পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২১৯-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তোমাদের কোন লোক যখন (রাতে) ঘুমিয়ে যায়, শায়ত্বন (শয়তান) তার মাথার পেছনের দিকে তিনটি গিরা লাগায়। প্রত্যেক গিরায় শায়ত্বন (শয়তান) তার মনে এ কথার উদ্রেক করে দেয় যে, এখনো অনেক রাত বাকী, কাজেই ঘুমিয়ে থাকো। সে যদি রাতে জেগে উঠে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাহলে তার (গাফলতির) একটি গিরা খুলে যায়। তারপর সে যদি উযূ (ওযু/ওজু/অজু) করে, (গাফলতির) আর একটি গিরা খুলে যায়। যদি সে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আরম্ভ করে তখন তার তৃতীয় গিরাটিও খুলে যায়। বস্ত্ততঃ এ লোক পাক-পবিত্র হয়ে ভোরের মুখ দেখে, নতুবা অপবিত্র হয়ে ভোরের দিকে কলূষ অন্তর ও অলস মন নিয়ে উঠে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم قَالَ: يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلَاثَ عُقَدٍ يَضْرِبُ عَلَى كُلِّ عُقْدَةٍ: عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيلٌ فَارْقُدْ. فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللَّهَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيطًا طيب النَّفس وَإِلَّا أصبح خَبِيث النَّفس كسلانا
ব্যাখ্যা: শায়ত্বন (শয়তান) কয়েক শ্রেণীর মানুষ ছাড়া সকলের গ্রীবাদেশে নিদ্রার সময় তিনটি গিরা দিয়ে থাকে। শায়ত্বন (শয়তান) দ্বারা এখানে (الجنس) জিন্স বা জাতি উদ্দেশ্য অর্থাৎ শায়ত্বনের (শয়তানের) সাথী বা সহকর্মী অথবা সাহায্যকারী ইত্যাদি হতে পারে। তবে এখানে শায়ত্বনের (শয়তানের) শীর্ষ নেতা অর্থাৎ ইবলীসের নিজে হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘তোমাদের প্রত্যেকের গ্রীবাদেশে গিরা লাগায়’ কিন্তু কয়েক শ্রেণীর মানুষ শায়ত্বনের (শয়তানের) এ অপকর্মের প্রভাব থেকে নিরাপদে থাকবে। তারা হলেনঃ
১। নাবী রসূলগণ।
২। ঐ শ্রেণীর লোক যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমার এমন বান্দা রয়েছেন যাদের উপর তোমার কোন রাজত্ব চলবে না। যেমন ঐ ব্যক্তি যে রাত্রিবেলা নিদ্রা গমনকালে আয়াতুল করসী পাঠ করে ঘুমায়। (এছাড়াও রাতে সূরাহ্ বাক্বারাহ্ তিলাওয়াতকারীর বাড়ীতেও শায়ত্বন প্রবেশ করতে পারে না।) এরা সকাল হওয়া পর্যন্ত শায়ত্বনের (শয়তানের) অনিষ্টতা থেকে মাহফূয থাকবে।
শায়ত্বন প্রত্যেক গিরা সময় বলে ‘ঘুমাও তোমার জন্য রাত দীর্ঘ রয়েছে।’ তিনটা গীরার কথা বলা হয়েছে হয়তো তাকীদের জন্য অথবা তিনটি কাজের দ্বারা খুলবে এজন্য তিনটি গিরার কথাই বলা হয়েছে। প্রথম গিরা খুললে যিকিরের (জিকিরের) দ্বারা দ্বিতীয়টি উযূর দ্বারা, তৃতীয়টি সালাতের দ্বারা। এ যেন প্রতিটি গিরার জন্য প্রতিটি কাজ প্রতিরোধক ও প্রতিকারক।
এভাবে রাত যাপন করার পর সকালে সে সাওয়াব আর প্রশান্তি নিয়ে আনন্দচিত্তে অতীব পবিত্র অবস্থায় জাগরিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তার এ সুন্দর কাজে বারাকাত দান করেন। আর যদি এরূপ না করে অর্থাৎ দু‘আ কালাম পাঠ না করেই, উযূ (ওযু/ওজু/অজু) না করেই, সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় না করেই শুধু ঘুমিয়ে রাত কাটায় তার উপর শায়ত্বনের (শয়তানের) মন্ত্র কার্যকর হয়, ফলে সে সকাল বেলা অলস অবশ দেহে, বিষণ্ণ ও দুঃশ্চিন্তা মনে জাগরিত হয়।