ইবন আব্বাস রা.বলেন, ‘ইবরাহীম আ. হাজেরা[1] ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলকে নিয়ে এলেন এবং বাইতুল্লাহর কাছে যমযমের ওপর একটি গাছের কাছে রাখলেন। মক্কায় সে সময় জনমানবের কোন চিহ্ন ছিল না। তখন সেখানে কোনো পানি ছিল না। এক পাত্রে খেজুর ও একটি মশকে পানি রেখে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ফিরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। ইসমাঈল আ.-এর মা তাঁর পিছু নিলেন। বললেন, এই জনমানবশূন্য তৃণ-লতাহীন মরুভূমিতে আমাদেরকে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি একাধিকবার ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে এ প্রশ্ন করলেন। ইবরাহীম তার প্রতি ভ্রূক্ষেপও না করে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন। অতঃপর হাজেরা বললেন, ‘আল্লাহ কি আপনাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন? ইবরাহীম আ. উত্তর করলেন : হ্যাঁ। তখন হাজেরা বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না’। হাজেরা ফিরে এলেন। আর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম চলতে চলতে সানিয়্যার নিকট গিয়ে থামলেন। তারা তাঁকে দেখতে পাচ্ছিল না। তিনি কিবলামুখি হয়ে উভয় হাত তুলে নিম্নোক্ত দো‘আ করলেন,
﴿ رَّبَّنَآ إِنِّيٓ أَسۡكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيۡرِ ذِي زَرۡعٍ عِندَ بَيۡتِكَ ٱلۡمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱجۡعَلۡ أَفِۡٔدَةٗ مِّنَ ٱلنَّاسِ تَهۡوِيٓ إِلَيۡهِمۡ وَٱرۡزُقۡهُم مِّنَ ٱلثَّمَرَٰتِ لَعَلَّهُمۡ يَشۡكُرُونَ ٣٧ ﴾ [ابراهيم: ٣٧]
‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমি আমার কিছু বংশধরদেরকে ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট বসতি স্থাপন করালাম। হে আমাদের রব, যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের হৃদয় আপনি তাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিন এবং তাদেরকে রিয্ক প্রদান করুন ফল-ফলাদি থেকে, আশা করা যায় তারা শুকরিয়া আদায় করবে।’[2]
হাজেরা ইসমাঈল আ. কে দুধ পান করাতে লাগলেন এবং নিজে ওই পানি পান করতে লাগলেন। পাত্রের পানি শেষ হয়ে গেলে তিনি পিপাসার্ত হলেন। পিপাসার্ত হল সন্তানও। সন্তানকে তিনি তেষ্টায় ছটফট করতে দেখে দূরে সরে গেলেন, যাতে এ অবস্থায় সন্তানকে দেখে কষ্ট পেতে না হয়। কাছে পেলেন সাফা পাহাড়। তিনি সাফায় আরোহণ করে উপত্যকার দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন কোন যাত্রীদল দেখা যায় কি-না, যাদের কাছে খাদ্য ও পানীয় থাকবে। কাউকে দেখতে না পেয়ে সাফা থেকে তিনি নেমে এলেন। উপত্যকায় পৌঁছলে তিনি তাঁর কামিজ টেনে ধরে পরিশ্রান্ত ব্যক্তির মতো দ্রুত চললেন। উপত্যকা অতিক্রম করলেন। অতঃপর মারওয়ায় আরোহণ করলেন। মারওয়ায় দাঁড়িয়েও তিনি তাকিয়ে দেখলেন কাউকে দেখা যায় কি-না। কাউকে দেখতে না পেয়ে নেমে এলেন মারওয়া থেকে। ছুটে গেলেন আবার সাফা পাহাড়ে। এভাবেই দু’পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। ইবন আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«فَذَلِكَ سَعْيُ النَّاسِ بَيْنَهُمَا».
এটাই হল সাফা-মারওয়ার মাঝে মানুষের সাঈ (করার কারণ)। তিনি মারওয়ার ওপর থাকাকালে একটি আওয়াজ শুনতে পেয়ে নিজকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘থামো!’ তিনি আবারও আওয়াজটি শুনতে পেয়ে বললেন, শুনতে পেয়েছি; তবে তোমার কাছে কোনো ত্রাণ আছে কি-না তাই বলো। এরপর তিনি দেখলেন, যমযমের জায়গায় একজন ফেরেশতা তাঁর পায়ের গোঁড়ালি বা পাখা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। এক পর্যায়ে সেখান থেকে পানি বের হল। তিনি হাউজের মতো করে বালির বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে লাগলেন। ইবন আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَرْحَمُ اللَّهُ أُمَّ إِسْمَاعِيلَ لَوْ تَرَكَتْ زَمْزَمَ ، أَوْ قَالَ لَوْ لَمْ تَغْرِفْ مِنَ الْمَاءِ - لَكَانَتْ عَيْنًا مَعِينًا».
‘আল্লাহ ইসমাঈলের মায়ের ওপর রহম করুন। তিনি যমযমকে ছেড়ে দিলে, বর্ণনান্তরে-যমযমের পানি না উঠালে, যমযম একটি চলমান ঝরণায় পরিণত হত।’
ফেরেশতা হাজেরাকে বললেন,
«لَا تَخَافِي مِنَ الضَّيْعَةِ فَإِنَّ هَهُنَا بَيْتَ اللهِ يَبْنِيهِ هَذَا الْغُلَامُ وَأَبُوهُ وَإِنَّ اللهَ لَا يُضَيِّعُ أَهْلَهُ»
‘তোমরা ধ্বংস হওয়ার ভয় করো না, কেননা এখানে হবে বাইতুল্লাহ, যা নির্মাণ করবে এই ছেলে ও এর পিতা। আর আল্লাহ তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করবেন না।’[3]
এ যমযমের পানি দিয়ে ইসরা ও মি‘রাজের রাতে রাসূল যমযমের পানি দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর বুক ধোয়া হয়েছে। আবূ যর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«فُرِجَ سَقْفِي وَأَنَا بِمَكَّةَ فَنَزَلَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَم فَفَرَجَ صَدْرِي ثُمَّ غَسَلَهُ بِمَاءِ زَمْزَمَ ثُمَّ جَاءَ بِطَسْتٍ مِنْ ذَهَبٍ مُمْتَلِئٍ حِكْمَةً وَإِيمَانًا فَأَفْرَغَهَا فِي صَدْرِي ثُمَّ أَطْبَقَهُ ثُمَّ أَخَذَ بِيَدِي فَعَرَجَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا».
‘মক্কায় অবস্থানকালে একদিন আমার ঘরের ছাদ ফাঁক করা হল। এরপর জিবরীল আলাইহিস সালাম নেমে আসলেন। তিনি আমার বুক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে তা ধৌত করলেন। এরপর তিনি হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ স্বর্ণের একটি প্লেট নিয়ে এসে আমার বক্ষে ঢেলে দিলেন। অতঃপর বক্ষ জোড়া লাগিয়ে আমার হাত ধরে নিকটবর্তী আসমানে আরোহণ করলেন। [4]
[2]. ইবরাহীম : ৩৭।
[3]. ঘটনাটি বিস্তারিত দেখুন সহীহ বুখারী : ১/৪৭৪-৪৭৫।
[4]. বুখারী :১৬৩৬।