সন্তান কখনো এমন মনে করে যে, আমার মাতা-পিতার এ আদেশটি মানার চাইতে অন্য কোন নেক আমল করা অনেক ভালো। যেমন: তার পিতা তাকে বলেছেন: অমুক বস্ত্তটি বাজার থেকে নিয়ে আসো। তখন দেখা যাচ্ছে, তার মন তা করতে চাচ্ছেনা। কারণ, সে মনে করছে, কুর‘আন হিফ্জ অথবা ধর্মীয় বিষয়ের কোন ক্লাসে বসা তার জন্য এর চাইতেও অনেক বেশি সাওয়াবের।
তার এ কথা জানা উচিৎ যে, তার নেক আমলটি তো আর জিহাদ চাইতে উত্তম নয়। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতা-পিতার খিদমতকে হিজ্রত ও জিহাদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন:
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
أَقْبَلَ رَجُلٌ إِلَى نَبِيِّ اللهِ فَقَالَ: أُبَايِعُكَ عَلَى الْـهِجْرَةِ وَالْـجِهَادِ، أَبْتَغِيْ الْأَجْرَ مِنَ اللهِ، قَالَ: فَهَلْ مِنْ وَالِدَيْكَ أَحَدٌ حَيٌّ ؟ قَالَ: نَعَمْ، بَلْ كِلَاهُمَا، قَالَ: فَتَبْتَغِيْ الْأَجْرَ مِنَ اللهِ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا.
‘‘আল্লাহ্’র নবীর নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে বললো: আমি সাওয়াবের আশায় আপনার নিকট হিজ্রত ও জিহাদের বায়‘আত করতে চাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার মাতা-পিতার কোন একজন বেঁচে আছে কি? সে বললো: জি, উভয় জনই বেঁচে আছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি কি সত্যিই সাওয়াব চাও? সে বললো: জি। তিনি বললেন: অতএব তুমি তোমার মাতা-পিতার নিকট চলে যাও। তাদের সঙ্গে সদাচরণ করো’’। (মুসলিম ২৫৪৯)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
سَأَلْتُ النَّبِيَّ : أَيُّ الْعَمَـلِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ؟ قَالَ: الصَّلَاةُ عَلَى وَقْتِهَا، قَالَ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: بِرُّ الْوَالِدَيْنِ، قَالَ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: الْـجِهَادُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ.
‘‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেছি, কোন আমল আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন: সময় মতো নামায পড়া। বর্ণনাকারী বলেন: আমি বললাম: অতঃপর। তিনি বললেন: মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ। আমি বললাম: অতঃপর। তিনি বললেন: আল্লাহ্’র পথে জিহাদ করা’’। (বুখারী ৫৯৭০)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রা.) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন:
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ ، فَقَالَ: جِئْتُ أُبَايِعُكَ عَلَى الْـهِجْرَةِ، وَتَرَكْتُ أَبَوَيَّ يَبْكِيَانِ، فَقَالَ: ارْجِعْ عَلَيْهِمَا ؛ فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا.
‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলের নিকট এসে বললো: আমার মাতা-পিতাকে কাঁদিয়ে আমি আপনার নিকট হিজ্রতের বায়‘আত করতে এসেছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাদের নিকট ফিরে যাও। তাদেরকে হাসাও যেমনিভাবে তাদেরকে কাঁদিয়েছো’’। (আবূ দাউদ ২৫২৮).
মু‘আবিয়া বিন্ জা’হিমা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমার পিতা জা’হিমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন:
أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ، وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيْرُكَ، فَقَالَ النَّبِيُّ : هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَالْزَمْهَا، فَإِنَّ الْـجَنَّةَ عِنْدَ رِجْلَيْهَا.
’’আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাচ্ছি। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার মা জীবিত আছেন? সে বললো: হাঁ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাঁর খিদমতে লেগে যাও। কারণ, নিশ্চয়ই জান্নাত তাঁর পায়ের কাছে। অর্থাৎ তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই জান্নাত পাবে’’। (সাহীহুল্ জা’মি’ : ১/৩৯৫)
২. সন্তান কোন একটি নফল নেক আমল করতে যাচ্ছে এবং তা করতে গেলে তার মাতা-পিতার খিদমতে সমস্যা দেখা দিবে সত্যিই কিংবা সে আমল করতে তাকে বহু দূর যেতে হবে। তবুও সে তা করতে গিয়ে মাতা-পিতার অনুমতি নিচ্ছে না অথবা তাদেরকে এ ব্যাপারটি জানিয়েও যাচ্ছে না। কারণ, সে মনে করছে, যে কোন নেক আমল করতে মাতা-পিতার অনুমতি নিতে হয় না। অথচ এ মানসিকতা একেবারেই ভুল। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক সাহাবীকে জিহাদ করার জন্য মাতা-পিতার অনুমতি নিতে আদেশ করেন। তা হলে অন্য যে কোন নফল নেক আমলের জন্য তাদের অনুমতি চাওয়া তো আবশ্যকই বটে। বিশেষ করে যখন তার অনুপস্থিতিতে তাদের খিদমতে সমস্যা দেখা দেওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা থাকে।
সুতরাং যে আমল করতে বহু দূর যেতে হয় না অথবা তা করতে গেলে মাতা-পিতার খিদমতে কোন ত্রুটি হয় না এমন আমল করার জন্য মাতা-পিতার অনুমতি আবশ্যক নয়। বরং এ সকল ক্ষেত্রে তাদের সন্তষ্টি অর্জনের জন্য তাদেরকে জানিয়ে যাবে মাত্র। অতএব সৌদী আরবে অবস্থানরত কোন প্রবাসীকে হজ্জ বা ’উমরাহ্ করার জন্য মাতা-পিতার অনুমতি নিতে হবে না।
আবূ সাঈদ খুদ্রী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
هَاجَرَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ مِنَ الْيَمَنِ، فَقَالَ: هَلْ لَكَ أَحَدٌ بِالْيَمَنِ؟ قَالَ: أَبَوَايَ، قَالَ: أَذِنَا لَكَ؟ قَالَ: لَا، قَالَ: ارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَاسْتَأْذِنْهُمَا، فَإِنْ أَذِنَا لَكَ فَجَاهِدْ، وَإِلاَّ فَبِرَّهُمَا.
