ক- নফল সালাত শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:
বান্দার ওপর আল্লাহর অশেষ নি‘আমত হচ্ছে তিনি মানুষের স্বভাব উপযোগী নানা ধরণের ইবাদতের ব্যবস্থা করেছেন। এর দ্বারা তিনি সঠিকভাবে বান্দার থেকে আরোপিত কাজ বাস্তবায়ন করেন। যেহেতু মানুষ ভুল-ত্রুটি করে। তাই আল্লাহ এসব ভুলের ক্ষতিপূরণে বিকল্প আমলের ব্যবস্থা করেছেন। আর তা হলো নফল সালাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, নফল সালাত ফরয সালাতের পরিপূরক। মুসল্লি যদি ফরয সালাত পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে না পারে তবে নফল সালাত তার পরিপূরক হয়।
খ- সর্বোত্তম নফল ইবাদত:
সর্বোত্তম নফল ইবাদত হলো আল্লাহর পথে জিহাদ। অতঃপর দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ١١﴾ [المجادلة: ١١]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন।
অতঃপর নফল সালাত। এটি সর্বোত্তম শারীরিক ইবাদাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«اسْتَقِيمُوا، وَلَنْ تُحْصُوا، وَاعْلَمُوا أَنَّ خَيْرَ أَعْمَالِكُمُ الصَّلَاةَ»
“তোমরা (দীনের ওপর) অবিচল থাকো, আর তোমরা কখনও তা যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না। জেনে রাখো, তোমাদের আমালসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সালাত।”[1]
নফল সালাতের মধ্যে অন্যতম হলো:
ক- সালাতুল লাইল তথা তাহাজ্জুদের সালাত:
সালাতুল লাইল তথা রাতের সালাত দিনের সালাতের চেয়ে উত্তম, আবার রাতের শেষার্ধের সালাত প্রথমার্ধের চেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا إِذَا مَضَى شَطْرُ اللَّيْلِ».[2]
“যখন রাতের অর্ধেক অতিবাহিত হয় তখন আমাদের সুমহান রব প্রতি রাতে পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন।” [3][মুসলিম]
তাহাজ্জুদ হলো ঘুমের পরে যে সালাত পড়া হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেছেন, রাতের বেলায় ঘুম থেকে জেগে উঠে সালাত আদায় করা হলো নাশিয়াতুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ সালাত।
খ- সালাতুদ-দোহা:
মাঝে মাঝে সালাতুদ্দোহা আদায় করা সুন্নাত। আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي الضُّحَى حَتَّى نَقُولَ لاَ يَدَعُ، وَيَدَعُهَا حَتَّى نَقُولَ لاَ يُصَلِّي.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে সালাতুদ-দোহা আদায় করতেন যে, আমরা বলতাম তিনি হয়ত আর পরিত্যাগ করবেন না। আবার যখন তা আদায় করা থেকে বিরত থাকতেন তখন আমরা বলতাম যে, হয়ত তিনি আর তা আদায় করবেন না”।[4]
সালাতুদ-দোহার সর্বনিম্ন সংখ্যা দুরাক‘আত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার ও ছয় রাকাত আদায় করেছেন। আর সালাতুদ-দোহার সর্বোচ্চ সংখ্যা আট রাকাত। এ সালাত সর্বদা আদায় করা শর্ত নয়।
গ- তাহিয়্যাতুল মাসজিদ:
মসজিদে প্রবেশ করে তাহিয়্যাতুল মাসজিদের সালাত আদায় করা সুন্নাত। আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ المَسْجِدَ، فَلاَ يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ»
“তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন দু’ রাকাত সালাত না পড়া পর্যন্ত না বসে।”[5] (বহু হাদীস প্রণেতারা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
ঘ- তিলাওয়াতের সাজদাহ:
কুরআন তিলাওয়াতকারী ও শ্রবণকারী উভয়ের জন্য তিলাওয়াতের সাজদাহ দেওয়া সুন্নাত। তাকবীর বলে সাজদাহ দিবে এবং সাজদাহ থেকে উঠে সালাম ফিরাবে। সাজদায় সুবহানা রাব্বিআল ‘আলা বা সাজদায় যেসব দো‘আ পড়া হাদীসে এসেছে সেগুলো পড়া।
ঙ- শুকরিয়ার সাজদাহ:
কোন নি‘আমত প্রাপ্ত হলে বা বিপদাপদ কেটে গেলে শুকরিয়ার সাজদাহ দেওয়া সুন্নাত। কেননা আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«كَانَ إِذَا أَتَاهُ أَمْرٌ يَسُرُّهُ أَوْ بُشِّرَ بِهِ، خَرَّ سَاجِدًا»
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনো খুশির খবর আসলে তিনি আল্লাহর সমীপে সাজদায় লুটিয়ে পড়তেন।
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খাওয়ারেজদের মধ্যে ‘যুসসুদাইয়্যা’ পেয়ে শুকরিয়ার সাজদাহ করেছেন। (মুসনাদ আহমাদ)
তাছাড়া কা‘ব ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর তাওবা কবুলের সুসংবাদ তার কাছে পৌঁছলে তিনি সাজদাহ করেন। তার এ ঘটনা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। এ সাজদার নিয়ম ও বিধান তিলাওয়াতের সাজদার মতোই।
