উপরের ২৫টা অনুচ্ছেদে আমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নিকট স্বীকৃত (canonical) বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন বক্তব্য উল্লেখ করেছি, যেগুলোকে মুসলিম লেখকরা মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে গণ্য করেছেন। সর্বশেষ একটা অস্বীকৃত ইঞ্জিলের বক্তব্য উদ্ধৃত করেই আমাদের আলোচনা শেষ করব।
বার্নাবাস (Barnabas) যীশুর অন্যতম শিষ্য ছিলেন। আমরা ইতোপূর্বে প্রথম অধ্যায়ে দেখেছি যে, তাঁর নামে তিনটা কর্ম বাইবেলের অস্বীকৃত পুস্তকগুলোর মধ্যে রয়েছে: (১) বার্নাবাসের পত্র (the Epistle of Barnabas) (২) বার্নাবাসের কার্যবিবরণী (Acts of Barnabas) ও (৩) বার্নাবাসের ইঞ্জিল (Gospel of Barnabas)। উইকিপিডিয়ার ভাষ্য থেকে এ ইঞ্জিলটার প্রাচীন দু’টো পাণ্ডুলিপির বিদ্যমানতার কথা জানা যায়, যেগুলো ১৬শ শতাব্দীতে ইটালি ও স্পেনীয় ভাষায় লিখিত। অষ্টাদশ শতকে প্রসিদ্ধ পাদরি ও প্রাচ্যবিদ জর্জ সেল এবং অক্সফোর্ডের প্রফেসর ড. মেনকহাউসর মাধ্যমে সুসমাচারটার ইংরেজি অনুবাদ করা হয়। ১৯০৭ সালে ইংরেজি অনুবাদটা প্রকাশ করা হয়।
খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, কোনো মুসলিম এই গসপেলটা লেখে ‘বার্নাবাসের’ নামে চালিয়েছে। তবে লক্ষণীয় যে, বার্নাবাসের ইঞ্জিলে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম, ইহূদী রীতিনীতি ও যীশুর সমসাময়িক বিষয়াবলির যে সকল বিবরণ রয়েছে তা প্রমাণ করে যে, ইঞ্জিলটার লেখক অত্যন্ত প্রাজ্ঞ পুরতান নিয়মের গভীর জ্ঞানধারী ইহূদী ছিলেন। এছাড়া এর ভাষা, পরিভাষা ও বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তা প্রথম খৃস্টীয় শতকে লিখিত। সর্বোপরি কোনো মুসলিম পন্ডিত যদি এ গ্রন্থটার রচনার সাথে জড়িত থাকতেন তবে অবশ্যই তা মুসলিমদেরক সাহায্য করার জন্যই করতেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি বইটার বিষয়ে মুসলিমদেরকে জানাতেন এবং এর বিষয়বস্ত্তকে খৃস্টানদের বিরূদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, বিংশ শতাব্দীতে ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার আগে কোনো মুসলিম আলিম বইটার কথা জানতেনই না। ৭ম/৮ম খৃস্টীয় শতক থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত শতশত মুসলিম পন্ডিত খৃস্টধর্মের আলোচনা, সমালোচনা ও বাইবেলের আলোকে মুহাম্মাদ (ﷺ) ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কেউই কখনো ‘বার্নাবাসের ইঞ্জিলের’ উদ্ধৃতি দেননি বা এর বিষয়বস্ত্তও উল্লেখ করেননি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো মুসলিম এটার রচনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।
বার্ণাবাসের ইঞ্জিলে বিভিন্ন স্থানে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এক স্থানে ঈসা মাসীহ বলেন: ‘‘হে বার্নাবাস, জেনে রাখ যে, পাপ ছোট হলেও ঈশ্বর তার প্রতিফল দান করেন। কারণ ঈশ্বর পাপের প্রতি সন্তুষ্ট নন। যেহেতু আমার মাতা ও আমার শিষ্যগণ আমাকে জাগতিক কারণে ভালবেসেছে একারণে ঈশ্বর তাদের উপরে ক্রোধান্বিত হয়েছেন। তিনি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কারণে সিদ্ধান্ত নেন যে, এই অন্যায় বিশ্বাসের কারণে তাদেরকে এই জগতে শাস্তি দান করবেন। যেন সেই জগতে তাদেরকে নরকের অগ্নিতে শাস্তিভোগ থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং তাদেরকে তথায় কষ্ট পেতে না হয়। আর আমি নিরপরাধ হলেও কিছু মানুষ আমার বিষয়ে বলেছে যে, তিনিই ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র। ঈশ্বর এই কথা অপছন্দ করেছেন। তিনি ইচ্ছা করেছেন যে, পুনরুত্থানের দিনে শয়তানগণ যেন আমাকে নিয়ে উপহাস করতে বা হাসাহাসি করতে না পারে। এজন্য তিনি করুণা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, যিহূদার মৃত্যুর মাধ্যমে যেন এই উপহাস ও হাসাহাসি আমি এই জগতে লাভ করি; কারণ সকল মানুষই ধারণা করেছে যে, আমিই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরেছি। তবে এই উপহাস ও হাসাহাসি ঈশ্বরের ভাববাদী মুহাম্মাদের (ﷺ) আগমন পর্যন্ত চলতে থাকবে। তিনি যখন পৃথিবীতে আগমন করবেন তখন সকল বিশ্বাসীকে এই ভুলটা বুঝিয়ে দিবেন; ফলে মানুষের হৃদয় থেকে এই বিভ্রান্তি অপসারিত হবে।’’[1]