আর তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে অধিক ভয় বা অধিক ভালোবাসা। অর্থাৎ অন্যকে ভালোবাসার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসা না পাওয়ার আশঙ্কা করা অথবা আল্লাহ্ তা‘আলাকে এমনভাবে ভালোবাসা যে, তিনি ভিন্ন অন্যকে আর ভালোবাসার সুযোগ না পাওয়া যার ভালোবাসা আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসার অধীন নয়। কারণ, এ কথা একেবারেই সত্য যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানব অন্তরে জন্মগতভাবেই এমন এক শূন্যতা রেখে দিয়েছেন যা একমাত্র তাঁরই ভালোবাসা পরিপূর্ণ করতে পারে। সূতরাং কারোর অন্তর উক্ত ভালোবাসা থেকে খালি হলে তিনি ভিন্ন অন্যদের ভালোবাসা তার অন্তরে অবশ্যই জায়গা করে নিতে চাইবে। তবে কারোর মধ্যে নিমোক্ত দু’টি গুণ থাকলেই সে উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যা নিম্নরূপ:
১. বিশুদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি। যার মাধ্যমে সে প্রিয়-অপ্রিয়ের স্তরসমূহের মাঝে পার্থক্য করতে পারে। তখনই সে মূল্যবান বন্ধুকে পাওয়ার জন্য নিম্নমানের বন্ধুকে ছাড়তে পারবে এবং বড় বিপদ থেকে বাঁচার জন্য ছোট বিপদ মাথা পেতে মেনে নিতে পারবে।
২. ধৈর্য ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। যার উপর নির্ভর করে সে উক্ত কর্মসমূহ আঞ্জাম দিতে পারবে। কারণ, এমন লোকও আছে যাদের মধ্যে প্রথমোক্ত গুণ রয়েছে। তবে সে তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না তার মধ্যে দ্বিতীয় গুণটি না থাকার দরুন।
সুতরাং কারোর মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসা এবং যার ভালোবাসা আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসার অধীন নয় তার ভালোবাসা একত্র হতে পারে না এবং যার মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসা নেই সেই একমাত্র মহিলাদের অথবা শ্মশ্রুবিহীন ছেলেদের ভালোবাসায় মত্ত থাকতে পারে।
দুনিয়ার কোন মানুষ যখন তাঁর ভালোবাসায় কারোর অংশীদারি সহ্য করতে পারে না তখন আল্লাহ্ তা‘আলা কেন তাঁর ভালোবাসায় অন্যের অংশীদারি সহ্য করবেন? এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর ভালোবাসায় শির্ক কখনোই ক্ষমা করবেন না।
ভালোবাসার আবার কয়েকটি স্তর রয়েছে। যা নিম্নরূপ:
১. সাধারণ সম্পর্ক জাতীয় ভালোবাসা যার দরুন এক জনের মন অন্য জনের সঙ্গে লেগে যায়। আরবী ভাষায় এ সম্পর্ককে ‘‘আলা’ক্বাহ্’’ বলা হয়।
২. ভালোবাসায় মন উপচে পড়া। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে ‘‘স্বাবা’বাহ্’’ বলা হয়।
৩. এমন ভালোবাসা যা মন থেকে কখনো ভিন্ন হয় না। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে ‘‘গারা’ম’’ বলা হয়।
৪. নিয়ন্ত্রণহীন ভালোবাসা। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে ‘‘ইশ্ক্ব’’ বলা হয়। এ জাতীয় ভালোবাসা আল্লাহ্ তা‘আলার শানে প্রযোজ্য নয়।
৫. এমন ভালোবাসা যার দরুন প্রিয়ের সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খা সৃষ্টি হয়। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে ‘‘শওক্ব’’ বলা হয়। এমন ভালোবাসা আল্লাহ্ তা‘আলার শানে অবশ্যই প্রযোজ্য।
’উবা’দাহ্ বিন্ স্বা’মিত, ‘আয়েশা, আবূ হুরাইরাহ্ ও আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ أَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ، وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللهِ كَرِهَ اللهُ لِقَاءَهُ.
