৮০. রোগ-বালাই হওয়া :
মুসলিম ব্যক্তির কোন রোগ হলে তার যে কষ্ট হয় তার বিনিময়েও আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করেন। মু’মিন ব্যক্তির যে কোন রোগ হলে এর বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন। হাদীসে কী পরিমাণ গুনাহ মাফ করা হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তাই আশা করা যায় আল্লাহ এর মাধ্যমে সকল সগীরা গুনাহ মাফ করবেন। নাবী (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيبُه أَذًى مِنْ مَرَضٍ فَمَا سِوَاهُ إِلَّا حَطَّ اللهُ بِه سَيِّئَاتِه كَمَا تَحُطُّ الشَّجَرَةُ وَرَقَهَا
‘‘কোন মুসলিম যখনই কোন রোগ অথবা অন্য কিছুর মাধ্যমে কষ্ট পায়, কাঁটা বিধে বা তার চেয়েও কঠিন কষ্ট হয়, আল্লাহ তা‘আলা এর কারণে তার গুনাহসমূহকে মোচন করে দেন এবং তার গুনাহসমূহকে এভাবে ঝরিয়ে দেয়া হয় যেভাবে গাছ তার পাতা ঝরিয়ে দেয়।’’[1]
জাবির হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নাবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
مَا مِنْ مُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ وَلَا مُسْلِمٍ وَلَا مَسْلَمَةٍ يَمْرَضُ مَرَضًا إِلَّا قَصَّ اللهُ بِه عَنْهُ مِنْ خَطَايَاهُ
‘‘যে কোন মু’মিন পুরুষ অথবা নারী, যে কোন মুসলিম পুরুষ অথবা নারী রোগাক্রান্ত হয় এর বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহরাশি মোচন করে দেন।’’[2]
জাবির (রাঃ) বলেন, উম্মে সায়িব বা উম্মে মুসাইয়িব-এর জ্বর হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মে সায়িব বা উম্মে মুসাইয়িব! তোমার কী হয়েছে যে, থরথর করে কাঁপছো? সে বললো, জ্বর হয়েছে, আল্লাহ তাতে বরকত না দিন। (এ কথা শুনে) রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন :
لَا تَسُبِّى الْحُمّٰى فَإِنَّهَا تُذْهِبُ خَطَايَا بَنِى آدَمَ كَمَا يُذْهِبُ الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ
‘‘জ্বরকে গালি দিও না। জ্বর তো আদম সন্তানের পাপ মোচন করে যেমন হাপর লোহার ময়লা দূর করে।’’[3]
‘আবদুর রহমান ইবন সা‘ঈদ তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন :
كُنْتُ مَعَ سَلْمَانَ وَعَادَ مَرِيضًا فِىْ كِنْدَةَ فَلَمَّا دَخَلَ عَلَيْهِ قَالَ : أَبْشِرْ ، فَإِنَّ مَرَضَ الْمُؤْمِنِ يَجْعَلُهُ اللهُ لَه كَفَّارَةً وَمُسْتَعْتَبًا وَإِنَّ مَرَضَ الْفَاجِرِ كَالْبَعِيرِ عَقَلَه أَهْلُه ثُمَّ أَرْسَلُوهُ فَلَا يَدْرِىْ لِمَ عُقِلَ وَلِمَ أُرْسِلَ
আমি একদিন সালমান (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তিনি তখন কিন্দায় এক রোগী দেখতে (অর্থাৎ তার কুশল জিজ্ঞেস করতে) গিয়েছিলেন। যখন তিনি তার শয্যাপাশে উপস্থিত হলেন তখন বললেন : সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দার রোগকে তার গুনাহসমূহের কাফফারাহ্ এবং কৈফিয়ত স্বরূপ গ্রহণ করেন। আর পাপী ব্যক্তির রোগ হল ঐ উটের মত যাকে তার মালিক পা মিলিয়ে বাঁধল। আবার ছেড়ে দিল অথচ সে জানল না যে কেন তাকে বাঁধা হল আর কেনই বা তাকে ছেড়ে দেয়া হল।[4]
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :
في هذه الاحاديث بشارة عظيمة للمسلمين …وفيه تكفير الخطايا بالامراض والاسقام ومصايب الدنيا وهمومها وان قلت مشقتها وفيه رفع الدرجات بهذه الامور وزيادة الحسنات وهذا هو الصحيح الذي عليه جماهير العلماء
‘‘এ হাদীসগুলোর মধ্যে মুসলিমদের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ রয়েছে।... এর মধ্যে রোগ-ব্যাধি, দুনিয়ার বিভিন্ন বিপদাপদ ও দুশ্চিন্তার বিনিময়ে গুনাহ মাফের ঘোষণা রয়েছে। যদিও এর জন্য সামান্য কষ্ট হোক না কেন এবং এগুলোর বিনিময়ে ব্যক্তির মর্যাদা উঁচু হয় এবং সাওয়াব বৃদ্ধি পায়। জামহূর ‘আলিমগণ প্রদত্ত বিশুদ্ধ মত এটিই।’’[5]
৮১. রোগাক্রান্ত হয়ে বা রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করা :
