে বর্ণনা করেছেন তা ব্যতীত।
‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ইবনুল মুনযীর রফ্‘উল ইয়াদায়নের বিষয়টি এভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, যদি তা سنة ثابتة (প্রমাণিত সুন্নাত) হতো তাহলে তা মদীনার ‘আলিমরাই সর্বাগ্রে বর্ণনা করতেন। এ বিষয়ে তারা অমনোযোগী হতেন না। তবে ‘আল্লামা কুসত্বালানী (রহঃ) মালিকী মাহযহাবের ইবনু ফারহুন থেকে হজ্জের জামারায় ‘আক্বাবাতে কংকর নিক্ষেপের পর দু‘আর ক্ষেত্রে রফ্‘উল ইয়াদায়ন করা বা না করা এ দু’ধরনের কথাই ইমাম মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন।
অত্র হাদীসটিতে কংকর নিক্ষেপ কি হেঁটে চলে করতে হবে না সওয়ারী হয়ে সে বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই। তবে অন্যান্য হাদীসের বিবরণ রয়েছে। যেমনঃ ইবনু আবী শায়বাহ্ সহীহ সনদে বর্ণনা করেন, ان ابن عمر كان عشى الى الجمار مقبلا ومدبرا অর্থাৎ- নিশ্চয়ই ইবনু ‘উমার জামারার দিকে হেঁটে হেঁটে যেতেন এবং জাবির (রাঃ) থেকে আরো একটি বর্ণনা এসেছে, তিনি খুব প্রয়োজন না হলে সওয়ারী হতেন না।
ইমাম তিরমিযী ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে এ বিষয়ে বর্ণনা করেছেন এবং বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন এমনকি ইমাম বায়হাক্বীও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন যে,
(ان النبى ﷺ كان اذا رمى الجمار مشى اليها ذاهبا وراجعا) অর্থাৎ- নিশ্চয়ই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কংকর নিক্ষেপ করতে ইচ্ছা করতেন তখন জামারায় যাওয়া-আসা করতেন পায়ে হেঁটে।
অন্য শব্দে এসেছে, (كان يرمى الجمرة يوم النحر ركبا وسائر ذلك ماشيا) অর্থাৎ- নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু কুরবানীর দিন সওয়ারী হওয়া ছাড়া বাদ বাকী সব সময় পায়ে হেঁটেই জামারায় কংকর নিক্ষেপ করতেন। (মুসনাদে আহমাদ ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ১১৪, ১৩৭, ১৫৬, ১৫২, বুখারী, আবূ দাঊদ, বায়হাক্বী ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৪৮)
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬২-[৪] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’আব্বাস ইবনু ’আবদুল মুত্ত্বালিব লোকদেরকে পানি পান করানোর জন্য মিনার রাতগুলো মক্কায় থাকার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে অনুমতি দিলেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: اسْتَأْذَنَ الْعَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَبِيتَ بِمَكَّةَ لَيَالِيَ منى من أجلِ سِقايتِهِ فَأذن لَهُ
ব্যাখ্যা: (اسْتَأْذَنَ الْعَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ) এর দ্বারা তথা অত্র হাদীসটি দ্বারা ১১, ১২ ও ১৩ তারিখের রাতগুলো উদ্দেশ্য।
(مِنْ أَجْلِ سِقَايَتِه) ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, পানি পান করানোর দায়িত্ব থাকার কারণে অর্থাৎ- মাসজিদুল হারামে যেখানে যমযম কূপের পানি দ্বারা ভরপুর আর হাজীদের জন্য সেখান থেকে পানি পান করা ‘‘মানদূব’’ এবং তা পান করতে হয় তাওয়াফে ইফাযাহ্-এর পরপরই। আর অন্যান্য তাওয়াফের পরও তা পান করা যায় এবং প্রচন্ড ভীড় থাকার কারণে এ কূপ থেকে পানি পান করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং যমযম কূপের পানি বারাকাতপূর্ণ এবং এ কূপটি প্রাথমিককালে কুসাই-এর তত্ত্বাবধানে, অতঃপর তার মৃত্যুর পর তারই পুত্র ‘আব্দ মানাফ-এর তত্ত্বাবধানে, অতঃপর তার মৃত্যুর পর তার পুত্র হাশিম-এর তত্ত্বাবধানে, তার মৃত্যুর পর তারই পুত্র ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর তত্ত্বাবধানে, অতঃপর তার মৃত্যুর পর তারই পুত্র ‘আবদুল্লাহ এর নিকটে, অতঃপর তার মৃত্যুর পর তারই পুত্রের তত্ত্বাবধানে, এভাবে পর্যায়ক্রমে আজ পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা চলছে।
আল ফাকিহী (রহঃ) ‘আত্বা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আত্বা (রহঃ)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে পানীয় দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হাজীদের যমযম কূপের পানি পান করানো।
আযরাক্বী (রহঃ) বলেন, ‘আব্দ মানাফ মশকে করে যমযম কূপের পানি মক্কায় নিয়ে যেতেন এবং তা চামড়ার পাত্রে পান করার জন্য কা‘বার আঙ্গিনায় হাজীদের জন্য ঢেলে দিতেন। তারপর তার মৃত্যুর পর তার ছেলে হাশিম, তারপর ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব এ দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর যমযম কূপ খনন করা হলে যাবীব (আঙ্গুর) কিনে তা যমযম কূপের পানিতে দিয়ে ‘নাবীয’ তৈরি করে তা মানুষের জন্য পরিবেশন করতেন।
ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক বলেন, কুসাই বিন কিলাব কাবা ঘরের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলো তখন তারই দায়িত্ব ছিল কা‘বার গিলাফ পরানোর দায়িত্ব থেকে শুরু করে হাজীদের পানি পান করানো, ঝাণ্ডা ধরা, দারুণ নাদওয়ার দায়িত্ব সবই তার দায়িত্বে ছিল তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা পরস্পর পরামর্শক্রমে পানি পান করানো ও কা‘বার রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব ‘আব্দ মানাফকে আর বাকী দায়িত্ব অন্যান্য ভাইদের ওপর ন্যাস্ত ছিল। তারপরের বর্ণনাটি আগের মতই উল্লেখ করেছেন এবং একটু বর্ধিত করে বলেছেন,
ثم ولى السقاية من بعد عبد المطلب ولده العباس وهو يومئذ من أحدث اخدثه سنا فلم نزل بيده حتى اقام الاسلام وهي بيده فاقرها رسول الله ﷺ معه فهى اليوم إلى بنى العباس كذا فى الفتح-
অর্থাৎ- অতঃপর ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র ‘আব্বাস (রাঃ) যিনি ছিলেন বয়সে নবীন তার হাতে এ মহান দায়িত্ব ন্যাস্ত হয় এবং ইসলাম ক্বায়িম হওয়া অবধি তা তারই হাতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে সমর্থন জানান আর এখন তা ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বংশধরের হাতে রয়েছে। এমনটাই হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ)-এর ফাতহুল বারীতে আছে।
(فَأذِنَ لَه) অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায়, আইয়্যামে তাশরীক্বের রাতগুলোতে মিনায় কাটানো শারী‘আতসম্মত। আর হাজীদের পানি পান করানোর উদ্দেশ্য যদি কেউ সেখানে রাত না কাটায় তাহলে তার কোন অসুবিধা নেই। এ ব্যাপারে সকল ‘উলামায়ে কিরামের ঐকমত্য রয়েছে। তবে মিনায় রাত কাটানো কি ওয়াজিব না সুন্নাহ- এ ব্যাপারে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
ইমাম মালিক ও তার ছাত্ররা বলেছেন ওয়াজিব। তিন রাতের এক রাত হলেও সেখানে কাটাতে হবে। আর সেখানে অবস্থান না করার প্রেক্ষিতে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাঃ)-এর কথানুপাতে কাফফারাও দেয়া প্রয়োজন। সে কথাটি হলো, (من نسى من نسكه شيئا اوتركه فليهرق دما- أخرجه البيهقى) অর্থাৎ- হজ্জের কোন কাজ কেউ ইচ্ছা করে ছেড়ে দিলে বা ভুলে গেলে তার অবশ্যই কাফফারাহ্ দিতে হবে। ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) কথাটি বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মালিক (রহঃ) এ ব্যাপারে তার মুয়াত্ত্বাতে নাফি‘ ইবনু ‘উমার, ‘উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেটি হলো ‘উমার বলেছেন, (لا يتبين احد من الحاج ليالى منى من واء العقبة) অর্থাৎ- হাজীদের কেউ যেন অবস্থানকালীন রাতগুলোকে ‘আক্বাবার পিছনে অবস্থান না করে।
এ ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মাযহাব হলো, মিনায় অবস্থানের রাতগুলো মিনা ব্যতীত অন্যত্র অবস্থান করা ‘‘মাকরূহ’’, কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনাতে অবস্থান করেছেন। তবে ইমাম আবূ হানীফা ও তার ছাত্রদের নিকট যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করেই মিনার রাতগুলোতে মিনা ব্যতীত অন্য কোথাও রাত কাটায় তাহলে তার কোন কাফফারাহ্ দিতে হবে না। কেননা তারা মনে করেন, এ রাতগুলোতে মিনায় অবস্থান করার কথা এজন্য বলা হয়েছে যাতে করে ঐ দিনগুলোতে কংকর নিক্ষেপ করা সহজ হয়। তাই কেউ যদি ঐ রাতগুলোতে সেখানে অবস্থান না করেও কংকর নিক্ষেপ করতে পারে তাহলে তা তার জন্য বৈধ হবে।
এ মাসআলাটিকে কেন্দ্র করে ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)-এর দু’ধরনের কথা রয়েছে সর্বাধিক সহীহ হচ্ছে ওয়াজিব। কেউ কেউ বলেন, সুন্নাহ। সুতরাং প্রথম কথা অনুযায়ী মিনায় অবস্থান করা যদি ওয়াজিবই হয় তাহলে তাঁরা তা না করলে তাদের ওপর এ ভুলের কাফফারাহ্ বর্তাবে ওয়াজিব হিসেবে আর দ্বিতীয় কথানুযায়ী কাফফারা দেয়া সুন্নাহ হবে।
শাফি‘ঈ মাযহাব অবলম্বীদের নিকট কাফফারাহ্ দেয়া আবশ্যক হবে শুধু তার জন্য যিনি তিন রাতের কোন রাতেই মিনায় রাত যাপন করেনি। আর যদি কোন ব্যক্তি তিন রাতের কোন এক রাত মিনায় যাপন না করে তাহলে সে ব্যাপারে ঐ কথাগুলোই প্রণিধানযোগ্য যা বলা হয়েছে কংকর নিক্ষেপ করার বিষয়ে (যদি কেউ সাতটি কংকরের একটি না করে) ঐ কথাগুলোর সর্বাধিক সহীহ কথা হলো প্রথম রাত যাপন না করলে সে জন্য এক মুদ পরিমাণ সাদাকা দিতে হবে। আর দ্বিতীয় রাত না করলে এক দিরহাম। আর তৃতীয় রাত যদি না করে তাহলে ثلث دم তথা তিন ভাগের একভাগ কাফফারাহ্ দিতে হবে। আর তাদের নিকট রাত যাপন অর্থ হলো রাতের বেশি সময় অবস্থান করা কারণ রাত যাপন কথাটি হাদীসের مطابق তথা সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং পূর্ণরাত মিনা থাকা আবশ্যক না।
