৩. তাওবাহ্ করা - (ঘ) খাঁটি তাওবার শর্তাবলী ও পদ্ধতি

তাওবাহ্ খাঁটি হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। সে শর্তসমূহ পূরণ না করে তাওবাহ্ করলে সে তাওবাহ্ খাঁটি তাওবাহ্ হবে না আর তা আল্লাহর নিকট কবূলও হবে না। শর্তাবলীর সংখ্যা সর্বনিমণ ৩টি আর সর্বোচ্চ ৬টি। যদি গুনাহের সম্পর্ক শুধু আল্লাহর (অবাধ্যতার) সঙ্গে থাকে এবং কোন মানুষের অধিকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে এ ধরনের তাওবাহ্ ক্ববূলের জন্য ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ)[1]ও সাউদী আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতী শাইখ ‘আবদুল ‘আযীয বিন ‘আবদুল্লাহ বিন বায (রহিমাহুল্লাহ)[2]সহ অনেক আলিমের মতে শর্ত ৩টি। তবে কোন গুনাহ যদি মানুষের অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তাহলে আরও একটি শর্ত বেড়ে তা হয়ে যাবে ৪টি।

তবে সাউদী আরবের আরেক বিখ্যাত ‘আলিম শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে তাওবার শর্ত মোট ৫টি। তবে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করার জন্য অতিরিক্ত ১টি শর্ত যোগ হবে। তা হলো পাওনাদারকে তার হক বা অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। সুতরাং যদি এগুলোর মধ্যে একটি শর্তও বাদ পড়ে, তাহলে সেই তাওবাহ্ খাঁটি তাওবাহ্ হবে না। নিম্নে ঐ সকল শর্ত সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :

তাওবাহ্ একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে করতে হবে;

গুনাহর কাজ করার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে;

যে গুনাহ হতে তাওবাহ্ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে;

ভবিষ্যতে এই গুনাহ আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে;

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওবাহ্ করতে হবে;

মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।


এসব শর্তাবলী নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

১. তাওবাহ্ একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে করতে হবে :

মহান আল্লাহর ভয় বা সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টির ভয় বা সন্তুষ্টির উদ্দেশে তাওবাহ্ করলে সেই তাওবাহ্ কখনো কবূল হবে না। কোন মানুষকে দেখানো বা তার নৈকট্য পাওয়ার উদ্দেশে কিংবা কারো চাপে পড়ে তাওবাহ্ করলে বা সুনাম নেওয়ার জন্য তাওবাহ্ করলে অথবা কারো মন রক্ষার জন্য তাওবাহ্ করলে বা কোন স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে তাওবাহ্ করলে, সে তাওবাহ্ খাঁটি তাওবাহ্ হবে না।

তাওবাহ্ দ্বারা উদ্দেশ্য হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকাল এবং গুনাহ থেকে মুক্তি। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশে তাওবাহ্ করা যাবে না। বরং অন্য কোন উদ্দেশে তাওবাহ্ করলে গুনাহ মাফ তো হবেই না উল্টো নতুন গুনাহ ‘আমলনামায় যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টানদের পাদ্রী কিংবা মুসলিমদের পীর-দরবেশ, বুজুর্গ-মাশায়েখ, হিন্দুদের ব্রাহ্মণ-ঠাকুর-পুরোহিতের কাছে তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ নেই। তাওবাহ্ মানে তাদের পড়ানো কোন গদ নয়। তারা কেউই ব্যক্তির পাপ মোচন করতে পারে না। আল্লাহ দুনিয়ার কাউকে এমন ক্ষমতা দেননি।

তাওবাহ্ করতে হবে সরাসরি আল্লাহর কাছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে তাওবাহ্ করলে সে তাওবাহ্ কখনই আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছবে না। কবূল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বরং তা শির্ক। খ্রিষ্টান পাদ্রীরা পাপ মোচনের দায়-দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে নিয়েছে আর হিন্দু মুশরিক পুরোহিতরাও নিজেরা তাদের পদ্ধতি অনুকরণ করেছে। কিন্তু ইসলামে এগুলোর অবকাশ নেই। তবে হ্যাঁ, ‘আলিমগণ অবশ্যই তাওবার নিয়ম-কানুন শিখাতে-পড়াতে ও কালেমার তালকীন দিতে শরীয়ত অনুযায়ী সহযোগিতা ও পরামর্শ দিতে পারেন। মূলত তাওবাহ্ করার বিষয় শুধু মুখে পড়ার বিষয় নয়।


