কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জ, উমরাহ ও মদীনা যিয়ারত অষ্টম অধ্যায় শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)
হাজ্জের রুকন বা ফরয ও ওয়াজিবসমূহ

হাজ্জের ওয়াজিবগুলি দু’ভাগে বিভক্ত:

এক প্রকারের ওয়াজিব যা ছাড়া হাজ্জ শুদ্ধ হয় না। অপর এক প্রকারের ওয়াজিব, যা ব্যতীত হাজ্জ শুদ্ধ হতে পারে। (তবে তা ছুটে গেলে কুরবানী দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে হবে)

যে সব ওয়াজিব যা ছাড়া হাজ্জ শুদ্ধ হয় না তাকে ফিকহের পরিভাষায় রুকন (ফরয) ও বলা হয়। আর তা হচ্ছে:

১। ইহরাম বাঁধা। তা হচ্ছে হাজ্জে প্রবেশ করার নিয়্যাত করা। এর প্রমাণ নাবী (সা.) এর বাণী:

إنّمَا الأَعْمَالُ بالنِّيّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امرِىءٍ مَا نَوَى

নিশ্চয়ই সমস্ত আমল (কর্ম) নির্ভরশীল নিয়্যাতের উপর। আর নিঃসন্দেহে প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যার নিয়্যাত করবে।[1]

আর হাজ্জের ইহরাম করার সময় শুরু হয় শাওয়াল মাসের প্রথম থেকে। এর দলীল মহান আল্লাহর বাণী:

الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَّعْلُومَاتٌ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلاَ رَفَثَ وَلاَ فُسُوقَ وَلاَ جِدَالَ فِي الْحَجِّ

হাজ্জ কয়েকটি নির্দিষ্ট মাসে, অতঃপর এ মাসগুলোতে যে কেউ হাজ্জ করার মনস্থ করবে, তার জন্য হজ্জের মধ্যে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়।[2]

আর এ মাসগুলির প্রথম মাস হচ্ছে শাওয়াল মাস এবং শেষ মাস হচ্ছে যিলহজ্জ মাস। আর ইহরাম করার জন্য নির্ধারিত স্থানসমূহ হচ্ছে পাঁচটি; যা পূর্বে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।

২। আরাফায় অবস্থান করা। দ্বিতীয় রুকুন হচ্ছে, ৯ই যিলহাজ্জ আরাফায় অবস্থান করা। এর দলীল মহান আল্লাহর বাণী:

فَإِذَا أَفَضْتُم مِّنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُواْ اللّهَ عِندَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ

আর যখন তোমরা আরাফাত হতে ফিরবে তখন মাশ‘আরুল হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করবে।[3]

আর নাবী (সা.) বলেছেন:

الْحَجُّ عَرَفَةُ مَنْ جَاءَ لَيْلَةَ جَمْعٍ قَبْلَ طُلُوعِ الْفَجْرِ فَقَدْ أَدْرَكَ الْحَجَّ

হাজ্জ হচ্ছে আরাফায় অবস্থানের নাম। সুতরাং যে ব্যক্তি মুযদালিফার রাত্রে ফজর হওয়ার পূর্বে (আরাফায়) এসে পৌঁছবে সে হাজ্জ পেয়ে গেল।[4]

আর আরাফায় অবস্থানের সময় হচ্ছে, ৯ যিলহাজ্জ মাথার উপর থেকে সূর্য ঢলার পর হতে ১০ যিলহাজ্জের ফজর হওয়া পর্যন্ত। কারণ, নাবী (সা.) সূর্য ঢলার পরই আরাফায় অবস্থান করেছেন এবং তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি মুযদালিফার রাত্রে ফজর হওয়ার পূর্বে (আরাফায়) এসে পৌঁছাবে সে হাজ্জ পেয়ে যাবে। তবে কিছু আলিমগণ বলেছেন যে, আরাফায় অবস্থানের সময় শুরু হয়, ৯ই যিলহাজ্জ ফজর সময় থেকে। আর অবস্থানস্থল হচ্ছে আরাফার পুরো ময়দান। কারণ, নাবী (সা.) বলেছেন:

وَقَفْتُ هَاهُنَا وَعَرَفَةُ كُلُّهَا مَوْقِفٌ

আমি এখানে (আরাফায়) অবস্থান করলাম। তবে আরাফার সব জায়গায় হচ্ছে অবস্থানের জায়গা।[5]

৩। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ইফাযাহ করা। হাজ্জের তৃতীয় রুকন হচ্ছে কা‘বা ঘরের তাওয়াফে ইফাযাহ (যিয়ারাহ) করা। এর দলীল মহান আল্লাহর বাণী:

وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ

আর তারা যেন প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।[6]

