আব্দুল গণি আল আযদির লিখিত ‘আলমুতাওয়ারূন’ বা ‘পলাতক’ নামক পুস্তকখানি আমি পড়েছি। এটি একটি মজাদার পুস্তক। এতে তাদের কাহিনী বর্ণিত আছে যারা তৎকালীন নির্মম, উৎপীড়ক, সার্বভৌম শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট বন্দী হয়ে আসার ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
আবু উমর ইবনুল উলা তার কষ্টের কথা বলেছেন, “আমাকে যখন হাজ্জাজ হুমকি দিল তখন আমি ইয়েমেনে পালিয়ে গিয়ে সানআতে এক গৃহে ছিলাম। রাতে আমি ছাদে বসে থাকতাম আর দিনে ঘরে লুকিয়ে থাকতাম। এক রাতে ছাদে থাকাকালে তিনি এক লোককে আবৃত্তি করতে শুনলেন-
رُبَّمَا تَكْرَهُ النُّفُوسُ مِنَ الْأَمْرِ ٭ لَهُ فَرْجَةٌ كَحَلِّ الْعِقَالِ
ভাবার্থঃ “আত্মা হয়তো এমন বিষয়ের ভয়ে ভীত, গিরা খোলার মতো যার সমাধান রয়েছে।”
আবু উমর আরো বলেছেন, লোকটি যখন বলল, সমাধান, তখন আমি আশার আলোর বিচ্ছুরণ অনুভব করলাম ও নিজেকে সুখীবোধ করলাম। আর আমি শুনলাম যে আরেক লোক ঘোষণা দিচ্ছে, হাজ্জাজ মারা গেছে। এতে বাকি কথার ব্যাখ্যা হয়ে গেল।
আল্লাহর কসম, আমি জানি না যে, ‘সমাধান’ ও ‘হাজ্জাজ মারা গেছে’ এ দুটি কথার কোনটি আমাকে আনন্দিত করেছে।
একমাত্র একটি সিদ্ধান্ত বা ফয়সালা আছে আর তা অবশ্যম্ভাবী ও অবশ্যই তা বাস্তবায়িত হবে। আর সে সিদ্ধান্তের ফয়সালা হল তার সিদ্ধান্ত বা ফয়সালা যার হাতে আসমান-জমিনের নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব ও শাসন।
“সর্বদা তিনি কাজে রত।” (৫৫-সূরা আর রহমানঃ আয়াত-২৯) (অর্থাৎ, কাউকে সম্মান দান, কাউকে অসম্মানিত করা, কাউকে জন্মের মাধ্যমে জীবন দান, কাউকে মৃত্যু দান করা ইত্যাদি কাজে আল্লাহ সর্বদা ব্যস্ত থাকেন।)
হাসান বসরী (রহঃ)-কেও হাজ্জাজ বিন ইউসুফ থেকে পালাতে হয়েছিল, হাজ্জাজের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে হাসান বসরী (রহঃ) সেজদা করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলেন।
“তাদের জন্য আসমান-জমিন কেউ কাঁদেনি এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হয়নি।” (৪৪-সূরা আদ দোখানঃ আয়াত-২৯)
ইব্রাহীম আননাখায়ীও আরেকজন যিনি হাজ্জাজের কারণে লুকিয়ে ছিলেন। হাজ্জাজের মৃত্যু সংবাদ যখন তার নিকট পৌঁছল তখন তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলে বললেন-
طفح السرور على حتى إننى ٭ من عظم ما قد سرني أبكاني
ভাবাৰ্থঃ “আনন্দ আমাকে এতটাই পরাভূত (আত্মহারা) করেছে যে, আমি আনন্দে কেদে ফেলেছি।”
“আর আমি তোমাদের কতককে কতকের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করে দিয়েছি। তোমরা ধৈর্য ধরবে কি? আর তোমার প্রতিপালক তো সর্বদ্ৰষ্টা।” (২৫-সূরা আল ফুরকানঃ আয়াত-২০)
একবার হুম্মারাহ নামে এক লাল বর্ণের ঘুঘু জাতীয় কবুতর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথার উপর দিয়ে পতপত করে উড়ছিল। এটা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
من فجع هذه بأفراخها؟ ردوا عليها افراخها
“কে এটার ছানাকে ছিনিয়ে নিয়ে এটাকে কষ্ট দিচ্ছ? এটাকে এর ছানা ফিরিয়ে দাও।”
এ বিষয়ে মন্তব্য করে একজন বলেছেন-
جاءت إليك حمامة مشتاقة ٭ تشكو إليك بقلب صَبٍ واجف
من أخبر الورقاء أن مكانكم ٭ حـَــرَمٌ وأنك ملجا للخائف
ভাবাৰ্থঃ “এক কবুতর আশা করে আপনার নিকট এসে অস্থির প্রেমিকের আত্মা নিয়ে আপনার নিকট অভিযোগ করল। ঘুঘুকে কে জানাল যে, আপনি নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং ভীত-সন্ত্রস্তদের জন্য অভয় আশ্রয়স্থল।”
সাঈদ ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর কসম, আমি কিছুকাল সর্বদা হাজ্জাজ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম। অবশেষে আমি লজ্জিতবোধ করলাম।” একথা বলার অল্পকাল পরেই তাকে হাজ্জাজের সামনে হাজির করা হলো। যখন তরবারি খাপমুক্ত করে তার মাথার উপর তুলে ধরা হলো, তখন তিনি হাসলেন। হাজ্জাজ বলল, “আপনি কেন হাসছেন? তিনি উত্তর দিলেন, “আমি যখন গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম, তখন আমার মনে একটি ধারণা হলো (বা চিন্তা ঢুকল) আর তাহলো, আল্লাহর প্রতি তোমার ধৃষ্টতা, ঔদ্ধত্য, নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা এবং তোমার প্রতি আল্লাহর করুণা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম।” ঐ পরিস্থিতিতে বিষয়াদিকে ঐ আলোকে দেখা অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতা ও আল্লাহর অঙ্গীকারের প্রতি ঈমান (বিশ্বাস) ও নির্ভরতা প্রদর্শন করেছে।