৩. ৯. ৪৪. যীশুর বোঝা হালকা না ভারী?

উপরের বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটা বৈপরীত্য, তা হল যীশুর বোঝা। যীশু তাঁর অনুসারী হয়ে বেহেশত লাভের জন্য যে কর্ম ও দায়িত্ব প্রদান করেছেন তা পালন করা সহজ না কঠিন। যীশু বলেন: ‘‘হে পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত লোক সকল, আমার নিকট আইস, আমি তোমাদেরকে বিশ্রাম দিব। আমার যোঁয়ালি আপনাদের উপর তুলিয়া লও, এবং আমার কাছে শিক্ষা কর, কেননা আমি মৃদুশীল ও নম্রচিত্ত; তাহাতে তোমরা আপন আপন প্রাণের জন্য বিশ্রাম পাইবে। কারণ আমার যোঁয়ালি সহজ ও আমার ভার লঘু।’’ (মথি ১১/২৮-৩০)। পবিত্র বাইবেল-২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘তোমরা যারা ক্লান্ত ও বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছ, তোমরা সবাই আমার কাছে এস, আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব। আমার জোয়াল তোমাদের উপর তুলে নাও ও আমার কাছ থেকে শেখো, কারণ আমার স্বভাব নরম ও নম্র। এতে তোমরা অন্তরে বিশ্রাম পাবে, কারণ আমার জোয়াল বয়ে নেওয়া সহজ ও আমার বোঝা হালকা।’’

এখানে যীশু বলছেন যে, তাঁর জোয়াল সহজ ও তাঁর বোঝা হালকা। কিন্তু তাঁর অন্যান্য বক্তব্য প্রমাণ করে যে, তাঁর জোয়াল কঠিন ও তাঁর বোঝা খুবই ভারী। আমরা জানি যে, কোনো ধর্মের মাধ্যমে মুক্তি পেতে ঈমান বা বিশ্বাসের পাশাপাশি মহাপাপগুলো বর্জন করতে হয় এবং কিছু সৎ কর্ম করতে হয়। পক্ষান্তরে যীশুর মাধ্যমে মুক্তি পেতে মহাপাপগুলোর পাশাপাশি অতি সাধারণ পাপও বর্জন করতে হবে। উপরন্তু নিজের সহায় সম্পত্তি সব বিক্রয় করতে হবে। নিজের পিতামাতা, ভাইবোন ও স্ত্রীসন্তানদের ঘৃণা করতে হবে। .... যীশুর বোঝাগুলো দেখুন:

(১) ক্ষুধিত, পিপাসিত, বস্ত্রহীন, অসুস্থ বা কারারুদ্ধকে সেবা না করলে অনন্ত শাস্তিতে দণ্ডিত করা হবে। (মথি ২৫ অধ্যায়, বিশেষত ২৫/৪৫-৪৬)

(২) ক্ষুদ্রতম কোনো বিশ্বাসী বা ঈমানদারকে কষ্ট দিলেই দোজখ।(মার্ক ৯/৪২)

(৩) তলোয়ার না থাকলে চাদর বেচে হলেও তা কিনতে হবে। (লূক ২২/৩৬)।

(৪) আল্লাহ ছাড়া কাউকে পিতা ডাকা যাবে না- নিজের জন্মদাতাকেও নয়: ‘‘এই দুনিয়াতে কাউকেই পিতা বলে ডেকো না, কারণ তোমাদের একজনই পিতা আর তিনি বেহেশতে আছেন।’’ (মথি ২৩/৯, মো.-০৬)।

(৫) সকল সহায়-সম্পত্তি বিক্রয় করে দান করে দিতে হবে: ‘‘তোমাদের বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে ভিক্ষা হিসেবে দান কর। যে টাকার থলি কখনও পুরানো হয় না তা-ই নিজেদের জন্য তৈরী কর, অর্থাৎ যে ধন চিরদিন টিকে থাকে তা-ই বেহেশতে জমা কর। সেখানে চোরও আসে না এবং পোকায়ও নষ্ট করে না। তোমাদের ধন যেখানে থাকবে তোমাদের মনও সেখানেই থাকবে।’’ (লূক ১২/৩৩, মো.-০৬)