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার সাক্ষাৎ চায় আল্লাহ্ তা‘আলাও তার সাক্ষাৎ চাইবেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার সাক্ষাৎ চায় না আল্লাহ্ তা‘আলাও তার সাক্ষাৎ চাইবেন না’’।
(বুখারী ৬৫০৭, ৬৫০৮; মুসলিম ২৬৮৩, ২৬৮৪, ২৬৮৫, ২৬৮৬)
৬. এমন ভালোবাসা যার দরুন কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার একান্ত গোলাম হয়ে যায়। এ জাতীয় ভালোবাসাই শির্কের মূল। কারণ, ইবাদতের মূল কথাই তো হচ্ছে, প্রিয়ের একান্ত আনুগত্য ও অধীনতা। আর এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানজনক গুণ হচ্ছে তাঁর ‘‘আব্দ’’ বা সত্যিকার গোলাম হওয়া তথা বিনয় ও ভালোবাসা নিয়েই আল্লাহ্ তা‘আলার অধীনতা স্বীকার করা। এ জন্যই আল্লাহ্ তা‘আলা জিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং যা ইসলামের মূল কথাও বটে। আর এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোতে ‘‘আব্দ’’ শব্দে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা দা’ওয়াতী ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ‘‘আব্দ’’ শব্দে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
«وَأَنَّهُ لَـمَّا قَامَ عَبْدُ اللهِ يَدْعُوْهُ كَادُوْا يَكُوْنُوْنَ عَلَيْهِ لِبَدًا»
‘‘আর যখন আল্লাহ্’র বান্দাহ্ (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে (আল্লাহ্ তা‘আলাকে) ডাকার (তাঁর ইবাদত করার) জন্য দন্ডায়মান হলো তখন তারা (জিনরা) সবাই তাঁর নিকট ভিড় জমালো’’। (জিন : ১৯)
আল্লাহ্ তা‘আলা নবুওয়াতের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ‘‘আব্দ’’ শব্দে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
«وَإِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِّثْلِهِ»
‘‘আমি আমার বান্দাহ্’র (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর) প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা যদি তাতে সন্দিহান হও তবে সেরূপ একটি সূরাহ নিয়ে আসো’’।
(বাক্বারাহ্ : ২৩)
আল্লাহ্ তা‘আলা ইস্রা’র ক্ষেত্রেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ‘‘আব্দ’’ শব্দে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
«سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَى بِعَبْدهِ لَيْلًا مِّنَ الْـمَسْجِدِ الْـحَرَامِ إِلَى الْـمَسْجِدِ الْأَقْصَى»
‘‘পবিত্র সে সত্তা যিনি নিজ বান্দাহ্কে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে) রাত্রিবেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মস্জিদুল হারাম থেকে মস্জিদুল আক্বসায় (বাইতুল মাক্বদিসে)’’। (ইস্রা’/বানী ইস্রাঈল : ১)
সুপারিশের হাদীসের মধ্যেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ‘‘আব্দ’’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিয়ামতের দিবসে ’ঈসা (আঃ) এর নিকট সুপারিশ চাওয়া হলে তিনি বলবেন:
اِئْتُوْا مُحَمَّدًا ، عَبْدًا غَفَرَ اللهُ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ.
