যাকোবের চতুর্থ পুত্র যিহূদা/ এহুদার প্রথম পুত্র এর (Er), দ্বিতীয় পুত্র ওনন (Onan) ও তৃতীয় পুত্র শেলা (Shelah)। এহুদা তার পুত্র এরের স্ত্রীর সাথে কিভাবে ব্যভিচার করেন সে বিষয়ে আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ (৩৮/৬-৩০, মো.-১৩) বলছে:
‘‘পরে এহুদা তামর (Tamar) নামণী একটা কন্যাকে এনে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র এরের সঙ্গে বিয়ে দিল। কিন্তু এহুদার জ্যেষ্ঠ পুত্র এর মাবুদের দৃষ্টিতে দূরাচারী হওয়াতে মাবুদ তাকে মেরে ফেললেন। তাতে এহুদা ওননকে বললো, তুমি তোমার ভাইয়ের স্ত্রীর কাছে গমন করো ও তার প্রতি দেবরের কর্তব্য সাধন করে নিজের ভাইয়ের জন্য বংশ উৎপন্ন করো। কিন্তু ঐ বংশ নিজের হবে না বুঝে ওনন ভাবীর কাছে গমন করলেও ভাইয়ের বংশ উৎপন্ন করার অনিচ্ছাতে ভূমিতে বীর্যপাত করলো। তার সেই কাজ মাবুদের দৃষ্টিতে মন্দ হওয়াতে তিনি তাকেও মেরে ফেললেন। তখন এহুদা পুত্রবধূ তামরকে বললো, যে পর্যন্ত আমার পুত্র শেলা বড় না হয়, সেই পর্যন্ত তুমি তোমার পিত্রালয়ে গিয়ে বিধবা হিসেবে জীবন যাপন করো। ... তখন কেউ তামরকে বললো, দেখ, তোমার শ্বশুর তাঁর ভেড়ার লোম কাটতে তিমণায় যাচ্ছেন। তখন সে বিধবার কাপড়-চোপড় ত্যাগ করে আবরণ দ্বারা নিজেকে আচ্ছাদন করলো ও গায়ে কাপড় দিয়ে তিমণার পথের পার্শ্বস্থিত ঐনয়িমের প্রবেশস্থানে বসে রইলো ... পরে এহুদা তাকে দেখে পতিতা মনে করলো, কেননা সে মুখ আচ্ছাদন করেছিল। অতএব সে পুত্রবধূকে চিনতে না পারাতে পথের পার্শ্বে তার কাছে গিয়ে বললো, এসো, তোমার সঙ্গে শয়ন করি। তামর বললো আমার সঙ্গে শয়ন করার জন্য তুমি কি দিতে পারবে? সে বললো, পাল থেকে একটা ছাগলের বাচ্চা পাঠিয়ে দেব। তামর বললো, যতক্ষণ তা না পাঠাও ততক্ষণ আমার কাছে কি কিছু বন্ধক রাখবে? সে বললো, কি বন্ধক রাখবো? তামর বললো, তোমার এই মোহর ও সুতা ও হাতের লাঠি। তখন সে তাকে সেগুলো দিয়ে তার সঙ্গে শয়ন করলো; তাতে সে তার দ্বারা গর্ভবতী হল। পরে সে উঠে চলে গেল এবং সেই আবরণ ত্যাগ করে নিজের বিধবার পোশাক পরলো।
... প্রায় তিন মাস পরে কেউ এহুদাকে বললো, তোমার পুত্রবধূ তামর জেনাকারিণী হয়েছে, আরো দেখ, জেনার কারণে তার গর্ভ হয়েছে। তখন এহুদা বললো, তাকে বাইরে এনে পুড়িয়ে দাও। পরে বাইরে আনবার সময়ে সে শ্বশুরকে বলে পাঠাল, যার এসব বসত্মু, সেই পুরুষ থেকে আমার গর্ভ হয়েছে। সে আরও বলল, এই মোহর, সুতা ও লাঠি কার? চেয়ে দেখ। তখন এহুদা সেগুলো চিনতে পেরে বললো, সে আমার চেয়েও বেশি ধার্মিকা, কেননা আমি তাকে আমার পুত্র শেলাকে দিই নি। এর পরে এহুদা