فاقبح المعظم مقام الكل أي للأكثر حكم الكل
এ ক্ষেত্রে রাতের প্রথমাংশ বা শেষাংশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
এ মাসআলাতে ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর মতামত হচ্ছে। মিনায় রাত্রিগুলোতে মিনায় অবস্থান করা واجب (ওয়াজিব)। সুতরাং যে কেউ তিন রাতের মধ্যে একটিও যদি সেখানে অবস্থান না করে তাহলে তার ওপর কাফফারাহ্ আবশ্যক। তার থেকে-এর বর্ণিত আছে সে কিছু সাদাকা করে দিবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে সাদাকা দেয়া লাগবে না। ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর সর্বাধিক স্পষ্ট দলীল হচ্ছে, মিনার দিনগুলোতে মিনায় রাত যাপন করা এটি হচ্ছে হজ্জের কাজসমূহের একটি অন্যতম কাজ। আর ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন,
(من نسى من نسكه شيئا أو تركه فليهرق دما) অর্থাৎ- যে কেউ হজ্জের কোন কাজ ভুলে গেলে একটি কুরবানী দিবে।
মিনায় রাত যাপনের মোটামুটি তিনটি দলীল হতে পারে,
১. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে রাত যাপন করেছেন আর তিনি বলেছেন, (خذوا عنى مناسككم) তোমরা আমার নিকট থেকে তোমাদের হজ্জের কাজ শিখে ‘আমল কর। সুতরাং আমাদের নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুসরণ করে মিনাতে রাত যাপন করতে হবে।
২. অত্র হাদীসে ‘আব্বাস (রাঃ)-কে সুযোগ দেয়ার কারণ প্রসঙ্গে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এ হাদীসটিও মিনায় রাত্রি যাপনের ওয়াজিবের দলীল, কারণ ‘আব্বাস (রাঃ)-কে সুযোগ দেয়ার একটি কারণ ছিল। আর যদি সে কারণ না থাকে তাহলে তো আর কেউ সুযোগ পাবে না। জমহূর ‘উলামায়ে কিরামের মতে মিনায় রাত যাপন করা ওয়াজিব।
৩. ‘উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) যিনি খুলাফায়ে রাশিদীনের অন্যতম যাদের অনুসরণ করতে আমরা আদিষ্ট তিনি মিনার দিনগুলোতে হাজীদেরকে মিনার বাইরে থাকতে নিষেধ করেছেন এবং যারা বাহিরে আছে তাদেরকে লোক পাঠিয়ে মিনার ভিতরে নিয়ে আসতে বলেছেন।
সুতরাং মোট কথা হলো, যদি কেউ উযরের কারণে মিনায় রাত যাপন করতে না পারে তাহলে তার কোন কাফফারাহ্ আবশ্যক হবে না। অন্যথায় আবশ্যক হবে।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৩-[৫] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে ’পানি পান’ করানো হয় সেখানে এসে পানি চাইলেন। তখন (আমার পিতা) ’আব্বাস (আমার ভাইকে) বললেন, হে ফযল! তোমার মায়ের কাছে যাও। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য তার কাছ থেকে খাবার পানি নিয়ে আসো। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমাকে এখান থেকে পানি পান করাও। আমার পিতা তখন বললেন, হে আল্লাহর রসূল! এতে লোকেরা হাত দেয়। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমাকে এখান থেকেই পানি পান করাও। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এখান থেকেই পানি পান করলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যমযমের কূপের কাছে গেলেন। তখনও তারা পানি পান করছিলেন। (এ অবস্থা দেখে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কাজ করতে থাকো, কেননা তোমরা নেক কাজে ব্যস্ত আছ। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যদি লোকেরা তোমাদেরকে পরাভূত করবে- এ আশংকা আমার না থাকতো তাহলে আমি সওয়ারী হতে নেমে এতে রশি নিতাম। (রাবী বলেন) এটা বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের কাঁধের দিকেই ইশারা করলেন। (বুখারী)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَاءَ إِلَى السِّقَايَةِ فَاسْتَسْقَى. فَقَالَ الْعَبَّاسُ: يَا فَضْلُ اذْهَبْ إِلَى أُمِّكَ فَأْتِ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِشَرَابٍ مِنْ عِنْدِهَا فَقَالَ: «اسْقِنِي» فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّهُمْ يَجْعَلُونَ أَيْدِيَهُمْ فِيهِ قَالَ: «اسْقِنِي» . فَشرب مِنْهُ ثُمَّ أَتَى زَمْزَمَ وَهُمْ يَسْقُونَ وَيَعْمَلُونَ فِيهَا. فَقَالَ: «اعْمَلُوا فَإِنَّكُمْ عَلَى عَمَلٍ صَالِحٍ» . ثُمَّ قَالَ: «لَوْلَا أَنْ تُغْلَبُوا لَنَزَلْتُ حَتَّى أَضَعَ الْحَبْلَ عَلَى هَذِهِ» . وَأَشَارَ إِلَى عَاتِقِهِ. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ جَاءَ إِلَى السِّقَايَةِ) মুজমাল গ্রন্থকার (রহঃ) বলেন, সিক্বায়াহ্ বলা হয় ঐ স্থানকে যেখান থেকে হজ্জের মওসুমে পানীয় সরবরাহ করা হয়। সেকালে কিসমিস ক্রয় করে যমযম কূপের পানির মধ্যে সংমিশ্রণ করে মানুষদেরকে পান করার জন্য পরিবেশন করা হতো। আর জাহিলী যুগ ও ইসলাম উভয় যুগেই ‘আব্বাস তার দায়িত্বে ছিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। সুতরাং এ দায়িত্ব কারো ছিনিয়ে নেয়া ঠিক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ‘আব্বাস-এর বংশধরদের কেউ জীবিত থাকবেন।