২. গুনাহের কাজ করার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে :

গুনাহ করার পর তা থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে তাওবাকারীকে অবশ্যই তার কৃতকর্মের জন্য অন্তর থেকে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে। অপরাধকর্মের কারণে লজ্জিত হওয়া খাঁটি তাওবার শর্ত। তাইতো নাবী (সা.) বলেছেন :

النَّدَمُ تَوْبَةٌ

‘‘অনুতপ্ত হওয়াই হল তাওবার মূল বিষয়।’’[3]

কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত না হয়ে, অনুতপ্ত না হয়ে যত তাওবাই করা হোক তা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। ইসলামের নীতিমালায় প্রসিদ্ধ নীতি হলো, ‘পাপকাজ করে লজ্জিত হলে পাপ কমে যায়। আর পুণ্য কাজ করে গর্ববোধ করলে পুণ্য বাতিল হয়ে যায়।’ যে পাপ কাজ করে, সে সাধারণ মানুষ। যে পাপ করে অনুতপ্ত হয়, সে নেককার মানুষ। আর যে পাপ করার পর তার বড়াই করে, সে শয়তান। এমন অনেক পাপ আছে, যা অনেক নির্বোধ মানুষের কাছে গর্বের বিষয়। ফলে পাপী সেই পাপ করে বন্ধু-বান্ধব ও জনগণের সামনে প্রকাশ করে গর্ব অনুভব করে। এর ফলে গুনাহ মাফ হওয়ার সহজ সম্ভাবনাটুকু নষ্ট হয়ে যায়। তখন তার পাপ কাজের অনেক সাক্ষী তৈরি হয়ে যায়। ফলে পাপ থেকে মাফ পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ সম্পর্কে নাবী (সা.) বলেছেন :

كُلُّ أُمَّتِى مُعَافَاةٌ إِلَّا الْمُجَاهِرِينَ وَإِنَّ مِنَ الْإِجْهَارِ أَنْ يَعْمَلَ الْعَبْدُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا ثُمَّ يُصْبِحُ قَدْ سَتَرَه رَبُّه فَيَقُولُ يَا فُلَانُ قَدْ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُه رَبُّه فَيَبِيتُ يَسْتُرُه رَبُّه وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللهِ عَنْهُ

‘‘আমার প্রত্যেক উম্মাতের পাপ মাফ করে দেয়া হবে, তবে যে প্রকাশ্যে পাপ করে (অথবা পাপ করে বলে বেড়ায়) তার পাপ মাফ করা হবে না। আর পাপ প্রকাশ করার এক ধরন এও যে, একজন লোক রাত্রে কোন পাপ করে ফেলে, অতঃপর আল্লাহ তা গোপন করে নেন। (অর্থাৎ কেউ তা জানতে পারে না।) কিন্তু সকাল বেলায় উঠে সে লোকের কাছে বলে বেড়ায়, ‘হে অমুক! গত রাতে আমি এই এই (পাপ) কাজ করেছি।’ রাতের বেলায় আল্লাহ তার পাপকে গোপন রেখে দেন; কিন্তু সে সকাল বেলায় আল্লাহর সে গোপনীয়তাকে নিজে নিজেই ফাঁস করে ফেলে।’’[4]

তাই গুনাহ হয়ে গেলে তা গোপন রাখতে হবে এবং গোপনে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে। তাহলেই আশা করা যায় পাপীর তাওবাহ্ কবূল হবে।


৩. যে গুনাহ হতে তাওবাহ্ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে :

গুনাহগার ব্যক্তি যে গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চাচ্ছেন তাওবার শুরুতেই তাকে ঐ গুনাহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ ঐ গুনাহ বর্জন করতে হবে। তাওবার শর্তসমূহের মধ্যে এই শর্তটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কোন ফরয কাজ না করার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে আগে ঐ কাজটি করে তাওবাহ্ করতে হবে। যেমন কেউ যাকাত দিত না। এখন যদি যে যাকাত না দেয়ার পাপ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে পূর্বের যত বছরের যাকাত দেয়নি তা হিসাব করে আদায় করতে হবে। কারণ যাকাত আল্লাহর হক এবং গরীবের হক। তাওবার দ্বারা আল্লাহর হক থেকে মুক্তি পেলেও গরীবের হক থেকে তো সে মুক্তি পাচ্ছে না। তাই সাউদী আরবের বিখ্যাত ফাতাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘‘ইসলাম কিউ এ’’-তে পুরনো বছরগুলোর যাকাত সাধ্য অনুযায়ী হিসাব করে আদায় করাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে। যদি সাধ্য থাকে আর সে তা আদায় করে তাহলে তার তাওবাহ্ কবূল হবে।[5]

একইভাবে কেউ যদি পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়ার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে পিতা-মাতার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। কেউ যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না রাখার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে যে সকল আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল তাদের সাথে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করে তাওবাহ্ করতে হবে। যারা মদ্যপান বা ধূমপান করে তাদেরকে মদ্যপান বা ধূমপান ছেড়ে দিয়ে তাওবাহ্ করতে হবে।

আবার একইভাবে হারাম কোন কাজ করে ফেলার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে সবার আগে খুব দ্রুত সেই হারাম কাজটি করা বর্জন করতে হবে। তারপর তাওবাহ্ করতে হবে। যেমন কেউ যদি সুদের পাপ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে সুদ গ্রহণ বন্ধ করতে হবে এবং তা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। আর সুদের যে অর্থ-সম্পদ তার কাছে আছে তা হিসাব করে হালাল অর্থ থেকে পৃথক করে সাওয়াবের উদ্দেশ্য ছাড়া সমাজকল্যাণমূলক কাছে ব্যয় করতে হবে। কেউ তাওবাহ্ করতে চায় অথচ ফরয ‘ইবাদাত বর্জন করেই যাচ্ছে বা হারাম কাজ করেই যাচ্ছে তাহলে তার তাওবাহ্ কখনোই কবূল হবে না। বরং তার তাওবাহ্ হয়ে যাবে আল্লাহর সাথে ঠাট্টা করার শামিল। ময়লা থেকে পা ধুয়ে সেই পা কোন ময়লাহীন শুকনো স্থানে রাখতে হবে। নয়তো ময়লায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পা ধুলে অথবা ধোয়া পা ময়লাতেই রাখলে পা ধোয়া নিরর্থক হবে।

কুয়ার মধ্যে পড়ে যাওয়া বিড়ালের ঘটনা থেকে গুনাহ থেকে কিভাবে তাওবাহ্ করতে হয় তার একটি বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায়। নীচের গল্পটি পড়ে দেখুন:

এক ব্যক্তি এক মুফতী সাহেবকে ফতোয়া জিজ্ঞেস করলো যে, যে পানি থেকে গন্ধ আসে, সে পানিতে উযূ-গোসল করলে পবিত্রতা অর্জিত হবে কিনা? মুফতী সাহেব বললেন, ‘৪০ বালতি পানি তুলে ফেললে পানি পবিত্র হয়ে যাবে।’ মুফতী সাহেবের ফতোয়া শুনে বাড়ির মালিক অতি কষ্টে কুয়া থেকে ৪০ বালতি পানি তুলে ফেললেন, কিন্তু তাতেও পানির দুর্গন্ধ গেল না।

ঐ ব্যক্তি মুফতী সাহেবকে আবার জিজ্ঞেস করলো, আমি তো কুয়া থেকে ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলে দিয়েছি, এখন কি কুয়ার পানি পবিত্র হয়েছে? মুফতী সাহেব তাকে আবারও ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলা হলো। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন নেই। আরো ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলতে আদেশ করার পরও যখন পানির দুর্গন্ধ গেল না, তখন বাড়িওয়ালা মুফতী সাহেবের প্রতি রাগান্বিত হলেন। এবার মুফতী সাহেব সরেজমিনে তদন্তে নামলেন।