চ- তারাবীহর সালাত:
তারাবীহর সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সুন্নাত চালু করেছেন। রমযান মাসে ইশার সালাতের পরে মসজিদে জামা‘আতের সাথে এ সালাত আদায় করতে হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সালাতের জামা‘আত চালু করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর খিলাফাত কালে এ সুন্নাত পুনর্জীবিত করেছেন। উত্তম হলো এগারো রাকাত পড়া, তবে এর চেয়ে বেশি পড়লেও কোনো অসুবিধে নেই। রমযানের শেষ দশকে কিয়ামুল লাইল, যিকির ও দো‘আ বেশি পরিমাণে করার চেষ্টা করা।
ছ- বিতরের সালাত:
বিতরের সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সালাত পড়েছেন এবং তা আদায় করতে আদেশ করেছেন। বিতরের সালাত সর্বনিম্ন এক রাকাত। তিন রাকাত হলো পরিপূর্ণভাবে আদায় এবং সর্বোচ্চ এগারো রাকাত।
বিতরের সালাতের সময়:
ইশা ও ফজর সালাতের মধ্যবর্তী সময়। রুকু থেকে উঠে দো‘আ কুনূত পড়া মুস্তাহাব।
বিতরের সালাতের নিয়ম:
১- একসাথে সব রাকাত পড়বে, তাশাহহুদের জন্য বসবে না, শুধু শেষ রাকাতে তাশাহহুদ পড়বে।
২- যত রাকাত পড়বে তার শেষ রাকাতের আগের রাকাতে বসে তাশাহহুদ পড়বে, অতঃপর সালাম না ফিরিয়ে দাঁড়াবে, অতঃপর এক রাকাত পড়বে, তারপরে তাশাহহুদ ও সালাম ফিরাবে।
৩- প্রত্যেক দুই রাকাতে সালাম ফিরাবে, অতঃপর এক রাকাত পড়বে ও এতে তাশাহহুদ ও সালাম ফিরাবে। এ পদ্ধতিটি সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পদ্ধতিতে বিতরের সালাত আদায় করেছেন এবং সর্বদা এভাবেই আদায় করেছেন।
জ- সুন্নাতে রাতেবা বা ফরয সালাতের আগে পিছের নফলসমূহ:
সুন্নাতে রাতেবা বা ফরযের আগে পরের সালাতের মধ্যে সর্বোত্তমটি হচ্ছে, ফজরের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নাত। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে,
«رَكْعَتَا الْفَجْرِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا»
“ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত দুনিয়া এবং তদস্থিত সমুদয় বস্তু থেকেও উত্তম।”[6] (ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
সুন্নাতে রাতেবা মুয়াক্কাদাহ বা ফরযের আগে পরে মোট বারো রাকাত তাকীদ দেওয়া সুন্নাত রয়েছে, সেগুলো হলো, যোহরের আগে চার রাকাত ও পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পরে দুই রাকাত, ইশার পরে দুই রাকাত ও ফজরের আগে দুই রাকাত।কারো সুন্নাতে রাতেবা বা ফরযের আগে পরের সুন্নাত ছুটে গেলে কাযা করা সুন্নাত। আর বিতরের কাযা জোড় সংখ্যায় করতে হবে, তবে একাধিক ফরয কাযা হলে তখন কষ্টকর হওয়ার কারণে বিতর কাযা করতে হবে না, তবে ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত কাযা করবে, যেহেতু এ ব্যাপারে তাগিদ এসেছে। ফরয ও জামা‘আতে পড়া যায় এমন সালাত ব্যতীত সব নফল সালাত ঘরে পড়া উত্তম।
>[2] হাদীসের মূল নসটি এভাবে, [অনুবাদক] «يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ». “আমাদের রব প্রতি রাতের যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৪৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৫৮) অথবা নসটি এভাবে হবে, [অনুবাদক]
«إِذَا مَضَى شَطْرُ اللَّيْلِ، أَوْ ثُلُثَاهُ، يَنْزِلُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا».
[3] সহীহ বুখারী, জুমু‘আ, হাদীস নং ১০৯৪; সহীহ মুসলিম, সালাতুল মুসাফিরীন ওয়াকাসরিহা, হাদীস নং ৭৫৮; তিরমিযী, সালাত, হাদীস নং ৪৪৬; আবু দাউদ, সালাত, হাদীস নং ১৩১৫; ইবন মাজাহ, ইকামাতুস সালাহ ওয়াসসুন্নাতু ফিহা, হাদীস নং ১৩৬৬; মুসনাদ আহমদ, ২/২৬৭; মালিক, নিদা লিসসালাহ, হাদীস নং ৪৯৬; সুনান দারেমী, সালাত, হাদীস নং ১৪৭৮।
[4] তিরমিযী, সালাত, হাদীস নং ৪৭৭; আহমদ, ৩/৩৬।
[5] সহীহ বুখারী, জুমু‘আ, হাদীস নং ১১১৪; সহীহ মুসলিম, সালাতুল মুসাফিরীন ওয়াকাসরিহা, হাদীস নং ৭১৪; তিরমিযী, সালাত, হাদীস নং ৩১৬; নাসাঈ, আল-মাসাজিদ, হাদীস নং ৭৩০; আবু দাউদ, সালাত, হাদীস নং ৪৬৭; ইবন মাজাহ, ইকামাতুস সালাহ ওয়াসসুন্নাতু ফিহা, হাদীস নং ১০১৩; আহমদ, ৫/৩১১; দারেমী, সালাত, হাদীস নং ১৩৯৩।
[6] সহীহ মুসলিম, সালাতুল মুসাফিরীন ওয়াকাসরিহা, হাদীস নং ৭২৫; তিরমিযী, সালাত, হাদীস নং ৪১৬; নাসাঈ, কিয়ামুল লাইল ওয়াতাতাও‘উন নাহারি, হাদীস নং ১৭৫৯; আহমদ, ৬/২৬৫।