(فَقَالَ الْعَبَّاسُ: يَا فَضْلُ اذْهَبْ إِلٰى أُمِّكَ) ফযল তিনি ‘আব্বাস (রাঃ)-এর ছেলে, ‘আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর ভাই আর তার মাতা হলেন উম্মু ফযল লুবাবাহ্ বিনতু হারিস আল হিলালিয়্যাহ্ (রাঃ) আর তিনিই ‘আবদুল্লাহ (রাঃ)-এরও মাতা।
(يَجْعَلُونَ أَيْدِيَهُمْ فِيهِ) তারা তাদের হাতগুলো পানীয়ের মধ্যে ডুবিয়ে দিচ্ছে আর অধিকাংশই তাদের হাত থাকতো অপরিষ্কার। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) ইয়াযীদ বিন আবী যিয়াদ ‘ইকরামার সূত্রে ত্ববারানীতে এ ব্যাপারে একটি হাদীস আছে, ‘আব্বাস (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন, ان هذا قد مرت অর্থাৎ- তাদের অপরিষ্কার হাত এখানে দেয়ার কারণে এ পানীয়ও অপরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
আমি কি আপনাকে আমাদের ঘর থেকে পরিষ্কার পানি এনে দিব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, না বরং আমাকে সেখান থেকেই পানি দিন যেখান থেকে মানুষেরা পান করছে। ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে (১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৩২০, ৩৩৬) য‘ঈফ সনদে একটি হাদীস নিয়ে এসেছেন সেটা হল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল ‘আব্বাস-এর কাছে এসে বললেন, আমাকে পান করাও। তখন আল ‘আব্বাস বললেন, এই নাবীয মিশ্রিত পানি তো ময়লা হয়ে গেছে আমরা কি আপনাকে দুধ বা মধু পান করতে দিব? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, না আমাকে সেখান থেকে পান করাও যেখান থেকে মানুষেরা পান করছে।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীসটিতে অনেকগুলো উপকারিতা রয়েছে। যেমনঃ
১. অন্যের নিকটে পানীয় অন্বেষণ করা দোষের নয়।
২. কেউ যদি সম্মানের সাথে কোন জিনিস দেয় তাহলে তা ফেরত দেয়া ঠিক নয় তবে যদি সেটা ফেরত দেয়ার মধ্যে ফেরত না দেয়ার চেয়ে বৃহৎ কোন কল্যাণ নিহিত থাকে তাহলে ফেরত দেয়া যাবে। কেননা এ হাদীসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য আল ‘আব্বাস যে পানীয় নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন তা তিনি গ্রহণ করেননি বিনয়ীতার খাতিরে তাই তিনি বলেছেন আমাকে সেখান থেকেই পানি পান করাও যেখান থেকে মানুষেরা পান করছে।
৩. পানি পান করানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে বিশেষ করে যমযম কূপের পানি।
৪. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিনয় এবং এ বিষয়ে সাহাবীগণের অনুসরণ।
৫. যেখানে মানুষেরা হাত ডুবিয়ে দিয়েছিল তা অপবিত্র হয়নি কারণ অপবিত্র হলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গ্রহণ করতেন না।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৪-[৬] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাস্সাব নামক স্থানে যুহর, ’আসর, মাগরিব ও ’ইশার সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করে এখানেই কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেন। অতঃপর সেখান থেকে বায়তুল্লাহর দিকে রওয়ানা হলেন এবং (বিদায়ী) তাওয়াফ সম্পন্ন করলেন। (বুখারী)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى الظُّهْرَ وَالْعَصْرَ وَالْمَغْرِبَ وَالْعَشَاءَ ثُمَّ رَقَدَ رَقْدَةً بِالْمُحَصَّبِ ثُمَّ رَكِبَ إِلَى الْبَيْتِ فَطَافَ بِهِ. رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ
ব্যাখ্যা: কুরবানীর চতুর্থদিনে মিনা থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন। এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, সূর্য ঢলে যাওয়ার পরপরই যুহরের সালাত আদায়ের পূর্বেই কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের সালাত আদায়ের পূর্বেই মিনা থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। ‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এ হাদীসের সাথে لم يرم الا بعد الزوال তথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সূর্য ঢলে যাওয়ার পরেই কংকর নিক্ষেপ করেছেন- এ হাদীসে কোন বিরোধ নেই। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনা থেকে ফিরে আল মুহাসসাবে নেমেছেন, অতঃপর সেখানেই যুহরের সালাত আদায় করেছেন।
(ثُمَّ رَقَدَ رَقْدَةً) হালকা ঘুম দিলেন। অপর এক বর্ণনায় ثم هجع هجعة এর কথা এসেছে।
