আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষের নিকট জান্নাতী পয়গাম নিয়ে আগমন করেছেন। তিনি পার্থিব আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত হতেন না। ব্যয় করার জন্য তার কোন ধন-ভাণ্ডার ছিল না। খাবার জন্য চমৎকার কোন (খেজুর) বাগান ছিল না; আর বসবাস করার জন্য কোন সুন্দর প্রাসাদ ও ছিল না। এতসব সত্ত্বেও তার প্রিয় অনুসারীরা তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়েছেন, অবিচল থেকেছেন। সমস্যা-সঙ্কুল এক কঠিন জীবন সহ্য করেছেন। তারা ছিলেন গুটি কয়েকজন ও দুর্বল, তাদের প্রতিবেশীদের দ্বারা সমূলে বিনাশ হয়ে যাবার ভয়ে ভীত, তবুও তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পুরোপুরি ভালোবাসতেন।
তাদেরকে গিরিপথে বন্দি করা হয়েছিল। আর সে সময়ে তাদের নিকট অল্প খাদ্য ছিল বা কোন খাদ্য ছিল না। তাদের সুখ্যাতি আক্রান্ত হয়েছিল; তাদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল, তবুও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি তাদের ভালোবাসা ছিল নিষ্কলুষ।
তাদের কাউকে মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর ফেলে হেঁচড়ানো হয়েছিল, কিছু লোককে বন্দী করা হয়েছিল আর অন্যরা নতুন নতুন ও অদ্ভুত অদ্ভুত শাস্তির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। এসব শাস্তিই তাদেরকে কাফেররা দিয়েছিল। তারা ঐসব শাস্তি সহ্য করতে বাধ্য হয়েও তাকে সর্বান্তঃকরণে মন খুলে ভালোবেসেছিলেন। তারা ঘর-বাড়ি, স্বদেশ, পরিবার ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তারা তাদের বাল্যকালের খেলার মাঠ ও বসত বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এসব ভোগান্তি সত্ত্বেও তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ভালোবেসেছেন তারা।
তার (নবুয়তের) সংবাদের কারণেই ঈমানদারগণ অগ্নিপরীক্ষার শিকার হয়েছিলেন। তাদের পদতলের ভূমি প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠেছিল। তবুও তার প্রতি তাদের ভালোবাসা অনবরত বাড়ছিলই।
তাদের যৌবনের বসন্ত ঋতুর শিরোপরি সদা বিপজ্জনকভাবে তরবারি ঝুলন্ত ছিল। তারা শুধুমাত্র তাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসত বলেই এমন মৃদুভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে (যুদ্ধের ময়দানে) মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন, যেন তারা প্রমোদ ভ্রমণে বা অবসর যাপনে ছিলেন।
একজন সাহাবীকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াতের সংবাদ বিদেশে এক রাজার নিকট নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো। অথচ তিনি জানতেন যে, এটা এমন এক কাজ যা থেকে তিনি ফিরে আসবেন না। আরেকজন সাহাবীকে এক কাজে পাঠানো হলো। তিনি জানতেন যে, এটা তার মৃত্যুর কারণ হবে, তবুও তিনি সন্তুষ্টচিত্তে সে কাজে গেলেন। কারণ, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিরঙ্কুশ ভালোবাসতেন। কিন্তু কেন তারা তাকে ভালবাসতেন এবং কেন তারা তার নবুওয়তে এত সন্তুষ্ট ও তার আদর্শে এত পরিতুষ্ট ছিলেন? কেন তারা তাকে অনুসরণ করাতে যে দুঃখ-কষ্ট ও ভোগান্তি হয়েছে তা ভুলে গিয়েছেন? এক কথায় বা সহজভাবে এর কারণ বলতে হয় যে, তিনি বদান্যতার ও ধার্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর অধিকার করেছিলেন। তারা তার মাঝে সত্য ও বিশুদ্ধতার সব লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন। যারা মহত্তর জিনিসের সন্ধান মানুষের মনের হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ও তিক্ততা শীতল করে দিয়েছিলেন। সত্য বাণী দিয়ে তিনি তাদের অন্তরকে শান্ত করে দিয়েছিলেন ও তার রিসালাত দ্বারা তিনি তাদের অন্তরসমূহকে শান্তিতে ভরে নিয়েছিলেন।
