আমরা দেখেছি যে, ওহীর জ্ঞানই দীনের মূল। ওহীকে সরল ও বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করাই মুক্তির সুনিশ্চিত পথ। পক্ষান্তরে ওহীকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করার দরজা উন্মোচন করাই ধ্বংসের সুনিশ্চিত পথ। এক্ষেত্রে নিম্নের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
(১) মহান আল্লাহ সকল মানুষের প্রেমময় স্রষ্টা। মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে মানুষ যে বিষয়ে নিশ্চিত সত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয় না বা মতভেদ সৃষ্টি করে সে বিষয়ে মতভেদ দূর করে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্যই মহান আল্লাহ ওহীসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেন এবং ওহীর বক্তব্য সকলের জন্য সহজবোধ্য করেন।[1] সাধারণ উপদেশের ক্ষেত্রে অলঙ্কার-এর আশ্রয় নেওয়া সম্ভব হলেও ঈমান-আকীদার বিষয় অলঙ্কারের নামে অস্পষ্ট করার অর্থ মানুষের জন্য মুক্তির পথকে দুর্বোধ্য করা এবং মতভেদ দূরীভূত না করে তা আরো ঘনীভূত করা। ওহীকে ব্যাখ্যার নামে বাহ্যিক অর্থ ভিন্ন অন্য অর্থে ব্যবহার করার অর্থ ওহীকে অকার্যকর করা।
(২) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী ও কিতাব লাভের পরেও বিভ্রান্তির অতল গহবরে নিপতিত হওয়ার অন্যতম পথ ওহীর ব্যাখ্যা। সাধু পল কর্তৃক খৃস্টধর্মের বিকৃতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান ঈসা মাসীহের বক্তব্যের মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদ, ঈসা মাসীহের মানবত্ব, তাঁর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, মুক্তি দানে তাঁর অপারগতা, মুক্তির জন্য শরীয়ত পালনের বাধ্যবাধকতা, মানুষের জন্মগত নিষ্পাপত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য বিদ্যমান। পক্ষান্তরে ত্রিত্ববাদ, ঈসা মাসীহের ঈশ্বরত্ব, শরীয়ত পালনের অপ্রয়োজনীয়তা, আদিপাপ, প্রায়শ্চিত্ববাদ, ঈসা মাসীহের পাপ বহন ইত্যাদি বিষয়ে একটিও সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য নেই। সাধু পল প্রথমে গ্রীক দর্শন ও রোমান পৌত্তলিক ধর্মের আদলে এ সকল বিভ্রান্তিকর কুফরী মতবাদ তৈরি করেন। এরপর বাইবেলের কিছু বক্তব্যের দূরবর্তী অপব্যাখ্যাকে তার এ কুফরী মতবাদের ‘‘দলীল’’ হিসেবে পেশ করেন। এরপর এগুলোর বিপরীতে তাওহীদ, রিসালাত, শরীয়ত, ঈসা মাসীহের মানবত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান অগণিত সুস্পষ্ট বক্তব্যকে নানাবিধ উদ্ভট দূরবর্তী ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করতে থাকেন। আমার লেখা ‘‘কিতাবুল মুকাদ্দাস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’’ বইটি পাঠ করলে পাঠক এ বিষয়ে অনেক তথ্য জানতে পারবেন। মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তদেরও একই অবস্থা। শীয়া, কাদিয়ানী, বাতিনী, মারিফতী-ফকীর সম্প্রদায় ও অন্যান্য সকল বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের সকল বিভ্রান্তির ভিত্তি ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থ গ্রহণ। কাজেই ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থের দরজা বন্ধ না করলে ওহীর কার্যকারিতা রক্ষা করা সম্ভব নয়।
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীকে বাহ্যিক অর্থ থেকে বের করা মানব হৃদয়ের মহাব্যাধি। নিজের মন-মর্জির বিপরীত হলেই সে ইচ্ছামত ওহীর একটি রূপক অর্থ বা ব্যাখ্যা করে। আল্লাহর অধিষ্ঠান অর্থ ক্ষমতা দখল, হস্ত অর্থ ক্ষমতা ইত্যাদি বলার পরে জান্নাত, জাহান্নাম, আখিরাত ইত্যাদি বিষয়ক অপব্যাখ্যাও সহজ হয়ে যায়। আকীদা বিষয়ক ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হওয়ার পর ফরয-ওয়াজিব ও হালাল-হারাম বিষয়ক ব্যাখ্যাও গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থ করে সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি বর্জন করা এবং মদ, ব্যভিচার ইত্যাদি মহাপাপে লিপ্ত হওয়ার পথও উন্মুক্ত হয়ে যায়। আমরা দেখব যে, কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো আন্তরিক অর্থ থেকে বের করে রূপক ব্যাখার মাধ্যমে মানুষ কিভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে ও হচ্ছে। এজন্যই প্রথম যুগগুলোর ইমামগণ ব্যাখ্যা বা রূপক অর্থের নামে ওহীর কোনো শব্দ বা বাক্যকে বাহ্যিক অর্থের ব্যতিক্রম অর্থে গ্রহণ করার বিরোধিতা করেছেন।