(الْمُحَصَّبِ) এটা হলো মিনা ও মক্কা নগরীর মাঝে অবস্থিত এক খোলা প্রশস্ত স্থান। এটাকে এ নামে অভিহিত করার কারণ হলো এখানে সব কংকর একত্রিত হয় যেহেতু এটা একটা নিচু ভূমি। সাহেবে শারহুল লুবাব (রহঃ) বলেন, المحصب হল الأبطح-এর অপর নামগুলো হলো আল হাসবা, বাত্বহা, খায়ফ। কেউ কেউ বলেছেন, এটা মিনার খুব সন্নিকটে কিন্তু এ কথা ঠিক নয়।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৫-[৭] ’আবদুল ’আযীয ইবনু রুফাই’ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি আনাস ইবনু মালিক-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যাপারে আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে যা জেনেছেন তা আমাকে বলুন। (যেমন) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তালবিয়ার দিন (যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে) যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) কোথায় আদায় করেছেন? জবাবে আনাস বললেন, ’মিনায়’। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, নাফরের দিন (যিলহজ্জ মাসের ১৩ তারিখে মদীনায় রওনা হবার দিন) ’আসরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) কোথায় আদায় করেছেন? তিনি বললেন, আবত্বাহ-এ। অতঃপর আনাস বললেন, কিন্তু তোমরা তোমাদের আমীর বা নেতৃবৃন্দ যেভাবে করেন সেভাবে করবে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ قَالَ: سألتُ أنسَ بنَ مالكٍ. قُلْتُ: أَخْبِرْنِي بِشَيْءٍ عَقَلْتَهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيْنَ صَلَّى الظُّهْرَ يومَ الترويةِ؟ قَالَ: بمنى. قلت: فَأَيْنَ صَلَّى الْعَصْرَ يَوْمَ النَّفْرِ؟ قَالَ: بِالْأَبْطَحِ. ثُمَّ قَالَ افْعَلْ كَمَا يَفْعَلُ أُمَرَاؤُكَ
ব্যাখ্যা: (عَنْ عَبْدِ الْعَزِيْزِ بْنِ رُفَيْعٍ) ‘আবদুল ‘আযীয বিন রুফাই‘ তিনি ছিলেন একজন সুপ্রসিদ্ধ তাবি‘ঈ। ইমাম বুখারী তার উস্তাদ ‘আলী ইবনুল মাদিনী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন ‘আব্দুল আযীয বিন রুফাই' প্রায় ৬০টি হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি ১৩০ হিজরীতে অথবা কেউ কেউ বলেছেন, তার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বুখারী এবং মুসলিমে ‘আবদুল ‘আযীয বিন রুফাই'-এর আনাস (রাঃ) থেকে এই একটি মাত্র হাদীসই উল্লেখিত হয়েছে।
(يَوْمَ التَّرْوِيَةِ) ইয়াওমুত্ তারবিয়াহ্ বলতে জিলহজ্জ মাসের অষ্টম দিনকে বুঝানো হয়েছে- এ দিনটি ইয়াওমুত তারবিয়াহ্ নামে অভিহিত হওয়ার কিছু কারণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘আল্লামা হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, لانهم كائما يرمون فيها ابلهم ويتروون من الماء ....الخ। কেননা এ দিনটিতে হাজী সাহেবরা তাদের উটগুলোকে পানি পান করাতেন দূর দূরান্ত থেকে পানি নিয়ে এসে, কারণ সে স্থানে তৎকালীন সময়ে কোন কূপ বা ঝর্ণা জাতীয় কিছু ছিল না। তবে এখন সেখানে পানি পান করার অনেক সুব্যবস্থা আছে তাইতো এখন সেখানে আর দূর থেকে পানি বহন করতে হয় না।
আল ফাকিহী (রহঃ) তার ‘‘মক্কা’’ নামক কিতাবে মুজাহিদ (রহঃ)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মুজাহিদ বলেন, ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার বলেছেন, হে মুজাহিদ! যখন তুমি মক্কার রাস্তায় বাধভাঙ্গা পানি দেখতে পাবে তখন তুমি সতর্কতা অবলম্বন কর। অন্য বর্ণনায় আছে, (فاعلم ان الأمر قد أظلك) এ ছাড়া এ দিনকে ইয়াওমুত্ তারবিয়াহ্ নামে অভিহিত করার আরো কারণ রয়েছে। যেমনঃ
১. এ দিনে আদম (আঃ) হাওয়া (আঃ)-কে দেখেছেন এবং তার সাথে তার জমায়েত হয়।
২. ইব্রাহীম (আঃ) কোন একরাত্রে দেখলেন তিনি স্বীয় পুত্রকে যাবাহ করছেন। অতঃপর ভয়ে তিনি চিন্তিত হলেন।
৩. এ দিনেই জিব্রীল (আঃ) ইব্রাহীম (আঃ)-কে مناسك الحج তথা হজ্জের কার্যাবলী দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
৪. এ দিনেই ইমাম মানুষদেরকে مناسك الحج তথা হজ্জের কার্যাবলী শিক্ষা দেন। এ কথাগুলো সবই যে বিরল এবং এক প্রকার ভিত্তিহীন কথা তার প্রমাণ হলো, যদি প্রথমটিই কারণ হয় তাহলে তার নাম (يوم التروية) তথা সাক্ষাতের দিন বা দেখার দিন নাম হতো। যদি দ্বিতীয়টিই কারণ হয় তাহলে তার নাম يوم التروية হতো। আর যদি কারণ তৃতীয়টি হয় তাহলে তার নাম يوم الرؤيا তথা স্বপ্নে দেখার দিন হতো। আর যদি কারণ চতুর্থটিই হতো তাহলে তার নাম يوم الزواية তথা বর্ণনা বা শিক্ষা দেয়ার দিন হতো। অথচ কোনটিই হয়নি বরং এর নাম হয়েছে يوم التروية তথা লালন-পালন পানি পান করানো ইত্যাদির দিন। তাই সঙ্গত কারণেই এখানে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ)-এর কথা প্রণিধানযোগ্য।
(قَالَ: بِمِنًى) হাদীসের এ অংশটি থেকে বুঝা যায় ইয়াওমুত্ তারবিয়াতে হাজী সাহেব যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) মিনাতে আদায় করবেন। এ বিষয়ে জমহূরের মত এটাই। এ বিষয়ের সমর্থনে পূর্বে উল্লেখিত জাবির -এর লম্বা হাদীসটিও উল্লেখযোগ্য যে,