‘‘তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যাও। তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার এমন এক বান্দাহ্ যাঁর পূর্বাপর সকল গুনাহ্ আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন’’। (বুখারী ৪৪৭৬; মুসলিম ১৯৩)
উক্ত হাদীসে সুপারিশের উপযুক্ততার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে ক্ষমা প্রাপ্ত আল্লাহ্ তা‘আলার খাঁটি বান্দাহ্ হওয়ার দরুন।
উক্ত নিরেট ভালোবাসা বান্দাহ্’র নিকট আল্লাহ্ তা‘আলার একান্ত প্রাপ্য হওয়ার দরুন আল্লাহ্ তা‘আলা তিনি ভিন্ন অন্য কাউকে বন্ধু বা সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«مَا لَكُمْ مِنْ دُوْنِهِ مِنْ وَّلِيٍّ وَّلَا شَفِيْعٍ»
‘‘তোমাদের জন্য তিনি ভিন্ন অন্য কোন বন্ধু নেই, না আছে কোন সুপারিশকারী’’। (সাজ্দাহ্ : ৪)
তিনি আরো বলেন:
«لَيْسَ لَهُمْ مِّنْ دُوْنِهِ وَلِيٌّ وَّلَا شَفِيْعٌ»
‘‘ওদের (মু’মিনদের) জন্য তিনি (আল্লাহ্ তা‘আলা) ভিনণ না আছে কোন বন্ধু আর না আছে কোন সুপারিশকারী’’। (আন্‘আম : ৫১)
তেমনিভাবে পরকালে তিনি ভিন্ন অন্য কোন বন্ধু কারোর কাজেও আসবে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَلَا يُغْنِيْ عَنْهُمْ مَّا كَسَبُوْا شَيْئًا وَلَا مَا اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ أَوْلِيَآءَ، وَلَـهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ»
‘‘তাদের ধন-সম্পদ এবং আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কোন বন্ধু সে দিন তাদের কোন কাজে আসবে না। উপরন্তু তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি’’।
(জা’সিয়াহ্ : ১০)
মূল কথা, ভালোবাসায় আল্লাহ্ তা‘আলার সঙ্গে কাউকে শরীক করে সত্যিকার ইবাদত করা যায় না। তবে আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য কাউকে ভালোবাসা এর বিপরীত নয়। বরং তা আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভালোবাসার পরিপূরকও বটে।
আবূ উমামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ أَحَبَّ لِلهِ وَأَبْغَضَ لِلهِ وَأَعْطَى لِلهِ وَمَنَعَ لِلهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانَ.
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্’র জন্য কাউকে ভালোবাসলো, আল্লাহ্’র জন্য কারোর সাথে শত্রুতা পোষণ করলো, আল্লাহ্’র জন্য কাউকে দিলো এবং আল্লাহ্’র জন্য কাউকে বঞ্চিত করলো সে যেন নিজ ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিলো’’। (আবূ দাউদ ৪৬৮১; ত্বাবারানী/কাবীর ৭৬১৩, ৭৭৩৭, ৭৭৩৮)
এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসাকে অন্য সবার ভালোবাসার উপর প্রধান্য না দিলে সে ব্যক্তি কখনো পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না।
অতএব আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য কাউকে ভালোবাসা যতই কঠিন হবে ততই আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসা কঠিন হবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে ভালোবাসা আবার চার প্রকার। যে গুলোর মধ্যে ব্যবধান না জানার দরুনই অনেকে এ ক্ষেত্রে পথভ্রষ্ট হয়। আর তা নিম্নরূপ:
ক. আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভালোবাসা। তবে তা নিরেট ভালোবাসা না হলে কখনো তা কারোর ফায়দায় আসবে না।
খ. আল্লাহ্ তা‘আলা যা ভালোবাসেন তাই ভালোবাসা। যে এ ভালোবাসায় যত অগ্রগামী সে আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসায় তত অগ্রগামী।
গ. আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য ভালোবাসা। এ ভালোবাসা উক্ত ভালোবাসার পরিপূরক।
ঘ. আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে অন্য কাউকে তাঁর সমপর্যায়েই ভালোবাসা। আর এটিই হচ্ছে শির্ক।
আরো এক প্রকারের ভালোবাসা রয়েছে যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আর তা হচ্ছে স্বভাবগত ভালোবাসা। যেমন: স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসা।
৭. চূড়ান্ত ভালোবাসা। এমন চরম ভালোবাসা যে, প্রেমিকের অন্তরে আর কাউকে ভালোবাসার কোন জায়গাই থাকে না। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে ‘‘খুল্লাহ্’’ এবং এ জাতীয় প্রেমিককে ‘‘খালীল’’ বলা হয়। আর এ জাতীয় ভালোবাসা শুধুমাত্র দু’ জন নবীর জন্যই নির্দিষ্ট। যারা হচ্ছেন ইব্রাহীম (আঃ) ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
জুন্দাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে এ কথা বলতে শুনেছি। তিনি বলেন:
إِنِّيْ أَبْرَأُ إِلَى اللهِ أَنْ يَّكُوْنَ لِيْ مِنْكُمْ خَلِيْلٌ، فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِيْ خَلِيْلًا، كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيْمَ خَلِيْلًا، وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أُمَّتِيْ خَلِيْلًا لَاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلًا.
