আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি ‘ঐক্য ও সংহতি’। বিভ্রান্ত দলগুলির সাথে এ বিষয়ে তাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, আকীদার উৎস এক হওয়ার কারণে আহলুস সুন্নাতের আলিমগণের আভ্যন্তরীন মতভেদ সীমিত এবং ব্যাখ্যা বা পরিভাষাগত মতভেদ তারা সহজে গ্রহণ করেন এবং এজন্য একে অপরকে বিভ্রান্ত বলে গণ্য করেন না। পক্ষান্তরে বিভ্রান্ত দলগুলির আকীদার উৎস অনেক হওয়াতে তাদের মধ্যকার বিভক্তিও খুবই বেশি। মানবীয় বুদ্ধি, আকল, যুক্তি ইত্যাদির মতপার্থক্যই স্বাভাবিক। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কাউকে ‘মা’সূম’ ‘অভ্রান্ত’ বা কারো মতকে চূড়ান্ত বলে গণ্য করলেও এরূপ অভ্রান্তদের একজনের মতের সাথে অন্যজনের মতের মিল হয় না। আর এ সকল বিষয় যেহেতু তাদের মতে আকীদার মূল সেহেতু তারা একে অপরকে কাফির বা বিভ্রান্ত বলে ঘোষণা করে।
দ্বিতীয়ত, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ সকল মুমিনকে যথাসম্ভব মুমিন বলে গণ্য করতে চেষ্টা করেন। এমনকি সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ফিরকাগুলিকেও তাঁরা কাফির বলে গণ্য না করে বিভ্রান্ত মুমিন বলে গণ্য করতে চেষ্টা করেন। পক্ষান্তরে বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলি একমাত্র নিজেদেরকে ছাড়া অন্য সকলকেই ইসলামের গন্ডি থেকে বের করে দেন। এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি হলো, যে ব্যক্তি কুরআন বা হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কথা বলেছে বা বিশ্বাস পোষণ করেছে তার কথার ওযর খোঁজার চেষ্টা করা। আর আহলুল বিদ‘আতের মূলনীতি হলো তাদের মতের বিরোধী ব্যক্তি যা বলেছে তা সরাসরি কুরআন ও হাদীসের বিরোধী না হলেও তার মধ্যে বিরোধিতা সন্ধান করা বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে তার বক্তব্যকে আকীদা বিরোধী বলে প্রমাণ করা এবং এরূপ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তাকে কাফির বা বিভ্রান্ত বলা।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বিশ্বাস করেন যে, আখিরাতে মুমিনগণ আল্লাহর দর্শন লাভ করবেন, তবে এ দেখার অর্থ কোনো মাখলুকের দেখার মত নয়, সৃষ্টির সাথে সকল তুলনার উদ্ধে এ দর্শনের প্রকৃতি মহান আল্লাহই জানেন। এ কথাটি কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত এবং কোনো বক্তব্যেরই সরাসরি বিপরীত নয়। তবে মুতাযিলী ও সমমনা ফিরকাগুলি আহলুস সুন্নাতের এ আকীদাকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে গণ্য করেছেন। তারা বলেন, আল্লাহ বলেছেন ‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’। আহলুস সুন্নাতের আকীদা এ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক, কারণ আল্লাহকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই হলো মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। কাজেই কুরআন অস্বীকার করার কারণে ‘আহলুস সুন্নাত’ কাফির!!
পক্ষান্তরে মুতাযিলীদের আকীদা সুস্পষ্টভাবেই কুরআন ও হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ মু’তাযিলীদের এ আকীদার কঠিন প্রতিবাদ করলেও এজন্য তাদেরকে কাফির বলে গণ্য করেন নি; কারণ তারা সরাসরি আয়াত ও হাদীস অস্বীকার করে না, বরং ব্যাখ্যা করে।
শীয়াগণ নবী-বংশের ভালবাসার নামে সাহাবীগণকে ঘৃণা করে এবং তাদেরকে মুরতাদ বলে গণ্য করে। তাদের এ বিশ্বাস কুরআনের অনেক আয়াত ও অগণিত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। তা সত্ত্বেও আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ তাদের এ বিশ্বাসের যথাসাধ্য ওজর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারিগণ সাহাবীগণ ও নবী-বংশকে সমানভাবে ভালবাসেন। তাদের এ আকীদা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। তা সত্ত্বেও শীয়াগণ প্রায়শ তাদেরকে কাফির বলে ঘোষণা করেছেন এ যুক্তিতে যে তাঁরা নবী-বংশকে ভালবাসেন না।
এ বিষয়ে ইমামগণের বিভিন্ন বক্তব্য আমরা উপরের অনুচ্ছেদগুলিতে ও তাকফীর অধ্যায়ে দেখেছি। ইমাম তাহাবী বলেন:
وَنَرَى الْجَمَاعَةَ حَقًّا وَصَوَابًا، وَالْفُرْقَةَ زَيْغًا وَعَذَابًا
‘‘আমরা দলাদলিমুক্ত বা ঐক্যবদ্ধ থাকাকে সত্য ও সঠিক বলে মনে করি এবং বিভক্তি ও দলাদলিকে বিভ্রান্তি ও শাস্তি বলে মনে করি।’’[1]
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আহলু কিতাব বা ইহূদী-নাসারাদের সাথেও উত্তমভাবে ছাড়া বিতর্ক না করতে, শুধু তাদের মধ্যে যারা জুলুম করেছে তাদের সাথে ছাড়া।[2] তাহলে আহলু কিবলার সাথে বিতর্কের আদব কেমন হতে পারে? আহলু কিবলা তো অন্তত আহলু কিতাবের চেয়ে উত্তম। কাজেই তাদের মধ্যে যারা জুলুম করেছে তারা ছাড়া কারো সাথে উত্তম পন্থা ছাড়া বিতর্ক করা যাবে না। এরূপ কেউ ভুল করলে বলা যাবে না যে, সে কাফির। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা পরিত্যাগ করাকে কুফরী বলে বিধান প্রদান করেছেন তা সে পরিত্যাগ করেছে বলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করার পরে তার কুফরীর বিধান দেওয়া যায়। মহান আল্লাহ এ উম্মাতের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করেছেন।’’[3]
[2] সূরা (২৯) আনকাবূতের ৪৬ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
[3] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩১৫।