فلما كان يوم التروية توجهوا إلى منى فأهلوا بالحج وركب رسول الله صلى الله عليه وسلم فصلى بها الظهر والعصر والمغرب والعشاء و الفجر
অর্থাৎ- যখন ইয়াওমুত্ তারবিয়ার দিন আসলো তখন তারা সবাই মিনা অভিমুখী হলেন এবং হজ্জের তালবিয়াহ্ পাঠ করতে লাগলেন আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ারীতে আরোহণ করলেন এবং সেই মিনাতেই তিনি যুহর, ‘আসর, মাগরিব, ‘ইশা এবং ফজরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন।
অনুরূপভাবে ইমাম আবূ দাঊদ, তিরমিযী, আহমাদ, হাকিম ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে এ রকম হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনু খুযায়মাহ্ ও হাকিম কাসিম বিন মুহাম্মাদ থেকে, তিনি ‘আবদুল্লাহ বিন যুবায়র থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবদুল্লাহ বিন যুবায়র (রাঃ) বলেন,
من سنة الحج ان يصلى الامام الظهر وما بعدها والفجر بمنى ثم يعدون إلى عرفة
হজ্জের নিয়মাবলীর অন্তর্গত এটাও যে, ইমাম যুহর ও তৎপরবর্তী সালাত এমনকি ফজরের সালাতও মিনায় আদায় করবেন, তারপর সকাল সকাল ‘আরাফাহ্ অভিমুখী হবেন। তবে সুফিয়ান সাওরী তার জামি' কিতাবে ভিন্ন কথা বর্ণনা করেছেন আর তা হলো ‘আমর ইবনে দীনার (রহঃ) বলেন, আমি যুবায়র (রাঃ)-কে দেখলাম ইয়াওমুত্ তারবিয়াতে তিনি যুহরের সালাত আদায় করছেন মক্কায়।
এ দু’ বর্ণনার সংঘর্ষের চমৎকার সমাধান পেশ করেছেন, হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) তিনি বলেন, ইবনুয্ যুবায়র (রাঃ)-এর এমন করার কারণ মূলত দু’টি হতে পারে। ১. لضرورة কোন কারণবশত তিনি তা করেছেন। ২. অথবা لبيان الجواز তথা জায়িযী অবস্থা বর্ণনার উদ্দেশে।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৬-[৮] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’আবত্বাহ’-এ নামা বা অবস্থান করা সুন্নাতসম্মত নয়। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যে ’আবত্বাহ’ হতে (মদীনার দিকে) রওয়ানা হওয়াটা সহজ ছিল বিধায় এখানে নেমেছেন বা অবস্থান করেছেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: نُزُولُ الْأَبْطَحِ لَيْسَ بِسُنَّةٍ إِنَّمَا نَزَلَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَنَّهُ كَانَ أسمح لِخُرُوجِهِ إِذا خرج
ব্যাখ্যা: বাতনুল মুহাস্সাবে অবতরণ করা لَيْسَ بِسُنَّةٍ তথা সুন্নাত নয়।
আবূ দাঊদ-এর রিওয়ায়াতে এসেছে فمن شاء نزل ومن شاء لم ينزل অর্থাৎ- যে চায় সেখানে বাত্বনি মুহাসসাবে অবতরণ করুক আর যে চায় সেখানে অবতরণ না করুক। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) ليس بسنة এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, سنة قصدية তথা পালন করতেই হবে এমন সুন্নাত নয় অথবা ليس من سنن الحج অর্থাৎ- হজ্জের সুন্নাতসমূহের অন্তর্গত নয়।
ইমাম বুখারী (রহঃ) ইমাম মুসলিম (রহঃ) ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, ليس التحصيب بشيئ তথা মুহাসসাবে অবস্থান করার কিছুই নেই। ইবনুল মুনযীর (রহঃ) বলেন, اى من أمر المناسك الذى يلزم فعله অর্থাৎ- এটা হজ্জের আবশ্যক কর্মসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) ইবনু আবী মুলায়কার সূত্রে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, (ثم ارتحل حتى نزل الحصبة) অর্থাৎ- অতঃপর তিনি সফর করে শেষ পর্যন্ত ‘‘হাসবাহ্’’ নামক স্থানে অবতরণ করলেন এবং তিনি বলেন, তিনি এখানে নেমেছিলেন শুধু আমার কারণে। অন্যান্য আরো কিছু হাদীস রয়েছে যা মুহাসসাবে অবতরণ করা এবং না করার প্রমাণ বহন করছে।
এর সমাধানকল্পে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, لكن لما نزله الشيئ كان النزول به مستحبا اتباعا له ولتقريره على ذلك وفعله الخلفاء অর্থাৎ- এ বিষয়ে বর্ণনা যাই থাকুক না কেন যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে অবতরণ করেছেন তাই অবতরণ করা মুস্তাহাব এবং যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে সমর্থন করেছেন সহাবায়ে কিরামের একদলসহ খুলাফায়ে রাশিদীনও এ কাজ করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৭-[৯] উক্ত রাবী [’আয়িশাহ্ (রাঃ)] হতে এ হাদীটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি তান্’ঈম হতে ’উমরার ইহরাম বাঁধলাম এবং মক্কায় পৌঁছে আমি আমার কাযা ’উমরা আদায় করলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবত্বাহ-এ এসে আমার জন্যে অপেক্ষা করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত আমি অবসর না হলাম (’উমরা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত)। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লোকদেরকে (মদীনার দিকে) রওয়ানা হতে আদেশ করলেন এবং নিজেও (মক্কার দিকে) রওয়ানা হলেন। আর বায়তুল্লাহ পৌঁছে ফজরের সালাতের আগেই (বিদায়ী) তাওয়াফ করলেন। অতঃপর মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন। (মিশকাত গ্রন্থকার বলেন, ইমাম বাগাবী এ হাদীসকে প্রথম অনুচ্ছেদে স্থান দিলেও আমি তা বুখারী, মুসলিমে পাইনি; তবে কিছু এর শেষে তারতম্যসহ আবূ দাঊদে রয়েছে।)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنْهَا قَالَتْ: أَحْرَمْتُ مِنَ التَّنْعِيمِ بِعُمْرَةٍ فَدَخَلْتُ فَقَضَيْتُ عُمْرَتِي وَانْتَظَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم بالأبطحِ حَتَّى فَرَغْتُ فَأَمَرَ النَّاسَ بِالرَّحِيلِ فَخَرَجَ فَمَرَّ بِالْبَيْتِ فَطَافَ بِهِ قَبْلَ صَلَاةِ الصُّبْحِ ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الْمَدِينَةِ. هَذَا الْحَدِيثُ مَا وَجَدْتُهُ بِرِوَايَةِ الشَّيْخَيْنِ بَلْ بِرِوَايَةِ أَبِي دَاوُدَ مَعَ اخْتِلَاف يسير فِي آخِره
ব্যাখ্যা: (فَأَمَرَ النَّاسَ بِالرَّحِيلِ) তবে এ অংশটুকু বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু হাদীসের পূর্ণ বর্ণনা বুখারীতে মুহাম্মাদ বিন বাশশার এর সনদে বর্ণিত হয়নি।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৮-[১০] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (হজ্জ/হজ সম্পন্ন করে শেষ তাওয়াফ না করেই) লোকজন চারদিক হতে দেশের দিকে ফিরতে শুরু করতো। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের কেউ যেন বায়তুল্লাহর সাথে (শেষ) সাক্ষাৎ না করে বাড়ীর দিকে রওয়ানা না হয়। তবে ঋতুমতী মহিলাদের (প্রতি শিথিলতা স্বরূপ) এর থেকে বিরত থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: كَانَ النَّاسُ يَنْصَرِفُونَ فِي كُلِّ وَجْهٍ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَنْفِرَنَّ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ بِالْبَيْتِ إِلَّا أَنَّهُ خُفِّفَ عَنِ الْحَائِضِ»
ব্যাখ্যা: মিনায় অবস্থান করার দিনগুলো শেষ হলে সবাই ফিরে যায়, কেউ তাওয়াফ করে আবার কেউ বা তাওয়াফ করে না। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, এ অংশটুকুর অর্থ হলো, তাদের হজ্জ/হজ শেষে তারা বিভিন্ন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন কেউ বা তাওয়াফে ওয়াদা' তথা বিদায়ী তাওয়াফকারী হিসেবে আবার কেউ তাওয়াফে ওয়াদা‘ না করে।
(لَا يَنْفِرَنَّ أَحَدُكُمْ) ‘তোমাদের কেউ যেন ফিরে না যায়’ এ ফিরে যাওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো النفر الأول প্রথমধাপে ফিরে যাওয়া যেটি তাড়াতাড়ি করে যারা তারা আইয়্যামে তাশরীক্বের দ্বিতীয় দিনে করে থাকে অথবা এর দ্বারা النفر الثانى তথা যারা দেরীতে করতে চায় তারা এটা আইয়্যামে তাশরীক্বের তৃতীয় দিনে করে থাকে এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে। অথবা এর দ্বারা এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, তোমাদের কেউ যেন মক্কা থেকে বের না হয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মক্কার বাইরে থেকে যারা হজ্জে এসেছে তারা মিশকাতের বর্ণনায় احدكم তথা ‘তোমাদের কেউ’ এ শব্দ এসেছে, তবে সহীহ মুসলিমে لاينفرن احد ‘কেউ যেন’ শব্দ এসেছে।
(حَتّٰى يَكُونَ اٰخِرُ عَهْدِه بِالْبَيْتِ) অর্থাৎ- ‘বায়তুল্লাহর বিদায়ী তাওয়াফ না করে যেন ফিরে না যায়’ সেদিকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যেমনটা বর্ণনা করেছেন ইমাম আবূ দাঊদ। এটা মূলত সহীহ মুসলিমের বর্ণনা কিন্তু সহীহুল বুখারীতে আছে, (قال ابن عباس : اأمر الناس ان نكون اخر عهدهم بالبيت الا انه خفف عن الحائض) অর্থাৎ- আদেশ দেয়া হয়েছে মানুষদের তারা যেন সবাই তাওয়াফে ওয়াদা‘ করে তবে হায়িযগ্রস্থ মহিলাদের ব্যাপারে একটু ছাড় দেয়া হয়েছে।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এভাবে صيغة مجهول দিয়ে সুফইয়ান ‘আবদুল্লাহ বিন ত্বাউস তার পিতা থেকে এবং তিনি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তবে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলেন আদেশ প্রদানকারী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অনুরূপ হালকা করা হয়েছে-এর ক্ষেত্রেও হালকাকারী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অবশ্য সুফিয়ান-এর অন্য রিওয়ায়াত সুলায়মান আল আওয়াল তিনি তাউস থেকে যেটি বর্ণনা করেছেন সেখানে صيغة مجهول তথা সরাসরি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কর্তা করে বর্ণনা করেছেন।
আর এর শব্দটি ইবনু ‘আব্বাস -এর তিনি বলেন, كان الناس ينهرفون فى كل وجه فقال رسول الله ﷺ : لا ينفرن احد حتى يكون اخر عهده بالبيت