(৬) ধনী কোনো খ্রিষ্টান বেহেশতে যেতে পারবে না: সুইয়ের ছিদ্রে উটের প্রবেশের চেয়েও ধনীর জন্য বেহেশতে যাওয়া অধিক কঠিন। (মার্ক ১০/২৫)

(৭) সর্বস্ব ত্যাগ না করলে যীশুর শিষ্য বা উম্মত হওয়া যাবে না: ‘‘তোমাদের মধ্যে যে কেহ আপনার সর্বস্ব ত্যাগ না করে, সে আমার শিষ্য হইতে পারে না।’’ কি. মো.-০৬: ‘‘আপনাদের মধ্যে যদি কেউ ভেবে-চিন্তে তার সব কিছু ছেড়ে না আসে তবে সে আমার উম্মত হতে পারে না।’’ (লূক ১৪/৩৩)

(৮) গুনাহের সম্ভাবনা থাকলে চোখ, হাত ইত্যাদি উপড়ে বা কেটে ফেলে দিতে হবে, নইলে পুরো দেহ জাহান্নামে পুড়বে: ‘‘তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা উপ্ড়ে দূরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর দোজখে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। যদি তোমার ডান হাত তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর দোজখে যাওয়ার চেয়ে বরং একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল।’’ (মথি ৫/২৯-৩০)

(৯) মেজবানি বা খানার আয়োজন করলে শুধু গরীব-দুঃখীদের দাওয়াত দিতে হবে। আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া যাবে না:  ‘‘যখন আপনি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করবেন বা ভোজ দেবেন তখন আপনার বন্ধুদের বা ভাইদের কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের বা ধনী প্রতিবেশীদের দাওয়াত করবেন না...।’’ (লূক ১৪/১২-১৪, মো.-০৬)

(১০) চোর, ডাকাত, পকেটমার, সন্ত্রাসী, ধর্ষক ইত্যাদি কোনো দুষ্ট বা অপরাধীকে বাধা দেওয়া যাবে না: ‘‘তোমরা দুষ্টের প্রতিরোধ করিও না; বরং যে কেউ তোমার দক্ষিণ গালে চড় মারে, অন্য গাল তাহার দিকে ফিরাইয়া দেও।’’ (মথি ৫/৩৯)

(১১) পারিবারিক অশান্তিকে যীশুর দান হিসেবে মেনে নিতে হবে: ‘‘আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি। এখন থেকে এক বাড়ীর পাঁচ জন ভাগ হয়ে যাবে, তিন জন দু’জনের বিরুদ্ধে আর দু’জন তিনজনের বিরুদ্ধে। ... বাবা ছেলের বিরুদ্ধে ও ছেলে বাবার বিরুদ্ধে, মা মেয়ের বিরুদ্ধে ও মেয়ে মায়ের বিরুদ্ধে, শাশুড়ী বউয়ের বিরুদ্ধে ও বউ শাশুড়ীর বিরুদ্ধে।’’ (লূক ১২/৪৯-৫৩: মো.-০৬) অন্যত্র যীশু বলেন: ‘‘আমি পিতার সঙ্গে পুত্রের, মায়ের সঙ্গে কন্যার এবং শাশুড়ির সঙ্গে পুত্র বধূর বিচ্ছেদ জন্মাতে এসেছি; আর নিজ নিজ পরিজনই মনুষ্যের দুশমন হবে।’’ (মথি ১০/৩২-৩৬: মো.-১৩)

(১২) নিজের পিতামাতা, ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তানদেরকে এবং নিজের প্রাণকেও ঘৃণা (যধঃব) করতে হবে। যীশু বলেন: ‘‘যদি কেউ আমার কাছে আসে, আর আপন পিতা-মাতা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে, ভাই-বোন, এমন কি নিজ প্রাণকেও অপ্রিয় জ্ঞান (hate ঘৃণা) না করে তবে সে আমার সাহাবী হতে পারে না’’ (মো.-১৩)। মো.-০৬: ‘‘... আমার উম্মত হতে পারে না।’’ (লূক ১৪/২৬)

