বাইবেলের অগণিত বৈপরীত্যের মধ্যে নতুন নিয়মের দুটো ইঞ্জিলে যীশুর দু’ রকমের বংশ তালিকা প্রাচীন যুগ থেকেই খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের হতভম্ব করেছে। তারা এ বিষয়ে বিভিন্ন সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এগুলোর মধ্যে তাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে শক্তিশালী সমাধান দু’ বংশ সমাধান। তারা বলেন, সম্ভবত এমন হতে পারে যে, মথি যোষেফ বা ইউসুফের বংশতালিকা লেখেছেন এবং লূক মরিয়মের বংশতালিকা লেখেছেন। এ ব্যাখ্যা অনুসারে যোশেফ এলির পুত্র নয়, বরং জামাতা। কিন্তু বংশ তালিকা বর্ণনায় যোশেফকে তার শ্বশুর এলির পুত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে।
মথির বংশ তালিকা উপর থেকে নিচে নেমেছে, অর্থাৎ ইবরাহিম থেকে শুরু করে মরিয়মের স্বামী যোষেফ পর্যন্ত শেষ হয়েছে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তিনি পরের ব্যক্তিকে জন্ম দিয়েছেন। শেষে বলা হয়েছে (and Jacob begat Joseph the husband of Mary) ‘‘এবং যাকোব জন্ম দিলেন যোষেফকে, যিনি মরিয়মের স্বামী’’ (মথি ১/১৬)। আর লূকের বংশ তালিকা নিচ থেকে উপরে গিয়েছে। অথাৎ যোষেফ থেকে শুরু হয়ে আদম পর্যন্ত গিয়েছে। সেমিটিক হিব্রু ও আরবি পদ্ধতিতে বলা হয়েছে যে, যোষেফ বিন এলি বিন মত্তয় বিন লেবি...। অনুবাদে প্রত্যেকের পরে বলা হয়েছে যে, তিনি পরবর্তী ব্যক্তির পুত্র। প্রথমেই বলা হয়েছে (Joseph, which was the son of Heli, which was the son of Matthat...) যোষেফ, যিনি এলির পুত্র, যিনি মত্ততের পুত্র...) (লূক ৩/২৩)।
মথির তালিকার কোনো ব্যাখ্যার সুযোগ তারা পাচ্ছেন না। কিন্তু লূকের তালিকার বিষয়ে তারা ব্যাখ্যা করছেন যে, যোষেফ বিন এলি বা যোষেফ যিনি এলির পুত্র ... বলতে জামাতা বুঝানো হয়েছে!! এ ব্যাখ্যা দ্বারা উভয় বংশ তালিকার মধ্যে বিদ্যমান নতুন ও পুরাতন নিয়ম সংশ্লিষ্ট আরো প্রায় ২০টা বৈপরীত্যের কোনো সমাধান হয় না। তবে একটা সমস্যা, অর্থাৎ যীশুর পিতার দুজন পিতা হওয়ার সমস্যাটার সমাধান হয়। তবে বিভিন্ন কারণে এ ব্যাখাটা বাতিল:
প্রথম কারণ: এ দাবিটা মূলতই ভিত্তিহীন। আরব ও হিব্রু জাতির বংশ তালিকা সংরক্ষণের সাথে পরিচিতরা সুনিশ্চিত জানেন যে, তারা কখনোই বংশতালিকা বলতে শ্বশুরের বংশ তালিকা বলতেন না। বংশ তালিকায় তারা জামাতাকে ‘শ্বশুরের পুত্র’ বলতেন না। বর্তমানে অনেক সমাজেই শ্বশুরকে ‘বাবা’ বলা হয়। কিন্তু এটা সম্বোধন বা ডাকার সময়। কিন্তু পিতৃ পরিচয় বা বংশ পরিচয় প্রদান করতে বর্তমানেও কোনো জাতির কোনো মানুষ নিজের পিতা ছাড়া অন্য কারো নাম নিয়ে বলবেন না যে, আমি অমুকের পুত্র, অথবা শ্বশুরের নাম নিয়ে বলবেন না যে, আমার পিতার নাম অমুক। খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা কোনো প্রাচীন ইহুদি ঐতিহ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পারেন নি যে, কখনো কারো বংশ তালিকায় পিতার নামের স্থলে শ্বশুরের নাম লেখা হত।
সর্বোপরি, এখানে যীশু থেকে আদম পর্যন্ত সকলের ক্ষেত্রেই ‘ইবন’ বা ‘বিন’ অর্থাৎ পুত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর যোষেফ বিন এলি বলতে যদি যোষেফ যিনি এলির জামাতা বুঝানো হয় তাহলে পরবর্তী সকলের ক্ষেত্রেই তো ‘বিন’ শব্দটার একই অর্থ হতে হবে। অর্থাৎ ইয়াকুব ইসহাকের জামাতা, ইসহাক ইবরাহিমের জামাতা... !!!
