আমাদের চিন্তাসমূহকে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়াতে, বিপথে যেতে, মুক্ত হতে ও বন্য-হন্যে হতে না দিয়ে ওগুলোকে লাগাম পড়ানো ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ, যদি আপনি আপনার চিন্তাগুলোকে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দেন তবে ওগুলো বন্য হয়ে গিয়ে আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। ওগুলো আপনার অতীত দুঃখ-দুর্বিপাকের সুবিন্যস্ত তালিকা খুলে বসবে। আপনার মা আপনাকে যেদিন জন্ম দিয়েছিলেন সেদিন থেকে শুরু করে আপনার দুঃখ দুর্দশার ইতিহাস এগুলো আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিবে।
যদি আপনার চিন্তা-ভাবনাসমূহকে পায়চারী করার বা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানার জন্য ছেড়ে দেয়া হয় তবে এগুলো আপনার সামনে আপনার অতীত দুঃখ-কষ্টের চিত্র ও একটি ভয়ংকর ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরবে। এসব চিন্তা-ভাবনা স্বয়ং আপনাকেই বিচলিত-শিহরিত করে তুলবে। আপনার অনুভূতিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে বাধ্য করবে। অতএব, যে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তায় ফলপ্রদ ও উপকারী কাজ হয়, সে ধরনের কেন্দ্রীভূত চিন্তা-চর্চার দিকে অভিমুখী করে ওগুলোকে (আপনার চিন্তাসমূহকে) লাগাম পড়ান ও নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
“এবং সে চিরঞ্জীবের উপর নির্ভর করুন, যিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।” (২৫-সূরা আল ফুরকান: আয়াত-৫৮)
সুখ-শাস্ত্রের একটি মূলনীতি হলো পার্থিব জীবনকে এর সত্যিকার গুণ ও মূল্যানুযায়ী মূল্যায়ন করা। এ জীবন তুচ্ছ এবং এটা আপনার নিকট শুধু এতটুকু দাবি রাখে যে, আপনি এর থেকে পালিয়ে যান। এ জীবন দুর্বিপাক, দুর্দশা, দুর্ঘটনা, ব্যথা-বেদনা ও আঘাতে ভরা, এই যদি হয় এ জীবনের বিবরণ তাহলে মানুষ কিভাবে এর নগণ্য দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে অযৌক্তিকভাবে বিচলিত হয় এবং কী করে তার ঘটে যাওয়া এমন সব পার্থিব বিষয়ের উপর দুঃখ করতে পারে? জীবনের সর্বোত্তম মুহুর্তগুলো কলঙ্কিত, এর ভবিষ্যৎ অঙ্গীকারসমূহ শুধু মরীচিকা, এর সফল ব্যক্তিদেরকে হিংসা করা হয়, ধন্যরা সদা হুমকিপ্রাপ্ত, আর প্রেমিকরা কোনও অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় ধরাশায়ী হয়।
হাদীসে আছে “নিশ্চয়, জ্ঞান-চর্চার মাধ্যমেই কেবল জ্ঞান অর্জিত হয় এবং ধৈর্য-চর্চার মাধ্যমেই সহনশীলতা অর্জিত হয়।”
আলোচ্য বিষয়ের এ হাদীসের অর্থের উপর কেউ যদি আমল করতে চায় বা এর অর্থকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয় তবে তিনি আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলতে পারেন যে, (সুখে থাকার) অনুমান করেই সুখ লাভ করা যায়। সদা হাসি-খুশি থেকে, যা আপনাকে সুখী করে তার সন্ধান করে এবং যতই অদ্ভুত মনে হোক না কেন, নিজের ভিতরে জোর করে সুখ-বোধ সঞ্চারিত করে সুখ অর্জন করা যায়। সুখ দ্বিতীয় প্রকৃতি বা স্বভাব না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে এ কাজগুলো করে যেতে হবে। আসল ব্যাপার হলো দুঃখ-বেদনার সকল স্মৃতি আপনার থেকে আপনি দূর করে ফেলতে পারবেন না। এর কারণ হলো জীবনকে পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ
“অবশ্যই, আমি মানুষকে কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে (জীবন-যাপনকারী হিসেবে) সৃষ্টি করেছি।” (৯০-সূরা আল বালাদ: আয়াত-৪)
“যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কে আমলে উত্তম।” (১১-সূরা হূদ: আয়াত-৭)
কিন্তু আমি আপনাদের নিকট যে সংবাদ পৌছে দিতে চাই, তা হলো আপনার উচিত আপনার দুঃখের পরিমাণ ও প্রাবল্য যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলা। সম্পূর্ণরূপে দুঃখমুক্ত হওয়া তো পরকালে জান্নাতবাসীদের জন্য (নির্ধারিত)। এ কারণে জান্নাতবাসীরা বলবে-
“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের থেকে সকল দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন।” (৩৫-সূরা ফাতির: আয়াত-৩৪)
সুতরাং, যখন কেউ এ দুনিয়ার প্রকৃতি ও গুণাগুণ জানতে পারে, তখন সে বুঝতে পারে, এ দুনিয়া নিরস, প্রবঞ্চণাময় ও মূল্যহীন এবং সে পুরোপুরি বুঝতে পারে, ওটাই হলো দুনিয়ার প্রকৃতি ও পরিচয়।
আরবের একজন কবি বলেন-
“তুমি তো আমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ না করার শপথ করেছ।”
আমি যেমনটি বর্ণনা করেছি দুনিয়ার পরিচয় যদি তেমনই হয়, তবে বুদ্ধিমান লোকদের উচিত নয় এর আক্রমণে সাহায্য করা এবং হতাশা ও দুশ্চিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করা। আমাদের যা করা উচিত তা হলো, আমাদের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে এমন সব আবেগ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করা। (এভাবে আত্মরক্ষা করে) আমাদের সর্বশক্তি দ্বারা অবশ্যই আমাদেরকে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
“এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখ। এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর শক্রকে ও তোমাদের শক্রকে ভীত করবে।” (৮-সূরা আনফাল: আয়াত-৬০)
“আল্লাহর পথে তাদের যা ঘটেছিল, তাতে তারা নিরুৎসাহিত হয়নি, দুর্বল এবং নতও হয়নি।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৪৬)