(১৩) নিজের শত্রুদেরকে মহববত করতে হবে (মথি ৫/৪৪-৪৫)। তবে যীশুর শত্রুগণকে ধরে এনে তাঁর সামনে হত্যা করতে হবে (লূক ১৯/২৭)।

(১৪) অবিবাহিত থাকার চেষ্টা করতে হবে: ‘‘স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ যদি এই রকমেরই হয় তাহলে তো বিয়ে না করাই ভাল। ... আবার এমন কেউ কেউ আছে যারা বেহেশতী রাজ্যের জন্য বিয়ে করবে না বলে মন স্থির করে। যে এই কথা মেনে নিতে পারে সে মেনে নিক’’ (মথি ১৯/১০-১২, মো.-০৬)।

‘‘স্ত্রীলোককে স্পর্শ না করা পুরুষের ভাল; ...আমার ইচ্ছা এই যে, সকল মানুষই আমার মত (চিরকুমার/চিরকুমারী) হয়। ... অবিবাহিত লোকদের ও বিধবাদের কাছে আমার কথা এই, তারা যদি আমার মত (চিরকুমার/চিরকুমারী) থাকতে পারে, তবে তাদের পক্ষে তা-ই ভাল।’’ (১ করিন্থীয় ৭/১-৮, মো.-০৬)।

যীশুর সাথে এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার মানুষ স্বর্গে থাকবেন, যারা সকলেই অবিবাহিত, অমৈথুন, চিরকুমার ও রমণীদের সংসর্গে কলুষিত না হওয়া পুরুষ। এরা ছাড়া কেউ স্বর্গের গান গাইতে পারবে না। (প্রকাশিত বাক্য ১৪/১-৪)

(১৫) যীশুর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান, ভক্তি ও মহববত সত্ত্বেও ঈশ্বরের সকল নির্দেশ পালন করা ছাড়া মুক্তি নেই: ‘‘যারা আমাকে ‘প্রভু, প্রভু’ বলে তারা প্রত্যেকে যে স্বর্গ-রাজ্যে ঢুকতে পারবে তা নয়, কিন্তু আমার স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছা যে পালন করে সে-ই ঢুকতে পারবে...। ’’ (মথি ৭/২১-২৩: পবিত্র বাইবেল-২০০০)

(১৬) সব কিছুর পাশাপাশি মূসা (আ.)-এর শরীয়তের প্রতিটা বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে হবে। তৌরাতের খুঁটিনাটি সকল বিধান পালনে গোঁড়া ইহুদি ফরীশীদের চেয়েও অগ্রগামী না হলে জান্নাত মিলবে না। ‘‘আলেম ও ফরীশীদের চেয়ে তোমাদের ধার্মিকতা যদি বেশি না হয়, তবে তোমরা কোন মতে বেহেশতী-রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (মথি ৫/১৭-২০: কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩)

(১৭) পাক কিতাবের একটা শব্দ বাদ দিলে বা সংযোগ করলেও অনন্ত শাস্তি ও সকল অভিশাপ। ‘‘যে লোক এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহর কালাম শোনে আমি তার কাছে এই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কেউ যদি এর সংগে কিছু যোগ করে তবে আল্লাহও এই কিতাবের লেখা সমস্ত গজব তার জীবনে যোগ করবেন। আর এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহর কালাম থেকে যদি কেউ কিছু বাদ দেয় তবে আল্লাহও এই কিতাবে লেখা জীবন-গাছ ও পবিত্র শহরের অধিকার তার জীবন থেকে বাদ দেবেন।’’ (প্রকাশিত বাক্য/ প্রকাশিত কালাম ২২/১৮-১৯: কি. মো.-২০০৬)

আমরা দেখছি যে, এ বক্তব্য অনুসারে বাইবেল অনুলিপিকার, অনুবাদক, প্রচারকরা কেউই মুক্তি লাভ করতে পারবেন না। কারণ প্রত্যেক সংস্করণ অন্যটা থেকে কিছু শব্দ, বাক্য, শ্লোক, এমনকি পুস্তকেও ভিন্ন। নিশ্চিতভাবেই কেউ সংযোজন করেছেন অথবা বিয়োজন করেছেন।

এগুলো সবই যীশুর বোঝার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হালকা কিনা তা পাঠক বিবেচনা করবেন।