সুতরাং নিহত ব্যক্তিও তার জন্য নির্ধারিত সময়েই মৃত্যু বরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা আগে থেকেই অবগত আছেন এবং নির্ধারণ করেছেন যে, এ লোকটি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করবে, অমুক ব্যক্তি হত্যার মাধ্যমে মৃত্যু বরণ করবে, অমুক দেয়ালের নীচে চাপা পড়ে মৃত্যু বরণ করবে, কেউ আগুনে পুড়ে মারা যাবে, কেউ বা ডুবে মারা যাবে এবং অন্যরা অন্যান্য কারণে মৃত্যু বরণ করবে। আল্লাহই জীবন-মরণ সৃষ্টি করেছেন। বেঁচে থাকার উপকরণ এবং মৃত্যুর কারণও তিনিই সৃষ্টি করেছেন।
মুতাযেলারা বলে যে, নিহত ব্যক্তিকে হায়াত থাকতেই মারা হয়। তাকে যদি হত্যা না করা হতো, তাহলে সে তার জন্য নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বাঁচতো। তাদের কথা মোতাবেক নিহত ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত সময় দু’টি। এ কথা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি এ কথা সম্বন্ধ করা সঙ্গত নয় যে, নিহত ব্যক্তির জন্য তিনি এমন একটি বয়োসীমা নির্ধারণ করেছেন, যে সম্পর্কে তিনি জানেন যে সে কখনোই সে সীমা পর্যন্ত বাঁচবে না অথবা তার জন্য দু’টি বয়োসীমার মধ্য থেকে যে কোন একটি নির্ধারণ করেছেন। যেমন পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা এমন কাজ করে থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো নিহত ব্যক্তি যদি নির্ধারিত সময়েই মৃত্যু বরণ করে, তাহলে হত্যাকারী থেকে কিসাস কিংবা রক্তপণ নেয়া হয় কেন?
এ প্রশ্নের জবাব হলো, হত্যাকারী যেহেতু নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এবং এমন কাজ করেছে, যা ইসলামী শরীয়াতে নিষিদ্ধ, এ কথার সাথে সংগতি বজায় রেখেই রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিন্মোক্ত বাণীর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন,
صِلَةُ الرَّحِمِ تَزِيدُ فِي الْعُمُرِ
‘‘আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার বয়স বাড়িয়ে দেয়’’।[1] অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা বয়স বৃদ্ধির উপায়।
আল্লাহ তা‘আলা আগেই জানতে পেরেছেন এবং নির্ধারণ করেছেন যে, এ ব্যক্তি তার আত্মীয়ের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। এ কারণে সে এ সময়সীমা পর্যন্ত হায়াত পাবে। এ আমলটি না করলে, সে এ সময়সীমা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জেনেছেন যে, সে এ আমলটি করবেই। তাই তিনি উহাকে তার জন্য নির্ধারণ করেছেন। এমনি তিনি আগে থেকেই জানতে পেরেছেন যে, অমুক ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবেই। সুতরাং এ কারণে সে এ বয়োসীমা পর্যন্ত অর্থাৎ কম বাঁচবে। নিহত ব্যক্তির নিহত হওয়া বা না হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা একই কথা বলেছি।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, বয়স বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা বা না রাখার যেমন প্রভাব রয়েছে, তা বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে দু‘আরও অনুরূপ প্রভাব আছে কি না?
এর জবাবে আমরা বলবো, বয়স বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে দু‘আর প্রভাব পড়ে না। কেননা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবীবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বলেছেন, ‘‘তুমি কেবল আল্লাহর কাছে নির্ধারিত সময়সীমাই প্রার্থনা করেছো’’। ইতিপূর্বে হাদীছটি বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সকল সৃষ্টির বয়স পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।
সুতরাং উহা পরিবর্তনের জন্য দু‘আ করা অবৈধ। তবে জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার দু‘আ করার কথা ভিন্ন। এ জন্য যে, দু‘আ করা শরীয়াত সম্মত একটি উত্তম আমল। এটি উপকারীও বটে। আপনি কি জানেন না যে, বয়স বৃদ্ধির দু‘আর মধ্যে যদি আখেরাতের কল্যাণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাহলে বয়স বৃদ্ধির দু‘আ করা জায়েয আছে। যেমন নাসায়ী শরীফে আম্মার বিন ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«اللَّهُمَّ بِعِلْمِكَ الْغَيْبَ وَقُدْرَتِكَ عَلَى الْخَلْقِ، أَحْيِنِي مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِي وَتَوَفَّنِي إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِي»
‘‘হে আল্লাহ! অদৃশ্যের প্রতি তোমার ইলমের উসীলায় এবং সৃষ্টির উপর তোমার ক্ষমতার উসীলায় আমি তোমার কাছে এ প্রার্থনা করছি যে, বেঁচে থাকা আমার জন্য যতদিন কল্যাণকর হয়, ততদিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখো এবং মৃত্যু বরণ করা যখন আমার জন্য উপকারী হবে, তখনই আমাকে মৃত্যু দান করো’’। এভাবে দু‘আটি শেষ পর্যন্ত।[2]
ছাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম হাকেম তার ছহীহ গ্রন্থে এ মর্মে যে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন তা উপরোক্ত বর্ণনাকে সমর্থন করে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلَّا الدُّعَاءُ، وَلَا يَزِيدُ فِي الْعُمُرِ إِلَّا الْبِرُّ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُهُ»
‘‘দু‘আই কেবল তাকদীরের অকল্যাণকে প্রতিহত করতে পারে এবং সৎকাজ ছাড়া অন্য কিছুই বয়স বাড়াতে পারে না। আর মানুষ স্বীয় পাপের কারণে তার রিযিক থেকে মাহরুম হয়’’।[3]
এ হাদীছে ঐসব লোকের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা মনে করে মানত বালা-মুসীবত দূর করে এবং নিয়ামত আনয়ন করে। ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি মানত করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন, মানত কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না; বরং উহার মাধ্যমে কৃপণের মাল থেকে কিছু খরচ করা হয় মাত্র’’। আর আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী:
وَمَا يُعَمَّرُ مِن مُّعَمَّرٍ وَلَا يُنقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلَّا فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
‘‘কোনো আয়ু লাভকারী আয়ু লাভ করলে এবং তার আয়ু থেকে কিছু কম করা হলে তা অবশ্যই একটি কিতাবে লিখা থাকে। আল্লাহর জন্য এসব একদম সহজ’’। (সূরা ফাতির: ১১)
এখানে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: من عمره এর যমীর বা সর্বনামের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, এটি হলো আরবদের এ কথার মতই عندي درهم ونصفه ‘‘আমার কাছে এক দিরহাম এবং তার অর্ধেক আছে। অর্থাৎ আরেক দিরহামের অর্ধেক আছে। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে যে, কোনো আয়ু লাভকারীর আয়ু বাড়ানো হলে এবং অন্য কারো আয়ু কমানো হলে, অবশ্যই তা কিতাবে লিখা থাকে।
কেউ কেউ বলেছেন, বয়স বাড়ানো বা কমানো ঐ কিতাবে হয়ে থাকে, যা ফেরেশতাদের হাতে রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِندَهُ أُمُّ الْكِتَابِ
‘‘প্রত্যেক বিষয়ের জন্য একটি লিখিত কিতাব (সময়সীমা) রয়েছে। আল্লাহ যা চান নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং যা চান কায়েম রাখেন। উম্মুল কিতাব তার কাছেই রয়েছে’’। (সূরা রা’দ: ৩৮-৩৯)
এখানে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া এবং বহাল রাখার যে কথা বলা হয়েছে, তা কেবল ঐ কিতাবসমূহের মধ্যেই হয়ে থাকে, যা রয়েছে ফেরেশতাদের হাতে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
وَعِندَهُ أُمُّ الْكِتَابِ
‘‘উম্মুল কিতাব তার কাছেই রয়েছে’’ এর দ্বারা লাওহে মাহফুয উদ্দেশ্য। আয়াতের বর্ণনা প্রসঙ্গ এ কথাই প্রমাণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ
‘‘প্রত্যেক বিষয়ের জন্য একটি লিখিত কিতাব (সময়সীমা) রয়েছে’’। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ
‘‘আল্লাহ যা চান নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং যা চান কায়েম রাখেন’’। অর্থাৎ সে কিতাব থেকে যা ইচ্ছা তিনি মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা বহাল রাখেন। আর মূল কিতাব তার নিকটেই রয়েছে। আর সেটি হলো লাওহে মাহফুয।
কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা শরীয়াত থেকে যা ইচ্ছা নিশ্চিহ্ন করেন ও রহিত করেন এবং যা ইচ্ছা বহাল রাখেন, তা রহিত করেন না। আয়াতের বর্ণনা প্রসঙ্গ প্রথম অর্থের চেয়ে এ অর্থের প্রতিই অধিক নির্দেশনা প্রদান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَن يَأْتِيَ بِآيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ
‘‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া নিজেই কোন নিদর্শন এনে দেখাবার শক্তি কোন রাসূলেরও ছিল না। প্রত্যেক জিনিসের জন্যই একটি কিতাব (সময়সীমা) রয়েছে’’।
এখানে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, রসূল নিজের পক্ষ হতে নিদর্শন নিয়ে আসতে পারেন না। বরং তিনি আল্লাহর পক্ষ হতেই নিদর্শন আনয়ন করেন। অতঃপর তিনি বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক বিষয়ের জন্য একটি লিখিত কিতাব রয়েছে। আল্লাহ যা চান নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং যা চান কায়েম রাখেন’’।
অর্থাৎ আল্লাহর শরীয়াতসমূহের জন্য এমন একটি সময়সীমা রয়েছে, যে পর্যন্ত গিয়ে তা শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর অন্য শরীয়াত দ্বারা তাকে রহিত করে দেয়া হবে। সুতরাং শরীয়াতের সময়সীমা শেষ হওয়ার সময় আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা রহিত করেন এবং যা ইচ্ছা বহাল রাখেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আরো অনেক কথা রয়েছে। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
[2]. হাদীছটি সহীহ: নাসাঈ ১৩০৬।
[3]. হাদীছটি হাসান। দেখুন: শাইখ আলবানীর তাহকীকসহ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ৯২।