আল্লাহর বিশেষণসমূহের বিষয়ে মুশাবিবহা ও জাহমী সম্প্রদায়ের প্রান্তিকতার বিষয় আমরা জেনেছি। মুশাবিবহা সম্প্রদায়ের যুক্তি নিম্নরূপ: (১) কুরআন-হাদীসের বক্তব্য অনুসারে মহান আল্লাহর শ্রবণ, দর্শন, অবস্থান, হস্ত, চক্ষু, মুখমণ্ডল ইত্যাদি বিদ্যমান। (২) মানুষের মধ্যেও এগুলো বিদ্যমান (৩) এ সকল বিশেষণের স্বরূপ ও প্রকৃতি আল্লাহর ক্ষেত্রেও অবশ্যই মানুষের মতই। (৪) কাজেই মহান আল্লাহ মানুষের মতই দেহধারী এবং বিশেষণধারী। তারা ‘কোনো কিছুই আল্লাহর মত নয়’ মর্মের আয়াতগুলিকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দেন।
জাহমিয়্যাহ-মু’তাযিলাদের যুক্তি নিম্নরূপ: (১) মানুষের শ্রবণ, দর্শন, হস্ত, চক্ষু, মুখমণ্ডল ইত্যাদি রয়েছে। (২) এ সকল বিশেষণের স্বরূপ আল্লাহর ক্ষেত্রেও অবশ্যই মানুষের মতই হতে হবে। (৩) আল্লাহর এ সকল বিশেষণ আছে বলে বিশ্বাস করার একমাত্র অর্থ তাঁকে মানুষের সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করা। (৪) আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব সমুন্নত রাখতে এ সকল বিশেষণ অস্বীকার, ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থে বিশ্বাস করা ফরয।
তাদের মতে আল্লাহর হাত অর্থ আল্লাহর ক্ষমতা বা নিয়ামত। আল্লাহর মুখমণ্ডল অর্থ আল্লাহর অস্তিত্ব বা সত্তা। ক্রোধ ও সন্তুষ্টি মানসিক পরিবর্তন, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বুঝায়। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এগুলি প্রযোজ্য নয়। আল্লাহর ক্রোধ অর্থ শাস্তির ইচ্ছা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্থ পুরস্কারের ইচ্ছা.... ইত্যাদি। এভাবে তারা আল্লাহর ‘অতুলনীয়ত্বে’ বিশ্বাস করার নামে আল্লাহর ওহীকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা ব্যাখ্যা করেন নি, তা ব্যাখ্যা করাকে তারা দীনের জন্য জরুরী বানিয়েছে। কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য সরল অর্থে বিশ্বাস করাকে কুফরী বলে দাবি করেছে!
সাহাবীগণ ওহীর এ সকল নির্দেশনা সরল অর্থে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা ওহীর মধ্যে কোনো বৈপরীত্য কল্পনা করেন নি। কারণ আল্লাহর বিশেষণকে সৃষ্টজীবের বিশেষণের সাথে তুলনা করলেই বৈপরীত্যের কল্পনা আসে। ওহীর উভয় শিক্ষাকে আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করলে কোনো বৈপরীত্য থাকে না। এ মতের যুক্তি নিম্নরূপ:
(১) আল্লাহর বিশেষণ ও অতুলনীয়ত্ব উভয়ই ওহীর মাধ্যমে জ্ঞাত বিষয়। (২) বিশেষণের প্রকৃতি ও স্বরূপ অজ্ঞাত। (৩) অজ্ঞাত বিষয়ের অজুহাতে ওহীর জ্ঞাত বিষয় ব্যাখ্যা বা অস্বীকার করার অর্থ ওহীকে অস্বীকার করা। (৪) এজন্য অজ্ঞাত বিষয়কে অজ্ঞাত রেখে বিশেষণ ও অতুলনীয়ত্ব উভয় জ্ঞাত বিষয় বিশ্বাস করতে হবে।
