ইসহাক (আ.)-এর ছোট ছেলে যাকোব বা ইয়াকুব (আ.)। তিনি ‘ইস্রায়েল/ইসরাইল’ (আল্লাহর সাথে মল্লযুদ্ধকারী) নামে খ্যাত। তাঁর নামেই বনি-ইসরাইল বংশ এবং এ বংশের গৌরবগাথার জন্যই ‘বাইবেল’। ইসরাইল ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র (ইবনুল্লাহ) এবং ঈশ্বরের প্রথমপুত্র (ইবনুল্লাহ আওয়াল): ‘‘ইসরাইল আমার পুত্র, আমার প্রথমজাত (Israel is my son, even my firstborn) (যাত্রাপুস্তক ৪/২২)। এ ‘ইবনুল্লাহ’ বিষয়ে বাইবেলে অনেক অশালীন কথা বলা হয়েছে। এরূপ অশালীনতার একটা বিষয় একত্রে দু’ সহোদরাকে বিবাহ করা।
দু বোনকে একত্রে বিবাহ করা বাইবেলে নিষিদ্ধ: ‘‘আর স্ত্রীর সপত্নী হবার জন্য তার জীবনকালে সহবাস করার জন্য তার বোনকে বিয়ে করো না।’’ (লেবীয় ১৮/১৮, মো.-১৩)। অবৈধ বিবাহ ব্যভিচার ও মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ (লেবীয় ২০/১৭ ও দ্বিতীয় বিবরণ ২৭/২২)। এছাড়া নতুন নিয়মে একাধিক বিবাহও নিষিদ্ধ করা হয়েছে (মথি ১৯/৪-৬; মার্ক ১০/৬-৮)। এর পাশাপাশি বাইবেল বলছে যে, যাকোব সহোদরা দু’ বোনকে বিবাহ করছেন! ধর্মীয় নির্দেশনা ছাড়াও স্বাভাবিক মানবীয় বিচারেও এরূপ বিবাহ অশালীন বলে গণ্য। আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ২৯/১৫-৩০ (মো.-১৩) বলছে:
‘‘পরে লাবন ইয়াকুবকে বললেন, তুমি আত্মীয় বলে কি বিনা বেতনে আমার গোলামীর কাজ করবে? বল কি বেতন নেবে? লাবনের দু’টি কন্যা ছিলেন; জ্যোষ্ঠার নাম লেয়া ও কনিষ্ঠার নাম রাহেলা। লেয়ার সুনয়না, কিন্তু রাহেলা রূপবতী ও সুন্দরী ছিলেন। আর ইয়াকুব রাহেলাকে বেশি মহববত করতেন, এজন্য তিনি জবাবে বললেন, আপনার কনিষ্ঠা কন্যা রাহেলার জন্য আমি সাত বছর আপনার গোলামীর কাজ করবো। লাবন বললেন, অন্য পাত্রকে দান করার চেয়ে তোমাকে দান করা উত্তম বটে; আমার কাছে থাক। এভাবে ইয়াকুব রাহেলার জন্য সাত বছর গোলামীর কাজ করলেন; রাহেলার প্রতি তাঁর ভালবাসার জন্য এক এক বছর তাঁর কাছে এক এক দিন মনে হল। পরে ইয়াকুব লাবনকে বললেন, আমার নিয়মিত কাল সম্পূর্ণ হল, এখন আমার স্ত্রী আমাকে দিন, আমি তার কাছে গমন করবো। তখন লাবন ঐ স্থানের সমস্ত লোককে একত্র করে একটা মেজবানী দিলেন। আর সন্ধ্যা কালে তিনি তাঁর কন্যা লেয়াকে তাঁর কাছে এনে দিলেন আর ইয়াকুব তাঁর কাছে গমন করলেন। আর লাবন সিল্পা নামণী নিজের বাঁদীকে তাঁর কন্যা লেয়ার বাঁদী বলে তাকেও লেয়ার সঙ্গে দিলেন। আর প্রভাত হলে দেখা গেল তিনি লেয়া। তাতে ইয়াকুব লাবনকে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে এ কি ব্যবহার করলেন? আমি কি রাহেলার জন্য আপনার গোলামীর কাজ করিনি? তবে কেন আমাকে ঠকালেন? তখন লাবন বললেন, জ্যেষ্ঠ মেয়ের আগে কনিষ্ঠ মেয়েকে দান করা আমাদের এই স্থানের নিয়ম নেই। তুমি এর বিয়ের সপ্তাহটি পূর্ণ করো; পরে আরো সাত বছর আমার গোলামীর কাজ স্বীকার করবে, সেজন্য আমরা রাহেলাকেও তোমায় দান করবো। ইয়াকুব তাই করলেন, তাঁর সপ্তাহ পূর্ণ করলেন; পরে লাবন তাঁর সঙ্গে তাঁর কন্যা রাহেলার বিয়ে দিলেন। আর লাবন বিল্হা নামণী নিজের বাঁদীকে রাহেলার বাঁদী বলে তাঁকে দিলেন। তখন ইয়াকুব রাহেলার কাছেও গমন করলেন এবং লেয়ার চেয়ে রাহেলাকে বেশী ভালবাসলেন। তিনি আরও সাত বছর লাবনের কাছে গোলামীর কাজ করলেন।’’
