এই বাক্য কি কুফরি হবে যে, তুমি এমন আত্মসম্মান নিয়ে আসো যে, আল্লাহ তকদির লেখার আগে জিজ্ঞাসা করবেন যে, বান্দা তুমি কী চাও?

এ বাক্যটি মারাত্মক ভ্রান্ত ও ইমান বিধ্বংসী কুফরি কথা।

নিম্নে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো: و بالله التوفيق

প্রথমত: তকদিরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হলো, ঈমানের ছয়টি রোকনের একটি। এ ছাড়া ইমানের দাবী করার সুযোগ নাই। এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে পর্যাপ্ত দলিল এসেছে। আর তকদিরের উপর ইমানের অন্তর্গত হলো এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ রব্বুল আলামিন আসমান-জমিন সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বেই সবকিছুর তকদির লিপিবদ্ধ করেছেন।

যেমন: হাদিসে এসেছে,

আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,


إنَّ اللَّهَ قدَّرَ مقاديرَ الخلائقِ قبلَ أن يخلقَ السَّمواتِ والأرضَ بخمسينَ ألفَ سنةٍ

‘‘আল্লাহ তা‘আলা আসমান-জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত সৃষ্টির তকদির লিপিবদ্ধ করেছেন।” [সহীহ বুখারী, হা/৩১৯১]
সুতরাং বান্দার তকদির লেখার আগে মহান আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন-এটা মারাত্মক ভ্রান্ত ও ইমন বিধ্বংসী কথা। কারণ মহান আল্লাহ তার সকল কর্মে স্বাধীন। ‌তিনি যা ইচ্ছে তাই করেন। তিনি কাউকে জিজ্ঞাসা করে তকদির লিখেন না। এটা তার বড়ত্ব, মর্যাদা ও শানের খেলাফ। বরং সবকিছুই সেভাবেই সংঘটিত হয় যেভাবে তিনি তকদিরে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং যখন যেভাবে চান। এর ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব নয়।

 আল্লাহ তাআলা বলেন,


فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ

“তিনি যা চান তাই করেন’’ [সূরা বুরুজ: ১৫]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বহাবি বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা যখন যা ইচ্ছা তাই করেন। فعال لما يريد এর মধ্যে ما শব্দটি সাধারণ মাওসুলা। এর অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলা যা করার ইচ্ছা করেন তা সবই করেন। তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত ইচ্ছার ব্যাপারে এ কথা। তার যে ইচ্ছা বান্দার কাজের সাথে সম্পৃক্ত, তার জন্য রয়েছে আরেক অবস্থা। বান্দা থেকে তিনি যে কাজ সম্পাদিত হওয়ার ইচ্ছা করেন, কিন্তু নিজের পক্ষ হতে বান্দাকে যদি উক্ত কাজ করতে সাহায্য না করেন এবং বান্দাকে কর্ম বাস্তবায়ন কারী না বানান তাহলে সে কাজ সংঘটিত হয় না। যদিও তিনি শরিয়ত গত দিক থেকে তার ইচ্ছা করেন। কিন্তু বান্দাকে কর্ম সম্পাদনকারী না বানানো পর্যন্ত সে কাজ সংঘটিত হয় না।” [শারহুল আক্বীদা আত্-ত্বহাবীয়া, অধ্যায়: ১৪. সৃষ্টি করার পর তার গুণবাচক নাম খালিক (সৃষ্টিকর্তা) হয়নি এবং সৃষ্টি জগৎ উদ্ভাবন করার কারণে তার গুণবাচক নাম উদ্ভাবক হয়নি (لَيْسَ بَعْدَ خَلْقِ الْخَلْقِ اسْتَفَادَ اسم الْخَالِق وَلَا بِإِحْدَاثِهِ الْبَرِيَّةَ اسْتَفَادَ اسم الْبَارِي)- ইমাম ইবনে আবিল ইয আল হানাফি রাহ.]


আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,


‏ لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ ‎

“তিনি যা করেন সে সম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন না এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে।” [সূরা আম্বিয়া: ২৩]


হাদিসে এসেছে, আবুল আসওয়াদ দুআলী রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রখ্যাত সাহাবি ইমরান ইবনে হুসাইন রা. আমাকে বললেন,


