অগণিত হাদীসে কিয়ামতের দিন নবীগণ ও অন্যান্য মানুষ এবং মানুষের বিভিন্ন আমল শাফা‘আত করবে এবং তাদের শাফা‘আত কবুল করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীসের বিস্তারিত আলোচনার জন্য বৃহৎ পরিসরের প্রয়োজন। হাদীসে বর্ণিত শাফা‘আতের পর্যায়গুলি নিম্নরূপে ভাগ করা যায়:
(১) শাফা‘আতে উযমা (الشفاعة العظمى) বা মহোত্তম শাফা‘আত। এদ্বারা বিচার শুরুর জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করা বুঝানো হয়। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিয়ামতের দিন মানুষ বিভিন্ন নবী-রাসূলের নিকট গমন করে ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট গমন করবেন। তিনি সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে শাফা‘আত করবেন, মানুষদের বিচার শেষ করে দেওয়ার জন্য।
(২) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আতে মহান আল্লাহ তাঁর উম্মাতের অনেক গোনাহগারকে ক্ষমা করবেন।
(৩) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আতে অনেক পাপী মুসলিম জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
(৪) উম্মাতে মুহাম্মাদীর অনেক নেককার মানুষ শাফা‘আত করবেন।
(৫) সন্তানগণ তাদের পিতামাতাদের জন্য শাফা‘আত করবে।
(৬) কুরআন তার তিলাওয়াতকারী ও অনুসারীদের জন্য শাফা‘আত করবে।
(৭) সিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত শাফা‘আত করবে এবং তা কবুল করা হবে।
উপরের আয়াত ও হাদীসগুলি থেকে আমরা বুঝতে পরি যে, শাফা‘আতের অর্থ এই নয় যে, ফিরিশতাগণ বা অন্য কোনো বান্দা ইচ্ছামত কোনো মানুষকে সুপারিশ করবেন। কেউ যদি কোনো ফিরিশতা বা আল্লাহর কোনো সম্মানিত বান্দার নামে মানত করে, তাঁকে সাজদা করে, তাঁকে ডাকে বা তাকে ‘চূড়ান্ত ভক্তি’ করে এবং আশা করে যে, এরূপ করাতে উক্ত ফিরিশতা বা সম্মানিত বান্দা তার জন্য সুপারিশ করবেন তবে তার এরূপ আশা কুরআনের আলোতে মরিচিকার পিছে ছোটা ছাড়া কিছুই নয়। এ ব্যক্তির শাফা‘আত লাভ তো দূরের কথা তার মানত, সাজদা, ডাক বা চূড়ান্ত বা অলৌকিক ভক্তিতে’ যদি কোনো ফিরিশতা বা আল্লাহর সম্মানিত বানদা সন্তুষ্টি বোধ করেন তবে তাকেও আল্লাহ জাহান্নামে শাস্তি দিবেন বলে ঘোষণা করেছেন।
অনুরূপভাবে কেউ যদি আল্লাহ থেকে বিমুখ থাকে বা ঈমান বিশুদ্ধ না করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা না করে কিন্তু কোনো ফিরিশতা বা আল্লাহর কোনো সম্মানিত বান্দাকে বিশেষভাবে ভালবাসে, তাকে ভক্তি-সম্মান করে বা সর্বদা তার জন্য দু‘আ করে এবং আশা করে যে, উক্ত ফিরিশতা বা সম্মানিত বান্দা তাকে সুপারিশ করে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা করবেন তবে বাতুল আশা ছাড়া কিছুই নয়।
পক্ষান্তরে কেউ যদি ঈমান ও তাওহীদ বিশুদ্ধ করেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন, কিন্তু মানবীয় দুর্বলতায় বা শয়তানের প্ররোচনায় কবীরা গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েন তবে মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হলে তাঁর কোনো সম্মানিত বান্দাকে তার জন্য শাফা‘আত করার অনুমতি প্রদান করবেন। মূল বিষয় আল্লাহর সন্তুষ্টি। মহান আল্লাহ কোনো পাপী বান্দার তাওহীদ ও ঈমানে সন্তুষ্ট হলে তিনি নিজেই তাঁকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। অথবা তাঁর কোনো সম্মানিত বান্দাকে সম্মান করে তার জন্য শাফা‘আতের অনুমতি দিতে পারেন।
মু’তাযিলাগণ শাফা‘আতে উযমা স্বীকার করে; কারণ তা তাদের মূলনীতির পরিপন্থী নয়। পাপী মুমিনের জন্য শাফা‘আত বিষয়ক অন্যান্য আয়াত ও হাদীসকে তারা শাফা‘আতে উযমা বলে ব্যাখ্যা করে বা বাতিল করে দেয়। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ সহীহ হাদীসে প্রমাণিত সকল প্রকারের শাফা‘আতেই বিশ্বাস করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, শাফ‘আতের মালিকানা একমাত্র মহান আল্লাহরই। তিনি যার উপর সন্তুষ্ট হবেন তার জন্য তিনি দয়া করে শাফা‘আতের ব্যবস্থা করে দিবেন। তিনি যার উপর সন্তুষ্ট থাকবেন তার জন্য তাঁর অনুমতিপ্রাপ্ত কেউ শাফা‘আত করলে তিনি ইচ্ছা করলে তা কবুল করে গোনাহগার মুমিনকে ক্ষমা করতে পারেন। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যা করে বলেন:
وشفاعة الأنبياء عليهم السلام حق، وشفاعة نبينا (ﷺ) للمؤمنين المذنبين ولأهل الكبائر منهم المستوجبين العقاب حق ثابت
‘‘নবীগণের শাফা‘আত সত্য। পাপী মুমিনগণ এবং কবীরা গোনাহকারিগণের জন্য, পাপের কারণে যাদের জাহান্নাম পাওনা হয়েছিল তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আমাদের নবী (ﷺ)-র শাফা‘আতও সত্য।’’[1]