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২০-[২] মুগীরাহ্ (রাঃ)থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাত্রে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করতে পড়তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পা ফুলে যেত। তাঁকে বলা হলো, আপনি কেন এত কষ্ট করছেন। অথচ আপনার পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে? (এ কথা শুনে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করলেন, আমি কী কৃতজ্ঞতা স্বীকারকারী বান্দা হবো না? (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَنِ الْمُغِيرَةِ قَالَ: قَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى تَوَرَّمَتْ قَدَمَاهُ فَقِيلَ لَهُ: لِمَ تَصْنَعُ هَذَا وَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكِ وَمَا تَأَخَّرَ؟ قَالَ: «أَفَلَا أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا»
ব্যাখ্যা: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে দাঁড়িয়ে থাকতে তার পা ফুলে যেত। এ সালাত ছিল রাতের তাহাজ্জুদের সালাত (সালাত/নামায/নামাজ)। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, তিনি রাতে দীর্ঘসূত্রী সালাত আদায় করতেন। বলা হয়েছে সালাত যেমন ছিল দীর্ঘ তেমনি ছিল দায়েমী। এ হাদীসসহ আরো অনেক হাদীসে দেখা যায় পা ফুলে যাওয়ার কথা এসেছে। আবার সহীহুল বুখারীতে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণনা সুনানে, নাসায়ীতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণনাসহ আরো কতিপয় রিওয়ায়াতে দেখা যায় পা ফেটে যাওয়ার কথা এসেছে।
শায়খুল হাদীস আল্লামা ‘উবায়দুল্লা মুবারকপূরী (রহঃ) বলেন, এগুলো পরস্পর বিরোধী কোন বর্ণনা নয়। পা যখন ফুলে যায় তখন ফেটেও যায়, (অথবা কখনো কখনো ফেটেও যেত।) অথবা ফুলে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যেত। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো আপনি এরূপ (কষ্ট) করছেন কেন? এ জিজ্ঞাসাকারী স্বয়ং ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) নিজেই ছিলেন। এ হাদীসের প্রশ্নের বাক্যের সাথে অন্যান্য হাদীসের বাক্যের শব্দগত কিছু পার্থক্য থাকলেও অর্থ একই। ‘আপনার পূর্বাপর অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে’ এ বাক্যটি কোন কোন হাদীসে কর্তৃবাচ্য হিসেবে ‘আল্লাহ আপনার পূর্বাপর গুনাহ বা অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন’ ব্যবহার হয়েছে।
প্রশ্ন হলো নাবীগণ তো ছিলেন নিষ্পাপ তাদের অপরাধ বা গুনাহ কিসের? উত্তর তাদের কোন অপরাধ বা গুনাহ ছিল না, তবে অনুত্তম কাজ বুঝানো আর তার মহান মর্যাদার কারণে ঐ কাজকেই অপরাধ বা গুনাহ বলে বুঝানো হয়েছে। যেমন (প্রবাদে) বলা হয় হাসানাতুল আবরার সাইয়্যিআতুল মুকাররিবীন। অথবা এর অর্থ হলোঃ যদি আপনার দ্বারা কোন গুনাহ হতো তাহলে তা অবশ্য হতো ক্ষমাযোগ্য। সর্বোপরি এ কথার দ্বারা তার গুনাহ নিশ্চিত হয়েছিল এটা আবশ্যক হয় না।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাঃ ‘আমি কি তাহলে আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না?’ এর অর্থ হলো আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে আমি তার ‘ইবাদাত বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব? আল্লাহর এই ক্ষমা এবং অন্যন্য অসংখ্য নি‘আমাতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে না? বরং আমার উপর তো আরো বেশী আবশ্যক যে, আমি আমার মাওলার এ সকল নি‘আমাতের আরো বেশি বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমি আরো অধিক রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায় করি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (عبد) বান্দা