আর নাবী (সা.) যখন জানতে পারলেন যে, সাফিয়াহ্ (রা.)-এর মাসিক ঋতু শুরু হয়ে গিয়েছে, তখন তিনি বললেন: তাহলে কি সে আমাদেরকে বিদায় হতে বিলম্ব করতে বাধ্য করবে? তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! সে তো কা’বা ঘরের তাওয়াফে ইফাযাহ করে নেয়ার পর তার হায়য (মাসিক ঋতু) এসেছে। তখন নাবী (সা.) বললেন, তাহলে সে মক্কা হতে প্রস্থান করতে পারবে। নাবী (সা.)-এর এ বাণী,

أَحَابِسَتُنَا هِيَ

সে কি আমাদেরকে বিদায় হতে বিলম্ব করতে বাধ্য করবে?[7]

এটা প্রমাণ করে যে, তাওয়াফে ইফাযা ফরয, যা অবশ্যই আদায় করতে হবে। কেননা তা যদি ফরয না হত তাহলে তাঁদের বিলম্ব করতে বাধ্য করার কারণ হতে পারে না। তাই যখন নাবী (সা.)-কে বলা হল যে, সাফিয়াহ্ তাওয়াফে ইফাযাহ করে নিয়েছে, তখন তিনি মক্কা থেকে প্রস্থানের অনুমতি দিলেন।

আর তাওয়াফে ইফাযার সময় হচ্ছে, আরাফা ও মুযদালিফায় অবস্থানের পরে। যার প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী:

ثُمَّ لْيَقْضُوا تَفَثَهُمْ وَلْيُوفُوا نُذُورَهُمْ وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ

অতঃপর তারা যেন তাদের দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানৎ পূর্ণ করে আর প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।[8]

আর দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করা এবং মানৎ পূর্ণ করা, আরাফা এবং মুযদালিফায় অবস্থানের পরই হয়ে থাকে।

৪। সাফা ও মারওয়ার সাঈ করা। ইহা হচ্ছে হাজ্জের চতুর্থ রুকন।

যার দলীল মহান আল্লাহর বাণী:

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْراً فَإِنَّ اللّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ

নিশ্চয়ই ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম। কাজেই যে ব্যক্তি কাবাগৃহের হাজ্জ অথবা উমরা করবে, এ দু’টোর সাঈ করাতে তাদের কোন গুনাহ নেই।[9]

আর আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, আমাদেরকে আল্লাহর রসূল (সা.) তারবিয়ার দিন বিকেল বেলা হাজ্জের তালবিয়া উচ্চারণ করতে নির্দেশ দিলেন। অতঃপর হাজ্জের কার্যাবলী সমাপ্ত হলে আমরা মক্কা এসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ করি। এর মাধ্যমে আমাদের হাজ্জ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। আর নাবী (সা.) আয়িশা (রা.)-কে সম্বোধন করে বলেন:

يُجْزِئُ عَنْكِ طَوَافُكِ بِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ عَنْ حَجِّكِ وَعُمْرَتِك

তোমার হাজ্জ ও উমরার জন্য সাফা ও মারওয়ার সাঈ করা যথেষ্ট।[10] আরো আয়িশা (রা.) বলেন:

مَا أَتَمَّ اللَّهُ حَجَّ امْرِئٍ وَلَا عُمْرَتَهُ لَمْ يَطُفْ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَة

মহান আল্লাহ এমন ব্যক্তির হাজ্জ ও উমরা কবুল করবেন না, যে সাফা ও মারওয়ার সাঈ না করবে।[11]

আর সাঈ করার সময় হচ্ছে তাওয়াফে ইফাযার পরে। তবে যদি কেউ তা তাওয়াফে ইফাযার আগেই সেরে নেয় তাহলে কোন অসুবিধা নেই। বিশেষ করে যদি তা ভুলে গিয়ে বা অজ্ঞতা বশতঃ হয়।

কারণ, নাবী (সা.)-কে জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসূল ! আমি তাওয়াফ করার পূর্বে সাঈ করে ফেলেছি? উত্তরে তিনি বলেন, এতে কোন অসুবিধা নেই।

এ চারটি; ইহরাম বাঁধা, আরাফায় অবস্থান, তাওয়াফে ইফাযাহ এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ হচ্ছে হাজ্জের রুকন বা ফরয, এছাড়া হাজ্জ বিশুদ্ধ হবে না।

">
[1]. সহীহ বুখারী ১ ও ইবনে মাজাহ ৪২২৭।

[2]. সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ১৯৭

[3]. সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ১৯৮

[4]. সহীহ: মুসনাদ আহমাদ ১৮৭৭৪ , নাসাঈ ৩০১৬, তিরিমিযী ৮৮৯ ও ইবনু মাজাহ ৩০১৫।

[5]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।

[6]. সূরা আল-হজ্জ ২২ঃ ২৯

[7]. সহীহ বুখারী ১৭৫৭, ১৭৩৩, সহীহ মুসলিম ১২১১।

[8]. সূরা আল-হাজ্জ ২২ঃ ২৯

[9]. সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ১৫৮

[10]. সহীহ মুসলিম ১২১১।

[11]. সহী বুখারী ১৭৯০ ও সহীহ মুসলিম ১২৭৭।