সরেজমিনে গিয়ে কুয়ার নিচে তাকিয়ে দেখলেন, সাদা সাদা কী যেন একটা জিনিস ভাসছে। তিনি বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়িওয়ালা বললেন, ‘ওই সেই বিড়ালটা, যেটা পড়ে মারা গেছে।’ মুফতী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা তুলে ফেলেননি কেন?’ বাড়িওয়ালা বলল, ‘হুযুর! আপনি তো ওটা তুলে ফেলতে বলেন নি।’ মুফতী সাহেব বললেন, ‘সেটাও কি বলতে হয়? এ কথা কি আপনার বুদ্ধিতে ধরে না যে, পানি থেকে বিড়ালের পচা-গলা দেহ না তুলে বালতির পর বালতি পানি তুলে ফেললেও কুয়ার পানি পবিত্র ও দুর্গন্ধহীন হবে না।’

এই গল্প কাল্পনিক হলেও এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবেই বোঝা গেল যে, কুয়ার মধ্যে বিড়ালের পচা-গলা দেহ রেখে কুয়ার পানিকে দুর্গন্ধমুক্ত ও পবিত্র করার চেষ্টা করা আর পাপরত অবস্থায় তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার করা প্রায় একই কথা। পাপে রত অবস্থায় তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার করার কী মূল্য হতে পারে? মদ খেতে খেতে ‘তাওবা-তাওবা’ বললে, ব্যভিচারে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ‘আস্তাগফিরুল্লাহ-আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়লে কী লাভ হতে পারে? তাই আগে পাপ বর্জন করতে হবে, তারপর তাওবাহ্ করতে হবে। তবেই সেই তাওবাহ্ কবূল হবে। নয়তো তা হবে পন্ডশ্রম। তবে ইস্তিগফার সবসময়ই করতে থাকতে হবে।


৪. ভবিষ্যতে এই গুনাহ আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে :

খাঁটি তাওবাহ্ করার জন্য কৃত গুনাহর জন্য লজ্জিত হয়ে গুনাহ বর্জন করলেই হবে না। ভবিষ্যতে আর এই গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। যদি তাওবাহ্ করার সময় মনে মনে নিয়ত থাকে যে সুযোগ পেলে আবার ঐ গুনাহর কাজ করবো তাহলে সেই তাওবার কোন গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। সেই তাওবাহ্ কোন তাওবাই নয়। যেমন কোন ব্যক্তি অঢেল অর্থ-সম্পত্তির মালিক। এমতাবস্থায় সে মদন্ডনারী নিয়ে যেনা-ব্যভিচার করার জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে বিদেশ গেলো। হঠাৎ কোন এক কারণে তার অর্থ-সম্পদ শেষ হয়ে সে নিঃস্ব হয়ে পড়লো। তখন সে তাওবাহ্ করতে লাগলো। অথচ তার মনে আকাঙক্ষা আছে যে, সে যদি আবার অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারে তাহলে সে আবার যেনা করবে। মদ পান করবে। তাহলে তার এই তাওবাহ্ আল্লাহর নিকট কবূল হবে না। তার তাওবাহ্ হচ্ছে অপারগের তাওবাহ্। কোন পাপ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে তা থেকে তাওবাহ্ করলে তা তাওবাহ্ হয় না। তবে যৌবন বয়সে করা পাপের তাওবাহ্ বৃদ্ধকালে করলে আশা করা যায় আল্লাহ কবূল করবেন। কারণ সে হয়তো যৌবনকালে বুঝতে পারেনি। বৃদ্ধকালে নিজের অপরাধের কথা বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে তাওবাহ্ করলে সেই তাওবাও আল্লাহ কবূল করবেন, ইনশা-আল্লা-হ।