বা গোলাম শব্দ ব্যবহার করা আল্লাহর নিকট বিনয়ী হওয়া এবং তাকে সম্মান প্রদর্শনের চূড়ান্ত ভাষা। এজন্য ইসরার আয়াতে আল্লাহ তা‘আলাও এ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এটা সম্পর্ক গভীর হওয়ারই প্রমাণ বাহক। আর এই সম্পর্কে ‘ইবাদাত ছাড়া সম্ভব হয় না, তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক রাত জেগে আল্লাহর ‘‘ইবাদাত (সালাত আদায়) করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২১-[৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে এক লোক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। তাঁকে বলা হলো, লোকটি সকাল পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে থাকে, সালাতের জন্যে উঠে না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, এ লোকের কানে অথবা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তার দু’কানে শায়ত্বন (শয়তান) পেশাব করে দিয়েছে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: ذُكِرَ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ فَقيل لَهُ مازال نَائِمًا حَتَّى أَصْبَحَ مَا قَامَ إِلَى الصَّلَاةِ قَالَ: «ذَلِكَ رَجُلٌ بَالَ الشَّيْطَانُ فِي أُذُنِهِ» أَو قَالَ: «فِي أُذُنَيْهِ»
ব্যাখ্যা: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যে ব্যক্তিকে নিয়ে এ আলোচনা হচ্ছিল হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, আমি তার প্রকৃত নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি। রাতে সে উঠে ‘সালাত’ আদায় করে না। এই সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রাতের সালাত তাহাজ্জুদ। আবার ফরয ‘ইশার সালাতও হতে পারে। এমনকি ফাজ্রের (ফজরের) সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। ফরয সালাত হওয়ার সম্ভাবনার স্বপক্ষে ইবনু হিব্বান-এর সহীহ সংকলনে একটি বর্ণনাও রয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্য কথা দৃষ্টে মনে হয় এটা নৈশকালীন সালাত অর্থাৎ সালাতুত্ তাহাজ্জুদ, যা ইবনু মাজাহ, নাসায়ী প্রভৃতি গ্রন্থেও প্রমাণ বহন করে।
শায়ত্বন (শয়তান) তার কানে প্রস্রাব করে দেয়, এই কান বলতে বর্ণনাকারীর সন্দেহ এক কানেও হতে পারে, দুই কানেও হতে পারে। তবে বুখারীর এক বর্ণনায় শুধুমাত্র এক কানের কথা এসেছে। কানে পেশাব করার বিষয়টি বাস্তবেই হতে পারে। ইমাম কুরতুবী বলেন, অন্যভাবে অর্থাৎ রূপক অর্থেও হতে পারে। তবে বাস্তবে হওয়া তো অসম্ভব কিছু নয়, কেননা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, শায়ত্বন (শয়তান) খায়, পান করে, বায়ু নির্গত করে, বিবাহ করে সুতরাং তার পেশাব করার বাস্তবতায় কোন বাধা নেই। কেউ কেউ এর সম্ভাব্য তাবীল করেছেন যে, তাকে সালাত থেকে এমনভাবে গাফিল করে রাখা হয় যেন তার কানে পেশাব করে দেয়া হয়েছে ফলে সে আযানও শোনে না, মোরগের ডাকাও শোনে না।
ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আরাবেরা ফাসাদ শব্দকে ‘বাওল’ উপনামে ব্যবহার করে থাকে। কেউ কেউ বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শায়ত্বন (শয়তান) নিদ্রিত ব্যক্তির কান এমনভাবে বন্ধ করে রেখে দিয়েছে যে, সে আযান ইক্বামাত কিছুই শুনতে পায় না। আল্লামা ত্বীবী বলেন, চক্ষু বা আরো অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকা সত্ত্বেও কানের কথা খাস করে বলা হয়েছে এ করণে যে, ভারী নিদ্রা হলে কান একেবারেই অচল হয়ে যায়। কানে কিছু শুনলেই তো সে জাগবে এবং সালাতে দাঁড়াবে। যেমন আল্লাহর বাণীঃ ‘আমি গুহায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের কানের উপর নিদ্রা ঢেলে দিলাম।’ এখানে নিদ্রা বলতে অতীব ভারী নিদ্রা যাকে কোন শব্দই জাগাতে পারে না।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২২-[৪] উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘাবড়িয়ে গিয়ে এ কথা বলতে বলতে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন, ’সুবহা-নাল্ল-হ’ আজ রাত্রে কত ধন-সম্পদ অবতরণ করা হয়েছে। আর কত ফিতনাহ্ অবতরণ করা হয়েছে। হুজরাবাসিনীদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিবে কে? তিনি এর দ্বারা তাঁর স্ত্রীদেরকেই বুঝিয়েছেন। যেন তারা সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করে। কত মহিলা দুনিয়ায় কাপড় পরিধান করে আছে, কিন্তু আখিরাতে তারা উলঙ্গ থাকবে। (বুখারী)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَن أم سَلمَة قَالَتْ: اسْتَيْقَظَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَزِعًا يَقُولُ: «سُبْحَانَ اللَّهِ مَاذَا أُنْزِلَ اللَّيْلَةَ مِنَ الْخَزَائِنِ؟ وَمَاذَا أُنْزِلَ مِنَ الْفِتَنِ؟ مَنْ يُوقِظُ صَوَاحِبَ الْحُجُرَاتِ» يُرِيدُ أَزْوَاجَهُ «لِكَيْ يُصَلِّينَ؟ رُبَّ كَاسِيَةٍ فِي الدُّنْيَا عَارِيَةٍ فِي الْآخِرَة» أخرجه البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীতু হয়ে পড়ছিলেন। এ ভয় ছিল তিনি যে ভয়াবহ দৃশ্য দর্শন করেছিলেন তা দেখে। সেটি ছিল নানা ‘আযাব ও গযব সেটাকেই (فِتَنِ) ‘ফিতান’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। এটা ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মালাকগণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ‘আযাব-গযবের সংবাদ পেশ, যা আল্লাহর কাছে নির্ধারিত রয়েছে এবং অনতিবিলম্বে কার্যকর হবে। আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন স্বপ্নে তাই দেখছিলেন যে এখনই তা ক্বায়িম হতে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে তার কাছে (বিশ্বের সমস্ত) ধন-ভান্ডার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। অথবা আল্লাহ তা‘আলা তার নিদ্রার পূর্বে ওয়াহী দ্বারা তাকে অবহিত করেছিলেন সেটাকেই তিনি ‘মা-যা- উনযিলাল লাইলাতা মিনাল খাযা-য়িনি’ শব্দে প্রকাশ করেছেন। এটা আল্লাহর রসূলের মু‘জিযাসমূহের একটি মু‘জিযা বিশেষ। এই ধন ভান্ডার হতে পারে রোম ও পারস্যের ধন ভান্ডার কেনানা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে খবর দিয়েছেন যা পরবর্তীতে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র স্ত্রীগণ সালাতের মাধ্যমে রাতের ফিতনাসমূহ থেকে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন এজন্য তিনি সর্বাগ্রে তাদের প্রতিই উদ্দেশ্য করেছেন। আরো একটি কারণ হলো যে সময় তিনি রাতে অবতীর্ণ ফিতনাহ্ দর্শন করেছিলেন এবং তা ব্যক্ত করেছিলেন সে সময় উম্মুল মু’মিনীনগণই উপস্থিত ছিলেন। অথবা এ নাসীহাতের বিশ্বজনীন ঘোষণা নিজ পরিবার দিয়েই শুরু করেছেন। এ হাদীস থেকে আরো প্রতীয়মান হয় যে, এই জাগানোটা ছিল রাতের সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়ের লক্ষ্যে অন্যথায় শুধু খবর দেয়ার জন্যই হলে তিনি দিনের বেলায় তা দিতে পারতেন। রাতের সালাতের জন্য উদ্বুদ্ধ করা সংক্রান্ত এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাত্রিকালীন সালাতটা ওয়াজিব নয়।
(رُبَّ) শব্দটি ‘অনেক’ এবং ‘কম’ উভয় অর্থেই ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে ‘অনেক’ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। (رُبَّ كَاسِيَةٍ) এবং (رُبَّ عَارِيَةٍ) শব্দের উদ্দেশ্য নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেছেনঃ এর অর্থ হলো, (رب امرأة) অনেক মহিলা। কেউ এর অর্থ করেছেন, (رَبَّ نَسَمَةٍ) অনেক আত্মা, কেউ আবার (رَبَّ نَفْسٍ) অনেক ব্যক্তি অর্থও করেছেন। যা হোক উদ্দেশ্য হলোঃ
১। এরা দুনিয়াতে অর্থের কারণে ভাল ভাল কাপড় পড়ে থাকবে কিন্তু আখিরাতে ‘আমল এবং সাওয়াববিহীন (উলঙ্গসম) উঠবে।
২। এরা দুনিয়াতে এত পাতলা এবং মসৃণ কাপড় পরিধান করত যে, মানুষের মনে হতো যেন ওটা পোষাকই নয়, বরং কাপড় পরেও হয়েছে তা উলঙ্গসম। এরই পরিণামে তারা আখিরাতে উলঙ্গ হয়ে উঠবে।
৩। তারা দুনিয়াতে আল্লাহর নি‘আমাত দ্বারা আবৃত কিন্তু তার শুকরিয়া আদায়ে মুক্ত বা উলঙ্গ থেকে আখিরাতে তারা সাওয়াব বা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত থাকবে।
৪। তাদের দেহ হবে পোষাক আবৃত কিন্তু পিছন থেকে ওড়না বাঁধা থাকায় বক্ষ উন্মুক্ত হয়ে যাবে, ফলে তারা উলঙ্গসম হয়ে পড়বে আর এজন্য ক্বিয়ামাতে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।
৫। সে নেককার স্বামীর সাথে যেন পোষাক আবৃত অবস্থায়ই ছিল কিন্তু ক্বিয়ামাতের (কিয়ামতের) দিন নিজের ‘আমল শূণ্য উলঙ্গ হয়ে উঠবে।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২৩-[৫] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ’যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (বুখারী, মুসলিম)[1]
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, কে আছে যে এমন সত্তাকে কর্য দেবে যিনি ফকীর নন, না অত্যাচারী এবং সকাল পর্যন্ত এ কথা বলতে থাকেন।
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ؟ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ؟ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ؟
وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ: ثُمَّ يَبْسُطُ يَدَيْهِ وَيَقُولُ: «مَنْ يُقْرِضُ غَيْرَ عَدُومٍ وَلَا ظَلُومٍ؟ حَتَّى ينفجر الْفجْر»
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলার আসমানে অবতরণের ধরণ ও প্রকৃতি হলো তার পবিত্র স্বকীয় সত্ত্বার জন্য যেভাবে শোভন সেভাবেই। এর অর্থ এতটুকু গ্রহণ করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। রাতের শেষ তৃতীয়াশং হলো দু‘আ কবূলের সময় এবং ব্যাপক রহমাতের ও মাগফিরাতের অনুপম মুহূর্ত। আল্লাহর রহমাত কল্যাণ ও মাগফিরাত অনুসন্ধানীর জন্য উচিত হলো তা গ্রহণ করা এবং তা যেন কোনভাবেই ছুটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা। আরো কর্তব্য হলো শারী‘আতের এই সীমাতে পরিতুষ্ট থাকা এর অতিরিক্ত না করা। সমস্যা দেখা দিয়েছে ‘অবতরণ’ নিয়ে, কেননা অবতরণ হলো স্বশরীরে উপর থেকে নিচে স্থানান্তরিত হওয়া, অথচ আল্লাহ এ থেকে পবিত্র। মুহাদ্দিসগণ এ জাতীয় হাদীসকে ‘মুতাশা বিহাতে’র অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকেন। ‘উলামাগণ এক্ষেত্রে দু’দলে বিভক্ত হয়েছেন, প্রথম দল তারা এটাকে ইজমালীভাবে নিয়ে এর প্রকৃতি ও ধরণকে যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে রেখে এর অর্থকে আল্লাহর উপর সোপর্দ করেছেন। এটা মু’মিনদের একটি দলের মত যারা আল্লাহকে ধরণ ও প্রকৃতি থেকে পবিত্র মনে করেন, জমহূর ‘উলামাহ্ এবং আয়িম্মায়ে আরবাআর এটাই মত।