‘‘তোমাদের মধ্য থেকে কেউ আমার খলীল হোক এ ব্যাপার থেকে আমি আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মুক্তি চাচ্ছি। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে নিজ খলীল হিসেবে চয়ন করেছেন যেমনিভাবে চয়ন করেছেন ইব্রাহীম (আঃ) কে। আমি যদি আমার উম্মত থেকে কাউকে খলীল বানাতাম তা হলে আবূ বকরকেই আমার খলীল বানাতাম’’। (মুসলিম ৫৩২)
খলীলের চাইতে হাবীব কখনো উন্নত হতে পারে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে নিজ খলীল বানাননি। তবে ‘আয়েশা তাঁর হাবীবাহ্ ছিলেন এবং আবূ বকর, ’উমর ও অন্যান্যরা তাঁর হাবীব ছিলেন।
এ কথা সবার জানা থাকা প্রয়োজন যে, ভালোবাসার পাত্র আবার দু’ প্রকার। যা নিম্নরূপ:
ক. স্বকীয়ভাবে যাকে ভালোবাসতে হয়। অন্য কারোর জন্য তার ভালোবাসা নয়। আর তা এমন সত্তার ব্যাপারে হতে পারে যার গুণাবলী চূড়ান্ত পর্যায়ের ও চিরস্থায়ী এবং যা তার থেকে কখনো ভিন্ন হয় না। তা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, মানুষ কাউকে দু’ কারণেই ভালোবাসে। আর তা হচ্ছে মহত্ত্ব ও পরম সৌন্দর্য। উক্ত দু’টি গুণ আল্লাহ্ তা‘আলার মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়েরই রয়েছে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতএব একান্ত স্বকীয়ভাবে তাঁকেই ভালোবাসতে হবে। তিনি ভিন্ন অন্য কাউকে নয়।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সব কিছু দিচ্ছেন, সুস্থ রাখছেন, সীমাহীন করুণা করছেন, তাঁর শানে অনেক অনেক দোষ করার পরও তিনি তা লুকিয়ে রাখছেন এবং ক্ষমা করে দিচ্ছেন, তিনি আমাদের দো‘আ কবুল করছেন, আমাদের সকল বিপদাপদ কাটিয়ে দিচ্ছেন; অথচ আমাদের প্রতি তাঁর কোন প্রয়োজন নেই বরং তিনি বান্দাহ্কে গুনাহ্ করার সুযোগ দিচ্ছেন, তাঁরই ছত্রছায়ায় বান্দাহ্ তার প্রবৃত্তির সকল চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছে যদিও তা তাঁর বিধান রিরুদ্ধ। সুতরাং আমরা তাঁকেই ভালো না বেসে আর কাকে ভালোবাসবো? বান্দাহ্’র প্রতি তাঁর পক্ষ থেকে শুধু কল্যাণই কল্যাণ নেমে আসছে অথচ তাঁর প্রতি বান্দাহ্’র পক্ষ থেকে অধিকাংশ সময় খারাপ আমলই উঠে যাচ্ছে, তিনি অগণিত নিয়ামত দিয়ে বান্দাহ্’র প্রিয় হতে চান অথচ তিনি তার মুখাপেক্ষী নন আর বান্দাহ্ গুনাহ্’র মাধ্যমে তাঁর অপ্রিয় হতে চায় অথচ সর্বদা সে তাঁর মুখাপেক্ষী। তারপরও আল্লাহ্’র অনুগ্রহ কখনো বন্ধ হচ্ছে না আর বান্দাহ্’র গুনাহ্ও কখনো কমছে না।
দুনিয়ার কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে তার স্বার্থের জন্যই ভালোবাসে কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাহ্কে ভালোবাসেন একমাত্র তারই কল্যাণে। তাতে আল্লাহ্ তা‘আলার কোন লাভ নেই।
দুনিয়ার কেউ কারোর সাথে কখনো লেনদেন করে লাভবান না হলে সে তার সাথে দ্বিতীয়বার আর লেনদেন করতে চায় না। লাভ ছাড়া সে সামনে এক কদমও বাড়াচ্ছে না। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাহ্’র সাথে লেনদেন করছেন একমাত্র তারই লাভের জন্য। নেক আমল একে দশ সাতশ’ পর্যন্ত আরো অনেক বেশি। আর গুনাহ্ একে এক এবং দ্রুত মার্জনীয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাহ্কে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই জন্যে। আর দুনিয়া ও আখিরাতের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন বান্দাহ্’র জন্যে।
বান্দাহ্’র সকল চাওয়া-পাওয়া একমাত্র তাঁরই নিকটে। তিনিই সবচেয়ে বড় দাতা। বান্দাহ্কে তিনি তাঁর নিকট চাওয়া ছাড়াই আশাতীত অনেক কিছু দিয়েছেন। তিনি বান্দাহ্’র পক্ষ থেকে কম আমলে সন্তুষ্ট হয়েই তাঁর নিকট তা ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন এবং গুনাহ্গুলো ক্ষমা করে দেন। তিনি তাঁর নিকট বার বার কোন কিছু চাইলে বিরক্ত হন না। বরং এর বিপরীতে তিনি তাতে প্রচুর সন্তুষ্ট হন। তিনি তাঁর নিকট কেউ কিছু না চাইলে খুব রাগ করেন।
আমাদের সবার জানা থাকা উচিত যে, আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি রক্ষা করে চলার নামই বিলায়াত। যার মূলে রয়েছে তাঁর একান্ত ভালোবাসা। শুধু নামায, রোযা কিংবা মুজাহাদার নামই বিলায়াত নয়। বান্দাহ্’র খারাপ কাজে তিনি লজ্জা পান। কিন্তু বান্দাহ্ তাতে একটুও লজ্জা পায় না। তিনি বান্দাহ্’র গুনাহ্সমূহ লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু বান্দাহ্ তার গুনাহ্গুলো লুকিয়ে রাখতে রাজি নয়। তিনি বান্দাহ্কে অগণিত নিয়ামত দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি কামনার প্রতি তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু বান্দাহ্ তা করতে অস্বীকার করে। তাই তিনি এ উদ্দেশ্যে যুগে যুগে রাসূল ও তাদের নিকট কিতাব পাঠান। এরপরও তিনি এ উদ্দেশ্যে প্রতি শেষ রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে বলতে থাকেন: কে আছো আমার কাছে চাইবে আমি তাকে সবই দেবো। কে আছো আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। তিনি বান্দাহ্’র প্রতি এতো মেহেরবান যে মাও তার সন্তানের প্রতি এতো মেহেরবানী করে না। বান্দাহ্’র তাওবা দেখে তিনি এতো বেশি খুশি হন যতটুকু খুশি সে ব্যক্তিও হয় না যে ধু ধু মরুভূমিতে খাদ্য-পানীয়সহ তার সওয়ারি হারিয়ে জীবনের আশা ছেড়ে দেয়ার পর আবার তা ফিরে পেয়েছে। তার আলোকে দুনিয়া আলোকিত। তিনি সর্বদা জাগ্রত। তাঁর জন্য কখনো ঘুম শোভা পায় না। তিনি সত্যিকার ইনসাফগার। তাঁর নিকট রাত্রের আমল উঠে যায় দিনের আমলের পূর্বে। দিনের আমল উঠে যায় রাতের আমলের পূর্বে। নূরই তাঁর আচ্ছাদন। সে আচ্ছাদন সরিয়ে ফেললে তাঁর ছেহারার আলোকরশ্মি তাঁর দৃষ্টির দূরত্ব পর্যন্ত তাঁর সকল সৃষ্টিকে জ্বালিয়ে ফেলবে। সুতরাং একমাত্র তাঁকেই ভালোবাসতে হবে।
জান্নাতের সর্ববৃহৎ নিয়ামত হবে সরাসরি আল্লাহ্ তা‘আলার সাক্ষাৎলাভ। আর আত্মার সর্বচূড়ান্ত স্বাদ তাতেই নিহিত রয়েছে। তা এখন থেকেই তাঁর ভালোবাসার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে এবং তাঁর ভালোবাসার মধ্যেই দুনিয়াতে আত্মার সমূহ তৃপ্তি নিহিত। এটাই মু’মিনের জন্য দুনিয়ার জান্নাত। এ কারণেই আলিমগণ বলে থাকেন: দুনিয়ার জান্নাত যে পেয়েছে আখিরাতের জান্নাত সেই পাবে। তাই আল্লাহ্ প্রেমিকদের কখনো কখনো এমন ভাব বা মজা অনুভব হয় যার দরুন সে বলতে বাধ্য হয় যে, এমন মজা যদি জান্নাতীরা পেয়ে থাকেন তা হলে নিশ্চই তাঁরা সুখে রয়েছেন।
