আল্লাহর রসূল (ﷺ) (তাহাজ্জুদের) নামাযে যখন কুরআন পড়তেন, তখন ধীরে ধীরে পড়তেন। কোন তাসবীহর আয়াত পাঠ করলে তাসবীহ পড়তেন, কোন প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে প্রার্থনা করতেন এবং কোন আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৭৭২ নং)
ব্যাপারটি নফল নামাযের হলেও ফরয নামাযেও আমল করা বৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৬)
তিনি সূরা কিয়ামাহ্ এর শেষ আয়াত, أَلَيْسَ ذلِكَ بِقَادِرٍ عَلى أَنْ يُحْيِىَ الْمَوْتى (অর্থাৎ যিনি এত কিছু করেন তিনি কি মৃতকে পুনঃজীবিত করতে সক্ষম নন?) পড়লে জওয়াবে বলতেন, سُبْحَانَكَ فَبَلى (সুবহা-নাকা ফাবালা), অর্থাৎ তুমি পবিত্র, অবশ্যই (তুমি সক্ষম)।
সূরা আ’লার প্রথম আয়াত, سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلىঅর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা কর) পাঠ করলে জওয়াবে বলতেন,سُبْحَانَ رَبِّىَ الأَعْلى (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা। অর্থাৎ আমি আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করছি)। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৮৩, ৮৮৪নং, বায়হাকী)
আল্লামা আলবানী বলেন, উক্ত আয়াতদ্বয়ের জওয়াবে উক্ত দুআ বলার ব্যাপারটা সাধারণ; অর্থাৎ, ক্বিরাআত নামাযে হোক বা তার বাইরে, ফরযে হোক বা নফলে সর্বক্ষেত্রে উক্ত জওয়াব দেওয়া যাবে। আবূ মূসা আশআরী এবং উরওয়াহ্ বিন মুগীরাহ্ ফরয নামাযে উক্ত দুআ বলতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৮৬৩৯, ৮৬৪০, ৮৬৪৫ নং)
একদা মহানবী (ﷺ) সাহাবীদের নিকট সূরা রহ্মান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন। সাহাবীগণ নীরব বসে তেলাওয়াত শুনছিলেন। তিনি বললেন, “যে রাত্রে আমার নিকট জিনের দল আসে, সে রাত্রে আমি উক্ত সূরা ওদের নিকট পাঠ করলে ওরা সুন্দর জওয়াব দিচ্ছিল। যখনই আমি পাঠ করছিলাম,
فَبِأَيِّ آلاَءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبانِ
(অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ নিয়ামতকে অস্বীকার কর?) তখনই তারাও এর জওয়াবে বলছিল,
لاَ بِشَيْءٍ مِّنْ نِّعَمِكَ رَبَّنَا نُكَذِّبُ، فَلَكَ الْحَمْدُ।
উচ্চারণ:- লা বিশাইইম মিন নিআ’মিকা রাব্বানা নুকাযযিবু, ফালাকালহাম্দ।
অর্থ:- তোমার নেয়ামতসমূহের কোন কিছুকেই আমরা অস্বীকার করি না হে আমাদের প্রতিপালক! (তিরমিযী, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২১৫০নং)
এ তো গেল ইমাম বা একাকী নামাযীর কথা। কিন্তু মুক্তাদী হলে ইমাম চুপ থেকে ঐ সমস্ত দুআ পাঠ করলে সেও পড়তে পারে। নচেৎ ইমাম চুপ না হলে ইমামের ক্বিরাআত চলাকালে ঐ সমস্ত জওয়াব পড়া বৈধ নয়। কারণ, ক্বিরাআতের সময় ইমামের পশ্চাতে সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্য কিছু পড়ার অনুমতি নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪)
ক্বিরাআতে মুসহাফের তরতীব (অনুক্রম) বজায় রেখে পাঠ করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, দ্বিতীয় সূরা বা দ্বিতীয় রাকআতে যে সূরা পাঠ করবে, তা যেন মুসহাফে প্রথমে পঠিত সূরার পরে হয়। অবশ্য এর বিপরীত করা দোষাবহ্ নয়; বরং বৈধ। যেমন মহানবী (ﷺ) এর তাহাজ্জুদের ক্বিরাআতে আমরা জানতে পারব। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৪৮, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১০৪পৃ:, ৪নং টীকা)