দ্বিতীয় আরেক দল এর তাবিল ও ব্যাখ্যাকারী দল। তারা এ জাতীয় কথার নানা ব্যাখ্যা করে থাকেন, যেমনঃ তারা বলেন, আল্লাহর অবতরণ হলো তার মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তার নির্দেশ নিয়ে অবতরণ করা; অথবা এটি আল্লাহ তার রহমাত, অনুগ্রহ দ্বারা দু‘আকারীর দু‘আ এবং আশ্রয় প্রার্থনাকারীর আহবান শোনার জন্য এবং তা কবূলের জন্য এগিয়ে আসার একটি ইঙ্গিতমূলক রূপক কথা। ক্বাযী বায়যাবী বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর অঢেল ও পরিপূর্ণ রহমাত। কেউ কেউ তাবিল করতে করতে সীমালঙ্ঘন করে ফেলেছেন, এমনকি এটাকে তারা তাহরীফ বা বিকৃত করে ফেলেছে। এরা হলো মুশাবিবহী সম্প্রদায়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ বিকৃত চিন্তার বহু ঊর্ধ্বে।
আবার আরেক শ্রেণীর লোক তারা এতদসংক্রান্ত হাদীসগুলোকেই অস্বীকার করে থাকে, এরা হলো খারিজী এবং মুতাযিলা সম্প্রদায়। এরা কুরআনের মধ্যে তাবিল পর্যন্ত করে থাকে, অবশ্য অজ্ঞতা এবং হঠকারিতার কারণেই তারা এ কাজ করে থাকে।
শায়খুল হাদীস আল্লামা মুবারকপূরী (রহঃ) বলেন, আমাদের নিকট হক হলো জমহূর সালাফগণ যা গ্রহণ করেছেন। কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে সহীহায় ইজমালীভাবে যা বিধৃত হয়েছে আমরা তার প্রতি ঈমাণ গ্রহণ করি, আর আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া এবং তার ধরণ প্রকৃতি ইত্যাদি থেকে পবিত্র মনে করি। আমরা অহেতুক তাবিল থেকে বিরত থেকে তার প্রতি ঈমান রাখাই জরুরী মনে করি। আল্লাহ তা‘আলার নাযিল হওয়া সংক্রান্ত হাদীস এবং সাদৃশ্য বিষয়ক বর্ণনাগুলো নিয়ে আমাদের পূর্বসুরী ইমামগণ যেমন ইমাম ইবনু তায়মিয়্যাহ্, হাফিয ইবনুল ক্বইয়্যূম হাফিয যাহাবী বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রত্যেক রাতেই অবতরণ বলতে রাতের নির্দিষ্ট কিছু সময় আর সেটা হলো রাতের শেষ প্রহর। অবশ্য সেই নির্দিষ্ট সময় নিয়ে ছয়টি মতামত রয়েছে।
প্রথম মতটি যা এ হাদীসেই বলা হয়েছে অর্থাৎ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, এটি এতদসংক্রান্ত বর্ণনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অধিক সহীহ বর্ণনা। হাফিয ইরাক্বীও এমন কথাই বলেছেন।
দ্বিতীয় মতঃ দ্বিতীয় মত হলো রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে। ইমাম মুসলিম এবং তিরমিযী এ মতামতই পেশ করেছেন।
তৃতীয় মতঃ যখন রাতের শেষ অর্ধ অবশিষ্ট থাকে।
চতুর্থ মতঃ চতুর্থ দলের মতে রাতের বড় একটা অংশ চলে গেলে অথবা শেষ তৃতীয়াংশে।
পঞ্চম মতঃ যখন রাতের অর্ধেক অথবা তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়।
ষষ্ঠ মতঃ এ সময়টি মুতলাক্ব, এর জন্য সুনির্দিষ্ট কোন সময় নেই।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন রকম বর্ণনার প্রেক্ষিতে ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি সময় সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, যখন যেটা প্রয়োজন সেটা বলেছেন।
মুল্লা ‘আলী আলী ক্বারী বলেন, কোন বর্ণনা কোন বর্ণনার পরিপন্থী নয় কারণ হতে পারে আল্লাহ আজকে রাতে প্রথম প্রহরে, পরের দিন অর্ধ রাতে তার পরদিন শেষ রাতে অবতরণ করেন ইত্যাদি।