তবে কখনো কখনো পাপ পুনরায় না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যদি আবার তা করে ফেলে, তাহলে বলা যাবে না যে, পাপীর আগের তাওবাহ্ কবূল হয়নি, তা বাতিল হয়ে গেছে। কারও আগের তাওবাহ্ কবূল হওয়ার পরও সে আবার পাপে লিপ্ত হতে পারে। তখন সে আবার তাওবাহ্ করবে। ভবিষ্যতে পাপ না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে বারবার সে পাপে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে সে বারবারই তাওবাহ্ করবে।

তবে মনে রাখতে হবে পাপী ব্যক্তি কোন অবস্থায় সেই পাপে লিপ্ত হয়েছে তা কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জানেন। তাই আল্লাহকে ফাঁকি দিয়ে তাওবাহ্ করা যায় না। সাধারণভাবে কেউ যদি অনিচ্ছকৃত বা না জেনে গুনাহ করে আল্লাহর কাছে মাফ চায়, আবার গুনাহ করে মাফ চায় আল্লাহ ক্ষমা করবেন। সে কথাই নাবী (সা.) হাদীসে কুদসীতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেন :

أَذْنَبَ عَبْدٌ ذَنْبًا فَقَالَ اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى. فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى أَذْنَبَ عَبْدِى ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَه رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ. ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى. فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى عَبْدِى أَذْنَبَ ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَه رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ. ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى. فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى أَذْنَبَ عَبْدِى ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَه رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ وَاعْمَلْ مَا شِئْتَ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ

‘‘কোন বান্দা একটি পাপ করে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার পাপ ক্ষমা কর।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা একটি পাপ করেছে, অতঃপর সে জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি পাপ ক্ষমা করেন অথবা তা দিয়ে পাকড়াও করেন।’ অতঃপর সে আবার পাপ করল এবং বলল, ‘হে আমার রব! তুমি আমার পাপ ক্ষমা কর।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা একটি পাপ করেছে, অতঃপর সে জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি পাপ ক্ষমা করেন অথবা তা দিয়ে পাকড়াও করেন।’ আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করলাম। সুতরাং সে যা ইচ্ছা করুক।’’[6]

‘সে যা ইচ্ছা করুক’ কথার অর্থ হল, সে যখন এরূপ করে; অর্থাৎ পাপ করে সাথে সাথে তাওবাহ্ করে এবং আমি তাকে মাফ করে দেই, তখন সে যা ইচ্ছা করুক, তার কোন চিন্তা নেই। যেহেতু তাওবাহ্ পূর্বকৃত পাপ মোচন করে দেয়। অবশ্য একই পাপ জেনেশুনে বারবার করলে অথবা তাওবার সময় পাপ বর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা না করলে সে ক্ষমার যোগ্য নাও হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلٰى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘‘আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজেদের প্রতি যুল্ম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তারা তার পুনরাবৃত্তি করে না।’’[7]

নাবী (সা.) বলেছেন :

ارْحَمُوا تُرْحَمُوا وَاغْفِرُوا يَغْفِرْ اللهُ لَكُمْ وَيْلٌ لِأَقْمَاعِ الْقَوْلِ وَيْلٌ لِلْمُصِرِّينَ الَّذِينَ يُصِرُّونَ عَلٰى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘‘তোমরা দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। তোমরা ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা কথা শুনেও শুনে না। দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা জেনে শুনে তাদের কৃত অপরাধের উপর অটল থাকে।’’[8]

তাই তাওবাহ্ করার সময় অবশ্যই ভবিষ্যতে আর সেই গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তাওবাহ্ করার পর আবার কোন কারণে পাপ হয়ে গেলে পুনরায় তাওবাহ্ করতে হবে। কোন অবস্থাতেই গুনাহর উপর অটল থাকা যাবে না। কারণ কেউ জানে না সে কখন মৃত্যুবরণ করবে, আদৌ সে তাওবার সুযোগ পাবে কিনা।


৫. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওবাহ্ করতে হবে :

তাওবাহ্ করার নির্ধারিত সময় আছে। আর তাওবার নির্ধারিত সময় দুই ধরনের :

এক. প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাওবার সর্বশেষ সময় হচ্ছে তার মৃত্যু। তাই মৃত্যু আসার আগেই তাওবাহ্ করতে হবে।