মহানবী (ﷺ) আল্লাহর আদেশ অনুসারে ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে কুরআন পাঠ করতেন; তাড়াহুড়ো করে শীঘ্রতার সাথে নয়। বরং এক একটা হ্রফ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে পাঠ করতেন। (ইবনুল মুবারক, যুহ্দ, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১২৪পৃ:)
তিনি বলতেন, “কুরআন তেলাওয়াতকারীকে পরকালে বলা হবে, ‘পড়তে থাক এবং মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক। আর (ধীরে ধীরে, শুদ্ধভাবে কুরআন) আবৃত্তি কর, যেমন দুনিয়ায় অবস্থানকালে আবৃত্তি করতে। যেহেতু যা তুমি পাঠ করতে তার সর্বশেষ আয়াতের নিকট তোমার স্থান হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, জামে ৮১২২ নং)
তিনি ‘হ্রফে-মাদ্দ্ ‘ (আলিফ, ওয়াউও ইয়া) কে টেনে পড়তেন। (বুখারী ৫০৪৫, আবূদাঊদ, সুনান ১৪৬৫ নং) কখনো কখনো বিনম্র সুরে ‘আ-আ-আ’ শব্দে অনুরণিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। (বুখারী ৭৫৪০, মুসলিম, সহীহ)
তিনি কুরআন মধুর সুরে পাঠ করতে আদেশ করতেন; বলতেন :-
“তোমাদের (সুমিষ্ট) শব্দ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কারণ, মধুর শব্দ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।” (বুখারী তা’লীক, আবূদাঊদ, সুনান ১৪৬৮, দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)
“কুরআন পাঠে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আওয়াজ তার, যার কুরআন পাঠ করা শুনে মনে হয়, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।” (যুহ্দ, ইবনুল মুবারক, দারেমী, সুনান, ত্বাবারানী, মু’জাম, প্রমুখ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১২৫ পৃ:)
“তোমরা আল্লাহর কিতাব শিক্ষা কর, (পাঠ করার মাধ্যমে) তার যত্ন কর, তা ঘরে রাখ এবং সুরেলা কণ্ঠে তা তেলাওয়াত কর। কারণ, উট যেমন রশির বন্ধন থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায়।” (দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/১৪৬, ১৫০, ১৫৩, ৩৯৭)
তিনি আরো বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন পড়ে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৪৭১, ১৪৭৯,হাকেম, মুস্তাদরাক)
কুরআন পাঠকালে তিনি প্রত্যেক আয়াত শেষে থামতেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৪৩ নং)
মহানবী (ﷺ) একই বা কাছাকাছি অর্থবোধক দুই সূরাকে কখনো কখনো একই রাকআতে পাঠ করতেন। (বুখারী ৭৭৫, মুসলিম, সহীহ ৭২২ নং) সূরা রহ্মান (৫৫নং সূরা / ৭৮ আয়াত বিশিষ্ট) ও নাজম (৫৩/৬২) এক রাকআতে, সূরা ইক্বতারাবাত (৫৪/৫৫) ওহা-ক্বাহ্ (৬৯/৫২) এক রাকআতে, সূরা তূর (৫২/৪৯) ও যারিয়াত (৫১/৬০) এক রাকআতে, সূরা ওয়া-ক্বিআহ্ (৫৬/৯৬) ও নূন (৬৮/৫২) এক রাকআতে, সূরা মাআ-রিজ (৭০/৪৪) ও না-যিআত (৭৯/৪৬) এক রাকআতে, সূরা মুত্বাফফিফীন (৮৩/৩৬) ও আবাসা (৮০/৪২) এক রাকআতে, সূরা মুদ্দাষষির (৭৪/৫৬) ও মুযযাম্মিল (৭৩/২০) এক রাকআতে, সূরা দাহ্র (৭৬/৩১) ও ক্বিয়ামাহ্ (৭৫/৪০) এক রাকআতে, সূরা নাবা (৭৮/৪০) ও মুরসালাত (৭৭/৫০) এক রাকআতে এবং সূরা দুখান (৪৪/৫৯) ও তাকবীর (তাকভীর) (৮১/২৯) এক রাকআতে পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১৩৯৬ নং)
আবার কখনো কখনো সূরা বাক্বারাহ্, আ-লে ইমরান ও নিসার মত বড় বড় সূরাকেও একই রাকআতে পাঠ করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৭৭২ নং)