أَرَأَيْتَ مَا يَعْمَلُ النَّاسُ الْيَوْمَ وَيَكْدَحُونَ فِيهِ أَشَىْءٌ قُضِيَ عَلَيْهِمْ وَمَضَى عَلَيْهِمْ مِنْ قَدَرِ مَا سَبَقَ أَوْ فِيمَا يُسْتَقْبَلُونَ بِهِ مِمَّا أَتَاهُمْ بِهِ نَبِيُّهُمْ وَثَبَتَتِ الْحُجَّةُ عَلَيْهِمْ فَقُلْتُ بَلْ شَىْءٌ قُضِيَ عَلَيْهِمْ وَمَضَى عَلَيْهِمْ قَالَ فَقَالَ أَفَلاَ يَكُونُ ظُلْمًا قَالَ فَفَزِعْتُ مِنْ ذَلِكَ فَزَعًا شَدِيدًا وَقُلْتُ كُلُّ شَىْءٍ خَلْقُ اللَّهِ وَمِلْكُ يَدِهِ فَلاَ يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ ‏.‏ فَقَالَ لِي يَرْحَمُكَ اللَّهُ إِنِّي لَمْ أُرِدْ بِمَا سَأَلْتُكَ إِلاَّ لأَحْزُرَ عَقْلَكَ إِنَّ رَجُلَيْنِ مِنْ مُزَيْنَةَ أَتَيَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالاَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ مَا يَعْمَلُ النَّاسُ الْيَوْمَ وَيَكْدَحُونَ فِيهِ أَشَىْءٌ قُضِيَ عَلَيْهِمْ وَمَضَى فِيهِمْ مِنْ قَدَرٍ قَدْ سَبَقَ أَوْ فِيمَا يُسْتَقْبَلُونَ بِهِ مِمَّا أَتَاهُمْ بِهِ نَبِيُّهُمْ وَثَبَتَتِ الْحُجَّةُ عَلَيْهِمْ فَقَالَ ‏"‏ لاَ بَلْ شَىْءٌ قُضِيَ عَلَيْهِمْ وَمَضَى فِيهِمْ وَتَصْدِيقُ ذَلِكَ فِي كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ :‏(‏ وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا - فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا‏)‏ ‏"‏

“আজকাল লোকেরা যে সব আমল করে এবং যে কষ্ট করে, সে সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কী? তা কি এমন কিছু যা তাদের উপর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এবং ভাগ্যলিপি দ্বারা তাদের উপর পূর্ব নির্ধারিত? নাকি ভবিষ্যতে তারা করবে যা তাদের কাছে তাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন এবং যাদের উপর দলিল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
তখন আমি বললাম, “বরং ব্যাপারটি তো তাদের উপর অতীতে নির্ধারিত হয়ে গেছে।”
বর্ণনাকারী বলেন, তখন তিনি (ইমরান রা.) বললেন, তাহলে তা কি জুলুম হবে না?
তিনি বললেন, এতে আমি খুবই ঘাবড়ে গেলাম এবং বললাম, প্রতিটি বস্তুই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর ক্ষমতার অধীন। সুতরাং তিনি যা করেন, সে বিষয়ে কেউ তাকে প্রশ্ন করতে পারবে না বরং তাদেরই জবাবদিহি করতে হবে।

এরপর তিনি (ইমরান রা.) আমাকে বললেন, আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন। আমি তোমাকে প্রশ্ন করে তোমার জ্ঞানের (ইলমের যথার্থতা) উপলব্ধি অনুমান করতে চেয়েছিলাম।
মুযায়না গোত্রের দুজন লোক রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, ইয়া রসুলাল্লাহ! লোকেরা বর্তমানে যে সব আমল করে এবং কষ্ট-পরিশ্রম করে, সেগুলো কি তাদের জন্য ফয়সালা হয়ে গিয়েছে, আগেই তকদির দ্বারা নির্ধারিত নাকি ভবিষ্যতে তারা সে সব আমল করবে, যা তাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে নিয়ে এসেছে এবং তাদের উপর দলিল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?


তখন তিনি বললেন, না বরং বিষয়টি তাদের জন্য আগেই ফয়সালা হয়ে গেছে এবং সু সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর কিতাবে তার প্রমাণ। (আল্লাহ বলেন,)


وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا‏

"আর কসম মানুষের এবং তার, তিনি তাকে সুঠাম করেছেন, এরপর তাকে তিনি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান দান করেছেন।" [সূরা শামস: ৭ ও ৮]
[সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৮/ তকদির, পরিচ্ছেদ: ১. মাতৃ উদরে মানুষ সৃষ্টির অবস্থা (ক্রমধারা), তার রিজিক, মৃত্যু, আমল এবং তার দুর্ভাগ্য ও তার সৌভাগ্য লিপিবদ্ধকরণ]

দ্বিতীয়ত: বান্দা কি নিজে নিজে আত্মসম্মান নিয়ে আসতে পারে আল্লাহ যদি তা তার আগে থেকেই তার তকদির লিপিবদ্ধ করে না রাখেন? তাহলে এমন কথা কি তকদিরের পূর্বে বান্দার কাজ করার ক্ষমতা প্রমাণিত হয় না? সুতরাং নিঃসন্দেহে এ কথা তকদিরের প্রতি ঈমানের‌ সাথে সাংঘর্ষিক। মোটকথা উক্ত কথাটি ঈমান পরিপন্থী ও কুফরি মূলক কথা। এতে কোন সন্দেহ নেই।


আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে গোমরাহি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।