ইবনু হাজার আস্ক্বালানী (রহঃ) বলেন, হতে পারে আল্লাহ একই রাতে বারবার অবতরণ করেন প্রথম প্রহরে মধ্যরাতে শেষ রাতে ইত্যাদি। সুতরাং কোন হাদীস কোন হাদীসের বিরোধী নয়। এরপর দু‘আ, সাওয়াল (চাওয়া) এবং ইস্তিগ্ফার (ক্ষমা প্রার্থনা) মোট তিনটির কথা বলা হয়েছে; এগুলো শব্দ পার্থক্য মাত্র অর্থ একই এর উদ্দেশ্যও এক।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২৪-[৬] জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, রাত্রে এমন একটা সময় অবশ্যই আছে, কোন মুসলিম যদি এ সময়টা প্রাপ্ত হয় এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের কোন কল্যাণ করে তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে তা অবশ্যই দান করেন। এ সময়টা প্রতি রাত্রেই আসে। (মুসলিম)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ فِي اللَّيْلِ لَسَاعَةً لَا يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللَّهَ فِيهَا خَيْرًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاه وَذَلِكَ كل لَيْلَة» رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: রাতের এই শুভ সন্ধিক্ষণটি আল্লাহ তা‘আলা মুবহাম বা অস্পষ্টকারে রেখেছেন যেন উহা পাওয়ার আশায় মানুষ রাতভরই আল্লাহর ‘ইবাদাত করে এবং তার কাছে চায়। রাতের এই মুহূর্তে নারী পুরুষ যে কেউই আল্লাহর কাছে দুনিয়া আখিরাতের যা কিছু চাক না কেন তা দিয়ে থাকেন; এ দেয়া হাকীকী হুকমী উভয়ই হতে পারে। আর তা নির্দিষ্ট কোন রাতের জন্যও নয় বরং প্রত্যহ রাতেই এ দানের দরজা উন্মুক্ত হয়। আল্লামা নাবাবী (রহঃ) বলেন, প্রতি রাতই দু‘আ কবূল হওয়া স্বীকৃত, তাই সারা রাতই দু‘আ করা উচিত যেন ঐ মোক্ষম সময়টুকু মিলে যায়।
‘আযীযী বলেন, শায়খ বলেছেন, প্রকাশ্য হাদীসে সময়কে নির্দিষ্ট করা হয়নি। কিন্তু সর্বজনবিদিত কথা হলো মধ্যরাতেই উত্তম এবং মধ্য রাতের পর হতে রাতের শেষ পর্যন্ত হলো ঐ উপযোগী সময়।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২৫-[৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার নিকট সকল সালাতের মাঝে দাঊদ (আঃ)-এর সালাত এবং সকল সওমের মাঝে দাঊদ (আঃ)-এর সওম সবচেয়ে বেশী প্রিয়। তিনি অর্ধেক রাত্র ঘুমাতেন। এক-তৃতীয়াংশ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করতেন। তারপর রাতের ষষ্ঠাংশে আবার ঘুমাতেন। আর তিনি একদিন সওম পালন করতেন এবং একদিন সওম ছেড়ে দিতেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَحَبُّ الصَّلَاةِ إِلَى اللَّهِ صَلَاةُ دَاوُدَ وَأَحَبُّ الصِّيَامِ إِلَى اللَّهِ صِيَامُ دَاوُدَ كَانَ يَنَامُ نِصْفَ اللَّيْلِ وَيَقُومُ ثُلُثَهُ وَيَنَامُ سُدُسَهُ وَيَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا»
ব্যাখ্যা: দাঊদ (আঃ) অর্ধরাত ঘুমাতেন, এ কথার অর্থ এই নয় যে, সূর্যাস্ত থেকে হিসাব করে অর্ধেক রাত পর্যন্ত বরং এর অর্থ হলো রাতের নিদ্রা গমনের পর হতে আধা রাত পর্যন্ত। তিনি রাতের সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) শেষে আবার এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন, এটা ছিল ইস্তিরাহাত বা সাময়িক ক্লান্তি দূর করার নিদ্রা। এভাবে তিনি সারা বছর ‘ইবাদাত করতেন। শরীরের জন্য এটা সহায়কও বটে কারণ সারা রাত জাগলে শরীর ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে যায়, দিনে সে পূর্ণমাত্রায় আল্লাহর যিকর আদায় করতে পারেনা। উপরন্ত রাতের ‘ইবাদাতটা রিয়া থেকেও অনেকাংশে মুক্ত।