দ্বিতীয় কারণ: এ ব্যাখ্যা অনুসারে যীশু দাউদের পুত্র শলোমনের বংশধর নন, বরং তিনি দাউদের পুত্র নাথনের বংশধর। কারণ তাঁর মাতার বংশই তাঁর বংশ। তাঁর মাতার স্বামী যোষেফের বংশ যাই হোক না কেন তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না। এ ব্যাখ্যা অনুসারে তাঁর মাতা যেহেতু নাথনের বংশধর সেহেতু তিনিও নাথনের বংশধর, শলোমনের বংশধর নন। এ থেকে প্রমাণিত হবে যে তিনি মসীহ (Christ) ছিলেন না। কারণ ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা একমত যে, মসীহ শলোমনের বংশধর হবেন। এজন্য অনেক খ্রিষ্টান ধর্মগুরু এ ব্যাখ্যা বাতিল করে বলেছেন, যে ব্যক্তি শলোমনকে যীশুর বংশতালিকা থেকে বাদ দিল, সে প্রকৃতপক্ষে যীশুর খ্রিষ্টত্ব বা মসীহত্ব বাতিল করে দিল।
তৃতীয় কারণ: এরপরও এ ব্যাখ্যা তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকে প্রমাণ হবে যে, মরিয়মের পিতার নাম ছিল এলি। শুধুমাত্র সম্ভাবনা দিয়ে এখানে কিছু বলা অর্থহীন। আর বাস্তবে কোনো শক্তিশালী প্রমাণ তো দূরের কথা কোনো দুর্বল প্রমাণ দিয়েও বিষয়টা প্রমাণ করা যায় নি।
উপরন্তু, এর বিপরীত বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। আমরা প্রথম অধ্যায়ে অস্বীকৃত ইঞ্জিলের তালিকায় ‘মরিয়মের জন্ম বিষয়ক ইঞ্জিল (The Gospel of the Birth of Mary), যাকোবের সুসমাচার (The Infancy Gospel of James/ Protevangelium of James) এবং মথির নামীয় ইঞ্জিল (The Gospel of Pseudo-Mattew) নামক নতুন নিয়মের তিনটা পুস্তক উল্লেখ করেছি। এগুলো নতুন নিয়মের মধ্যে স্বীকৃত না হলেও এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে সকলেই একমত। খ্রিষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকে এগুলো রচিত ও প্রচারিত ছিল। বাইবেল গবেষকরা এগুলোর তথ্যের উপর নির্ভর করেন। এ তিনটা পুস্তকেই বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরিয়মের পিতার নাম ছিল যিহোয়াকীম (Jehoi'akim/Joachim) ও মাতার নাম আনা (হিব্রু Hannah, ল্যাটিন Anna ও ইংরেজি Anne)।[1] এরূপ নিশ্চিত ঐতিহাসিক তথ্যের বিপরীত সম্পূর্ণ আন্দাযের উপর ঢিল ছুড়ে ধর্মগ্রন্থের বৈপরীত্যের ব্যাখ্যার চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য।
চতুর্থ কারণ: এ ব্যাখ্যা দাবি করছে যে, মরিয়ম দাউদের পুত্র নাথনের বংশধর ছিলেন। বিষয়টা শুধু অপ্রমাণিতই নয়; উপরন্তু প্রমাণিত তথ্যের বিপরীত:
(ক) ৪র্থ শতকের প্রসিদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মগুরু সাধু অগাস্টাইন (St. Augustine, Bishop of Hippo: 354-430) লেখেছেন যে, তার যুগে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরিয়ম লেবির বংশধর। ‘ইসরাইল’ বা ইয়াকুব (আ.)-এর সন্তানদের একজন লেবি ও অন্যজন যিহূদা। মোশি ও হারোণ ছিলেন লেবির বংশধর। অপরদিকে দাউদ ছিলেন যিহূদার বংশধর। লেবির বংশধর হলে যিহূদার বংশধর বা দাউদের বংশধর হওয়া যায় না।[2]
(খ) গণনাপুস্তকের ৩৬ অধ্যায়ে আমরা দেখি যে, তৌরাতের বিধান অনুসারে ইহুদিদের প্রত্যেক পুরুষ তার নিজের বংশের মধ্যে বিবাহ করতেন। অনুরূপভাবে তাদের মহিলারা প্রত্যেকে নিজের বংশের মধ্যে বিবাহ করতেন। এ বিধানের উদ্দেশ্য ছিল যে, প্রত্যেক বংশের ও গোত্রের উত্তরাধিকার ও সম্পদ যেন নিজেদের মধ্যে থাকে এবং এক বংশের সাথে অন্য বংশের রক্ত যেন মিশে না যায়।