দুই. সকল মানুষের জন্য তাওবাহ্ করার সর্বশেষ সময় হচ্ছে ক্বিয়ামাতের আলামত হিসেবে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাই সাধারণভাবে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগেই তাওবাহ্ করতে হবে।

মূলত পাপ করার পরক্ষণেই তাওবাহ্ করা উচিত। অনেকে শেষ জীবনে দাড়ি-চুল পাকলে পরে তাওবাহ্ করবেন বলে অপেক্ষায় থাকে, অবহেলা করে। কিন্তু হঠাৎ মৃত্যু এসে যাওয়ায় সে আর তাওবার সুযোগ পায় না।

মহান আল্লাহ বলেছেন :

إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولٰئِكَ يَتُوبُ اللهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللهُ عَلِيمًا حَكِيمًا - وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتّٰى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولٰئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

‘‘নিশ্চয় তাদের তাওবাহ্ কবূল করা আল্লাহর দায়িত্ব যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে। তারপর অনতিবিলম্বে তারা তাওবাহ্ করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবাহ্ কবূল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, অতিপ্রজ্ঞাময়। আর তাওবাহ্ নেই তাদের, যারা অন্যায় কাজসমূহ করতে থাকে, অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন বলে, আমি এখন তাওবাহ্ করলাম; আর তাওবাহ্ তাদের জন্য নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়; আমরা এদের জন্যই তৈরী করেছি যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব।’’[9]

আর নাবী (সা.) বলেছেন :إِنَّ اللهَ يَقْبَلُ تَوْبَةَ الْعَبْدِ مَا لَمْ يُغَرْغِرْ

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবাহ্ সে পর্যন্ত কবূল করবেন, যে পর্যন্ত তার প্রাণ কণ্ঠাগত না হয় (অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ঘ্যার ঘ্যার করা শুরু করে)।’’[10]

মহান আল্লাহর ‘আযাব দেখার পরে করা তাওবাও কোন উপকারে আসবে না। মৃত্যুর সময় ফির‘আওনের ঈমান তার কোন উপকার করেনি। সুতরাং কেউ আল্লাহর ‘আযাব গ্রাস করার মুহূর্তে তাওবাহ্ করলে তা তার কোন উপকারে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

فَلَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا قَالُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَحْدَه وَكَفَرْنَا بِمَا كُنَّا بِه مُشْرِكِينَ -فَلَمْ يَكُ يَنْفَعُهُمْ إِيمَانُهُمْ لَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا سُنَّتَ اللهِ الَّتِىْ قَدْ خَلَتْ فِىْ عِبَادِه وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْكَافِرُونَ

‘‘তারপর তারা যখন আমার ‘আযাব দেখল তখন বলল, ‘আমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, আর যাদেরকে আমরা তার সাথে শরীক করতাম তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম’। সুতরাং তারা যখন আমার ‘আযাব দেখল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকার করল না। এটা আল্লাহর বিধান, তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে। আর তখনই ঐ ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’[11]

একইভাবে ক্বিয়ামাতের পূর্বে তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। যখন কেউ তাওবাহ্ করতে চাইলেও তখন তার তাওবাহ্ প্রতিপালকের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন :

هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلِ انْتَظِرُوا إِنَّا مُنْتَظِرُونَ

‘‘তারা কি এরই অপেক্ষা করছে যে, তাদের নিকট ফেরেশতাগণ হাযির হবেন, কিংবা তোমার রব উপস্থিত হবেন অথবা তোমার রব-এর আয়াতসমূহের কিছু সংখ্যক আয়াত প্রকাশ পাবে? যেদিন তোমার রবের আয়াতসমূহের কিছু সংখ্যক আয়াত প্রকাশ পাবে, সেদিন কোন ব্যক্তিরই তার ঈমান উপকারে আসবে না যে পূর্বে ঈমান আনেনি, কিংবা সে তার ঈমানের মাধ্যমে কোন কল্যাণ অর্জন করেনি। বল, ‘তোমরা অপেক্ষা কর, নিশ্চয় আমরাও অপেক্ষা করছি’।’’[12]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