বাইবেল গবেষকরা এখানে কয়েকটা আপত্তি উত্থাপন করেছেন:
প্রথমত: যাকোব তাঁর মামা লাবনের বাড়িতেই থাকতেন ও গোলামী করতেন। তিনি তাঁর কন্যাদ্বয়কে সর্বদাই দেখতেন এবং খুব ভাল করেই চিনতেন এবং দেখাসাক্ষাতের মাধ্যমেই একজনের প্রেমে পড়েছেন। তিনি তাদের দেহের আকৃতি, গড়ন, মুখের আকৃতি ও কণ্ঠস্বরের পার্থক্যও ভালভাবেই জানতেন। আর লেয়া ছিলেন মৃদুলোচনা/ সুনয়না (tender eyed), কাজেই লেয়াকে রাহেল থেকে পৃথক করে চিনতে কোনোরূপ অসুবিধাই ছিল না। কাজেই অত্যন্ত অবাক বিষয় যে, সারা রাত লেয়া যাকোবের বিছানায় থাকলেন, যাকোব তাঁকে সারা রাত ধরে দেখলেন, কাছে নিয়ে শুয়ে থাকলেন, ‘গমন করলেন’, কিন্তু তাকে চিনতে পারলেন না!! দেখার কথা বাদ দিলেও, স্বভাবতই বাসর ঘরে প্রেমিক-প্রেমিকার কথাবার্তা ও প্রেমের আদান প্রদান হয়েছে। কথাবার্তা, আচরণ ইত্যাদি কিছু দিয়েই তিনি প্রেমিকা ও প্রেমিকার বোনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারলেন না! তবে হ্যাঁ, এ সবকিছুর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে, তা হল, সারা রাত যাকোবও লোটের ন্যায় পাড় মাতাল ছিলেন। একারণে লোট যেমন তাঁর কন্যাদেরকে চিনতে পারেননি, তেমনি যাকোবও কে লেয়া ও কে রাহেল তা বুঝতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত: যাকোব রাহেলকে ভালবাসতেন। এই প্রেমের মাশুল দিতে তিনি ৭ বছর দাস্যকর্ম করলেন। আর প্রেমও এতই গভীর ছিল যে প্রেমের আকর্ষণে ৭ বছর ৭ দিনের মত মনে হল তাঁর কাছে! যখন তাঁর মামা লাবন ধোঁকা দিয়ে তাঁর সাথে বড় মেয়ের বিবাহ দিলেন তখন তিনি তাঁর প্রেমিকার জন্য পুনরায় ৭ বছর দাস্যকর্ম করতে রাজি হয়ে গেলেন! স্বাভাবিক শালীনতা, ধার্মিকতা ও রুচির দাবি যে, তিনি কষ্টসহ বিবাহ মেনে নিয়ে সংসার করবেন। একান্তই অভদ্রতা বা কঠোরতা করলে প্রবঞ্চনার প্রতিবাদে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু দু’ বোনকে একত্রে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আগ্রহে তিনি পুনরায় ৭ বছর দাস্যকর্ম করতে রাজি হলেন?
তৃতীয়ত, যাকোব বাসর রাতেই স্ত্রীর সাথে তার দাসীকেও স্ত্রী হিসেবে পেলেন। দু স্ত্রীতেও তিনি তৃপ্ত হলেন না। তৃতীয় স্ত্রী গ্রহণের জন্য ৭ বছরের দাস্যকর্মের চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন। তিনি তৃতীয় বিবাহে বাধ্য ছিলেন না। তাঁর দায়িত্ব ছিল এক স্ত্রী এবং এক দাসী-স্ত্রী দুজনকে নিয়েই পরিতৃপ্ত থাকা। প্রেমিকাকে ‘বিদায়’ জানালেও তার অসুবিধা হত না। প্রেমিকা বা শ্বশুর কেউই তাঁকে তৃতীয় বিবাহের জন্য চাপ দেননি। বাইবেলের ঘটনা প্রমাণ করে যে, রাহেল, লেয়া, লাবন ও পরিবারের সকলের সম্মতিতেই ‘কনে পরিবর্তনের’ ষড়যন্ত্র ঘটেছিল। নইলে কনে পরিবর্তনের সময়েই রাহেল তার প্রেমিককে বিষয়টা জানিয়ে দিতে পারতেন।