মানব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, যুগে যুগে সকল সমাজের মুশরিকদেরই ধারণা যে, নেককার মানুষ মৃত্যুর পরে আরো বেশি অলৌকিক ক্ষমতা ও অধিকার লাভ করে। তারা দেহের খোলস থেকে মুক্ত হয়ে পুরো আত্মিক আধিপত্য ও ক্ষমতা অর্জন করে। এজন্য জীবিত নেককারদের চেয়ে মৃত নেককারদের ইবাদত করা বা তাদেরকে আল্লাহর শরীক বাননোর প্রবণতা সব মুশরিকদের মধ্যেই বেশি।
আমরা দেখেছি যে, বিপদে আপদে মূর্ত কিছুকে আকড়ে ধরে নিজের মনের আবেগ জানানো এবং বিপদ থেকে ত্রাণ প্রার্থনা করার আগ্রহ শিরকের অন্যতম কারণ। দুর্বল চিত্ত মানুষ অদৃশ্য কোনো কিছুর কাছে প্রার্থনা করে পুরো তৃপ্তি পায় না। মূর্ত কিছুকে জড়িয়ে ধরতে চায়। এজন্য মৃত মৃত নেককার ব্যক্তির ইবাদত করা বা তার প্রতি চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় প্রকাশের জন্য মুশরিক ব্যক্তি একটি মূর্ত কিছু সন্ধান করে। এজন্য মূল বাহন (১) উক্ত ব্যক্তির সমাধি বা কবর, (২) উক্ত ব্যক্তির ছবি,মূর্তি বা প্রতিকৃতি এবং (২) উক্ত ব্যক্তির স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা দ্রব্য। সাধারণত এগুলিকে কেন্দ্র করেই শিরক আবর্তিত হয়।
ইসলামে শিরকের এ সকল উপকরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেন কোনোভাবে মানবীয় দুর্বলতা বা শয়তানের প্রবঞ্চনার কারণে কোনো মুমিন এগুলির প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করতে যেয়ে শিরকে নিপতিত না হয়। ছবি, প্রতিকৃতি, মুর্তি ইত্যাদি তৈরি, সংরক্ষণ ইত্যাদি কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। স্মৃতিবিজড়িত দ্রব্য বা স্থানের বিষয়ে ইসলামী নির্দেশনা ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি। কবর যেন মানুষের অতিভক্তির বিষয়ে পরিণত না হয় সে জন্য কবর কেন্দ্রিক মসজিদ ও ইবাদত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বোপরি কবর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচু করা, পাকা করা, চুনকাম করা, কবরের উপরে কিছু লেখা ইত্যাদি নিষেধ করা হয়েছে। মুর্তি, ছবি ও প্রতিকৃতির পাশাপাশি উচু কবর ভেঙ্গে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হাদীসে খলীফা আলীর (রাঃ) পুলিশ বাহিনীর প্রধান আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন:
قَالَ لِي عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ أَلا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) أَنْ لا تَدَعَ تِمْثَالا إِلا طَمَسْتَهُ وَلا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلا سَوَّيْتَهُ ...وَلا صُورَةً إِلا طَمَسْتَهَا
‘‘আলী (রাঃ) আমাকে বলেন: আমি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করছি, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে প্রেরণ করেছিলেন : যত মূর্তি-প্রতিকৃতি দেখবে সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবে, (স্বাভাবিক কবরের পরিচিতি জ্ঞাপক সামান্য উচ্চতার বেশি) কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সব সমান করে দেবে এবং যত ছবি দেখবে সব মুছে ফেলবে।’’[1]।
আবূ মুহাম্মাদ আল-হুযালী আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) فِي جَنَازَةٍ فَقَالَ أَيُّكُمْ يَنْطَلِقُ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلا يَدَعُ بِهَا وَثَنًا إِلا كَسَرَهُ وَلا قَبْرًا إِلا سَوَّاهُ وَلا صُورَةً إِلا لَطَّخَهَا فَقَالَ رَجُلٌ أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ فَانْطَلَقَ فَهَابَ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرَجَعَ فَقَالَ عَلِيٌّ أَنَا أَنْطَلِقُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَانْطَلِقْ فَانْطَلَقَ ثُمَّ رَجَعَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَدَعْ بِهَا وَثَنًا إِلا كَسَرْتُهُ وَلا قَبْرًا إِلا سَوَّيْتُهُ وَلا صُورَةً إِلا لَطَّخْتُهَا ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) مَنْ عَادَ لِصَنْعَةِ شَيْءٍ مِنْ هَذَا فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ (ﷺ).
‘‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক জানাযায় (মদীনার বাইরে) ছিলেন। তিনি বললেন: তোমাদের মধ্যে কে আছ যে মদীনার অভ্যন্তরে গিয়ে যত মূর্তি পাবে সব বিচূর্ণ করবে, যত কবর দেখবে সব সমান করে দেবে, এবং যত ছবি পাবে সব মুছে বা নষ্ট করে দেবে। তখন একজন সাহাবী বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি যাব। কিন্তু তিনি মদীনাবাসীকে ভয় পেয়ে ফিরে আসলেন। তখন আলী (রাঃ) বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি যাব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: যাও। তখন আলী চলে গেলেন। পরে ফিরে এসে বললেন: আমি সকল মূর্তি ভেঙ্গে দিয়েছি, সকল কবর ভেঙ্গে সমান করে দিয়েছি এবং সকল ছবি মুছে নষ্ট করে দিয়েছি। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: যদি কেউ পুনরায় এসকল কাজের কোনো একটি করে তবে সে মুহাম্মাদের (ﷺ) উপর অবতীর্ণ ধর্মের সাথে কুফ্রী করল।’’ হাদীসটির সনদ হাসান।[2]
যাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন :
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ
‘‘রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কবর চুনকাম করতে, কবরের উপর বসতে এবং কবরের উপর ইমারত বা ঘর বানাতে নিষেধ করেছেন।[3]
অন্য হাদীসে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন :
إنَّ النَّبِيَّ (ﷺ) نَهَى أَنْ يُـبْـنَى عَلَى الْـقَـبْـرِ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবরের উপর ঘর তৈরি করতে নিষেধ করেছেন।’’[4]
এ অর্থে উম্মে সালামা (রাঃ) থেকেও হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[5]
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় মোট ৫টি বিষয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেছেন: কবর চুনকাম করা, কবরের উপরে বসা, কবর বাঁধানো বা কবরের উপরে ঘর জাতীয় কিছু তৈরি করা, কবরের উপরে লেখা এবং অতিরিক্ত মাটি এনে কবর উঁচু করা।[6]
[2] আহমদ, আল-মুসনাদ ১/৮৭, ১৩৮; আহমদ শাকির, মুসনাদ আহমদ ২/৬৮-৬৯, ২৭৪-২৭৫।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৬৭।
[4] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪৯৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫২৫। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে ইমাম মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন।
[5] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৬/২২৯।
[6] ইবনুল আসীর, জামিউল উসূল ১১/১৪৫-১৪৬।