❑ এক. ইসলামের দৃষ্টিতে হিজড়াদের সাথে মেলামেশা, লেনদেন, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির বিধান:
আমাদের জানা আবশ্যক যে, একজন হিজড়া এবং সাধারণ মানুষের মাঝে মৌলিক কোন পার্থক্য নাই বিয়ে-যৌনতা ইত্যাদি কিছু বিধি-বিধান ছাড়া। তারাও আল্লাহর প্রতি ঈমান-কুফরি, আল্লাহর আনুগত্য-নাফরমানি, ইবাদত-বন্দেগি, ইসলামের বিধিবিধান পালন এবং সামাজিক সম্মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতই। তারাও ইসলাম, ঈমান, তাকওয়া-পরহেজগারিতা, হালাল-হারাম ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত।
তারা যদি নেকির কাজ করে তাহলে আখিরাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরষ্কার প্রাপ্ত হবে এবং যদি কোন অন্যায় করে আখিরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। কারণ তারাও মানুষ। আর প্রতিটি সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের উপর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ প্রযোজ্য।
আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সকল মানুষের উদ্দেশ্য বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে পারবে।” [সূরা বাকারা: ২১]
তিনি আরও বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً
“হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।” [সূরা নিসা: ১]
আল্লাহ তাআলা মানবজাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।” [সূরা যারিয়াত: ৫৬]
এভাবে কুরআনে আল্লাহ মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের অন্যান্য সুস্থ মস্তিষ্ক ও প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মানুষই এর অন্তর্ভুক্ত। চাই সে সুস্থ হোক, অসুস্থ হোক, স্বাভাবিক হোক বা প্রতিবন্ধী হোক, সাধারণ নারী-পুরুষ হোক বা হিজড়া হোক। কেউই এ নির্দেশনার বাইরে নয়। তবে তারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। এটি আল্লাহ তাআলার কর্ম কুশলতা এবং সৃষ্টি বৈচিত্রের নিদর্শন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে হিজড়াদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা হয় এবং সামাজিকভাবে তাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। যার কারণে তারাও জীবন-জীবিকার তাগিদে এমন কিছু কাজ করে যা অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়-জুলুমের পর্যায়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সুতরাং তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, তাদেরকে সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে এবং তাদের প্রতি সব ধরণের বৈষম্য এবং বর্ণবাদী মনোভাব দূর করতে হবে।
অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রতিবন্ধীদের মত লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হিজড়ারা আমাদের সভ্য সমাজেরই অংশ। তারা আমাদেরই কারও সন্তান। অতএব তাদেরকে নপুংসক বলে তিরস্কার করা যাবে না, তাদেরকে হেয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবহেলা করা যাবে না, অন্যায়ভাবে তাদের উপর জুলুম-নির্যাতন করা যাবে না, তাদেরকে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, হালাল পন্থায় চিত্তবিনোদন, সামাজিক নিরাপত্তা, বিচার পাওয়া ইত্যাদি কোনও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
মোটকথা, যারা সৃষ্টিগতভাবে প্রকৃতই হিজড়া ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের সাথে সাধারণভাবে মেলামেশা, উঠবস, লেনদেন, খাওয়া-দাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে কোন আপত্তি নেই। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকাও জরুরি যে, বর্তমানে হিজড়া হিসেবে পরিচিত কিছু মানুষ প্রকৃত হিজড়া নয় বরং তারা কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে হিজড়া বেশ ধারণ করে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে আবার কিছু মানুষকে দুষ্কৃতিকারীরা বাধ্য করে হিজড়া বানিয়ে রেখেছে বিশেষ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।
❑ দুই. হিজড়াদের সাথে আচরণের পদ্ধতি ও মূলনীতি:
বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিকাহবিদ এবং সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. বলেন,
الخنثى فيه تفصيل؛ فالخنثى قبل البلوغ يشتبه هل هو ذكر أو أنثى؛ لأن له آلتين آلة امرأة وآلة رجل، لكن بعد البلوغ يتبين في الغالب ذكورته أو أنوثته. فإذا ظهر منه ما يدل على أنه امرأة مثل أن يتفلك ثدياه، أو ظهر عليه ما يميزه عن الرجال بحيض أو بول من آلة الأنثى، فهذا يحكم بأنه أنثى وتزال منه آلة الذكورة بالعلاج الطبي المأمون. وإذا ظهر منه ما يدل على أنه ذكر كنبات اللحية والبول من آلة الذكر وغيرها مما يعرفه الأطباء فإنه يحكم بأنه ذكر ويعامل معاملة الرجال، وقبل ذلك يكون موقوفًا حتى يتبين الأمر، فلا يزوج حتى يتبين الأمر هل هو ذكر أو أنثى، وهو بعد البلوغ كما قال العلماء بتبين أمره
“হিজড়ার ব্যাপারে ব্যাখ্যা রয়েছে। বয়ঃসন্ধির আগে একজন হিজড়া সে পুরুষ না মহিলা তা অনিশ্চিত। কারণ তার দুটি অঙ্গ রয়েছে-একটি নারীর, অপরটি পুরুষের। কিন্তু বয়ঃসন্ধির পর তার পুরুষত্ব বা নারীত্ব প্রায়শই স্পষ্ট হয়ে যায়। যদি লক্ষণ দেখা যায় যে, সে একজন নারী, যেমন: তার স্তন শিথিল হয়ে যাওয়া, অথবা এমন কিছু যা তাকে পুরুষদের থেকে আলাদা করে। যেমন: ঋতুস্রাব বা স্ত্রীলিঙ্গ থেকে প্রস্রাব নির্গত হওয়া ইত্যাদি তাহলে তাকে নারী বলে গণ্য করা হবে এবং নিরাপদ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার পুরুষাঙ্গটি রিমুভ করে ফেলতে হবে।
আর যদি তার মধ্যে এমন কিছু পাওয়া যায় যা ইঙ্গিত করে যে, সে একজন পুরুষ, যেমন: দাড়ি বৃদ্ধি, পুরুষ লিঙ্গ থেকে প্রস্রাব নির্গত হওয়া ইত্যাদি যে সব বিষয় ডাক্তারগণ জানেন, তাহলে তাকে পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তার সাথে পুরুষের মতই আচরণ করা হবে।
তবে যদি কোনো একটি দিক পরিষ্কার না হয় তাহলে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত থাকবে। তাই যতদিন না বিষয়টি পরিষ্কার হবে যে তিনি একজন পুরুষ অথবা নারী (যা বিশেষজ্ঞদের মতে বয়ঃসন্ধির মাধ্যম প্রকাশিত হয়) তার বিয়ে দেওয়া যাবে না।” [binbaz org]