রোগাক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। রোগাক্রান্ত হলেই যেখানে গুনাহ মাফ হয় সেখানে কেউ যদি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায় বা রোগ ভোগ করে মারা যায় তাহলে তারও গুনাহ মাফ হওয়া তো স্বাভাবিক। এ মর্মে আনাস ইবন মালিক বর্ণনা করেন যে, নাবী (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ ابْتَلَاهُ اللهُ فِىْ جَسَدِه إِلَّا كُتِبَ لَه مَا كَانَ يَعْمَلُ فِىْ صِحَّتِه، مَا كَانَ مَرِيضًا فَإِنْ عَافَاهُ أُرَاهُ قَالَ : غَسَلَه وَإِنْ قَبَضَه غَفَرَ لَه
‘‘যে কোন মুসলিমকে আল্লাহ যখন দৈহিকভাবে পরীক্ষায় ফেলে দেন (অর্থাৎ রোগগ্রস্ত করেন) তার সুস্থাবস্থায় সে যেরূপ ‘আমল করত ঠিক সেরূপ সাওয়াবই তার ‘আমলনামায় লিখিত হয় যতক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি এরূপ রোগে আক্রান্ত থাকে। অতঃপর যদি তিনি তাকে নিরোগ করেন তবে- আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি বলেছেন- তাকে তিনি (তার পাপ) ধৌত করে দেন। [অর্থাৎ তার গুনাহ হতে মুক্ত করে দেন] আর যদি তাকে মৃত্যু প্রদান করেন তবে তাকে ক্ষমা করে দেন।’’[6]
৮২. সম্পর্কচ্যুত দুই ব্যক্তির মধ্যে সর্বপ্রথম কথা বলার উদ্যোগ গ্রহণ করা :
দুই ব্যক্তির মাঝে কোনো কারণে সম্পর্ক নষ্ট হলে তাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম অপরজনের সাথে কথা বলা বা সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। আনাস ইবন মালিক-এর চাচাতো ভাই হিশাম ইবন ‘আমির আল আনসারী (যার পিতা উহুদের যুদ্ধের দিন শহীদ হন) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يُصَارِمَ مُسْلِمًا فَوْقَ ثَلَاثٍ فَإِنَّهُمَا نَاكِبَانِ عَنِ الْحَقِّ مَا دَامَا عَلٰى صِرَامِهِمَا وَإِنَّ أَوَّلَهُمَا فَيْئًا يَكُونُ كَفَّارَةً عَنْهُ سَبْقُه بِالْفَيْءِ وَإِنْ مَاتَا عَلٰى صِرَامِهِمَا لَمْ يَدْخُلَا الْجَنَّةَ جَمِيعًا أَبَدًا وَإِنْ سَلَّمَ عَلَيْهِ فَأَبٰى أَنْ يَقْبَلَ تَسْلِيمَه وَسَلَامَه رَدَّ عَلَيْهِ الْمَلَكُ وَرَدَّ عَلَى الْآخَرِ الشَّيْطَانُ
‘‘কোন মুসলিমের জন্য অপর কোন মুসলিমের সাথে তিন দিনের অধিককাল সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকা জায়িয নয়। যদি তারা এরূপ সম্পর্কচ্যুতভাবে থাকে তবে যতক্ষণ তারা এভাবে সম্পর্কচ্যুত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা দু’জনেই সত্য বিমুখ বলে গণ্য হবে। তদের মধ্যে যে প্রথম কথা বলার উদ্যোগ গ্রহণ করবে তার এই উদ্যোগ পূর্ববর্তী গুনাহসমূহের কাফ্ফারাহ্ স্বরূপ হবে। আর যদি তারা দু’জনই এরূপ সম্পর্কচ্যুতভাবে মারা যায়, তবে তারা দু’জনের কেউই কখনও জান্নাতে যেতে পারবে না। যদি তাদের একজন অপরজনকে সালাম করে আর দ্বিতীয়জন তা গ্রহণ করতে রাযী না হয় তবে তার সালামের জবাব একজন ফেরেশতা দিয়ে থাকেন, আর দ্বিতীয়জনকে জবাব দেয় শয়তান।’’[7]
৮৩. সালাম প্রদান করা ও সুন্দর কথা বলা :
মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক সালামের আদান-প্রদান অন্যতম প্রাচীন রীতি। এটি গুবই গুরুত্বপূর্ণ ‘আমল, যার মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় ও সাওয়াব অর্জিত হয়। কিন্তু সালামের সাথে সাথে সুন্দর কথা বলাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই দু’টি কাজ বান্দাকে গুনাহ থেকে মুক্তি দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
إنَّ مُوْجِبَات الْمَغْفِرَةِ بَذْلُ السَّلَامِ وَحُسْنُ الْكَلَامِ
‘‘সালাম প্রদান ও সুন্দর কথা বলা মাগফিরাত বা ক্ষমাকে আবশ্যক করে দেয়।’’[8]
[2]. আল আদাবুল মুফরাদ : ৫০৮, হাদীসটি সহীহ; আলবানী আস্ সহীহাহ্ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ২৫০৩।
[3]. সহীহ মুসলিম : ৬৭৩৫।
[4].আল আদাবুল মুফরাদ : ৪৯৩; হাদীসটি সহীহ; আলবানী তাখরীজ আহাদীস আল আদাব আল মুফরাদ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ৪৯৩।
[5]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ১৬, পৃ. ২৪৪-৪৫।
[6]. সহীহ ইবনু হিব্বান, খ. ২, পৃ. ৫৪; আল আদাব আল মুফরাদ : ৫০১; আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[7]. আল মু‘জামুল কাবীর, খ. ২২, পৃ. ১৭৫, হাদীস নং ৪৫৫; আলবানী আস্ সহীহাহ্ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ১২৪৬।
[8]. সহীহ আল জামি‘ : ২২৩২, হাদীসটি সহীহ।