মহান স্রষ্টার জন্য তাঁর মর্যাদার সাথে সুসমঞ্জস ও সৃষ্টির সাথে অতুলনীয় হস্ত, মুখমণ্ডল, সত্তা, ক্রোধ, সন্তুষ্টি ইত্যাদি বিশেষণ থাকা মানবীয় বুদ্ধির সাথে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক নয়। যেহেতু তাঁর সৃষ্টির সাথে অতুলনীয় অস্তিত্ব আছে কাজেই তাঁর অস্তিত্বের সাথে সুসামঞ্জস্য অতুলনীয় বিশেষণাদি থাকাই স্বাভাবিক। আহলুস সুন্নাত এক্ষেত্রে দুটি মূলনীতি অনুসরণ করেছেন: (ক) ওহীর বক্তব্য বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করা এবং (খ) সাহাবীগণের অনুসরণ করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফার উপরের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ শাইখ আহমদ ইবন মুহাম্মাদ মাগনীসাবী (১০০০ হি) বলেন:
أصلها معلوم ووصفها مجهول لنا، فلا يبطل الأصل المعلوم بسبب التشابه والعجز عن إدراك الوصف... قال الشيخ الإمام فخر الإسلام علي البزدوي في أصول الفقه: وكذلك إثبات اليد والوجه عندنا معلوم بأصله متشابه بوصفه، ولن يجوز إبطال الأصل بالعجز عن إدراك الوصف. وإنما ضلت المعتزلة من هذا الوجه؛ فإنهم ردوا الأصول لجهلهم بالصفات
‘‘এ সকল বিশেষণের মূল অর্থ জ্ঞাত কিন্তু এগুলোর বিবরণ বা ব্যাখ্যা আমাদের অজ্ঞাত। জ্ঞাত মূল বিষয়টি বিবরণের অস্পষ্টতা বা তা জানতে অক্ষম হওয়ার কারণে বাতিল করা যায় না। ইমাম ফাখরুল ইসলাম আলী (ইবন মুহাম্মাদ) বাযদাবী (৪৮২ হি) ‘উসূলুল ফিকহ’ গ্রন্থে বলেন: হাত ও মুখমণ্ডল বিশ্বাস করা আমাদের নিকট তার মূল অর্থে জ্ঞাত কিন্তু তার বিবরণে দ্ব্যার্থবোধক বা অস্পষ্ট। বিবরণ জানতে অক্ষমতার কারণে মূল বিষয় বাতিল করা বৈধ নয়। এ দিক থেকেই মুতাযিলীগণ বিভ্রান্ত হয়েছে। বিবরণ বা ব্যাখ্যা না জানার কারণে তারা মূল বিষয়ই প্রত্যাখ্যান করেছে।’’[1]
মুতাযিলা-জাহমিয়াগণ সাধারণত আহলুস্ সুন্নাত-কে মুশাবিবহা (তুলনাকারী) বা মুজাসসিমা (দেহেবিশ্বাসী) বলে অপবাদ দেন। তাদের দাবি, মহান আল্লাহর হাত, মুখমণ্ডল, চক্ষু, আরশের ঊর্ধ্বে থাকা ইত্যাদির কথা কুরআন-হাদীসে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করা এবং তাঁকে ‘দেহবিশিষ্ট’ বলে দাবী করা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন যে, আহলুস সুন্নাত এগুলোকে বিশেষণ হিসেবে বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, এগুলো কোনোভাবে সৃষ্টির কোনো বিশেষণের সাথে তুলনীয় নয়। এগুলোর প্রকৃতি আমরা জানি না এবং জানতে চেষ্টা করি না। তাঁরা তুলনা অস্বীকার করেন, কারণ আল্লাহ তুলনা অস্বীকার করেছেন, কিন্তু তাঁরা তুলনা অস্বীকারের নামে মূল বিশেষণ অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করেন না, কারণ মহান আল্লাহই এ সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। তাঁকে কি বিশেষণে বিশেষিত করলে তাঁর মর্যাদা রক্ষা হয় তা তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন।