একই বছর রমাযান মাসে নাবী কারীম (ﷺ) হারাম শরীফের উদ্দেশ্যে বের হন। কুরাইশগণের এক বিরাট জনতা সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নাবী কারীম (ﷺ) সেখানে উপস্থিত হয়েই আকস্মিকভাবে সুরায়ে ‘নাজাম’ পাঠ করতে আরম্ভ করেন। ঐ সকল লোকেরা ইতোপূর্বে কুরআন শ্রবণ করত না এবং কোথাও কুরআন পাঠ করা হলে তারা শোরগোল করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করত যাতে তা শ্রুতিগোচর না হয়। কারণ, তাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল কুরআন শ্রবণ করলে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়বে। কুরআনের ভাষায় ব্যাপারটি ছিল এরূপঃ
(لاَ تَسْمَعُوْا لِهٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ) [فصلت:26]
‘‘এ কুরআন শুনো না, আর তা পড়ার কালে শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার।’ (ফুসসিলাত ৪১ : ২৬)
কিন্তু নাবী কারীম (ﷺ) যখন এ সূরাহটি পাঠ আরম্ভ করলেন তখন এর অশ্রুত পূর্ব সুললিত বানী, অবর্ণনীয় কমনীয়তা ও অপরূপ মিষ্টতা যখন তাদের কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হল তখন তারা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সম্পূর্ণ ভাবাবিষ্ট এবং হতচকিত হয়ে পড়লেন। ইতোপূর্বে কুরআন পাঠের সময় তারা যেভাবে গন্ডগোল করত সে রকম গন্ডগোল করা তো দূরের কথা বরং আরও গভীর মনোযোগের সঙ্গে কান পেতে তারা তা শুনতে থাকল। তাদের অন্তরে ভিন্নমুখী কোন ভাবেরই উদ্রেক হল না। তারপর নাবী কারীম (ﷺ) যখন এ সূরাহর শেষের আয়াতসমূহ পাঠ করতে থাকলেন তখন তাদের অন্তরে কম্পন সৃষ্টি হতে থাকল। যখন তিনি আল্লাহর নির্দেশ-সম্বলিত শেষের আয়াতটি পাঠ করলেন :
(فَاسْجُدُوْا لِلهِ وَاعْبُدُوْا)
[1]
‘‘তাই, আল্লাহর উদ্দেশে সিজদাহয় পতিত হও আর তাঁর বন্দেগী কর। [সাজদাহ] (আন-নাজম ৫৩ : ৬২)
অতঃপর রাসূল (ﷺ) সিজদা করলেন এবং সাথে উপস্থিত মুশরিকরাও সকলে সিজদা করল।
কিন্ত পরক্ষণেই যখন ভাবাবিষ্ট অবস্থা থেকে তাঁরা স্বাভাবিকতায় প্রত্যাবর্তন করলেন তখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন যে, আল্লাহর কুরআনের অলৌকিকত্ব তাদের স্বকীয়তা বিনষ্ট করে দিয়েছে যার ফলে তাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহ করতেও বাধ্য হয়েছেন। অথচ যাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাহহ করেন তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য তাঁরা বদ্ধপরিকর। এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তাঁরা আত্মগ্লানির অনলে দগ্ধীভূত হতে থাকেন। তাঁদের এ শোচনীয় মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে যখন অনুপস্থিত অন্যান্য মুশরিকগণ এ আচরণের জন্য তাঁদের লজ্জা দিতে ও নিন্দা জ্ঞাপন করতে থাকেন।
এ ত্রিশংকু অবস্থা থেকে আত্মরক্ষা এবং তাঁদের সমালোচনা মুখর মুশরিকগণের দৃষ্টির মোড় পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে অপবাদ দিয়ে একটি অপপ্রচার শুরু করলেন। তাঁরা একটি নির্জলা মিথ্যাকে নানা রূপ ও রং দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচার শুরু করলেন যে, তিনি তাঁদের প্রতিমাসমূহের ইজ্জত ও সম্মানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেনঃ
(تِلْكَ الْغَرَانِيْـقُ الْعُلٰى، وَإِنَّ شَفَاعَتَهُمْ لَتُرْتَجٰى)
(এরা সব উচ্চ পর্যায়ের দেবদেবী, তাদের শাফা‘আতের আশা করা যায়।)
অথচ তা ছিল মিথ্যা। নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে সিজদাহ করে তাদের ধারণায় তারা যে ভুলটি করেছিলেন তার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই তাঁদের এ অপপ্রচার। নাবী (ﷺ) সম্পর্কে সর্বদাই যাঁরা মিথ্যা কুৎসা রটনা এবং নানা অপপ্রচারে লিপ্ত থাকতেন এ ক্ষেত্রেও যে তাঁরা তা করবেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, যে কোন সূত্রে যে কোন মুহূর্তে নাবী (ﷺ)-এর নির্মল চরিত্রে কলংক লেপন করতে তারা কখনই কুণ্ঠা বোধ করবেন না।[2]
যা হোক, কুরাইশ মুশরিকগণের সিজদাহ করার খবর আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলিমগণের নিকটও গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু সেই সংবাদের রকম-সকম ছিল ভিন্ন। মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত কথার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যেমন নানা রং-চংয়ের সংযোজন ও সংমিশ্রণ ঘটে যায় এ ক্ষেত্রেও হল ঠিক তাই। আবিসিনিয়ায় অবস্থানকারী মুহাজিরগণ খবর পেলেন যে, মক্কার কুরাইশগণ মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। এ কথা শোনা মাত্রই স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনেকেরই মনে ব্যগ্রতা পরিলক্ষিত হল এবং পরবর্তী শওয়াল মাসেই তাঁদের একটি দল মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। কিন্তু মক্কা থেকে তাঁরা এক দিনের পথের দূরত্বে অবস্থান করছিলেন তখন প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, ব্যাপারটি যেভাবে তাঁদের নিকট চিত্রিত করা হয়েছে প্রকৃত ঘটনাটি তা নয়। তাই দলের কিছু সংখ্যক লোক আবিসিনিয়া অভিমুখে পুনরায় যাত্রা করলেন এবং কিছু সংখ্যক সঙ্গোপনে কিংবা কুরাইশগণের আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন।[3]
এর পর মক্কা প্রত্যাগত মুহাজিরগণের উপর বিশেষভাবে এবং অন্যান্য মুসলিমগণের উপর সাধারণভাবে কুরাইশগণের অন্যায়, অত্যাচার ও উৎপীড়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেল। শুধু মুহাজিরগণই নন, এমন কি তাঁদের পরিবার পরিজনও এ নির্যাতনের হাত থেকে নিস্তার পেল না। এর কারণ হচ্ছে ইতোপূর্বে কুরাইশগণ যখন অবগত হয়েছিলেন যে, আবিসিনিয়ায় মুহাজিরগণের সাথে নাজ্জাশী অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে আচরণ করছেন এবং নানাভাবে তাঁদের প্রতি মদদ জুগিয়ে চলেছেন। মুসলিমদের উপর প্রতিহিংসাপরায়ণ কুরাইশদের জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পরামর্শ দিলেন পুনরায় আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে।
[2] বিশেষজ্ঞগণ এ বর্ণনা সূত্রের সমস্ত পথগুলো যাচাই করার পরে এ ফলাফলের গ্রহণ করেছেন।
[3] যাদুল মা’আদ ১ম খন্ড ২৪ পৃঃ এবং ২য় খন্ড ৪৪পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৬৪ পৃঃ।