খ. অন্যের জন্য যাকে ভালোবাসতে হয়। অর্থাৎ দুনিয়ার কাউকে ভালোবাসতে হলে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার জন্যই ভালোবাসতে হবে। স্বকীয়ভাবে নয়। তবে এ কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসা কখনো মনের বিপরীতও হতে পারে। তবে তা তাঁর জন্যই মেনে নিতে হবে যেমনিভাবে সুস্থতার জন্য অপছন্দ পথ্য খাওয়া মেনে নিতে হয়।
অতএব সর্ব নিকৃষ্ট ভালোবাসা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে ভালোবাসা। আর সর্বোৎকৃষ্ট ভালোবাসা হচ্ছে এককভাবে আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভালোবাসা এবং তাঁর ভালোবাসার বস্ত্তকে সর্বদা প্রাধান্য দেয়া।
ভালোবাসাই সকল কাজের মূল। চাই সে কাজ ভালোই হোক বা খারাপ। কারণ, কোন ব্যক্তিকে ভালোবাসলেই তার মর্জিমাফিক কাজ করতে ইচ্ছা হয় এবং কোন বস্ত্তকে ভালোবাসলেই তা পাওয়ার জন্য মানুষ কর্মোদ্যোগী হয়। সুতরাং সকল ধর্মীয় কাজের মূল হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসা যেমনিভাবে সকল ধর্মীয় কথার মূল হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দৃঢ় বিশ্বাস।
কোন ভালোবাসা কারোর জন্য লাভজনক প্রমাণিত হলে তার প্রভাব তথা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তার জন্য লাভজনক হতে বাধ্য। আর কোন ভালোবাসা কারোর জন্য ক্ষতিকর হলে তার প্রভাব তথা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তার জন্য ক্ষতিকর হতে বাধ্য। তাই আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভালোবেসে তাঁকে পাওয়ার জন্য কান্না করলে বা তাঁকে না পাওয়ার দরুন হৃদয়ে ব্যথা অনুভূত হলে তা বান্দাহ্’র কল্যাণেই আসবে। ঠিক এরই বিপরীতে কোন সুন্দরী মেয়ে অথবা শ্মশ্রুবিহীন সুদর্শন কোন ছেলেকে ভালোবেসে তাঁকে পাওয়ার জন্য কান্না করলে বা তাঁকে না পাওয়ার দরুন হৃদয়ে ব্যথা অনুভূত হলে তা কখনোই বান্দাহ্’র কল্যাণে আসবে না। বরং তা তার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলেই প্রমাণিত হবে।
সুন্দরী কোন নারী অথবা শ্মশ্রুবিহীন সুদর্শন কোন ছেলেকে এমনভাবে ভালোবাসা যে, তার সন্তুষ্টিকে আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির উপর প্রাধান্য দেয়া হয়, কখনো আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার ও তার অধিকার পরস্পর সাংঘর্ষিক হলে তার অধিকারকেই প্রাধান্য দেয়া হয়, তার জন্য মূল্যবান সম্পদ ব্যয় করা হয় অথচ আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য মূল্যহীন সম্পদ, তার জন্য মূল্যবান সময় ব্যয় করা হয় যা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য করা হয় না, সর্বদা তার নৈকট্যার্জনের চেষ্টা করা হয় অথচ আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্যার্জনের একটুও চেষ্টা করা হয় না এমন ভালোবাসা বড় শির্ক যা ব্যভিচার চাইতেও অত্যন্ত মারাত্মক।