দাঊদ (আঃ)-এর সওমটাও ছিল অনুরূপ। তিনি সারা বছর সওম পালন করতেন। তবে তা একদিন পর পর। ইবনু মুনীর (রহঃ) বলেন, দাঊদ (আঃ) দিন-রাতকে নিজের জন্য এবং তার রবের জন্য ভাগ করে নিতেন। রাতে তার রবের অংশে প্রত্যহ তিনি সালাতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন আর তার প্রভুর দিনের অংশে ওযর না থাকলে সিয়াম পালন করতেন, এটাকেই বুঝানো হয়েছে তিনি একদিন রোযা রাখতেন একদিন ইফত্বার করতেন। বলা হয়েছে নাফসের উপর (অর্থাৎ নাফস্ দমনে) এই পদ্ধতির সওম অধিক কার্যকর। আল্লাহর কাছে প্রিয় বা পছন্দনীয় সওম যেহেতু এটা, সুতরাং এটাই উত্তম সওমও বটে। কোন কোন বর্ণনায় তো সরাসরি বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে উত্তম সওম হলো দাঊদ (আঃ)-এর সওম।’ এ পদ্ধতি উত্তম হওয়ার বহুবিধি কারণ রয়েছে। যেহেতু এটা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিয়াম, সিয়াম ভঙ্গের দিনগুলোতে সে তার নাফসের হক, তার পরিবারের হক, সাক্ষাৎকারী আত্মীয়ের হকসমূহ আদায় করতে পারেন। কিন্তু সিয়ামুদ্ দাহর (সর্বদা সিয়াম) পালনকারীরা তা আদায় করতে পারে না। অনুরূপভাবে রাতের সালাতের জন্য উত্তম সময় হলো অর্ধরাতের পরে শেষ তৃতীয় প্রহর।
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্বিয়ামুল লায়ল-এর প্রতি উৎসাহ দান
১২২৬-[৮] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রের প্রথমাংশে ঘুমাতেন, আর শেষাংশে জেগে থাকতেন। এরপর তিনি যদি তাঁর কোন স্ত্রীর নিকট যাওয়া দরকার মনে করতেন যেতেন। এরপর আবার ঘুমিয়ে যেতেন। তিনি যদি ফাজ্রের (ফজরের) পূর্বে আযানের সময় অপবিত্র অবস্থায় থাকতেন, উঠে যেতেন। নিজের শরীরে পানি ঢেলে নিতেন। আর অপবিত্র অবস্থায় না থাকলে ফাজ্রের (ফজরের) সালাতের জন্যে উযূ (ওযু/ওজু/অজু) করতেন। (ফজরের) দু’ রাক্’আত (সালাত) আদায় করে নিতেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ التَّحْرِيْضِ عَلى قِيَامِ اللَّيْلِ
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ تَعْنِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنَامُ أَوَّلَ اللَّيْلِ وَيُحْيِي آخِرَهُ ثُمَّ إِنْ كَانَتْ لَهُ حَاجَةٌ إِلَى أَهْلِهِ قَضَى حَاجَتَهُ ثُمَّ يَنَامُ فَإِنْ كَانَ عِنْدَ النداء الأول جنبا وثب فَأَفَاضَ عَلَيْهِ الماس وَإِنْ لَمْ يَكُنْ جُنُبًا تَوَضَّأَ لِلصَّلَاةِ ثُمَّ صلى رَكْعَتَيْنِ
ব্যাখ্যা: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের প্রথমাংশে ঘুমাতেন, এর অর্থ হলো প্রথম অর্ধাংশের পূর্বে, তবে ‘ইশার সালাতের পূর্বে তিনি ঘুমাতেন না। কেননা ‘ইশার পূর্বে ঘুমানো তিনি পছন্দ করতেন না। রাত্রি জাগরণকে হায়াতের অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, নিদ্রাকে মৃত্যুর সাথে সাদৃশ্য দেয়ার কারণে। কেননা নিদ্রা হলো জাগরণের বিপরীত।
অতঃপর যদি তার স্ত্রীদের প্রতি প্রয়োজন হতো। অর্থাৎ রাত্রিকালীন সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) এবং আল্লাহর গুণগান মহিমা পেশ করার পর তার জৈবিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজন হলে তিনি তা পূরণ করতেন। এখানে একটি কথা গ্রহণীয় যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে উঠে আগে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন তার পর তার স্ত্রীদের নিকট গিয়ে নিজের চাহিদা পূরণ করতেন। শিক্ষণীয় বিষয় হলো আল্লাহর ‘ইবাদাতকে নিজের প্রবৃত্তি পূরণের পূর্বেই সম্পাদন করতে হবে।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, শেষ রাতের দিকে বিলম্ব করে স্ত্রী গমন উত্তম। কেননা রাতের প্রথমাংশে পেট ভরা থাকে, আর ভরা পেটে এ কাজ সর্বসম্মতভাবে ক্ষতিকর। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্রতার আবশ্যকতা দেখা দিলে তিনি কখনে অলসতা করতেন না, দ্রুত গোসল করে নিতেন। সুতরাং শিক্ষণীয় বিষয় হলো আল্লাহর ‘ইবাদাতকে অতীব গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে অলসতা করা যাবে না।