লূকের প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যোহন বাপ্তাইজকের পিতা সখরিয় বা জাকারিয়ার স্ত্রী ছিলেন হারোণ-বংশীয়া (লূক ১/৫)। এ পুস্তকেরই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরিয়ম জাকারিয়ার স্ত্রীর চাচাতো/মামাতো বোন (Cousin) ছিলেন (লূক ১/৩৬)। যোহনের মাতা ইলীশাবেৎ হারোণ-বংশীয়া হলে তার চাচাতো বোন মরিয়মও অবশ্যই হারোণ-বংশীয়া, অর্থাৎ লেবী বংশীয়া হবেন। কারো চাচাতো বোন হওয়ার অর্থই একই বংশের হওয়া। আর ইহুদিদের শরীয়তে চাচাতো, ফুফাতো, খালাতো, মামাতো সকল প্রকারের ভাইবোন অবশ্যই একই বংশীয় হবেন।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইঞ্জিলগুলো যীশুর ঊর্ধ্বারোহণের শতাধিক বছর পরে অজ্ঞাতপরিচয় মানুষদের রচনা। ফলে সত্য, মিথ্যা, কল্পনা ইত্যাদি মিশ্রিত হয়ে এরূপ বৈপরীত্যের জন্ম হয়েছে। এছাড়া আমরা নিশ্চিত হই যে, ‘মথি’র নামে প্রচলিত এ ইঞ্জিলটা লূকের ইঞ্জিলের লেখকের সময় প্রচলিত ছিল না। নইলে কিভাবে কল্পনা করা যায় যে, লূক যীশুর এমন একটা ‘বংশনামা’ প্রদান করবেন যা প্রথম নযরেই মথির প্রদত্ত বংশনামা বিপরীত এবং বৈপরীত্য এত কঠিন যে সকল প্রাচীন ও আধুনিক ধর্মবেত্তা পণ্ডিত যার সমাধান করতে যেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছেন। আমরা দেখেছি যে, এ বৈপরীত্য ছাড়াও বংশ তালিকাদ্বয়ের মধ্যে অনেক নিশ্চিত ভুল তথ্য বিদ্যমান।
বৈপরীত্যের এ জাতীয় ব্যাখ্যা উল্লেখ করে গবেষক রবার্ট বয়ড লেখেছেন:
“This is what inerrantists consider ‘a successful explanation of an alleged inconsistency’. But such far-fetched, entirely speculative ‘explanations’ do nothing to inform or convince intelligent, honest, and unbiased observers. They only serve to confirm the ignorant in their ignorance. The renowned theologian, Reinhold Niebuhr, once observed wisely: Frantic orthodoxy is never rooted in faith but in doubt. It is when we are not sure that we are doubly sure." And the French philosopher, Voltaire, once observed, ‘Those who can make you believe absurdities can make you commit atrocities’.”
‘‘অভ্রান্ততাবাদীরা এরূপ ব্যাখ্যাকেই ‘অভিযুক্ত বৈপরীত্যের সফল ব্যাখ্যা’ বলে গণ্য করেন। কিন্তু এরূপ দূর থেকে টেনে আনা একান্তই অনুমান নির্ভর ব্যাখ্যা বুদ্ধিমান, সৎ ও নিরপেক্ষ কোনো পর্যবেক্ষককে কোনো তথ্য প্রদান করে না এবং বুঝাতেও সক্ষম হয় না। এরূপ ব্যাখ্যা দ্বারা শুধু অজ্ঞদেরকে তাদের অজ্ঞতায় আস্থাশীল করে। প্রসিদ্ধ ধর্মতত্ত্ববিদ রিনোল্ড নেবর প্রাজ্ঞভাবেই বলেছেন: ‘উন্মত্ত গোঁড়ামির ভিত্তি কখনোই বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং সন্দেহের উপর প্রতিষ্ঠিত। তা হল, যখন আমরা নিশ্চিত হতে পারি না তখন দ্বিগুণ নিশ্চিত হয়ে যাই।’ প্রসিদ্ধ ফরাসী দার্শনিক ভল্টেয়ার বলেন: ‘যারা আপনাকে অযৌক্তিক কথা বিশ্বাস করাতে পারে তারা আপনাকে দিয়ে নৃশংস কাজও করাতে পারে’।’’[3]
তিনি আরো বলেন : “Why is it so difficult for intelligent and informed Christians to recognize – and openly and publicly admit – that the Bible is NOT free of all errors?.... it's impossible for contradictory statements to be made by the same intelligent person, especially if he is God! ... The Bible itself proves the foolishness of BIBLICAL INERRANCY.”
‘‘বাইবেলে যে ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত নয় তা অনুধাবন করা এবং প্রকাশ্যে ও জনসম্মুখে তা স্বীকার করা বুদ্ধিমান ও জানাশোনা খ্রিষ্টানদের জন্য কেন এত কঠিন? এ কথা অসম্ভব যে, একই বুদ্ধিমান ব্যক্তি এরূপ পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রদান করবেন। বিশেষত তিনি যদি ঈশ্বর হন! বাইবেল নিজেই প্রমাণ করে যে, বাইবেলকে অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করা মূঢ়তা।’’[4]
[2] কিরানবী, আল্লামা রাহমাতুল্লাহ, ইযহারুল হক (বঙ্গানুবাদ, ইফাবা) খ. ১, পৃ. ১৬৪-১৬৫।
[3] http://LiberalsLikeChrist.Org/inerrancy.html
[4] http://LiberalsLikeChrist.Org/inerrancy.html