তার সঙ্গে আর শয়ন করলো না। পরে তামরের প্রসবকাল উপস্থিত হল, আর দেখ, তার গর্ভে যমজ সন্তান। তার প্রসব কালে একটা বালক হাত বের করলো; তাতে ধাত্রী সেই হাত ধরে লাল রংয়ের সুতা বেঁধে বললো, এই প্রথমে ভূমিষ্ঠ হল। কিন্তু সে তার হাত টেনে নিলে দেখ, তার ভাই ভূমিষ্ঠ হল; তখন ধাত্রী বলল, তুমি কি ভাবে নিজে বাধা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসলে? অতএব তার নাম পেরস (বাধা ভাঙ্গা) হল। পরে হাতে লাল রংয়ের সুতা বাঁধা অবস্থায় তার ভাই ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম হল সেরহ।’’
আল্লামা রাহমতুল্লাহ কিরানবী এ কাহিনী উল্লেখ করে কাহিনীটার অশালীনতা ও বিবেকবিরুদ্ধতা অনুধাবনের জন্য নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন:
প্রথমত: এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যিহূদার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘এর’ দুরাচারী হওয়াতে মাবুদ তাকে মেরে ফেললেন। এরের পাপের কোনো বিবরণ এখানে দেওয়া হয়নি। এখানে প্রশ্ন হলো, তার পাপ কি তার বড় চাচার পাপের চেয়ে মারাত্মক ছিল? তাঁর বড় চাচা রূবেন তো তাঁর নিজের পিতার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করেছিলেন! এরের দূরাচারিতা কি তাঁর অন্য দু’ চাচা শিমিয়োন ও লেবির দূরাচারিতার চেয়েও ঘৃণ্য ছিল? তাঁর এ দু’ চাচা তো অন্যায়ভাবে পুরো একটা শহরের সকল পুরুষকে হত্যা করেন! এর-এর অন্যায় কি তার পিতা এহুদা ও তাঁর অন্যান্য ভাইয়ের অন্যায়ের চেয়েও খারাপ ছিল? তাঁরা তো উক্ত শহরের নিহত মানুষদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেন এবং শিশু ও স্ত্রীদেরকে বন্দি করেন! তাঁর অন্যায় কি তাঁর পিতার অন্যায়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল? তিনি তো ‘এর’-এর মৃত্যুর পরে তার বিধবা স্ত্রী সাথে ব্যভিচার করলেন! এরা সকলেই তো ঈশ্বরের দয়া, ক্ষমা, আশীর্বাদ ও অনন্ত মর্যাদা লাভ করার যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন আর ‘এর’ ক্ষমার অযোগ্য বলে গণ্য হলেন, যার ফলে তাকে সদাপ্রভু হত্যা করলেন!
দ্বিতীয়ত: সদাপ্রভু ঈশ্বর ওননকে মেরে ফেললেন; কারণ সে ভূমিতে রেতঃপাত করেছিল। অথচ তাঁর পিতা ও পিতৃব্যদেরকে উপরের অপরাধগুলোর কারণে হত্যা করলেন না! তাহলে কি ভূমিতে রেতঃপাত করা গণহত্যা, লুণ্ঠন, পিতার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার, পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার ইত্যাদি সকল পাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর?