‘‘জনৈক ব্যক্তি ইয়েমেন থেকে হিজ্রত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: ইয়েমেনে তোমার কেউ আছে? সে বললো: সেখানে আমার মাতা-পিতা রয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তারা তোমাকে হিজ্রত করার অনুমতি দিয়েছে কি? সে বললো: না। তিনি বললেন: তুমি তাদের নিকট গিয়ে অনুমতি চাও। তারা অনুমতি দিলে যুদ্ধ করবে। নতুবা তাদের নিকট থেকেই তাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে’’। (আবূ দাউদ ২৫৩০)
৩. সাধারণত ক্লাসের শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে এ ব্যাপারে কমই নসীহত করে থাকেন। তারা এ ব্যাপারে কম গুরুত্ব দেয়ার কারণেই মাতা-পিতার অবাধ্যতা বেড়েই চলছে।
৪. অন্যন্য ব্যাপারে যেমন প্রচুর বাস্তব নমুনা পাওয়া যায় তেমনিভাবে মাতা-পিতার বাধ্যতার ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ছোটরা বড়দের কাছ থেকে এ ব্যাপারে অনুকরণীয় জ্বলন্ত আদর্শ খুঁজে না পাওয়ার দরুন হাতে-কলমে কার্যকরী শিক্ষা পাচ্ছে না।
৫. আদতেই মাতা-পিতারা নেককার সন্তানকে যে কোন কাজের জন্য বেশি বেশি আদেশ করেন। যা বদকার ছেলেকে করেন না। কিন্তু এতে করে অনেক নেককার ছেলের মধ্যে এ ভুল মনোভাব জন্ম নেয় যে, আমার মাতা-পিতা ওকে খুব ভালোবাসে। অথচ ব্যাপারটা এমন নয়। বরং তাঁরা আপনাকে বেশি ভালোবাসার দরুনই বার বার কাজের ফরমায়েশ করছেন। কারণ, তারা জানেন, আপনি ভালো হওয়ার দরুন ওদের সকল ফরমায়েশ আপনি ঠিক ঠিক মানবেন। এর বিপরীতে অন্য জন এমন নয়। তাই আপনি ওদের একমাত্র নেক সন্তান হিসেবে অন্যদের পক্ষের ঘাটতিটুকু আপনারই পূরণ করা উচিৎ।
৬. সন্তানের মধ্যে আল্লাহ্’র ভয় না থাকা অথবা মাতা-পিতার অনুগ্রহের কথা অস্বীকার করা।
৭. পিতা-মাতা সন্তানকে ছোট থেকেই এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ না দেয়া অথবা সন্তান নেককার হওয়ার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে দো‘আ না করা।
৮. পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। তবে তা তাদের সন্তান তাদের সঙ্গে দূরাচার করা জায়িয করে দেয়না। কারণ, তারা পাপ করলে আপনিও পাপ করবেন কি? আপনি তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করলে আপনার সন্তানরাও আপনার সঙ্গে তেমন আচরণ করবে।
৯. অনেক মাতা-পিতা সন্তানদেরকে কিছু দেয়ার ব্যাপারে সমতা বজায় রাখে না। যদ্দরুন যে কম পাচ্ছে সে নিজকে মাযলুম তথা অত্যাচারিত মনে করে। তখন সে মাতা-পিতার অবাধ্য হতে উদ্ধত হয়।
১০. অনেক মাতা-পিতা কোন সন্তান তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার পরও তাকে ভুল বুঝে থাকে অথবা তার উপর যুলুম করে অথবা তারা তার কাছ থেকে এমন কিছু চায় যা তার পক্ষে দেয়া সম্ভবপর নয়। এমতাবস্থায় সন্তানটি তাদের সাথে আর ভালো ব্যবহার করতে চায় না। এমন করা ঠিক নয়। বরং আপনি ধৈর্যের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়্যাতে তাদের খিদমত করে যাবেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ»
‘‘নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদেরকে অপরিমিত সাওয়াব দেয়া হবে’’। (যুমার : ১০)