لَا تَنْقَطِعُ الْهِجْرَةُ حَتّٰى تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَلَا تَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا

‘‘তাওবার সুযোগ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত হিজরত বন্ধ হবে না। আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত তাওবার সুযোগ কেটে যায় না।’’[13]

অন্যত্র নাবী (সা.) বলেছেন :

مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ اللهُ عَلَيْهِ

‘‘যে ব্যক্তি পশ্চিম দিকে থেকে সূর্যোদয় হওয়ার পূর্বে তাওবাহ্ করবে, আল্লাহ তার তাওবাহ্ গ্রহণ করবেন।’’[14]

তাই মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হওয়ার বা পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বেই গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে হবে। আগামীকাল নয়, আজই এখনই তাওবাহ্ করতে হবে।


৬. মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে :

যদি কোন গুনাহর সম্পর্ক কোন মানুষের অধিকারের সাথে হয়, তাহলে যার অধিকার নষ্ট হয়েছে, তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা ক্ষমা চেয়ে তার সাথে মিটমাট করে নিতে হবে। যদি অবৈধ পন্থায় কারো মাল বা অন্য কিছু গ্রহণ-হরণ করে থাকে, তাহলে তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যদি কারো উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় অথবা অনুরূপ কোনো দোষ করে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে শাস্তি নিতে নিজেকে পেশ করতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যার প্রতি যুল্ম করা হয়েছে, তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে গিয়ে বলতে হবে, ভাই/বোন! আমি আপনার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছি বা আপনার গীবত করে আপনার সম্মান নষ্ট করেছি বা যুলুম করেছি। এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে তাওবাহ্ করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। এভাবে যত মানুষের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহ করেছে তত মানুষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যদি সেই ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, অর্থ-সম্পদ হরণ করে থাকলে তা ঐ ব্যক্তির উত্তরাধিকারের নিকট পৌঁছে দিবে, তার পক্ষ থেকে দান-সদাক্বাহ্ করবে এবং নিজে বেশি বেশি করে সৎ কাজ/সাওয়াবের কাজ করে সাওয়াব বাড়িয়ে নেবে। কেননা ঐ যার অধিকার নষ্ট করেছে সে ব্যক্তি যদি জাহান্নামী হয় তাহলে সে ক্বিয়ামাতের মাঠে এই ব্যক্তির কাছে তার অধিকার ফেরত চাইতে পারে। তখন তাকে সাওয়াব দিয়ে প্রতিদান দিতে হবে।

নাবী (সা.) বলেছেন :

مَنْ كَانَتْ لَه مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ مِنْ عِرْضِه أَوْ شَيْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ قَبْلَ أَنْ لَا يَكُونَ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ إِنْ كَانَ لَه عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِه وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَه حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِه فَحُمِلَ عَلَيْهِ

‘‘যদি কোন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি তার সম্ভ্রম বা অন্য কিছুতে কোন যুলুম ও অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেদিন আসার পূর্বেই সে যেন আজই তার নিকট হতে (ক্ষমা চাওয়া অথবা প্রতিশোধ/পরিশোধ দেয়ার মাধ্যমে) নিজেকে মুক্ত করে নেয়; যে দিন (ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য) না দীনার হবে না দিরহাম, টাকা-পয়সা, মাল-ধন (সেদিন) যালেমের নেক ‘আমল থাকলে তার যুল্ম অনুপাতে নেকী তার নিকট থেকে কেটে নিয়ে (মাযলুমকে দেয়া) হবে। পক্ষান্তরে যদি যদি তার নেকি না থাকে (অথবা নিঃশেষ হয়ে যায়) তাহলে তার বাদীর (মাযলূমের) গুনাহ নিয়ে তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’’[15]

আর কেউ যদি কোন বান্দার হক নষ্ট করে কিন্তু যার হক নষ্ট করেছে শত চেষ্টা করেও তাওবাহ্ করার সময় তাকে খুঁজে না পায় বা তার কাছে পৌঁছতে না পারে তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তা‘আলা গুনাহকারীকে মাফ করবেন। ইন-শা-আল্লাহ।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করার জন্য প্রথম ৫টি শর্ত যথেষ্ট। তবে আল্লাহর হকের মধ্যে কিছু হক আছে যা তাওবার মাধ্যমে মাফ হয় না সেগুলো কাযা আদায় করে হক পূরণ করতে হয়। যেমন, সলাত, সিয়াম ইত্যাদি।

উপরে উল্লিখিত সকল সকল শর্ত পালন করে যে পাপী তাওবাহ্ করবে, তার তাওবাহ্ হবে খাঁটি তাওবাহ্। এই তাওবাই আল্লাহ চান এবং তিনি এই তাওবাই গ্রহণ করেন।

বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী মা‘ইয বিন মালিক-এর মত তাওবা। যার ব্যাপারে নাবী (সা.) বলেছিলেন :

لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أُمَّةٍ لَوَسِعَتْهُمْ

‘‘সে এমন তাওবাহ্ করেছে যে, যদি তা একটি জাতির মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হত, তাহলে সকলের জন্য তা যথেষ্ট হত।’’[16]

বিশুদ্ধ তাওবার উদাহরণ স্বরূপ ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী জুহায়নাহ্ গোত্রের নারীটির তাওবার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أهْلِ المَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ

‘‘এই মহিলাটি এমন বিশুদ্ধ তাওবাহ্ করেছে যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তাহলে তা তাদের জন্য যথেষ্ট হত।’’[17]

বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল, যার পরে গুপ্ত ও প্রকাশ্যভাবে ‘আমলে কোন প্রকার পাপের আচরণ থাকবে না। যে তাওবাহ্ তাওবাকারীকে বিলম্বে ও অবিলম্বে সাফল্য দান করে। বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল তাই, যার পরে তাওবাকারী বিগত অপরাধ-জীবনের জন্য কান্না করে, পুনরায় সেই অপরাধ যেন ঘটে না যায় তার জন্য ভীত-আতঙ্কিত ও সতর্ক থাকে, অসৎসঙ্গীদের সংসর্গ বর্জন করে এবং সৎসঙ্গীদের সাহচর্য অবলম্বন করে।

[1]. জন্ম : ৬৩১ হি./১২৩৩ ঈ. - মৃত্যু : ৬৭৬ হি./১২৭৭ ঈ.।

[2]. জন্ম : ১৩৩০ হি./১৯১০ ঈ. - মৃত্যু : ১৪২০ হি./১৯৯৯ ঈ.।

[3]. সুনান ইবনু মাজাহ : ৪২৫২, সহীহ ইবনু হিব্বান : ৬১৪, সহীহুত্ তারগীব : ৩১৪৬-৩১৪৭, হাদীসটি সহীহ।

[4]. সহীহুল বুখারী : ৬০৬৯; সহীহ মুসলিম : ৭৬৭৬।

[5]. https ://islamqa.info/ar/26119

[6]. সহীহুল বুখারী : ৭৫০৭; সহীহ মুসলিম : ৭১৬২।

[7] সূরা আ-লি ‘ইমরা-ন ০৩ : ১৩৫।

[8]. মুসনাদ আহমাদ : ৭০৪১; আল আদাব আল মুফরাদ : ৩৮০; শু‘আবুল ঈমান : ৭২৩৬; আস্ সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ : ৪৮২।

[9] সূরা আন্ নিসা ০৪ : ১৭-১৮।

[10]. মুসনাদ আহমাদ : ৬১৬০; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৫৩৭; হাদীসটি হাসান, সহীহুত তিরমিযী : ২৮০২।

[11] সূরা আল মু’মিন/গাফির ৪০ : ৮৪-৮৫।

[12] সূরা আল আন্‘আম ০৬ : ১৫৮।

[13]. সুনান আবূ দাঊদ : ২৪৮১, হাদীসটি সহীহ।

[14]. সহীহ মুসলিম : ৭০৩৬।

[15]. সহীহুল বুখারী : ২৪৪৯; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ২৪১৯।

[16]. সহীহ মুসলিম : ৪৫২৭।

[17]. সহীহ মুসলিম : ৪৫২৯।