তৃতীয়ত: যিহুদা/এহুদা তার পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার করায় তার পিতা যাকোব/ ইয়াকুব তাকে কোনোরূপ শাস্তি প্রদান করলেন না। আদিপুস্তক ৪৯ অধ্যায় প্রমাণ করে যে, যিহূদার ব্যভিচারে যাকোব বিরক্ত হন নি। যাকোব রূবেন, শিমিয়োন ও লেবিকে তাদের উপর্যুক্ত কর্মকান্ডের কারণে নিন্দা করেছেন। কিন্তু তিনি যিহূদাকে তার কর্মকান্ডের জন্য কোনোরূপ নিন্দা করেননি। তিনি তার অপরাধের বিষয়ে নীরব থেকেছেন এবং তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। উপরন্তু তিনি তাঁর জন্য অতিরিক্ত আশীর্বাদ করেছেন এবং তাঁকে তাঁর ভাইদের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। বাহ্যত পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার করে তাকে দুটো পুত্রসন্তান উপহার দেওয়ার কারণেই ‘ইবনুল্লাহ ইসরাইল’ (যাকোব) যিহূদাকে অতিরিক্ত আশীর্বাদ করেন। বাহ্যত ঈশ্বরও যিহূদার এ ব্যভিচারে তৃপ্ত হন; এজন্য বাইবেলের মূল আশীর্বাদের ধারা দাউদ ও যীশু দু’জন খ্রিষ্ট বা মাসীহকেই এ জারজ সন্তানের বংশে জন্ম দেন। দাউদ, শলোমন ও যীশু সকলেই এ ব্যভিচারের বংশধর।
চতুর্থত: যিহূদা তাঁর পুত্রবধু তামরের বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, সে ধার্মিকা ছিল। উপরন্তু তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, সে তাঁর নিজের চেয়েও বেশি ধার্মিক ছিল। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি! সত্যিকারের ধার্মিক পুরুষ এ শ্বশুর। আর সত্যিকারের ধার্মিকা এ পুত্রবধু যে ধার্মিকতায় শ্বশুরকেও হার মানিয়েছে! কারণ তিনি তার গুপ্তাঙ্গকে স্বামীর পিতা ছাড়া আর কারো কাছে অনাবৃত করেননি এবং শ্বশুর ছাড়া আর কারো সাথে ব্যভিচার করেননি। আর এ এক ব্যভিচারের পুরস্কার হিসেবে তিনি দুটো পুত্র লাভ করলেন এবং দাউদ ও যীশু এ দুজন ইবনুল্লাহ (ঈশ্বরের পুত্র) ও দু’জন মাসীহ (খৃস্ট)-এর দাদী হওয়ার মর্যাদা লাভ করলেন।
পঞ্ছমত: পেরস ও সেরহ উভয়ে ব্যভিচার-জাত জারজ সন্তান। কিন্তু সে কারণে সদাপ্রভু ঈশ্বর তাদেরকে হত্যা করেননি। তিনি লোটের দু কন্যার গর্ভে জন্মলাভকারী দু’ জারজ পুত্রের ন্যায় এদেরকেও জীবিত রেখেছেন। তবে দাউদের সাথে উরিয়ের স্ত্রীর ব্যভিচার-জাত সন্তানকে ঈশ্বর হত্যা করেছিলেন। সম্ভবত পরস্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা নিজের পুত্রবধু বা কন্যার সাথে ব্যভিচার করার চেয়ে কঠিনতর অপরাধ![1]
এহুদার পুত্রবধু শুধু মুখের উপর ওড়না দিলেন বলে তিনি আর চিনতে পারলেন না? মুখ আবৃত ছিল বলে এহুদা তামরকে বেশ্যা মনে করলেন, কিন্তু আকৃতি, কণ্ঠস্বর, চালচলন ইত্যাদি দেখে নিজের পুত্রবধু বলে একবারও সন্দেহ হল না? যে পুত্রবধুর জন্য তার দুটো পুত্র ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে তার কথা একবারও মনে পড়ল না? এ বৃদ্ধ মানুষটা কি এতই লোলুপ ছিলেন যে, রাস্তার পাশে একজন মহিলাকে দেখেই প্রস্তাব করে বসলেন? ঘরে ঢুকেও কি তামর মুখটা ঢেকে রেখেছিলেন? পুত্রবধুর সাথে শয়ন করলেন, পুত্রবধু গর্ভবতী হল, কিন্তু কখনোই তার মুখটা নজরে পড়ল না? মুখ দেখা ছাড়া কন্যা বা পুত্রবধুর মত অতি আপনজনকে চেনা যায় না?
বাইবেলেই ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন: ‘‘কেউ যদি তার ছেলের স্ত্রীর সংগে সহবাস করে তবে তাদের দু’জনকেই হত্যা করতে হবে।’’ (লেবীয় ২০/১২) বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে ঈশ্বর অতি সামান্য অপরাধে ও বিনা অপরাধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজে হত্যা করেছেন। কিন্তু এ বাইবেল নির্দেশিত হত্যাযোগ্য অপরাধের জন্য ঈশ্বর নিজে বা ঈশ্বরের পুত্র ও প্রথম পুত্র ইয়াকুব কেউই এহুদা ও তামর দু’জনকে বা দুজনের কাউকেই হত্যা করলেন না।