হাদীসের এ ভাষ্য থেকে বুঝা যায় طواف الوداع তথা বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব যেহেতু কড়া আদেশ দেয়া হয়েছে।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীসে প্রমাণ রয়েছে তাদের জন্য যারা বলেন, طواف الوداع তথা বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব। আর যারা বিদায়ী তাওয়াফ না করবে তাদের কাফফারাহ্ স্বরূপ একটি কুরবানী দেয়া আবশ্যক হবে। এটাই অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের মতামত; হাসান বাসরী, হাকাম, হাম্মাদ, সাওরী, আবূ হানীফা, আহমাদ, ইসহাক, আবূ সাওর তাদের অন্যতম।
حَائِضِ ‘‘হায়িয’’ তথা ‘ঋতুবতী মহিলার সাথে যে সব মহিলার নিফাস হয়েছে তারাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর হায়িয-নিফাসওয়ালী মহিলাদের طواف الوداع তথা বিদায়ী তাওয়াফ করা লাগবে না। এ ব্যাপারে সকল ‘উলামায়ে কিরামের ঐকমত্য রয়েছে। তাওয়াফ করার জন্য যে পবিত্রতা শর্ত- এ হাদীস তার দলীল হিসেবে পেশ করা হয়ে থাকে।
পরিচ্ছেদঃ ১০. প্রথম অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৬৯-[১১] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মদীনাহ্ হতে রওয়ানা হবার রাতেই বিবি সফিয়্যাহ্ ঋতুমতী হয়ে পড়লেন। তিনি (সফিয়্যাহ্) বললেন, আমার মনে হয় আমি আপনাদেরকে আটকে দিলাম। (এ কথা শুনে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ধ্বংস হোক, নিপাত যাক। সে কি কুরবানীর দিন তাওয়াফ (ইফাযাহ্) করেনি? বলা হলো, হ্যাঁ, করেছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে রওয়ানা হও। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابٌ خُطْبَةُ يَوْمِ النَّحْرِ وَرَمْىِ أَيَّامِ التَّشْرِيْقِ وَالتَّوْدِيْعِ
وَعَن عائشةَ قَالَتْ: حَاضَتْ صَفِيَّةُ لَيْلَةَ النَّفْرِ فَقَالَتْ: مَا أُرَانِي إِلَّا حَابِسَتَكُمْ. قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «عَقْرَى حَلْقَى أَطَافَتْ يَوْمَ النَّحْرِ؟» قيل: نعم. قَالَ: «فانفري»
ব্যাখ্যা: (صَفِيَّةُ) অর্থাৎ- তিনি হচ্ছেন উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যাহ্ বিনতু হুয়াই বিন আখতাব বিন সা‘নাহ্ বিন সা‘লাবাহ্ আল ইসরাঈলিয়্যাত বিন সাবত্বিল লাবী বিন ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধর অতঃপর মূসা (আঃ)-এর সহোদর হারূন (আঃ)-এর বংশধর। তিনি জাহিলী যুগে সাল্লাম বিন মাশকাম আল ইয়াহূদীর স্ত্রী ছিলেন। তারপর কিনানাহ্ বিন আবিল হাক্বীক্ব তাকে বিবাহ করে এ দু’ স্বামীই ছিল কবি। পরে তার স্বামী কিনানাহ্ খায়বার যুদ্ধে নিহত হয়। সেটা ছিল ৭ম হিজরীতে সে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বার বিজয় করেন। সফিয়্যাহ্ (রাঃ) ছিলেন বন্দীদের মধ্যে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিজের জন্য পছন্দ করেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মুক্ত করে তাকে বিবাহ করেন। আর সেটা ছিল ৭ম হিজরীতে খায়বার যুদ্ধের পর। কেউ কেউ বলেছেন তার নাম ছিল যায়নাব আর ইসলাম গ্রহণ করে যখন পরিষ্কার হয়ে যান তখন তার নামকরণ করা হয় সফিয়্যাহ্। তিনি খুবই বুদ্ধিমতি সহনশীলা মহিলা ছিলেন। ৫০ অথবা ৫২ হিজরীতে খালিদ মু‘আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর যুগে তিনি রমাযান মাসে মৃত্যুবরণ করেন। কেউ বলে থাকেন তিনি ৩৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু তা ভুল। ‘আলী বিন হুসায়ন সফিয়্যাহ্ (রাঃ)-এর নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন যা সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে আর তিনি যদি ৩৬ হিজরীতে মারা যেয়ে থাকেন তাহলে কিভাবে হয়? কারণ ‘আলী বিন হুসায়ন তো তখন জন্মগ্রহণই করেননি। সফিয়্যাহ্ (রাঃ) থেকে বুখারী ও মুসলিমে (سماعه) শ্রবণ সাব্যস্ত হয়েছে। ৬০ বছর বয়সে সফিয়্যাহ্ (রাঃ)-কে বাক্বী‘ আল গরকাদে দাফন করা হয়েছে।
(حَاضَتْ) হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেনঃ যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ কুরবানীর দিন তাওয়াফে ইফাযাহ্’র তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঋতুবতী হয়েছিলেন, যেমনটি বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে ‘কুরবানীর দিন যিয়ারত’ অধ্যায়ে।
(عَقْرٰى) এর ব্যাখ্যায় কেউ বলেন, আল্লাহ সফিয়্যাহ্ (রাঃ)-কে বন্ধ্যা বানিয়ে দিন। (حَلْقٰى) এর ব্যাখ্যায় কেউ বলেন, আল্লাহ সফিয়্যাহ্ (রাঃ)-কে মাথা মুন্ডিয়ে দিন। এ উভয় গুণটি মহিলাদের সৌন্দর্যের প্রতীক।
(أَطَافَتْ يَوْمَ النَّحْرِ) বুখারীর অন্য রিওয়ায়াতে রয়েছে, অতঃপর আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ كنت طفت يوم النحر؟ قالت: نعم (قال: فانفري)।