তিনি তাদের অন্তরে এত শান্তি ঢেলে দিয়েছিলেন যে, তারা তার পাশে থাকার কারণে যে যাতনা ভোগ করেছিলেন, তা তারা তুচ্ছ মনে করেছিলেন। তিনি তাদের অন্তরে এমন ঈমান বা বিশ্বাস সঞ্চার করেছিলেন যে, তারা যে আঘাত ও প্রতিকূল অবস্থা সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা তারা ভুলে গিয়েছিল। তিনি তাদের ভিতরকে হিদায়াতের আলো দ্বারা ঘষেমেঝে চকচকে করে দিয়েছিলেন ও তাদের চক্ষুসমূহকে তার নূরে নূরান্বিত বা তার আলোতে আলোকিত করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের থেকে মূর্খতার বোঝা, মূর্তিপূজার বিকৃত রুচি এবং বহু-ঈশ্বরবাদের কুফল দূর করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের অন্তরে ঈমানের পানি ঢেলে দিয়েছেন। এভাবে তাদের দেহমন প্রশান্ত হয়েছিল ও তাদের আত্মা শান্তি পেয়েছিল।
তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থেকে জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করেছেন এবং তারা তার সাহচার্যে পুলক বোধ করেছিলেন বা আনন্দ পেয়েছিলেন।
তারা তার পাশে থেকে সুখ এবং তার অনুসরণে নিরাপত্তা, মুক্তি ও আত্মসমৃদ্ধি পেয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন-
“এবং আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ!) সারা বিশ্বের জন্য রহমত বা করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (২১-সূরা আল আম্বিয়া: আয়াত-১০৭)
“এবং অবশ্যই তুমি (মানবজাতিকে) সরল পথ দেখাচ্ছে।” (৪২-সূরা আশ শুরা: আয়াত-৫২)
“এবং তিনি (গ্রন্থকার তিনি বলতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বুঝিয়েছেন; কিন্তু কুরআনের ঐ আয়াত দ্বারা তিনি বলতে স্পষ্টরূপে আল্লাহকেই বুঝা যায়। -অনুবাদক।) স্বেচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে (নিয়ে যান)।” (৫-সূরা মায়িদা: আয়াত-১৬)
“তিনিই নিরক্ষরদের মাঝ থেকে তাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ (কুফুরি ও শিরক থেকে) পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন এবং নিশ্চয় তারা পূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিল। (৬২-সূরা আল জুমুআ: আয়াত-২)
“তাদের উপরে যে বোঝা ও শৃঙ্খল ছিল, তিনি তাদের থেকে তা সরিয়ে দেন।” (৭-সূরা আল আ'রাফ: আয়াত-১৫৭)
“যখন তিনি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের দিকে আহবান করেন যা তোমাদের প্রাণ সঞ্চার করে তখন তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আহবান সাড়া দিও।” (৮-সূরা আনফাল: আয়াত-২৪)
তারা তাদের নেতার সাথে থেকে সত্যিই সুখী ছিলেন এবং তারা যথার্থই সুখী হওয়ার যোগ্য ছিলেন।
হে আল্লাহ! বিপথ গমনের শৃঙ্খল হতে আত্মার মুক্তিদাতা ও মিথ্যার অভিশাপ থেকে আত্মার উদ্ধারকারী মুহাম্মাদের উপর করুণা ও শান্তি বর্ষণ করুন এবং তার মহান সাহাবীদের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার প্রতিদানস্বরূপ তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।